৯.১ প্রথম পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুর বিদ্যাসাগর স্কুলের দ্বারে গাড়ি করিয়া আসিয়া উপস্থিত। বেলা তিনটা হইবে। গাড়িতে মাস্টারকে তুলিয়া লইলেন। রাখাল ও আরও দু-একটি ভক্ত গাড়িতে আছেন। আজ বুধবার ১৫ই নভেম্বর ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ, কার্তিক শুক্লা পঞ্চমী। গাড়ি ক্রমে চিত্পুর রাস্তা দিয়া গড়ের মাঠের দিকে যাইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দময়—মাতালের ন্যায়—গাড়ির একবার এধার একবার ওধার মুখ বাড়াইয়া বালকের ন্যায় দেখিতেছেন। আর পথিকদের উদ্দেশে ভক্তদের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। মাস্টারকে বলিতেছেন, দেখ, সব লোক দেখছি নিম্নদৃষ্টি। পেটের জন্য সব যাচ্ছে, ঈশ্বরের দিকে দৃষ্টি নাই!
শ্রীরামকৃষ্ণ আজ গড়ের মাঠে উইলসনের সার্কাস দেখিতে যাইতেছেন। মাঠে পৌঁছিয়া টিকিট কেনা হইল। আট আনার অর্থাৎ শেষশ্রেণীর টিকিট। ভক্তেরা ঠাকুরকে লইয়া উচ্চস্থানে উঠিয়া এক বেঞ্চির উপরে বসিলেন। ঠাকুর আনন্দে বলিতেছেন, “বাঃ, এখান থেকে বেশ দেখা যায়।”
রঙ্গস্থলে নানারূপ খেলা অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখা হইল। গোলাকার রাস্তায় ঘোড়া দৌড়িতেছে। ঘোড়ার পৃষ্ঠে একপায়ে বিবি দাঁড়াইয়া। আবার মাঝে মাঝে সামনে বড় বড় লোহার রিং (চক্র)। রিং-এর কাছে আসিয়া ঘোড়া যখন রিং-এর নিচে দৌড়িতেছে, বিবি ঘোড়ার পৃষ্ঠ হইতে লম্ফ দিয়া রিং-এর মধ্য দিয়া পুনরায় ঘোড়ার পৃষ্ঠে আবার একপায়ে দাঁড়াইয়া! ঘোড়া পুনঃ পুনঃ বনবন করিয়া ওই গোলাকার পথে দৌড়াইতে লাগিল, বিবিও আবার ওইরূপ পৃষ্ঠে দাঁড়াইয়া!
সার্কাস সমাপ্ত হইল। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে নামিয়া আসিয়া ময়দানে গাড়ির কাছে আসিলেন। শীত পড়িয়াছে। গায়ে সবুজ বনাত দিয়া মাঠে দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছেন, কাছে ভক্তেরা দাঁড়াইয়া আছেন। একজন ভক্তের হাতে বেটুয়াটি (মশলার ছোট থলেটি) রহিয়াছে। তাহাতে মশলা বিশেষতঃ কাবাব চিনি আছে।
[আগে সাধন, তারপর সংসার; অভ্যাসযোগ]
শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে বলিতেছেন, “দেখলে, বিবি কেমন একপায়ে ঘোড়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে, আর ঘোড়া বনবন করে দৌড়ুচ্ছে! কত কঠিন, অনেকদিন ধরে অভ্যাস করেছে, তবে তো হয়েছে! একটু অসাবধান হলেই হাত-পা ভেঙে যাবে, আবার মৃত্যুও হতে পারে। সংসার করা ওইরূপ কঠিন। অনেক সাধন-ভজন করলে ঈশ্বরের কৃপায় কেউ কেউ পেরেছে। অধিকাংশ লোক পারে না। সংসার করতে গিয়ে আরও বদ্ধ হয়ে যায়, আরও ডুবে যায়, মৃত্যুযন্ত্রণা হয়! কেউ কেউ, যেমন জনকাদি অনেক তপস্যার বলে সংসার করেছিলেন। তাই সাধন-ভজন খুব দরকার, তা না হলে সংসারে ঠিক থাকা যায় না।”
