৫৪.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – কাশীপুর উদ্যানে নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে
কৃপাসিন্ধু শ্রীরামকৃষ্ণ—মাস্টার, নিরঞ্জন, ভবনাথ
শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কাশীপুরে বাস করিতেছেন। এতো অসুখ—কিন্তু এক চিন্তা—কিসে ভক্তদের মঙ্গল হয়। নিশিদিন কোন না কোন ভক্তের বিষয় চিন্তা করিতেছেন।
শুক্রবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২৭শে অগ্রহায়ণ, শুক্লা পঞ্চমীতে শ্যামপুকুর হইতে ঠাকুর কাশীপুরের বাগানে আইসেন। আজ বারো দিন হইল। ছোকরা ভক্তেরা ক্রমে কাশীপুরে আসিয়া অবস্থিতি করিতেছেন—ঠাকুরের সেবার জন্য। এখনও বাটী অনেকে যাতায়াত করেন। গৃহী ভক্তেরা প্রায় প্রত্যহ দেখিয়া যান—মধ্যে মধ্যে রাত্রেও থাকেন।
ভক্তেরা প্রায় সকলেই জুটিয়াছেন। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ভক্ত সমাগম হইতেছে। শেষের ভক্তেরা সকলেই আসিয়া পড়িয়াছেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের শেষাশেষি শশী ও শরৎ ঠাকুরকে দর্শন করেন; কলেজের পরীক্ষাদির পর, ১৮৮৫-র মাঝামাঝি হইতে তাঁহারা সর্বদা যাতায়াত করেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে স্টার থিয়েটারে শ্রীযুক্ত গিরিশ (ঘোষ) ঠাকুরকে দর্শন করেন। তিনমাস পরে অর্থাৎ ডিসেম্বরের প্রারম্ভ হইতে তিনি সর্বদা যাতায়াত করেন। ১৮৮৪, ডিসেম্বরের শেষে সারদা ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে দর্শন করেন। সুবোধ ও ক্ষীরোদ ১৮৮৫-র অগস্ট মাসে ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন।
আজ সকালে প্রেমের ছড়াছড়ি। নিরঞ্জনকে বলছেন, “তুই আমার বাপ, তোর কোলে বসব।” কালীপদর বক্ষ স্পর্শ করিয়া বলিতেছেন, “চৈতন্য হও!” আর চিবুক ধরিয়া তাহাকে আদর করিতেছেন; আর বলিতেছেন, “যে আন্তরিক ঈশ্বরকে ডেকেছে বা সন্ধ্যা-আহ্নিক করেছে, তার এখানে আসতেই হবে।” আজ সকালে দুইটি ভক্ত স্ত্রীলোকের উপরও কৃপা করিয়াছেন। সমাধিস্থ হইয়া তাহাদের বক্ষে চরণ দ্বারা স্পর্শ করিয়াছেন। তাঁহারা অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন; একজন কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “আপনার এত দয়া!” প্রেমের ছড়াছড়ি! সিঁথির গোপালকে কৃপা করিবেন বলিয়া বলিতেছেন, “গোপালকে ডেকে আন।”
আজ বুধবার, ৯ই পৌষ, অগ্রহায়ণের কৃষ্ণা দ্বিতীয়া, ২৩শে ডিসেম্বর, ১৮৮৫। সন্ধ্যা হইয়াছে। ঠাকুর জগন্মাতার চিন্তা করিতেছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর অতি মৃদুস্বরে দু-একটি ভক্তের সহিত কথা কহিতেছেন। ঘরে কালী, চুনিলাল, মাস্টার, নবগোপাল, শশী, নিরঞ্জন প্রভৃতি ভক্তেরা আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—একটি টুল কিনে আনবে—এখানকার জন্য। কত নেবে?
মাস্টার—আজ্ঞা, দু-তিন টাকার মধ্যে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—জলপিড়ি যদি বার আনা, ওর দাম অত হবে কেন?
মাস্টার—বেশি হবে না,—ওরই মধ্যে হয়ে যাবে!
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, কাল আবার বৃহস্পতিবারের বারবেলা,—তুমি তিনটের আগে আসতে পারবে না?
মাস্টার—যে আজ্ঞা, আসব।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার? অসুখের গুহ্য উদ্দেশ্য]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—আচ্ছা, এ-অসুখটা কদ্দিনে সারবে?
মাস্টার—একটু বেশি হয়েছে—দিন নেবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কত দিন?
মাস্টার—পাঁচ-ছ’ মাস হতে পারে।
এই কথায় ঠাকুর বালকের ন্যায় অধৈর্য হইলেন। আর বলিতেছেন—“বল কি?”
মাস্টার—আজ্ঞা, সব সারতে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাই বল।—আচ্ছা, এত ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন, ভাব, সমাধি!—তবে এমন ব্যামো কেন?
মাস্টার—আজ্ঞা, খুব কষ্ট হচ্ছে বটে, কিন্তু উদ্দেশ্য আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি উদ্দেশ্য?
মাস্টার—আপনার অবস্থা পরিবর্তন হবে—নিরাকারের দিকে ঝোঁক হচ্ছে।—‘বিদ্যার আমি’ পর্যন্ত থাকছে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, লোকশিক্ষা বন্ধ হচ্ছে—আর বলতে পারি না। সব রামময় দেখছি।—এক-একবার মনে হয়, কাকে আর বলব! দেখো না,—এই বাড়ি-ভাড়া হয়েছে বলে কত রকম ভক্ত আসছে।
“কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন বা শশধরের মতো সাইন্বোর্ড তো হবে না,—অমুক সময় লেকচার হইবে!” (ঠাকুরের ও মাস্টারের হাস্য)
মাস্টার—আর একটি উদ্দেশ্য, লোক বাছা। পাঁচ বছরের তপস্যা করে যা না হত, এই কয়দিনে ভক্তদের তা হয়েছে। সাধনা, প্রেম, ভক্তি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, তা হল বটে! এই নিরঞ্জন বাড়ি গিছলো। (নিরঞ্জনের প্রতি) তুই বল দেখি, কিরকম বোধ হয়?
নিরঞ্জন—আজ্ঞে, আগে ভালবাসা ছিল বটে,—কিন্তু এখন ছেড়ে থাকতে পারবার জো নাই।
মাস্টার—আমি একদিন দেখেছিলাম, এরা কত বড়লোক!
শ্রীরামকৃষ্ণ—কোথায়?
মাস্টার—আজ্ঞা, একপাশে দাঁড়িয়ে শ্যামপুকুরের বাড়িতে দেখেছিলাম। বোধ হল, এরা এক-একজন কত বিঘ্ন-বাধা ঠেলে ওখানে এসে বসে রয়েছে—সেবার জন্য।
[সমাধিমন্দিরে—আশ্চর্য অবস্থা—নিরাকার—অন্তরঙ্গ নির্বাচন]
এই কথা শুনিতে শুনিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। কিয়ত্ক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। সমাধিস্থ!
ভাবের উপশম হইলে মাস্টারকে বলিতেছেন—“দেখলাম, সাকার থেকে সব নিরাকারে যাচ্ছে! আর আর কথা বলতে ইচ্ছা যাচ্ছে কিন্তু পারছি না।
“আচ্ছা, ওই নিরাকারে ঝোঁক,—ওটা কেবল লয় হবার জন্য; না?”
মাস্টার (অবাক্ হইয়া)—আজ্ঞা, তাই হবে!
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখনও দেখছি নিরাকার অখণ্ডসচ্চিদানন্দ এইরকম করে রয়েছে।………কিন্তু চাপলাম খুব কষ্টে।
“লোক বাছা যা বলছ তা ঠিক। এই অসুখ হওয়াতে কে অন্তরঙ্গ, কে বহিরঙ্গ, বোঝা যাচ্ছে। যারা সংসার ছেড়ে এখানে আছে, তারা অন্তরঙ্গ। আর যারা একবার এসে ‘কেমন আছেন মশাই’, জিজ্ঞাসা করে, তারা বহিরঙ্গ।
“ভবনাথকে দেখলে না? শ্যামপুকুরে বরটি সেজে এলো। জিজ্ঞাসা করলে ‘কেমন আছেন?’ তারপর আর দেখা নাই। নরেন্দ্রের খাতিরে ওইরকম তাকে করি, কিন্তু মন নাই।”
৫৪.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত—শ্রীরামকৃষ্ণ কে? মুক্তকণ্ঠ
শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত—শ্রীরামকৃষ্ণ কে? মুক্তকণ্ঠ
আহুস্ত্বাম্ ঋষয়ঃ সর্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা ।
অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ঞ্চৈব ব্রবীষি মে ॥
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—তিনি ভক্তের জন্য দেহধারণ করে যখন আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ভক্তরাও আসে। কেউ অন্তরঙ্গ, কেউ বহিরঙ্গ। কেউ রসদ্দার।
“দশ-এগারো বছরের সময় দেশে বিশালক্ষী দেখতে গিয়ে মাঠে অবস্থা হয়। কি দেখলাম!—একেবারে বাহ্যশূন্য!
“যখন বাইশ-তেইশ বছর বয়স১ কালীঘরে (দক্ষিণেশ্বরে) বললে, ‘তুই কি অক্ষর হতে চাস?’—অক্ষর মানে জানি না! জিজ্ঞাসা করলাম—হলধারী বললে, ‘ক্ষর মানে জীব, অক্ষর মানে পরমাত্মা’।
১ যখন ২২/২৩ বয়স অর্থাৎ ১৮৫৮/৫৯ খ্রীঃ, তখন প্রথম এই অবস্থা
“যখন আরতি হত, কুঠির উপর থেকে চিত্কার করতাম, ‘ওরে কে কোথায় ভক্ত আছিস আয়! ঐহিক লোকদের সঙ্গে আমার প্রাণ যায়!’ ইংলিশম্যানকে (ইংরাজী পড়া লোককে) বললাম। তারা বলে, ‘ও-সব মনের ভুল!’ তখন ‘তাই হবে’ বলে শান্ত হলাম। কিন্তু এখন তো সেই সব মিলছে!—সব ভক্ত এসে জুটছে!