[বলরাম-মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণ]
শ্রীরামকৃষ্ণ গাড়িতে উঠিলেন। গাড়ি বাগবাজারে বসুপাড়ায় বলরামের বাটীর দ্বারে উপস্থিত হইল, ঠাকুর ভক্তসঙ্গে দোতলার বৈঠকখানায় গিয়া বসিলেন। সন্ধ্যার বাতি জ্বালা হইয়াছে। ঠাকুর সার্কাসের গল্প করিতেছেন। অনেকগুলি ভক্ত সমবেত হইয়াছেন, তাঁহাদের সহিত ঈশ্বরীয় অনেক কথা হইতেছে। মুখে অন্য কথা কিছুই নাই, কেবল ঈশ্বরীয় কথা।
[Sri Ramakrishna, the caste-system and the problem of the Untouchables solved]
জাতিভেদ সম্বন্ধে কথা পড়িল। ঠাকুর বলিলেন, “এক উপায়ে জাতিভেদ উঠে যেতে পারে। সে উপায়—ভক্তি।ভক্তের জাতি নাই। ভক্তি হলেই দেহ, মন, আত্মা—সব শুদ্ধ হয়। গৌর, নিতাই হরিনাম দিতে লাগলেন, আর আচণ্ডালে কোল দিলেন। ভক্তি না থাকলে ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ নয়। ভক্তি থাকলে চণ্ডাল, চণ্ডাল নয়। অস্পৃশ্য জাতি ভক্তি থাকলে শুদ্ধ, পবিত্র হয়।”
[সংসারী বদ্ধজীব]
শ্রীরামকৃষ্ণ সংসারী বদ্ধজীবের কথা বলিতেছেন। তারা যেন গুটিপোকা, মনে করলে কেটে বেরিয়ে আসতে পারে; কিন্তু অনেক যত্ন করে গুটি তৈয়ার করেছে, ছেড়ে আসতে পারে না; তাতেই মৃত্যু হয়। আবার যেন ঘুনির মধ্যে মাছ; যে-পথে ঢুকেছে, সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু জলের মিষ্ট শব্দ আর অন্য অন্য মাছের সঙ্গে ক্রীড়া, তাই ভুলে থাকে, বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করে না। ছেলেমেয়ের আধ-আধ কথাবার্তা যেন জলকল্লোলের মধুর শব্দ। মাছ অর্থাৎ জীব, পরিবারবর্গ। তবে দু-একটা দৌড়ে পালায়, তাদের বলে মুক্তজীব।
ঠাকুর গান গাহিতেছেন :
এমনি মহামায়ার মায়া রেখেছে কি কুহক করে ।
ব্রহ্মা বিষ্ণু অচৈতন্য জীবে কি জানিতে পারে ॥
বিল করে ঘুনি পাতে মীন প্রবেশ করে তাতে ।
গতায়াতের পথ আছে তবু মীন পালাতে নারে ॥
ঠাকুর আবার বলিতেছেন, “জীব যেন ডাল, জাঁতার ভিতর পড়েছে; পিষে যাবে। তবে যে কটি ডাল খুঁটি ধরে থাকে, তারা পিষে যায় না। তাই খুঁটি অর্থাৎ ঈশ্বরের শরণাগত হতে হয়। তাঁকে ডাক, তাঁর নাম কর তবে মুক্তি। তা না হলে কালরূপ জাঁতায় পিষে যাবে।”
ঠাকুর আবার গান গাহিতেছেন :
পড়িয়ে ভবসাগরে ডুবে মা তনুর তরী ।
মায়া-ঝড় মোহ-তুফান ক্রমে বাড়ে গো শঙ্করী ॥
একে মন-মাঝি আনাড়ি, তাহে ছজন গোঁয়ার দাঁড়ি;
কুবাতাসে দিয়ে পাড়ি, হাবুডুবু খেয়ে মরি ।
ভেঙে গেল ভক্তির হাল; ছিঁড়ে পড়ল শ্রদ্ধার পাল,
তরী হল বানচাল, উপায় কি করি;—
উপায় না দেখি আর, অকিঞ্চন ভেবে সার;
তরঙ্গে দিয়ে সাঁতার, শ্রীদুর্গানামের ভেলা ধরি ॥
[Duty to wife and children]