“আবার দেখালে পাঁচজন সেবায়েত। প্রথম, সেজোবাবু (মথুরবাবু) তারপর শম্ভু মল্লিক,—তাকে আগে কখন দেখি নাই। ভাবে দেখলাম,—গৌরবর্ণ পুরুষ, মাথায় তাজ। যখন অনেকদিন পরে শম্ভুকে দেখলাম, তখন মনে পড়ল,—একেই আগে ভাবাবস্থায় দেখেছি! আর তিনজন সেবায়েত এখনও ঠিক হয় নাই। কিন্তু সব গৌরবরণ। সুরেন্দ্র অনেকটা রসদ্দার বলে বোধ হয়।
“এই অবস্থা যখন হল ঠিক আমার মতো একজন এসে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ী সব ঝেড়ে দিয়ে গেল! ষড়চক্রের এক-একটি পদ্মে জিহ্বা দিয়ে রমণ করে, আর অধোমুখ পদ্ম ঊর্ধ্বমুখ হয়ে উঠে। শেষে সহস্রার পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়ে গেল।
“যখন যেরূপ লোক আসবে, আগে দেখিয়ে দিত! এই চক্ষে—ভাবে নয়—দেখলাম, চৈতন্যদেবের সংকীর্তন বটতলা থেকে বকুলতলার দিকে যাচ্ছে। তাতে বলরামকে দেখলাম, আর যেন তোমায় দেখলাম। চুনিকে আর তোমাকে আনাগোনায় উদ্দীপন হয়েছে। শশী আর শরৎকে দেখেছিলাম, ঋষি কৃষ্ণের (ক্রাইস্ট্) দলে ছিল।
“বটতলায় একটি ছেলে দেখেছিলাম। হৃদে বললে, তবে তোমার একটি ছেলে হবে। আমি বললাম, ‘আমার যে মাতৃযোনী! আমার ছেলে কেমন করে হবে?’ সেই ছেলে রাখাল।
“বললাম, মা, এরকম অবস্থা যদি করলে, তাহলে একজন বড়মানুষ জুটিয়ে দাও। তাই সেজোবাবু চৌদ্দ বছর1 ধরে সেবা কল্লে। সে কত কি!—আলাদা ভাঁড়ার করে দিলে—সাধুসেবার জন্য—গাড়ি, পালকি—যাকে যা দিতে বলেছি, তাকে তা দেওয়া। বামনী খতাতো—প্রতাপ রুদ্র।
“বিজয় এই রূপ (অর্থাৎ ঠাকুরের মূর্তি) দর্শন করেছে। একি বলো দেখি? বলে, তোমায় যেমন ছোঁয়া, ওইরূপ ছুঁয়েছি।
“নোটো (লাটু) খতালে একত্রিশজন ভক্ত। কই তেমন বেশি কই!—তবে কেদার আর বিজয় কতকগুলো কচ্ছে!
“ভাবে দেখালে, শেষে পায়েস খেয়ে থাকতে হবে!
“এ অসুখে পরিবার (ভক্তদের শ্রীশ্রীমা) পায়েস খাইয়ে দিচ্ছিল, তখন কাঁদলাম এই বলে,—এই কি পায়েস খাওয়া! এই কষ্টে!”
৫৪.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – কাশীপুর বাগানে ভক্তসঙ্গে
ঈশ্বরের জন্য শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রের ব্যাকুলতা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে উপরের সেই পূর্বপরিচিত ঘরে বসিয়া আছেন। দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দির হইতে শ্রীযুক্ত রাম চাটুজ্যে তাঁহার কুশল সংবাদ লইতে আসিয়াছিলেন। ঠাকুর মণির সহিত সেই সকল কথা কহিতেছেন—বলিতেছেন—ওখানে (দক্ষিণেশ্বরে) কি এখন বড় ঠাণ্ডা?
আজ ২১শে পৌষ, কৃষ্ণা চতুর্দশী, সোমবার, ৪ঠা জানুয়ারি, ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ। অপরাহ্ণ—বেলা ৪টা বাজিয়া গিয়াছে।
নরেন্দ্র আসিয়া বসিলেন। ঠাকুর তাঁহাকে মাঝে মাঝে দেখিতেছেন ও তাঁহার দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিতেছেন,—যেন তাঁহার স্নেহ উথলিয়া পড়িতেছে। মণিকে সঙ্কেত করিয়া বলিতেছেন, “কেঁদেছিল!” ঠাকুর কিঞ্চিৎ চুপ করিলেন। আবার মণিকে সঙ্কেত করিয়া বলিতেছেন, “কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে এসেছিল!”
সকলে চুপ করিয়া আছেন। এইবার নরেন্দ্র কথা কহিতেছেন—
নরেন্দ্র—ওখানে আজ যাব মনে করেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কোথায়?
নরেন্দ্র—দক্ষিণেশ্বরে—বেলতলায়—ওখানে রাত্রে ধুনি জ্বালাব।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না; ওরা (ম্যাগাজিনের কর্তৃপক্ষীয়েরা) দেবে না। পঞ্চবটী বেশ জায়গা,—অনেক সাধু ধ্যান-জপ করেছে!
“কিন্তু বড় শীত আর অন্ধকার।”
সকলে চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি, সহাস্যে)—পড়বি না?
নরেন্দ্র (ঠাকুর ও মণির দিকে চাহিয়া)—একটা ঔষধ পেলে বাঁচি, যাতে পড়া-টড়া যা হয়েছে সব ভুলে যাই!
শ্রীযুক্ত (বুড়ো) গোপাল বসিয়া আছেন। তিনি বলিতেছেন—আমিও ওই সঙ্গে যাব। শ্রীযুক্ত কালীপদ (ঘোষ) ঠাকুরের জন্য আঙ্গুর আনিয়াছিলেন। আঙ্গুরের বাক্স ঠাকুরের পার্শ্বে ছিল। ঠাকুর ভক্তদের আঙ্গুর বিতরণ করিতেছেন। প্রথমেই নরেন্দ্রকে দিলেন—তাহার পর হরিরলুঠের মতো ছড়াইয়া দিলেন, ভক্তেরা যে যেমন পাইলেন কুড়াইয়া লইলেন!
৫৪.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঈশ্বরের জন্য শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রের ব্যাকুলতা ও তীব্র বৈরাগ্য
সন্ধ্যা হইয়াছে, নরেন্দ্র নিচে বসিয়া তামাক খাইতেছেন ও নিভৃতে মণির কাছে নিজের প্রাণ কিরূপ ব্যাকুল গল্প করিতেছেন।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি)—গত শনিবার এখানে ধ্যান করছিলাম। হঠাৎ বুকের ভিতর কিরকম করে এল!
মণি—কুণ্ডলিনী জাগরণ।
নরেন্দ্র—তাই হবে, বেশ বোধ হল—ইড়া-পিঙ্গলা। হাজরাকে বললাম, বুকে হাত দিয়ে দেখতে।
“কাল রবিবার, উপরে গিয়ে এঁর সঙ্গে দেখা কল্লাম, ওঁকে সব বললাম।
“আমি বললাম, ‘সব্বাই-এর হল, আমায় কিছু দিন। সব্বাই-এর হল, আমার হবে না’?”
মণি—তিনি তোমায় কি বললেন?
নরেন্দ্র—তিনি বললেন, ‘তুই বাড়ির একটা ঠিক করে আয় না, সব হবে। তুই কি চাস?’
[Sri Ramakrishna and the Vedanta—নিত্যলীলা দুই গ্রহণ]
“আমি বললাম,—আমার ইচ্ছা অমনি তিন-চারদিন সমাধিস্থ হয়ে থাকব! কখন কখন এক-একবার খেতে উঠব!
“তিনি বললেন, ‘তুই তো বড় হীনবুদ্ধি! ও অবস্থার উঁচু অবস্থা আছে। তুই তো গান গাস, ‘যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়’।”
মণি—হাঁ, উনি সর্বদাই বলেন যে, সমাধি থেকে নেমে এসে দেখে—তিনিই জীবজগৎ, এই সমস্ত হয়েছেন। ঈশ্বরকোটির এই অবস্থা হতে পারে। উনি বলেন, জীবকোটি সমাধি অবস্থা যদিও লাভ করে আর নামতে পারে না।
নরেন্দ্র—উনি বললেন,—তুই বাড়ির একটা ঠিক করে আয়, সমাধিলাভের অবস্থার চেয়েও উঁচু অবস্থা হতে পারবে।
“আজ সকালে বাড়ি গেলাম। সকলে বকতে লাগল,—আর বললে, ‘কি হো-হো করে বেড়াচ্ছিস? আইন একজামিন (বি. এল.) এত নিকটে, পড়াশুনা নাই, হো-হো করে বেড়াচ্ছ’।”
মণি—তোমার মা কিছু বললেন?
নরেন্দ্র—না, তিনি খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত, হরিণের মাংস ছিল;—খেলুম,—কিন্তু খেতে ইচ্ছা ছিল না।
মণি—তারপর?
নরেন্দ্র—দিদিমার বাড়িতে, সেই পড়বার ঘরে পড়তে গেলাম। পড়তে গিয়ে পড়াতে একটা ভয়ানক আতঙ্ক এল,—পড়াটা যেন কি ভয়ের জিনিস! বুক আটুপাটু করতে লাগল!—অমন কান্না কখনও কাঁদি নাই।
“তারপর বই-টই ফেলে দৌড়!—রাস্তা দিয়ে ছুট! জুতো-টুতো রাস্তায় কোথায় একদিকে পড়ে রইল! খড়ের গাদার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম,—গায়েময়ে খড়, আমি দৌড়ুচ্চি,—কাশীপুরের রাস্তায়।”
নরেন্দ্র একটু চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন।
নরেন্দ্র—বিবেক চূড়ামণি শুনে আরও মন খারাপ হয়েছে! শঙ্করাচার্য বলেন—যে, এই তিনটি জিনিস অনেক তপস্যায়, অনেক ভাগ্যে মেলে,—মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ।
“ভাবলাম আমার তো তিনটিই হয়েছে!—অনেক তপস্যার ফলে মানুষ জন্ম হয়েছে, অনেক তপস্যার ফলে মুক্তির ইচ্ছা হয়েছে,—আর অনেক তপস্যার ফলে এরূপ মহাপুরুষের সঙ্গ লাভ হয়েছে।”
মণি—আহা!
নরেন্দ্র—সংসার আর ভাল লাগে না। সংসারে যারা আছে তাদেরও ভাল লাগে না। দুই-একজন ভক্ত ছাড়া।
নরেন্দ্র অমনি আবার চুপ করিয়া আছেন। নরেন্দ্রের ভিতর তীব্র বৈরাগ্য! এখনও প্রাণ আটুপাটু করিতেছে। নরেন্দ্র আবার কথা কহিতেছেন।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি)—আপনাদের শান্তি হয়েছে, আমার প্রাণ অস্থির হচ্ছে! আপনারাই ধন্য!
মণি কিছু উত্তর করিলেন না, চুপ করিয়া আছেন। ভাবিতেছেন, ঠাকুর বলিয়াছিলেন, ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল হতে হয়, তবে ঈশ্বরদর্শন হয়। সন্ধ্যার পরেই মণি উপরের ঘরে গেলেন। দেখলেন, ঠাকুর নিদ্রিত।
রাত্রি প্রায় ৯টা। ঠাকুরের কাছে নিরঞ্জন, শশী। ঠাকুর জাগিয়াছেন। থাকিয়া থাকিয়া নরেন্দ্রের কথাই বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নরেন্দ্রের অবস্থা কি আশ্চর্য! দেখো, এই নরেন্দ্র আগে সাকার মানত না! এর প্রাণ কিরূপ আটুপাটু হয়েছে দেখছিস। সেই যে আছে—একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, ঈশ্বরকে কেমন করে পাওয়া যায়। গুরু বললেন, ‘এস আমার সঙ্গে; তোমায় দেখিয়ে দিই কি হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।’ এই বলে একটা পুকুরে নিয়ে গিয়ে তাকে জলে চুবিয়ে ধরলেন! খানিকক্ষণ পরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার পর শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার প্রাণটা কি-রকম হচ্ছিল?’ সে বললে, ‘প্রাণ যায় যায় হচ্ছিল!’
“ঈশ্বরের জন্য প্রাণ আটুবাটু করলে জানবে যে দর্শনের আর দেরি নাই। অরুণ উদয় হলে—পূর্বদিক লাল হলে—বুঝা যায় সূর্য উঠবে।”
ঠাকুরের আজ অসুখ বাড়িয়াছে। শরীরের এত কষ্ট। তবুও নরেন্দ্র সম্বন্ধে এই সকল কথা,—সঙ্কেত করিয়া বলিতেছেন।
নরেন্দ্র এই রাত্রেই দক্ষিণেশ্বরে চলিয়া গিয়াছেন। গভীর অন্ধকার—অমাবস্যা পড়িয়াছে। নরেন্দ্রের সঙ্গে দু-একটি ভক্ত। মণি রাত্রে বাগানেই আছেন। স্বপ্নে দেখিতেছেন, সন্ন্যাসীমণ্ডলের ভিতর বসিয়া আছেন।
৫৪.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ভক্তদের তীব্র বৈরাগ্য—সংসার ও নরক যন্ত্রণা
পরদিন মঙ্গলবার, ৫ই জানুয়ারি, ২২শে পৌষ। অনেকক্ষণ অমাবস্যা আছে। বেলা ৪টা বাজিয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শয্যায় বসিয়া আছেন, মণির সহিত নিভৃতে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ক্ষীরোদ যদি ৺গঙ্গাসাগর যায় তাহলে তুমি কম্বল একখানা কিনে দিও।
মণি—যে আজ্ঞা।
ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, ছোকরাদের একি হচ্ছে বল দেখি? কেউ শ্রীক্ষেত্রে পালাচ্ছে—কেউ গঙ্গাসাগরে!
“বাড়ি ত্যাগ করে করে সব আসছে। দেখ না নরেন্দ্র। তীব্র বৈরাগ্য হলে সংসার পাতকুয়ো বোধ হয়, আত্মীয়েরা কালসাপ বোধ হয়।”
মণি—আজ্ঞা, সংসারে ভারী যন্ত্রণা!
শ্রীরামকৃষ্ণ—নরকযন্ত্রণা! জন্ম থেকে। দেখছ না—মাগছেলে নিয়ে কি যন্ত্রণা!
মণি—আজ্ঞা হাঁ। আর আপনি বলেছিলেন, ওদের (সংসারে ঢুকে নাই তাদের) লেনাদেনা নাই, লেনাদেনার জন্য আটকে থাকতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখছ না—নিরঞ্জনকে! ‘তোর এই নে আমার এই দে’—বাস! আর কোনও সম্পর্ক নাই। পেছুটান নাই!
“কামিনী-কাঞ্চনই সংসার। দেখ না, টাকা থাকলেই বাঁধতে ইচ্ছা করে।” মণি হো-হো করিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। ঠাকুরও হাসিলেন।
মণি—টাকা বার করতে অনেক হিসাব আসে। (উভয়ের হাস্য) তবে দক্ষিণেশ্বরে বলেছিলেন, ত্রিগুণাতীত হয়ে সংসারে থাকতে পারলে এক হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, বালকের মতো।
মণি—আজ্ঞা, কিন্তু বড় কঠিন, বড় শক্তি চাই।
ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন।
মণি—কাল ওরা দক্ষিণেশ্বরে ধ্যান করতে গেল। আমি স্বপ্ন দেখলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি দেখলে?
মণি—দেখলাম যেন নরেন্দ্র প্রভৃতি সন্ন্যাসী হয়েছেন—ধুনি জ্বেলে বসে আছেন। আমিও তাদের মধ্যে বসে আছি। ওরা তামাক খেয়ে ধোঁয়া মুখ দিয়ে বার ক’চ্চে, আমি বললাম, গাঁজার ধোঁয়ার গন্ধ।
[সন্ন্যাসী কে—ঠাকুরের পীড়া ও বালকের অবস্থা]
শ্রীরামকৃষ্ণ—মনে ত্যাগ হলেই হল, তাহলেও সন্ন্যাসী।
ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু বাসনায় আগুন দিতে হয়, তবে তো!
মণি—বড়বাজারে মারোয়াড়ীদের পণ্ডিতজীকে বলেছিলেন, ‘ভক্তিকামনা আমার আছে।’—ভক্তিকামনা বুঝি কামনার মধ্যে নয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যেমন হিঞ্চেশাক শাকের মধ্যে নয়। পিত্ত দমন হয়।
“আচ্ছা, এত আনন্দ, ভাব—এ-সব কোথায় গেল?”
মণি—বোধ হয় গীতায় যে ত্রিগুণাতীতের কথা বলা আছে সেই অবস্থা হয়েছে। সত্ত্ব রজঃ তমোগুণ নিজে নিজে কাজ করছে, আপনি স্বয়ং নির্লিপ্ত—সত্ত্ব গুণেতেও নির্লিপ্ত।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ; বালকের অবস্থায় রেখেছে।
“আচ্ছা, দেহ কি এবার থাকবে না?”
ঠাকুর ও মণি চুপ করিয়া আছেন। নরেন্দ্র নিচে হইতে আসিলেন। একবার বাড়ি যাইবেন। বন্দোবস্ত করিয়া আসিবেন।
পিতার পরলোক প্রাপ্তির পর তাঁহার মা ও ভাইরা অতি কষ্টে আছেন,—মাঝে মাঝে অন্নকষ্ট। নরেন্দ্র একমাত্র তাঁহাদের ভরসা,—তিনি রোজগার করিয়া তাঁহাদের খাওয়াইবেন। কিন্তু নরেন্দ্রের আইন পরীক্ষা দেওয়া হইল না। এখন তীব্র বৈরাগ্য! তাই আজ বাড়ির কিছু বন্দোবস্ত করিতে কলিকাতায় যাইতেছেন। একজন বন্ধু তাঁহাকে একশত টাকা ধার দিবেন। সেই টাকায় বাড়ির তিন মাসের খাওয়ার যোগাড় করিয়া দিয়া আসিবেন।
নরেন্দ্র—যাই বাড়ি একবার। (মণির প্রতি) মহিম চক্রবর্তীর বাড়ি হয়ে যাচ্ছি, আপনি কি যাবেন?
মণির যাইবার ইচ্ছা নাই; ঠাকুর তাঁহার দিকে তাকাইয়া নরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “কেন”?
নরেন্দ্র—ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, তাঁর সঙ্গে বসে একটু গল্পটল্প করব।
ঠাকুর একদৃষ্টে নরেন্দ্রকে দেখিতেছেন।
নরেন্দ্র—এখানকার একজন বন্ধু বলেছেন, আমায় একশ টাকা ধার দিবেন। সেই টাকাতে বাড়ির তিন মাসের বন্দোবস্ত করে আসব।
ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। মণির দিকে তাকাইলেন।
মণি (নরেন্দ্রকে)—না, তোমরা এগোও,—আমি পরে যাব।
৫৪.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কাশীপুর উদ্যানে শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
নরেন্দ্রকে জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের সমন্বয় উপদেশ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে হলঘরে ভক্তসঙ্গে অবস্থান করিতেছেন। রাত্রি প্রায় আটটা। ঘরে নরেন্দ্র, শশী, মাস্টার, বুড়োগোপাল, শরৎ। আজ বৃহস্পতিবার—২৮শে ফাল্গুন, ১২৯২ সাল; ফাল্গুন মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথি; ১১ই মার্চ, ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ।
ঠাকুর অসুস্থ—একটু শুইয়া আছেন। ভক্তেরা কাছে বসিয়া। শরৎ দাঁড়াইয়া পাখা করিতেছেন। ঠাকুর অসুখের কথা বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভোলানাথের কাছে গেলে তেল দেবে। আর সে বলে দেবে, কি-রকম করে লাগাতে হবে।
বুড়োগোপাল—তাহলে কাল সকালে আমরা গিয়ে আনব।
মাস্টার—আজ কেউ গেলে বলে দিতে পারে।
শশী—আমি যেতে পারি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শরৎকে দেখাইয়া)—ও যেতে পারে।
শরৎ কিয়ত্ক্ষণ পরে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে মুহুরী শ্রীযুক্ত ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের নিকট হইতে তেল আনিতে যাত্রা করিলেন।
ঠাকুর শুইয়া আছেন। ভক্তেরা নিঃশব্দে বসিয়া আছেন। ঠাকুর হঠাৎ উঠিয়া বসিলেন। নরেন্দ্রকে সম্বোধন করিয়া কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—ব্রহ্ম অলেপ। তিন গুণ তাঁতে আছে, কিন্তু তিনি নির্লিপ্ত।
“যেমন বায়ুতে সুগন্ধ-দুর্গন্ধ দুই-ই পাওয়া যায়, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত। কাশীতে শঙ্করাচার্য পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন! চণ্ডাল মাংসের ভার নিয়ে যাচ্ছিল—হঠাৎ ছুঁয়ে ফেললে। শঙ্কর বললেন—ছুঁয়ে ফেললি! চণ্ডাল বললে,—ঠাকুর, তুমিও আমায় ছোঁও নাই! আমিও তোমায় ছুঁই নাই! আত্মা নির্লিপ্ত। তুমি সেই শুদ্ধ আত্মা।
“ব্রহ্ম আর মায়া। জ্ঞানী মায়া ফেলে দেয়।
“মায়া আবরণস্বরূপ। এই দেখ, এই গামছা আড়াল করলাম—আর প্রদীপের আলো দেখা যাচ্ছে না।
ঠাকুর গামছাটি আপনার ও ভক্তদের মাঝখানে ধরিলেন। বলিতেছেন, “এই দেখ, আমার মুখ আর দেখা যাচ্ছে না।
“রামপ্রসাদ যেমন বলেছে—‘মশারি তুলিয়া দেখ—’
“ভক্ত কিন্তু মায়া ছেড়ে দেয় না। মহামায়ার পূজা করে। শরণাগত হয়ে বলে, ‘মা, পথ ছেড়ে দাও! তুমি পথ ছেড়ে দিলে তবে ব্রহ্মজ্ঞান হবে।’ জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি,—এই তিন অবস্থা জ্ঞানীরা উড়িয়ে দেয়! ভক্তেরা এ-সব অবস্থাই লয়—যতক্ষণ আমি আছে ততক্ষণ সবই আছে।
“যতক্ষণ আমি আছে, ততক্ষণ দেখে যে, তিনিই মায়া, জীবজগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব, সব হয়েছেন!
[নরেন্দ্র প্রভৃতি চুপ করিয়া আছেন।]
“মায়াবাদ শুকনো। কি বললাম, বল দেখি।”
নরেন্দ্র—শুকনো।
ঠাকুর নরেন্দ্রের হাত-মুখ স্পর্শ করিতে লাগিলেন। আবার কথা কহিতেছেন—“এ-সব (নরেন্দ্রের সব) ভক্তের লক্ষণ। জ্ঞানীর সে আলাদা লক্ষণ,—মুখ, চেহারা শুকনো হয়।
“জ্ঞানী জ্ঞানলাভ করবার পরও বিদ্যামায়া নিয়ে থাকতে পারে—ভক্তি, দয়া, বৈরাগ্য—এই সব নিয়ে থাকতে পারে। এর দুটি উদ্দেশ্য। প্রথম, লোকশিক্ষা হয়, তারপর রসাস্বাদনের জন্য।
“জ্ঞানী যদি সমাধিস্থ হয়ে চুপ করে থাকে, তাহলে লোকশিক্ষা হয় না। তাই শঙ্করাচার্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন।
“আর ঈশ্বরের আনন্দ ভোগ করবার জন্য—সম্ভোগ করবার জন্য—ভক্তি-ভক্ত নিয়ে থাকে!