বিশ্বাসবাবু অনেকক্ষণ বসিয়াছিলেন, এখন উঠিয়া গেলেন। তাঁহার অনেক টাকা ছিল, কিন্তু চরিত্র মলিন হওয়াতে সমস্ত উড়িয়া গিয়াছে। এখন পরিবার, কন্যা প্রভৃতি কাহাকেও দেখেন না। বলরাম তাঁহার কথা পাড়াতে ঠাকুর বলিলেন, “ওটা লক্ষ্মীছাড়া দারিদ্দির। গৃহস্থের কর্তব্য আছে, ঋণ আছে, দেব-ঋণ, পিতৃ-ঋণ, ঋষি-ঋণ আবার পরিবারদের সম্বন্ধে ঋণ আছে। সতী স্ত্রী হলে তাকে প্রতিপালন; সন্তানদিগকে প্রতিপালন যতদিন না লায়েক হয়।
“সাধুই কেবল সঞ্চয় করবে না। ‘পঞ্ছি আউর দরবেশ’ সঞ্চয় করে না। কিন্তু পাখির ছানা হলে সঞ্চয় করে। ছানার জন্যে মুখে করে খাবার নিয়ে যায়।”
বলরাম—এখন বিশ্বাসের সাধুসঙ্গ করবার ইচ্ছা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—সাধুর কমণ্ডলু চারধাম ঘুরে আসে, কিন্তু যেমন তেতো, তেমনি তেতো থাকে। মলয়ের হাওয়া যে গাছে লাগে, সে-সব চন্দন হয়ে যায়! কিন্তু শিমুল, অশ্বত্থ, আমড়া এরা চন্দন হয় না। কেউ কেউ সাধুসঙ্গ করে, গাঁজা খাবার জন্য। (হাস্য) সাধুরা গাঁজা খায় কিনা, তাই তাদের কাছে এসে বসে গাঁজা সেজে দেয় আর প্রসাদ পায়। (সকলের হাস্য)
৯.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ষড়ভুজদর্শন ও শ্রীরাজমোহনের বাড়িতে শুভাগমন—নরেন্দ্র
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গড়ের মাঠে যেদিন সার্কাস দর্শন করিলেন তাহার পরদিনেই আবার কলিকাতায় শুভাগমন করিয়াছেন; বৃহস্পতিবার ১৬ই নভেম্বর ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ, কার্তিক শুক্লা ষষ্ঠী, (১লা অগ্রহায়ণ)। আসিয়াই প্রথমে গরাণহাটায়১ষড়ভুজ মহাপ্রভু দর্শন করিলেন। বৈষ্ণব সাধুদের আখড়া; মহন্ত শ্রীগিরিধারী দাস। ষড়ভুজ মহাপ্রভুর সেবা অনেকদিন হইতে চলিতেছে। ঠাকুর বৈকালে দর্শন করিলেন।
সন্ধ্যার কিয়ত্কাল পরে ঠাকুর সিমুলিয়া নিবাসী শ্রীযুক্ত রাজমোহনের বাড়িতে গাড়ি করিয়া আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর শুনিয়াছেন যে, এখানে নরেন্দ্র প্রভৃতি ছোকরারা মিলিয়া ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা করেন। তাই দেখিতে আসিয়াছেন। মাস্টার ও আরও দু-একজন ভক্ত সঙ্গে আছেন। শ্রীযুক্ত রাজমোহন পুরাতন ব্রাহ্মভক্ত।১ বর্তমান নিমতলা স্ট্রীট।
[ব্রাহ্মভক্ত ও সর্বত্যাগ বা সন্ন্যাস]
ঠাকুর নরেন্দ্রকে দেখিয়া আনন্দিত হইলেন। আর বলিলেন, “তোমাদের উপাসনা দেখব!” নরেন্দ্র গান গাহিতে লাগিলেন। শ্রীযুক্ত প্রিয় প্রভৃতি ছোকরারা কেহ কেহ উপস্থিত ছিলেন।
এইবার উপাসনা হইতেছে। ছোকরাদের মধ্যে একজন উপাসনা করিতেছেন। তিনি প্রার্থনা করিতেছেন, ঠাকুর যেন সব ছেড়ে তোমাতে মগ্ন হই! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিয়া বোধ হয় তাঁহার উদ্দীপন হইয়াছে। তাই সর্বত্যাগের কথা বলিতেছেন। মাস্টার ঠাকুরের খুব কাছে বসিয়াছিলেন, তিনিই কেবল শুনিতে পাইলেন, ঠাকুর অতি মৃদুস্বরে বলিতেছেন, “তা আর হয়েছে!”