“এই ‘বিদ্যার আমি’, ‘ভক্তের আমি’—এতে দোষ নাই। ‘বজ্জাৎ আমি’তে দোষ হয়। তাঁকে দর্শন করবার পর বালকের স্বভাব হয়। ‘বালকের আমি’তে কোন দোষ নাই। যেমন আরশির মুখ—লোককে গালাগাল দেয় না। পোড়া দড়ি দেখতেই দড়ির আকার, ফুঁ দিলে উড়ে যায়। জ্ঞানাগ্নিতে অহংকার পুড়ে গেছে। এখন আর কারও অনিষ্ট করে না। নামমাত্র ‘আমি’।
“নিত্যেতে পৌঁছে আবার লীলায় থাকা। যেমন ওপারে গিয়ে আবার এপারে আসা। লোকশিক্ষা আর বিলাসের জন্য—আমোদের জন্য।”
ঠাকুর অতি মৃদুস্বরে কথা কহিতেছেন। একটু চুপ করিলেন। আবার ভক্তদের বলিতেছেন—“শরীরের এই রোগ—কিন্তু অবিদ্যা মায়া রাখে না! এই দেখো, রামলাল, কি বাড়ি, কি পরিবার, আমার মনে নাই!—কে না পূর্ণ কায়েত তার জন্য ভাবছি।—ওদের জন্য তো ভাবনা হয় না!
“তিনিই বিদ্যামায়া রেখে দিয়েছেন—লোকের জন্য—ভক্তের জন্য।
“কিন্তু বিদ্যামায়া থাকলে আবার আসতে হবে। অবতারাদি বিদ্যামায়া রাখে! একটু বাসনা থাকলেই আসতে হয়, ফিরে ফিরে আসতে হয়। সব বাসনা গেলে মুক্তি। ভক্তেরা কিন্তু মুক্তি চায় না।
“যদি কাশীতে কারু দেহত্যাগ হয় তাহলে মুক্তি হয়—আর আসতে হয় না। জ্ঞানীদের মুক্তি।”
নরেন্দ্র—সেদিন মহিম চক্রবর্তীর বাড়িতে আমরা গিছলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তারপর?
নরেন্দ্র—ওর মতো এমন শুষ্ক জ্ঞানী দেখি নাই!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কি হয়েছিল?
নরেন্দ্র—আমাদের গান গাইতে বললে। গঙ্গাধর গাইলে—
শ্যামনামে প্রাণ পেয়ে ইতি উতি চায়,
সম্মুখে তমালবৃক্ষ দেখিবারে পায় ।
“গান শুনে বললে—ও-সব গান কেন? প্রেম-ট্রেম ভাল লাগে না। তা ছাড়া, মাগছেলে নিয়ে থাকি, এ-সব গান এখানে কেন?”
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—ভয় দেখেছ!
৫৪.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে সাঙ্গোপাঙ্গসঙ্গে
ভক্তের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের দেহধারণ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে রহিয়াছেন। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। ঠাকুর অসুস্থ। উপরের হলঘরে উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র ও রাখাল দুইজনে পদসেবা করিতেছেন, মণি কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুর ইঙ্গিত করিয়া তাহাকে পদসেবা করিতে বলিলেন। মণি পদসেবা করিতেছেন।
আজ রবিবার, ১৪ই মার্চ, ১৮৮৬; ২রা চৈত্র, ফাল্গুন শুক্লা নবমী। গত রবিবারে ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষে বাগানে পূজা হইয়া গিয়াছে। গত বর্ষে জন্মমহোত্সব দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে খুব ঘটা করিয়া হইয়াছিল। এবার তিনি অসুস্থ। ভক্তেরা বিষাদসাগরে ডুবিয়া আছেন। পূজা হইল। নামমাত্র উত্সব হইল।
ভক্তেরা সর্বদাই বাগানে উপস্থিত আছেন ও ঠাকুরের সেবা করিতেছেন। শ্রীশ্রীমা ওই সেবায় নিশিদিন নিযুক্ত। ছোকরা ভক্তেরা অনেকেই সর্বদা থাকেন, নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, শরৎ, শশী, বাবুরাম, যোগীন, কালী, লাটু প্রভৃতি।
বয়স্ক ভক্তেরা মাঝে মাঝে থাকেন ও প্রায় প্রত্যহ আসিয়া ঠাকুরকে দর্শন করেন বা তাঁহার সংবাদ লইয়া যান। তারক, সিঁথির গোপাল, ইঁহারাও সর্বদা থাকেন। ছোট গোপালও থাকেন।
ঠাকুর আজও বিশেষ অসুস্থ। রাত্রি দুই প্রহর। আজ শুক্ল পক্ষের নবমী তিথি, চাঁদের আলোয় উদ্যানভূমি যেন আনন্দময় হইয়া রহিয়াছে। ঠাকুরের কঠিন পীড়া,—চন্দ্রের বিমলকিরণ দর্শনে ভক্তহৃদয়ে আনন্দ নাই। যেমন একটি নগরীর মধ্যে সকলই সুন্দর, কিন্তু শত্রুসৈন্য অবরোধ করিয়াছে। চতুর্দিক নিস্তব্ধ, কেবল বসন্তানিলস্পর্শে বৃক্ষপত্রের শব্দ হইতেছে। উপরের হলঘরে ঠাকুর শুইয়া আছেন। ভারী অসুস্থ,—নিদ্রা নাই। দু-একটি ভক্ত নিঃশব্দে কাছে বসিয়া আছেন—কখন কি প্রয়োজন হয়। এক-একবার তন্দ্রা আসিতেছে ও ঠাকুরকে নিদ্রাগতপ্রায় বোধ হইতেছে।
এ কি নিদ্রা না মহাযোগ? ‘যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে!’ এ কি সেই যোগাবস্থা?
মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুর ইঙ্গিত করিয়া আরও কাছে আসিতে বলিতেছেন। ঠাকুরের কষ্ট দেখিলে পাষাণ বিগলিত হয়! মাস্টারকে আস্তে আস্তে অতি কষ্টে বলিতেছেন—“তোমরা কাঁদবে বলে এত ভোগ করছি—সব্বাই যদি বল যে—‘এত কষ্ট, তবে দেহ যাক’—তাহলে দেহ যায়!”
কথা শুনিয়া ভক্তদের হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। যিনি তাঁহাদের পিতা মাতা রক্ষাকর্তা তিনি এই কথা বলিতেছেন!—সকলে চুপ করিয়া আছেন। কেহ ভাবিতেছেন, এরই নাম কি Crucifixion! ভক্তের জন্য দেহ বিসর্জন!
গভীর রাত্রি। ঠাকুরের অসুখ আরও যেন বাড়িতেছে! কি উপায় করা যায়? কলিকাতায় লোক পাঠানো হইল। শ্রীযুক্ত উপেন্দ্র ডাক্তার আর শ্রীযুক্ত নবগোপাল কবিরাজকে সঙ্গে করিয়া গিরিশ সেই গভীর রাত্রে আসিলেন।
ভক্তেরা কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুর একটু সুস্থ হইতেছেন। বলিতেছেন, “দেহের অসুখ, তা হবে, দেখছি পঞ্চভূতের দেহ!”
গিরিশের দিকে তাকাইয়া বলিতেছেন, “অনেক ঈশ্বরীয় রূপ দেখছি! তার মধ্যে এই রূপটিও (নিজের মূর্তি) দেখছি!”
৫৪.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – সমাধিমন্দিরে
পরদিন সকাল বেলা। আজ সোমবার, ৩রা চৈত্র; ১৫ই মার্চ, (১৮৮৬)। বেলা ৭টা-৮টা হইবে। ঠাকুর একটু সামলাইয়াছেন ও ভক্তদের সহিত আস্তে আস্তে, কখনও ইশারা করিয়া কথা কহিতেছেন। কাছে নরেন্দ্র, রাখাল, মাস্টার, লাটু, সিঁথির গোপাল প্রভৃতি।
ভক্তদের মুখে কথা নাই, ঠাকুরের পূর্বরাত্রির দেহের অবস্থা স্মরণ করিয়া তাঁহারা বিষাদগম্ভীর মুখে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন।
[ঠাকুরের দর্শন, ঈশ্বর, জীব, জগৎ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের দিকে তাকাইয়া, ভক্তদের প্রতি)—কি দেখছি জানো? তিনি সব হয়েছেন! মানুষ আর যা জীব দেখছি, যেন চামড়ার সব তয়েরি—তার ভিতর থেকে তিনিই হাত পা মাথা নাড়ছেন! যেমন একবার দেখেছিলাম—মোমের বাড়ি, বাগান, রাস্তা, মানুষ, গরু সব মোমের—সব এক জিনিসে তয়েরি।
“দেখছি—সে-ই কামার, সে-ই বলি, সে-ই হাড়িকাট হয়েছে!”
ঠাকুর কি বলিতেছেন, জীবের দুঃখে কাতর হইয়া তিনি নিজের শরীর জীবের মঙ্গলের জন্য বলিদান দিতেছেন?
ঈশ্বরই কামার, বলি, হাড়িকাট হইয়াছেন। এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর ভাবে বিভোর হইয়া বলিতেছেন—“আহা! আহা!”
আবার সেই ভাবাবস্থা! ঠাকুর বাহ্যশূন্য হইতেছেন। ভক্তেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছেন।
ঠাকুর একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিতেছেন—“এখন আমার কোনও কষ্ট নাই, ঠিক পূর্বাবস্থা।”
ঠাকুরের এই সুখ-দুঃখের অতীত অবস্থা দেখিয়া ভক্তেরা অবাক্ হইয়া রহিয়াছেন। লাটুর দিকে তাকাইয়া আবার বলিতেছেন—
“ওই লোটো—মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে,—তিনিই (ঈশ্বরই) মাথায় হাত দিয়ে যেন রয়েছেন!”
ঠাকুর ভক্তদের দেখিতেছেন ও স্নেহে যেন বিগলিত হইতেছেন। যেমন শিশুকে আদর করে, সেইরূপ রাখাল ও নরেন্দ্রকে আদর করিতেছেন! তাঁহাদের মুখে হাত বুলাইয়া আদর করিতেছেন!
[কেন লীলা সংবরণ]
কিয়ত্পরে মাস্টারকে বলিতেছেন, “শরীরটা কিছুদিন থাকত, লোকদের চৈতন্য হত।” ঠাকুর আবার চুপ করিয়া আছেন।
ঠাকুর আবার বলিতেছেন—“তা রাখবে না।”
ভক্তেরা ভাবিতেছেন, ঠাকুর আবার কি বলিবেন। ঠাকুর আবার বলিতেছেন, “তা রাখবে না,—সরল মূর্খ দেখে পাছে লোকে সব ধরে পড়ে। সরল মূর্খ পাছে সব দিয়ে ফেলে! একে কলিতে ধ্যান-জপ নাই।”
রাখাল (সস্নেহে)—আপনি বলুন—যাতে আপনার দেহ থাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে ঈশ্বরের ইচ্ছা।
নরেন্দ্র—আপনার ইচ্ছা আর ঈশ্বরের ইচ্ছা এক হয়ে গেছে।
ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন—যেন কি ভাবিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্র, রাখালাদি ভক্তের প্রতি)—আর বললে কই হয়?
“এখন দেখছি এক হয়ে গেছে। ননদিনীর ভয়ে কৃষ্ণকে শ্রীমতী বললেন, ‘তুমি হৃদয়ের ভিতর থাকো’। যখন আবার ব্যাকুল হয়ে কৃষ্ণকে দর্শন করিতে চাইলেন,—এমনি ব্যাকুলতা—যেমন বেড়াল আঁচড় পাঁচড় করে,—তখন কিন্তু আর বেরয় না!”
রাখাল (ভক্তদের প্রতি, মৃদুস্বরে)—গৌর অবতারের কথা বলছেন।
৫৪.৯ নবম পরিচ্ছেদ – গুহ্যকথা—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁহার সাঙ্গোপাঙ্গ
ভক্তেরা নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছেন। ঠাকুর ভক্তদের সস্নেহে দেখিতেছেন, নিজের হৃদয়ে হাত রাখিলেন—কি বলিবেন—
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদিকে)—এর ভিতর দুটি আছেন। একটি তিনি।
ভক্তেরা অপেক্ষা করিতেছেন আবার কি বলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—একটি তিনি—আর একটি ভক্ত হয়ে আছে। তারই হাত ভেঙে ছিল—তারই এই অসুখ করেছে। বুঝেছ?
ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কারেই বা বলব কেই বা বুঝবে।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন—
“তিনি মানুষ হয়ে—অবতার হয়ে—ভক্তদের সঙ্গে আসেন। ভক্তেরা তাঁরই সঙ্গে আবার চলে যায়।”
রাখাল—তাই আমাদের আপনি যেন ফেলে না যান।
ঠাকুর মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বলিতেছেন, “বাউলের দল হঠাৎ এল,—নাচলে, গান গাইলে; আবার হঠাৎ চলে গেল! এল—গেল, কেউ চিনলে না। (ঠাকুরের ও সকলের ঈষৎ হাস্য)
কিয়ত্ক্ষণ চুপ করিয়া ঠাকুর আবার বলিতেছেন,—
“দেহধারণ করলে কষ্ট আছেই।
“এক-একবার বলি, আর যেন আসতে না হয়।
“তবে কি,—একটা কথা আছে। নিমন্ত্রণ খেয়ে খেয়ে আর বাড়ির কড়াই-এর ডাল-ভাত ভাল লাগে না।
“আর যে দেহধারণ করা,—এটি ভক্তের জন্য।”
ঠাকুর ভক্তের নৈবেদ্য—ভক্তের নিমন্ত্রণ—ভক্তসঙ্গে বিহার ভালবাসেন, এই কথা কি বলিতেছেন?
[নরেন্দ্রের জ্ঞান-ভক্তি—নরেন্দ্র ও সংসারত্যাগ]
ঠাকুর নরেন্দ্রকে সস্নেহে দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—চণ্ডাল মাংসের ভার নিয়ে যাচ্ছিল। শঙ্করাচার্য গঙ্গা নেয়ে কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। চণ্ডাল হঠাৎ তাঁকে ছুঁয়ে ফেলেছিল। শঙ্কর বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই আমায় ছুঁয়ে ফেললি! সে বললে, ‘ঠাকুর তুমিও আমায় ছোঁও নাই, আমিও তোমায় ছুঁই নাই! তুমি বিচার কর! তুমি কি দেহ, তুমি কি মন, তুমি কি বুদ্ধি; কি তুমি, বিচার কর! শুদ্ধ আত্মা নির্লিপ্ত—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ; তিনগুণ;—কোন গুণে লিপ্ত নয়।’
“ব্রহ্ম কিরূপ জানিস। যেমন বায়ু। দুর্গন্ধ, ভাল গন্ধ—সব বায়ুতে আসছে, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত।”
নরেন্দ্র—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—গুণাতীত। মায়াতীত। অবিদ্যামায়া বিদ্যামায়া দুয়েরই অতীত। কামিনী-কাঞ্চন অবিদ্যা। জ্ঞান বৈরাগ্য ভক্তি—এ-সব বিদ্যার ঐশ্বর্য। শঙ্করাচার্য বিদ্যামায়া রেখেছিলেন। তুমি আর এরা যে আমার জন্যে ভাবছ, এই ভাবনা বিদ্যামায়া!
“বিদ্যামায়া ধরে ধরে সেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। যেমন সিঁড়ির উপরের পইটে—তারপরে ছাদ। কেউ কেউ ছাদে পৌঁছানোর পরও সিঁড়িতে আনাগোনা করে—জ্ঞানলাভের পরও বিদ্যার আমি রাখে। লোকশিক্ষার জন্য। আবার ভক্তি আস্বাদ করবার জন্য—ভক্তের সঙ্গে বিলাস করবার জন্য।”
নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর কি এ-সমস্ত নিজের অবস্থা বলিতেছেন?
নরেন্দ্র—কেউ কেউ রাগে আমার উপর, ত্যাগ করবার কথায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মৃদুস্বরে)—ত্যাগ দরকার।
ঠাকুর নিজের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখাইয়া বলিতেছেন, “একটা জিনিসের পর যদি আর-একটা জিনিস থাকে, প্রথম জিনিসটা পেতে গেলে, ও জিনিসটা সরাতে হবে না? একটা না সরালে আর একটা কি পাওয়া যায়?”
নরেন্দ্র—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রকে, মৃদুস্বরে)—সেই-ময় দেখলে আর কিছু কি দেখা যায়?
নরেন্দ্র—সংসারত্যাগ করতে হবেই?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যা বললুম সেই-ময় দেখলে কি আর কিছু দেখা যায়? সংসার-ফংসার আর কিছু দেখা যায়?
“তবে মনে ত্যাগ। এখানে যারা আসে, কেউ সংসারী নয়। কারু কারু একটু ইচ্ছা ছিল—মেয়েমানুষের সঙ্গে থাকা। (রাখাল, মাস্টার প্রভৃতি ঈষৎ হাস্য) সেই ইচ্ছাটুকু হয়ে গেল।
[নরেন্দ্র ও বীরভাব]
ঠাকুর নরেন্দ্রকে সস্নেহে দেখিতেছেন। দেখিতে দেখিতে যেন আনন্দে পরিপূর্ণ হইতেছেন। ভক্তদের দিকে তাকাইয়া বলিতেছেন—‘খুব’! নরেন্দ্র ঠাকুরকে সহাস্যে বলিতেছেন, ‘খুব’ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—খুব ত্যাগ হয়ে আসছে।
নরেন্দ্র ও ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন ও ঠাকুরকে দেখিতেছেন। এইবার রাখাল কথা কহিতেছেন।
রাখাল (ঠাকুরকে, সহাস্যে)—নরেন্দ্র আপনাকে খুব বুঝছে।
ঠাকুর হাসিতেছেন ও বলিতেছেন, “হাঁ, আবার দেখছি অনেকে বুঝছে! (মাস্টারের প্রতি)—না গা?”
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ।
ঠাকুর নরেন্দ্র ও মণিকে দেখিতেছেন ও হস্তের দ্বারা ইঙ্গিত করিয়া রাখালাদি ভক্তদিগকে দেখাইতেছেন। প্রথম ইঙ্গিত করিয়া নরেন্দ্রকে দেখাইলেন—তারপর মণিকে দেখাইলেন! রাখাল ঠাকুরের ইঙ্গিত বুঝিয়াছেন ও কথা কহিতেছেন।
রাখাল (সহাস্যে, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আপনি বলছেন নরেন্দ্রের বীরভাব? আর এঁর সখীভাব? [ঠাকুর হাসিতেছেন।]
নরেন্দ্র (সহাস্যে)—ইনি বেশি কথা কন না, আর লাজুক; তাই বুঝি বলছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে নরেন্দ্রকে)—আচ্ছা, আমার কি ভাব?
নরেন্দ্র—বীরভাব, সখীভাব,—সবভাব।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ—কে তিনি?]
ঠাকুর এই কথা শুনিয়া যেন ভাবে পূর্ণ হইলেন, হৃদয়ে হাত রাখিয়া কি বলিতেছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদি ভক্তদিগকে)—দেখছি এর ভিতর থেকেই যা কিছু।
নরেন্দ্রকে ইঙ্গিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “কি বুঝলি?”
নরেন্দ্র—(“যা কিছু” অর্থাৎ) যত সৃষ্ট পদার্থ সব আপনার ভিতর থেকে!
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাখালের প্রতি, আনন্দে)—দেখছিস!
ঠাকুর নরেন্দ্রকে একটু গান গাইতে বলিতেছেন। নরেন্দ্র সুর করিয়া গাহিতেছেন। নরেন্দ্রের ত্যাগের ভাব,—গাহিতেছেন :
“নলিনীদলগতজলমতিতরলম্ তদ্বজ্জীবনমতিশয়চপলম্
ক্ষণমিহ সজ্জনসঙ্গতিরেকা, ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা ।”
দুই-এক চরণ গানের পরই ঠাকুর নরেন্দ্রকে ইঙ্গিত করিয়া বলিতেছেন, “ও কি! ও-সব ভাব অতি সামান্য!”
নরেন্দ্র এইবার সখী ভাবের গান গাহিতেছেন :
কাহে সই, জিয়ত মরত কি বিধান!