শ্রীযুক্ত রাজমোহন ঠাকুরকে জল খাওয়াইবার জন্য বাড়ির ভিতরে লইয়া যাইতেছেন।
৯.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – শ্রীযুক্ত মনোমোহন ও শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ
পরের রবিবারে (১৯শে নভেম্বর ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ) ৺জগদ্ধাত্রীপূজা, সুরেন্দ্র নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। তিনি ঘর বাহির করিতেছেন—কখন ঠাকুর আসেন। মাস্টারকে দেখিয়া তিনি বলিতেছেন, “তুমি এসেছ, আর তিনি কোথায়?” এমন সময় ঠাকুরের গাড়ি আসিয়া উপস্থিত। কাছে শ্রীযুক্ত মনোমোহনের বাড়ি, ঠাকুর প্রথমে সেখানে নামিলেন, সেখানে একটু বিশ্রাম করিয়া সুরেন্দ্রের বাড়িতে আসিবেন।
মনোমোহনের বৈঠকখানায় ঠাকুর বলিতেছেন, “যে অকিঞ্চন,যে দীন, তার ভক্তি ঈশ্বরের প্রিয় জিনিস। খোল মাখানো জাব যেমন গরুর প্রিয়! দুর্যোধন অত টাকা অত ঐশ্বর্য দেখাতে লাগল; কিন্তু তার বাটীতে ঠাকুর গেলেন না। তিনি বিদুরের বাটী গেলেন। তিনি ভক্তবত্সল, বৎসের পাছে যেমন গাভী ধায় সেইরূপ তিনি ভক্তের পাছে পাছে যান।”
ঠাকুর গান গাহিতেছেন :
যে ভাব লাগি পরম যোগী, যোগ করে যুগ-যুগান্তরে ।
হলে ভাবের উদয় লয় সে যেমন লোহাকে চুম্বকে ধরে ।
“চৈতন্যদেবের কৃষ্ণনামে অশ্রু পড়ত। ঈশ্বরই বস্তু,আর সব অবস্তু। মানুষ মনে করলে ঈশ্বরলাভ করতে পারে। কিন্তু কামিনী-কাঞ্চন ভোগ করতেই মত্ত। মাথায় মাণিক রয়েছে তবু সাপ ব্যাঙ খেয়ে মরে!
“ভক্তিই সার। ঈশ্বরকে বিচার করে কে জানতে পারবে। আমার দরকার ভক্তি। তাঁর অনন্ত ঐশ্বর্য অত জানবার আমার কি দরকার? এক বোতল মদে যদি মাতাল হই শুঁড়ির দোকানে কত মন মদ আছে, সে খবরে আমার কি দরকার? একঘটি জলে আমার তৃষ্ণার শান্তি হতে পারে; পৃথিবীতে কত জল আছে, সে খবরে আমার প্রয়োজন নাই।”
[সুরেন্দ্রের দাদা ও সদরওয়ালার পদ—জাতিভেদ—cast system and problem of the Untouchables solved—Theosophy]
শ্রীরামকৃষ্ণ এইবার সুরেন্দ্রের বাড়িতে আসিয়াছেন। আসিয়া দোতলার বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। সুরেন্দ্রের মেজোভাই সদরওয়ালা, তিনিও উপস্থিত ছিলেন। অনেক ভক্ত ঘরে সমবেত হইয়াছেন। ঠাকুর সুরেন্দ্রের দাদাকে বলিতেছেন, “আপনি জজ, তা বেশ; এটি জানবেন সবই ঈশ্বরের শক্তি। বড় পদ তিনিই দিয়েছেন, তাই হয়েছে। লোকে মনে করে আমরা বড়লোক; ছাদের জল সিংহের মুখওলা নল দিয়ে পড়ে, মনে হয় সিংহটা মুখ দিয়ে জল বার কচ্ছে। কিন্তু দেখ কোথাকার জল। কোথা আকাশে মেঘ হয়, সেই জল ছাদে পড়েছে, তারপর গড়িয়ে নলে যাচ্ছে; তারপর সিংহের মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে।”