ব্রজকি কিশোর সই, কাঁহা গেল ভাগই, ব্রজজন টুটায়ল পরাণ ॥
মিলি সই নাগরী, ভুলিগেই মাধব, রূপবিহীন গোপকুঙারী ।
কো জানে পিয় সই, রসময় প্রেমিক, হেন বঁধু রূপ কি ভিখারি ॥
আগে নাহি বুঝুনু, রূপ হেরি ভুলনু, হৃদি কৈনু চরণ যুগল ।
যমুনা সলিলে সই, অব তনু ডারব, আন সখি ভখিব গরল ॥
(কিবা) কানন বল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই, নবীন তমালে দিব ফাঁস ।
নহে শ্যাম শ্যাম শ্যাম শ্যাম শ্যাম নাম-জপই, ছার তনু করিব বিনাশ ॥
গান শুনিয়া ঠাকুর ও ভক্তেরা মুগ্ধ হইয়াছেন। ঠাকুর ও রাখালের নয়ন দিয়া প্রেমাশ্রু পড়িতেছে। নরেন্দ্র আবার ব্রজগোপীর ভাবে মাতোয়ারা হইয়া কীর্তনের সুরে গাহিতেছেন :
তুমি আমার, আমার বঁধু, কি বলি (কি বলি তোমায় বলি নাথ) ।
(কি জানি কি বলি আমি অভাগিনী নারীজাতি) ।
তুমি হাতোকি দর্পণ, মাথোকি ফুল
(তোমায় ফুল করে কেশে পরব বঁধু) ।
(তোমায় কবরীর সনে লুকায়ে লুকায়ে রাখব বঁধু)
(শ্যামফুল পরিলে কেউ নখতে নারবে) ।
তুমি নয়নের অঞ্জন, বয়ানের তাম্বুল
(তোমায় শ্যাম অঞ্জন করে এঁখে পরবো বঁধু)
(শ্যাম অঞ্জন পরেছি বলে কেউ নখতে নারবে)
তুমি অঙ্গকি মৃগমদ গিমকি হার ।
(শ্যামচন্দন মাখি শীতল হব বঁধু)
তোমার হার কণ্ঠে পরব বঁধু । তুমি দেহকি সর্বস্ব গেহকি সার ॥
পাখিকো পাখ মীনকো পানি । তেয়সে হাম বঁধু তুয়া মানি ॥
৫৪.১০ দশম পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে
বুদ্ধদেব ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানে আছেন। আজ শুক্রবার বেলা ৫টা, চৈত্র শুক্লা পঞ্চমী। ৯ই এপ্রিল, ১৮৮৬।
নরেন্দ্র, কালী, নিরঞ্জন, মাস্টার নিচে বসিয়া কথা কহিতেছেন।
নিরঞ্জন (মাস্টারের প্রতি)—বিদ্যাসাগরের নূতন একটা স্কুল নাকি হবে? নরেনকে এর একটা কর্ম যোগাড় করে—
নরেন্দ্র—আর বিদ্যাসাগরের কাছে চাকরি করে কাজ নাই!
নরেন্দ্র বুদ্ধগয়া হইতে সবে ফিরিয়াছেন। সেখানে বুদ্ধমূর্তি দর্শন করিয়াছেন এবং সেই মূর্তির সম্মুখে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হইয়াছিলেন। যে বৃক্ষের নিচে বুদ্ধদেব তপস্যা করিয়া নির্বাণ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, সেই বৃক্ষের স্থানে একটি নূতন বৃক্ষ হইয়াছে, তাহাও দর্শন করিয়াছিলেন। কালী বলিলেন, “একদিন গয়ার উমেশ বাবুর বাড়িতে নরেন্দ্র গান গাইয়াছিলেন,—মৃদঙ্গ সঙ্গে খেয়াল, ধ্রুপদ ইত্যাদি।”
শ্রীরামকৃষ্ণ হলঘরে বিছানায় বসিয়া। রাত্রি কয়েক দণ্ড হইয়াছে। মণি একাকী পাখা করিতেছেন।—লাটু আসিয়া বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—একখানি গায়ের চাদর ও একজোড়া চটি জুতা আনবে।
মণি—যে আজ্ঞা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (লাটুকে)—চাদর দশ আনা ও জুতা, সর্বসুদ্ধ কত দাম?
লাটু—একটাকা দশ আনা।
ঠাকুর মণিকে দামের কথা শুনিতে ইঙ্গিত করিলেন।
নরেন্দ্র আসিয়া উপবিষ্ট হইলেন। শশী, রাখাল ও আরও দু-একটি ভক্ত আসিয়া বসিলেন। ঠাকুর নরেন্দ্রকে পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ইঙ্গিত করিয়া নরেন্দ্রকে বলিতেছেন—“খেয়েছিস?”
[বুদ্ধদেব কি নাস্তিক? “অস্তি নাস্তির মধ্যের অবস্থা”]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি, সহাস্যে)—ওখানে (অর্থাৎ বুদ্ধগয়ায়) গিছল।
মাস্টার (নরেন্দ্রের প্রতি)—বুদ্ধদেবের কি মত?
নরেন্দ্র—তিনি তপস্যার পর কি পেলেন, তা মুখে বলতে পারেন নাই। তাই সকলে বলে, নাস্তিক।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ইঙ্গিত করিয়া)—নাস্তিক কেন? নাস্তিক নয়, মুখে বলতে পারে নাই। বুদ্ধ কি জানো? বোধ স্বরূপকে চিন্তা করে করে,—তাই হওয়া,—বোধ স্বরূপ হওয়া।
নরেন্দ্র—আজ্ঞে হাঁ। এদের তিন শ্রেণী আছে,—বুদ্ধ, অর্হৎ আর বোধিসত্ত্ব।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ তাঁরই খেলা,—নূতন একটা লীলা।
“নাস্তিক কেন হতে যাবে! যেখানে স্বরূপকে বোধ হয়, সেখানে অস্তি-নাস্তির মধ্যের অবস্থা।”
নরেন্দ্র (মাস্টারের প্রতি)—যে অবস্থায় contradictions meet, যে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন-এ শীতল জল তৈয়ার হয়, সেই হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দিয়ে Oxyhydrogen-blowpipe (জ্বলন্ত অত্যুষ্ণ অগ্নিশিখা) উত্পন্ন হয়।
“যে অবস্থায় কর্ম, কর্মত্যাগ দুইই সম্ভবে, অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম।
“যারা সংসারী, ইন্দ্রিয়ের বিষয় নিয়ে রয়েছে, তারা বলেছে, সব ‘অস্তি’; আবার মায়াবাদীরা বলছে,—‘নাস্তি’; বুদ্ধের অবস্থা এই ‘অস্তি’ ‘নাস্তির’ পরে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ অস্তি নাস্তি প্রকৃতির গুণ। যেখানে ঠিক ঠিক সেখানে অস্তি নাস্তি ছাড়া।
ভক্তেরা কিয়ত্ক্ষণ সকলে চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
[বুদ্ধদেবের দয়া ও বৈরাগ্য ও নরেন্দ্র]
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—ওদের (বুদ্ধদেবের) কি মত?
নরেন্দ্র—ঈশ্বর আছেন, কি, না আছেন, এ-সব কথা বুদ্ধ বলতেন না। তবে দয়া নিয়ে ছিলেন।
“একটা বাজ পক্ষী শিকারকে ধরে তাকে খেতে যাচ্ছিল, বুদ্ধ শিকারটির প্রাণ বাঁচাবার জন্য নিজের গায়ের মাংস তাকে দিয়েছিলেন।”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ চুপ করিয়া আছেন। নরেন্দ্র উত্সাহের সহিত বুদ্ধদেবের কথা আরও বলিতেছেন।
নরেন্দ্র—কি বৈরাগ্য! রাজার ছেলে হয়ে সব ত্যাগ করলে! যাদের কিছু নাই—কোনও ঐশ্বর্য নাই, তারা আর কি ত্যাগ করবে।
“যখন বুদ্ধ হয়ে নির্বাণলাভ করে বাড়িতে একবার এলেন, তখন স্ত্রীকে, ছেলেকে—রাজ বংশের অনেককে—বৈরাগ্য অবলম্বন করতে বললেন। কি বৈরাগ্য! কিন্তু এ-দিকে ব্যাসদেবের আচরণ দেখুন,—শুকদেবকে বারণ করে বললেন, পুত্র! সংসারে থেকে ধর্ম কর!”
ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। এখনও কোন কথা বলিতেছেন না।
নরেন্দ্র—শক্তি-ফক্তি কিছু (বুদ্ধ) মানতেন না।—কেবল নির্বাণ। কি বৈরাগ্য! গাছতলায় তপস্যা করতে বসলেন, আর বললেন—ইহৈব শুষ্যতু মে শরীরম্! অর্থাৎ যদি নির্বাণলাভ না করি, তাহলে আমার শরীর এইখানে শুকিয়ে যাক—এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা!
“শরীরই তো বদমাইস!—ওকে জব্দ না করলে কি কিছু!—”
শশী—তবে যে তুমি বল, মাংস খেলে সত্ত্বগুণ হয়।—মাংস খাওয়া উচিত, এ-কথা তো বল।
নরেন্দ্র—যেমন মাংস খাই,—তেমনি (মাংসত্যাগ করে) শুধু ভাতও খেতে পারি—লুন না দিয়েও শুধু ভাত খেতে পারি।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কথা কহিতেছেন। আবার বুদ্ধদেবের কথা ইঙ্গিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—(বুদ্ধদেবের) কি, মাথায় ঝুঁটি?
নরেন্দ্র—আজ্ঞা না, রুদ্রাক্ষের মালা অনেক জড় করলে যা হয়, সেই রকম মাথায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—চক্ষু?
নরেন্দ্র—চক্ষু সমাধিস্থ।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ দর্শন—“আমিই সেই”]
ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। নরেন্দ্র ও অন্যান্য ভক্তেরা তাঁহাকে একদৃষ্টে দেখিতেছেন। হঠাৎ তিনি ঈষৎ হাস্য করিয়া আবার নরেন্দ্রের সঙ্গে কথা আরম্ভ করিলেন। মণি হাওয়া করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—আচ্ছা,—এখানে সব আছে, না?—নাগাদ মুসুর ডাল, ছোলার ডাল, তেঁতুল পর্যন্ত।
নরেন্দ্র—আপনি ও-সব অবস্থা ভোগ করে, নিচে রয়েছেন!—
মণি (স্বগত)—সব অবস্থা ভোগ করে, ভক্তের অবস্থায়!—
শ্রীরামকৃষ্ণ—কে যেন নিচে টেনে রেখেছে!
এই বলিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মণির হাত হইতে পাখাখানি লইলেন এবং আবার কথা কহিতে লাগিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এই পাখা যেমন দেখছি, সামনে—প্রত্যক্ষ—ঠিক অমনি আমি (ঈশ্বরকে) দেখেছি! আর দেখলাম—
এই বলিয়া ঠাকুর নিজের হৃদয়ে হাত দিয়া ইঙ্গিত করিতেছেন, আর নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, “কি বললুম বল দেখি?”
নরেন্দ্র—বুঝেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বল দেখি?
নরেন্দ্র—ভাল শুনিনি।
শ্রীরামকৃষ্ণ আবার ইঙ্গিত করিতেছেন,—দেখলাম, তিনি (ঈশ্বর) আর হৃদয় মধ্যে যিনি আছেন এক ব্যক্তি।
নরেন্দ্র—হাঁ, হাঁ, সোঽহম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তবে একটি রেখামাত্র আছে—(‘ভক্তের আমি’ আছে) সম্ভোগের জন্য।
নরেন্দ্র (মাস্টারকে)—মহাপুরুষ নিজে উদ্ধার হয়ে গিয়ে জীবের উদ্ধারের জন্য থাকেন,—অহঙ্কার নিয়ে থাকেন—দেহের সুখ-দুঃখ নিয়ে থাকেন।
“যেমন মুটেগিরি, আমাদের মুটেগিরি on compulsion (কারে পড়ে)। মহাপুরুষ মুটেগিরি করেন সখ করে।”
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও গুরুকৃপা]
আবার সকলে চুপ করিয়া আছেন। অহেতুক-কৃপাসিন্ধু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার কথা কহিতেছেন। আপনি কে, এই তত্ত্ব নরেন্দ্রাদি ভক্তগণকে আবার বুঝাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদি ভক্তের প্রতি)—ছাদ তো দেখা যায়!—কিন্তু ছাদে উঠা বড় শক্ত!
নরেন্দ্র—আজ্ঞে হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তবে যদি কেউ উঠে থাকে, দড়ি ফেলে দিয়ে আর-একজনকে তুলে নিতে পারে।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পাঁচপ্রকার সমাধি]
“হৃষীকেশের সাধু এসেছিল। সে (আমাকে) বললে, কি আশ্চর্য! তোমাতে পাঁচপ্রকার সমাধি দেখলাম!
“কখন কপিবৎ—দেহবৃক্ষে বানরের ন্যায় মহাবায়ু যেন এ-ডাল থেকে ও-ডালে একেবারে লাফ দিয়ে উঠে, আর সমাধি হয়।
“কখন মীনবৎ—মাছ যেমন জলের ভিতরে সড়াৎ সড়াৎ করে যায় আর সুখে বেড়ায়, তেমনি মহাবায়ু দেহের ভিতর চলতে থাকে আর সমাধি হয়।
“কখন বা পক্ষীবৎ—দেহবৃক্ষে পাখির ন্যায় কখনও এ-ডালে কখনও ও-ডালে।
“কখন পিপীলিকাবৎ—মহাবায়ু পিঁপড়ের মতো একটু একটু করে ভিতরে উঠতে থাকে, তারপর সহস্রারে বায়ু উঠলে সমাধি হয়। কখন বা তির্যক্বৎ—অর্থাৎ মহাবায়ুর গতি সর্পের ন্যায় আঁকা-ব্যাঁকা; তারপর সহস্রারে গিয়ে সমাধি।”
রাখাল (ভক্তদের প্রতি)—থাক আর কথায়,—অনেক কথা হয়ে গেল;—অসুখ করবে।
৫৪.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – কাশীপুর বাগানে ভক্তসঙ্গে
শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে সেই উপরের ঘরে শয্যার উপর বসিয়া আছেন। ঘরে শশী ও মণি। ঠাকুর মণিকে ইশারা করিতেছেন—পাখা করিতে। তিনি পাখা করিতেছেন।
বৈকাল বেলা ৫টা-৬টা। সোমবার চড়কসংক্রান্তি, বাসন্তী মহাষ্টমী পূজা। চৈত্র শুক্লাষ্টমী, ৩১শে চৈত্র, ১২ই এপ্রিল, ১৮৮৬।
পাড়াতেই চড়ক হইতেছে। ঠাকুর একজন ভক্তকে চড়কের কিছু কিছু জিনিস কিনিতে পাঠাইয়াছিলেন। ভক্তটি ফিরিয়া আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি কি আনলি?
ভক্ত—বাতাসা একপয়সা, বঁটি—দুপয়সা, হাতা—দুপয়সা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ছুরি কই?
ভক্ত—দুপয়সায় দিলে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্যগ্র হইয়া)—যা যা, ছুরি আন।
মাস্টার নিচে বেড়াইতেছেন। নরেন্দ্র ও তারক কলিকাতা হইতে ফিরিলেন। গিরিশ ঘোষের বাড়ি ও অন্যান্য স্থানে গিয়াছিলেন।
তারক—আজ আমরা মাংস-টাংস অনেক খেলুম।
নরেন্দ্র—আজ মন অনেকটা নেমে গেছে। তপস্যা লাগাও।
(মাস্টারের প্রতি)—“কি Slavery (দাসত্ব) of body,—of mind! (শরীরের দাসত্ব—মনের দাসত্ব!) ঠিক যেন মুটের অবস্থা! শরীর-মন যেন আমার নয়, আর কারু।”
সন্ধ্যা হইয়াছে; উপরের ঘরে ও অন্যান্য স্থানে আলো জ্বালা হইল। ঠাকুর বিছানায় উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন; জগন্মাতার চিন্তা করিতেছেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে ফকির ঠাকুরের সম্মুখে অপরাধভঞ্জন স্তব পাঠ করিতেছেন। ফকির বলরামের পুরোহিতবংশীয়।
প্রাগ্দেহস্থো যদাসং তব চরণযুগং নাশ্রিতো নার্চিতোঽহং,
তেনাদ্যেঽকীর্তিবর্গৈর্জঠরজদহনৈর্বাধ্যমানো বলিষ্ঠৈঃ,
স্থিত্বা জন্মান্তরে নো পুনরিহ ভবিতা ক্বাশ্রয়ঃ ক্বাপি সেবা,
ক্ষন্তব্যো মেঽপরাধঃ প্রকটিতবদনে কামরূপে করালে! ইত্যাদি।
ঘরে শশী, মণি, আরও দু-একটি ভক্ত আছেন।
স্তবপাঠ সমাপ্ত হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অতি ভক্তিভাবে হাতজোড় করিয়া নমস্কার করিতেছেন। মণি পাখা করিতেছেন। ঠাকুর ইশারা করিয়া তাঁহাকে বলিতেছেন “একটি পাথরবাটি আনবে। (এই বলিয়া পাথরবাটির গঠন অঙ্গুলি দিয়া আঁকিয়া দেখাইলেন) একপো, অত দুধ ধরবে? সাদা পাথর।”
মণি—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর সব বাটিতে ঝোল খেতে আঁষটে লাগে।
৫৪.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – ঈশ্বরকোটির কি কর্মফল, প্রারব্ধ আছে? যোগবাশিষ্ঠ
পরদিন মঙ্গলবার, রামনবমী; ১লা বৈশাখ, ১৩ই এপ্রিল, ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ। প্রাতঃকাল,—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উপরের ঘরে শয্যায় বসিয়া আছেন। বেলা ৮টা-৯টা হইবে। মণি রাত্রে ছিলেন, প্রাতে গঙ্গা স্নান করিয়া আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন। রাম (দত্ত) সকালে আসিয়াছেন ও প্রণাম করিয়া উপবেশন করিলেন। রাম ফুলের মালা আনিয়াছেন ও ঠাকুরকে নিবেদন করিলেন। ভক্তেরা অনেকেই নিচে বসিয়া আছেন। দুই-একজন ঠাকুরের ঘরে আছেন। রাম ঠাকুরের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি)—কিরকম দেখছ?
রাম—আপনার সবই আছে। এখনই রোগের সব কথা উঠবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ঈষৎ হাস্য করিলেন ও সঙ্কেত করিয়া রামকেই জিজ্ঞাসা করিতেছেন—“রোগের কথাও উঠবে?”
ঠাকুরের চটিজুতা আছে, পায়ে লাগে। ডাক্তার রাজেন্দ্র দত্ত মাপ দিতে বলিয়াছেন,—তিনি ফরমাশ দিয়া আনিবেন। ঠাকুরের পায়ের মাপ লওয়া হইল। এই পাদুকা এখন বেলুড় মঠে পূজা হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ মণিকে সঙ্কেত করিতেছেন, “কই, পাথরবাটি?” মণি তত্ক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইলেন,—কলিকাতায় পাথরবাটি আনিতে যাইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “থাক্ থাক্ এখন।”
মণি—আজ্ঞা না, এঁরা সব যাচ্ছেন, এই সঙ্গেই যাই।
মণি নূতন বাজারের জোড়াসাঁকোর চৌমাথায় একটি দোকান হইতে একটি সাদা পাথরবাটি কিনিলেন। বেলা দ্বিপ্রহর হইয়াছে, এমন সময়ে কাশীপুরে ফিরিয়া আসিলেন ও ঠাকুরের কাছে আসিয়া প্রণাম করিয়া বাটিটি রাখিলেন। ঠাকুর সাদা বাটিটি হাতে করিয়া দেখিতেছেন। ডাক্তার রাজেন্দ্র দত্ত, গীতাহস্তে শ্রীনাথ ডাক্তার, শ্রীযুক্ত রাখাল হালদার, আরও কয়েকজন আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঘরে রাখাল, শশী, ছোট নরেন প্রভৃতি ভক্তেরা আছেন। ডাক্তারেরা ঠাকুরের পীড়া সম্বন্ধে সমস্ত সংবাদ লইলেন।
শ্রীনাথ ডাক্তার (বন্ধুদের প্রতি)—সকলেই প্রকৃতির অধীন। কর্মফল কেউ এড়াতে পারে না! প্রারব্ধ!
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন,—তাঁর নাম করলে, তাঁকে চিন্তা করলে, তাঁর শরণাগত হলে—
শ্রীনাথ—আজ্ঞে, প্রারব্ধ কোথা যাবে?—পূর্ব পূর্ব জন্মের কর্ম।
শ্রীরামকৃষ্ণ—খানিকটা কর্ম ভোগ হয়। কিন্তু তাঁর নামের গুণে অনেক কর্মপাশ কেটে যায়। একজন পূর্বজন্মের কর্মের দরুন সাত জন্ম কানা হত; কিন্তু সে গঙ্গাস্নান করলে। গঙ্গাস্নানে মুক্তি হয়। সে ব্যক্তির চক্ষু যেমন কানা সেইরকমই রইল, কিন্তু আর যে ছজন্ম সেটা হল না।
শ্রীনাথ—আজ্ঞে, শাস্ত্রে তো আছে, কর্মফল কারুরই এড়াবার জো নাই।
[শ্রীনাথ ডাক্তার তর্ক করিতে উদ্যত।]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—বল না, ঈশ্বরকোটির আর জীবকোটির অনেক তফাত। ঈশ্বরকোটির অপরাধ হয় না; বল না।
মণি চুপ করিয়া আছেন; মণি রাখালকে বলিতেছেন, “তুমি বল।”
কিয়ত্ক্ষণ পরে ডাক্তারেরা চলিয়া গেলেন। ঠাকুর শ্রীযুক্ত রাখাল হালদারের সহিত কথা কহিতেছেন।
হালদার—শ্রীনাথ ডাঃ বেদান্ত চর্চা করেন—যোগবাশিষ্ঠ পড়েন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সংসারী হয়ে, ‘সব স্বপ্নবৎ’—এ-সব মত ভাল নয়।
একজন ভক্ত—কালিদাস বলে সেই লোকটি—তিনিও বেদান্ত চর্চা করেন; কিন্তু মোকদ্দমা করে সর্বস্বান্ত।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—সব মায়া—আবার মোকদ্দমা! (রাখালের প্রতি) জনাইয়ের মুখুজ্জে প্রথমে লম্বা লম্বা কথা বলছিল; তারপর শেষকালে বেশ বুঝে গেল! আমি যদি ভাল থাকতুম ওদের সঙ্গে আর খানিকটা কথা কইতাম। জ্ঞান জ্ঞান কি করলেই হয়?
[কামজয় দৃষ্টে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের রোমাঞ্চ]
হালদার—অনেক জ্ঞান দেখা গেছে। একটু ভক্তি হলে বাঁচি। সেদিন একটা কথা মনে করে এসেছিলাম। তা আপনি মীমাংসা করে দিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্যগ্র হইয়া)—কি কি?
হালদার—আজ্ঞে, এই ছেলেটি এলে বললেন যে—জিতেন্দ্রিয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ গো, ওর (ছোট নরেনের) ভিতর বিষয়বুদ্ধি আদপে ঢোকে নাই! ও বলে কাম কাকে বলে তা জানি না।
(মণির প্রতি) “হাত দিয়ে দেখ আমার রোমাঞ্চ হচ্চে!”