সুরেন্দ্রের ভ্রাতা—মহাশয়, ব্রাহ্মসমাজে বলে স্ত্রী-স্বাধীনতা; জাতিভেদ উঠিয়ে দাও; এ-সব আপনার কি বোধ হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঈশ্বরের উপর নূতন অনুরাগ হলে ওইরকম হয়। ঝড় এলে ধুলো ওড়ে, কোন্টা আমড়া, আর কোন্টা তেঁতুলগাছ, কোন্টা আমগাছ বোঝা যায় না। ঝড় থেমে গেলে, তখন বোঝা যায়। নবানুরাগের ঝড় থেমে গেলে ক্রমে বোঝা যায় যে, ঈশ্বরই শ্রেয়ঃ নিত্যপদার্থ আর সব অনিত্য। সাধুসঙ্গ তপস্যা না করলে এ-সব ধারণা হয় না! পাখোয়াজের বোল মুখে বললে কি হবে; হাতে আনা বড় কঠিন। শুধু লেকচার দিলে কি হবে; তপস্যা চাই, তবে ধারণা হবে।
“জাতিভেদ? কেবল এক উপায়ে জাতিভেদ উঠতে পারে। সেটি ভক্তি। ভক্তের জাতি নাই। অস্পৃশ্য জাত শুদ্ধ হয়—চণ্ডাল ভক্ত হলে আর চণ্ডাল থাকে না! চৈতন্যদেব আচণ্ডালে কোল দিয়েছিলেন।
“ব্রহ্মজ্ঞানীরা হরিনাম করে, খুব ভাল। ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তাঁর কৃপা হবে, ঈশ্বরলাভ হবে।
“সব পথ দিয়েই তাঁকে পাওয়া যায়। এক ঈশ্বরকে নানা নামে ডাকে। যেমন একঘাটের জল হিন্দুরা খায়, বলে জল; আর-একঘাটে খ্রীষ্টানরা খায়, বলে ওয়াটার; আর-একঘাটে মুসলমানেরা খায়, বলে পানি।”
সুরেন্দ্রের ভ্রাতা—মহাশয়, থিওজফি কিরূপ বোধ হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—শুনেছি নাকি ওতে অলৌকিক শক্তি (Miracles) হয়। দেব মোড়লের বাড়িতে দেখেছিলাম একজন পিশাচসিদ্ধ। পিশাচ কত কি জিনিস এনে দিত। অলৌকিক শক্তি নিয়ে কি করব? ওর দ্বারা কি ঈশ্বরলাভ হয়? ঈশ্বর যদি না লাভ হল তাহলে সকলই মিথ্যা!
৯.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – মণি মল্লিকের ব্রাহ্মোত্সবে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় শ্রীযুক্ত মণিলাল মল্লিকের সিন্দুরিয়াপটীর বাটীতে ভক্তসঙ্গে শুভাগমন করিয়াছিলেন। সেখানে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি বত্সর উত্সব হয়। বৈকাল, বেলা ৪টা হইবে। এখানে আজ ব্রাহ্মসমাজের সাংবাত্সরিক উত্সব। (২৬শে) নভেম্বর, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ। শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও অনেকগুলি ব্রাহ্মভক্ত আর শ্রীপ্রেমচাঁদ বড়াল ও গৃহস্বামীর অন্যান্য বন্ধুগণ আসিয়াছেন। মাস্টার প্রভৃতি সঙ্গে আছেন।
শ্রীযুক্ত মণিলাল ভক্তদের সেবার জন্য অনেক আয়োজন করিয়াছেন। প্রহ্লাদ-চরিত্র-কথা হইবে। তত্পরে ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা হইবে। অবশেষে ভক্তগণ প্রসাদ পাইবেন।
শ্রীযুক্ত বিজয় এখনও ব্রাহ্মসমাজভুক্ত আছেন। তিনি অদ্যকার উপাসনা করিবেন। তিনি এখনও গৈরিকবস্ত্র ধারণ করেন নাই।
কথক মহাশয় প্রহ্লাদচরিত্র-কথা বলিতেছেন। পিতা হিরণ্যকশিপু হরির নিন্দা ও পুত্র প্রহ্লাদকে বারবার নির্যাতন করিতেছেন। প্রহ্লাদ করজোড়ে হরির নিকট প্রার্থনা করিতেছেন আর বলিতেছেন, “হে হরি, পিতাকে সুমতি দাও।” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথা শুনিয়া কাঁদিতেছেন। শ্রীযুক্ত বিজয় প্রভৃতি ভক্তেরা ঠাকুরের কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুরের ভাবাবস্থা হইয়াছে।
[শ্রীবিজয় গোস্বামী প্রভৃতি ব্রাহ্মভক্তদিগকে উপদেশ—ঈশ্বরদর্শন ও আদেশপ্রাপ্তি, তবে লোকশিক্ষা]
কিয়ত্ক্ষণ পরে বিজয়াদি ভক্তদিগকে বলিতেছেন, “ভক্তিই সার। তাঁর নামগুণকীর্তন সর্বদা করতে করতে ভক্তিলাভ হয়। আহা! শিবনাথের কি ভক্তি! যেন রসে ফেলা ছানাবড়া।
“এরকম মনে করা ভাল নয় যে, আমার ধর্মই ঠিক, আর অন্য সকলের ধর্ম ভুল। সব পথ দিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়। আন্তরিক ব্যাকুলতা থাকলেই হল। অনন্ত পথ—অনন্ত মত।”
“দেখ! ঈশ্বরকে দেখা যায়। ‘অবাঙ্মনসোগোচর’ বেদে বলেছে : এর মানে বিষয়াসক্ত মনের অগোচর। বৈষ্ণবচরণ বলত, তিনি শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধির গোচর।১ তাই সাধুসঙ্গ, প্রার্থনা, গুরুর উপদেশ এই সব প্রয়োজন। তবে চিত্তশুদ্ধি হয়। তবে তাঁর দর্শন হয়। ঘোলা জলে নির্মলি ফেললে পরিষ্কার হয়। তখন মুখ দেখা যায়। ময়লা আরশিতেও মুখ দেখা যায় না।
“চিত্তশুদ্ধির পর ভক্তিলাভ করলে, তবে তাঁর কৃপায় তাঁকে দর্শন হয়। দর্শনের পর আদেশ পেলে তবে লোকশিক্ষা দেওয়া যায়। আগে থাকতে লেকচার দেওয়া ভাল নয়। একটা গানে আছে :
ভাবছো কি মন একলা বসে,
অনুরাগ বিনে কি চাঁদ গৌর মিলে ।
মন্দিরে তোর নাইকো মাধব,
পোদো শাঁক ফুঁকে তুই করলি গোল ।
তায় চামচিকে এগারজনা,
দিবানিশি দিচ্ছে থানা ।১ মন এব মনুষ্যাণাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ ।বন্ধায় বিষয়াসঙ্গি মোক্ষ নির্বিষয়ং স্মৃতমিতি ॥—(মৈত্রায়ণী উপনিষদ্—৬।৩৪)
“হৃদয়মন্দির আগে পরিষ্কার করতে হয়; ঠাকুর প্রতিমা আনতে হয়; পূজার আয়োজন করতে হয়। কোন আয়োজন নাই, ভোঁভোঁ করে শাঁক বাজানো, তাতে কি হবে?”
এইবার শ্রীযুক্ত বিজয় গোস্বামী বেদীতে বসিয়া ব্রাহ্মসমাজের পদ্ধতি অনুসারে উপাসনা করিতেছেন; উপাসনান্তে তিনি ঠাকুরের কাছে আসিয়া বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয়ের প্রতি)—আচ্ছা, তোমরা অত পাপ পাপ বললে কেন? একশোবার “আমি পাপী” “আমি পাপী” বললে তাই হয়ে যায়। এমন বিশ্বাস করা চাই যে, তাঁর নাম করেছি—আমার আবার পাপ কি? তিনি আমাদের বাপ-মা; তাঁকে বল যে, পাপ করেছি, আর কখনও করব না। আর তাঁর নাম কর, তাঁর নামে সকলে দেহ-মন পবিত্র কর—জিহ্বাকে পবিত্র কর।