কাম নাই, এই শুদ্ধ অবস্থা মনে করিয়া ঠাকুরের রোমাঞ্চ হইতেছে। যেখানে কাম নাই সেখানে ঈশ্বর বর্তমান। এই কথা মনে করিয়া কি ঠাকুরের ঈশ্বরের উদ্দীপন হইতেছে? ★ ★ ★
রাখাল হালদার বিদায় লইলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ এখনও ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। পাগলী তাঁহাকে দেখিবার জন্য বড়ই উপদ্রব করে। পাগলীর মধুর ভাব। বাগানে প্রায় আসে ও দৌড়ে দৌড়ে ঠাকুরের ঘরে এসে পড়ে। ভক্তেরা প্রহারও করেন,—কিন্তু তাহাতেও নিবৃত্ত হয় না।
শশী—পাগলী এবার এলে ধাক্কা মেরে তাড়াব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (করুণামাখা স্বরে)—না, না। আসবে, চলে যাবে।
রাখাল—আগে আগে অপর পাঁচজন ওঁর কাছে এলে আমার হিংসে হত। তারপর উনি কৃপা করে আমায় জানিয়ে দিয়েছেন,—মদ্গুরু শ্রীজগৎ গুরু!—উনি কি কেবল আমাদের জন্য এসেছেন?
শশী—তা নয় বটে, কিন্তু অসুখের সময় কেন? আর ও-রকম উপদ্রব।
রাখাল—উপদ্রব সব্বাই করে। সকলেই কি খাঁটি হয়ে ওঁর কাছে এসেছে? ওঁকে আমরা কষ্ট দিই নাই? নরেন্দ্র—টরেন্দ্র আগে কিরকম ছিল, কত তর্ক করত?
শশী—নরেন্দ্র যা মুখে বলত, কাজেও তা করত।
রাখাল—ডাক্তার সরকার কত কি ওঁকে বলেছে! ধরতে গেলে কেহই নির্দোষ নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাখালের প্রতি, সস্নেহে)—কিছু খাবি?
রাখাল—না;—খাবো এখন।
শ্রীরামকৃষ্ণ মণিকে সঙ্কেত করিতেছেন, তুমি আজ এখানে খাবে?
রাখাল—খান না, উনি বলছেন।
ঠাকুর পঞ্চম বর্ষীয় বালকের ন্যায় দিগম্বর হইয়া ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। এমন সময়ে পাগলী সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া ঘরের দরজার কাছে দাঁড়াইয়াছে।
মণি (শশীকে আস্তে আস্তে)—নমস্কার করে যেতে বল, কিছু বলে কাজ নাই। শশী পাগলীকে নামাইয়া দিলেন।
আজ নব বর্ষারম্ভ, মেয়ে ভক্তেরা অনেকে আসিয়াছেন। ঠাকুরকে ও শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিলেন ও তাঁহাদের আশীর্বাদ লইলেন। শ্রীযুক্ত বলরামের পরিবার, মণিমোহনের পরিবার, বাগবাজারের ব্রাহ্মণী ও অন্যান্য অনেক স্ত্রীলোক ভক্তেরা আসিয়াছেন। কেহ কেহ সন্তানাদি লইয়া আসিয়াছেন।
তাঁহারা ঠাকুরকে প্রণাম করিতে উপরের ঘরে আসিলেন। কেহ কেহ ঠাকুরের পাদপদ্মে পুষ্প ও আবির দিলেন। ভক্তদের দুইটি ৯।১০ বর্ষের মেয়ে ঠাকুরকে গান শুনাইতেছেন :
জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই ।
ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি,
কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই ॥
গান—হরি হরি বলরে বীণে ।
গান—ওই আসছে কিশোরী, ওই দেখ এলো
তোর নয়ন বাঁকা বংশীধারী ।
গান—দুর্গানাম জপ সদা রসনা আমার,
দুর্গমে শ্রীদুর্গা বিনে কে করে উদ্ধার?
শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্কেত করিয়া বলিতেছেন, “বেশ মা মা বলছে!”
ব্রাহ্মণীর ছেলেমান্সের স্বভাব। ঠাকুর হাসিয়া রাখালকে ইঙ্গিত করিতেছেন, “ওকে গান গাইতে বল না।” ব্রাহ্মণী গান গাইতেছেন। ভক্তেরা হাসিতেছেন।
‘হরি খেলব আজ তোমার সনে,
একলা পেয়েছি তোমায় নিধুবনে ।’
মেয়েরা উপরের ঘর হইতে নিচে চলিয়া গেলেন।
বৈকাল বেলা। ঠাকুরের কাছে মণি ও দু-একটি ভক্ত বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র ঘরে প্রবেশ করিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিকই বলেন, নরেন্দ্র যেন খাপখোলা তলোয়ার লইয়া বেড়াইতেছেন।
[সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম ও নরেন্দ্র]
নরেন্দ্র আসিয়া ঠাকুরের কাছে বসিলেন। ঠাকুরকে শুনাইয়া নরেন্দ্র মেয়েদের সম্বন্ধে যত্পরোনাস্তি বিরক্তিভাব প্রকাশ করিতেছেন। মেয়েদের সঙ্গ ঈশ্বরলাভের ভয়ানক বিঘ্ন,—বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ কোন কথা কহিতেছেন না, সকলি শুনিতেছেন।
নরেন্দ্র আবার বলিতেছেন, আমি চাই শান্তি, আমি ঈশ্বর পর্যন্ত চাই না। শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে একদৃষ্টে দেখিতেছেন। মুখে কোন কথা নাই। নরেন্দ্র মাঝে মাঝে সুর করিয়া বলিতেছেন—সত্যং জ্ঞানমনন্তম্।
রাত্রি আটটা। ঠাকুর শয্যাতে বসিয়া আছেন, দু-একটি ভক্তও সম্মুখে বসিয়া। সুরেন্দ্র আফিসের কার্য সারিয়া ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছেন, হস্তে চারিটি কমলালেবু ও দুইছড়া ফুলের মালা। সুরেন্দ্র ভক্তদের দিকে এক-একবার ও ঠাকুরের দিকে এক-একবার তাকাইতেছেন; আর হৃদয়ের কথা সমস্ত বলিতেছেন।
সুরেন্দ্র (মণি প্রভৃতির দিকে তাকাইয়া)—আফিসের কাজ সব সেরে এলাম। ভাবলাম, দুই নৌকায় পা দিয়ে কি হবে, কাজ সেরে আসাই ভাল। আজ ১লা বৈশাখ, আবার মঙ্গলবার; কালীঘাটে যাওয়া হল না। ভাবলাম যিনি কালী—যিনি কালী ঠিক চিনেছেন, তাঁকে দর্শন করলেই হবে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঈষৎ হাস্য করিতেছেন।
সুরেন্দ্র—গুরুদর্শনে, সাধুদর্শনে শুনেছি ফুল-ফল নিয়ে আসতে হয়। তাই এগুলি আনলাম। আপনার জন্যে টাকা খরচ, তা ভগবান মন দেখেন। কেউ একটি পয়সা দিতে কাতর, আবার কেউ বা হাজার টাকা খরচ করতে কিছুই বোধ করে না। ভগবান মনের ভক্তি দেখেন তবে গ্রহণ করেন।
ঠাকুর মাথা নাড়িয়া সঙ্কেত করিয়া বলিতেছেন, “তুমি ঠিক বলছ।” সুরেন্দ্র আবার বলিতেছেন, “কাল আসতে পারি নাই, সংক্রান্তি। আপনার ছবিকে ফুল দিয়ে সাজালুম।”
শ্রীরামকৃষ্ণ মণিকে সঙ্কেত করিয়া বলিতেছেন, “আহা কি ভক্তি!”
সুরেন্দ্র—আসছিলাম, এই দুগাছা মালা আনলাম, চার আনা দাম।
ভক্তেরা প্রায় সকলেই চলিয়া গেলেন। ঠাকুর মণিকে পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে বলিতেছেন ও হাওয়া করিতে বলিতেছেন।
৫৪.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুর উদ্যানে—গিরিশ ও মাস্টার
কাশীপুর বাগানের পূর্বধারে পুষ্করিণীর ঘাট। চাঁদ উঠিয়াছে। উদ্যানপথ ও উদ্যানের বৃক্ষগুলি চন্দ্রকিরণে স্নাত হইয়াছে। পুষ্করিণীর পশ্চিমদিকে দ্বিতল গৃহ। উপরের ঘরে আলো জ্বলিতেছে, পুষ্করিণীর ঘাট হইতে সেই আলো খড়খড়ির মধ্য দিয়া আসিতেছে, তাহা দেখা যাইতেছে। কক্ষমধ্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শয্যার উপর বসিয়া আছেন। একটি-দুটি ভক্ত নিঃশব্দে কাছে বসিয়া আছেন বা এ-ঘর হইতে ও-ঘর যাইতেছেন। ঠাকুর অসুস্থ, চিকিত্সার্থে বাগানে আসিয়াছেন। ভক্তেরা সেবার্থ সঙ্গে আছেন। পুষ্করিণীর ঘাট হইতে নিচের তিনটি আলো দেখা যাইতেছে। একটি ঘরে ভক্তেরা থাকেন, তাহার আলো দেখা যাইতেছে। সে ঘরটি দক্ষিণদিকের ঘর। মাঝের আলোটি শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর ঘর হইতে আসিতেছে। মা ঠাকুরের সেবার্থ আসিয়াছেন। তৃতীয় আলোটি রান্নাঘরের। সেই ঘর গৃহের উত্তরদিকে। উদ্যান মধ্যস্থিত ওই দুতলা বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব কোণ হইতে একটি পথ পুষ্করিণীর ঘাটের দিকে গিয়াছে। পূর্বাস্য হইয়া ওই পথ দিয়া ঘাটে যাইতে হয়। পথের দুই ধারে, বিশেষতঃ দক্ষিণ পার্শ্বে, অনেক ফল-ফুলের গাছ।
চাঁদ উঠিয়াছে। পুকুরঘাটে গিরিশ, মাস্টার, লাটু আরও দুই-একটি ভক্ত বসিয়া আছেন। ঠাকুরের কথা হইতেছে। আজ শুক্রবার, ১৬ই এপ্রিল, ১৮৮৬, ৪ঠা বৈশাখ, ১২৯৩। চৈত্র শুক্লা ত্রয়োদশী।
কিয়ত্ক্ষণ পরে গিরিশ ও মাস্টার ওই পথে বেড়াইতেছেন ও মাঝে মাঝে কথাবার্তা কহিতেছেন।
মাস্টার—কি সুন্দর চাঁদের আলো! কতকাল ধরে এই নিয়ম চলছে!
গিরিশ—কি করে জানলে?
মাস্টার—প্রকৃতির নিয়ম বদলায় না (Uniformity of Nature) আর বিলাতের লোকেরা নূতন নূতন নক্ষত্র টেলিস্কোপ দিয়ে দেখেছে। চাঁদে পাহাড় আছে, দেখেছে।
গিরিশ—তা বলা শক্ত, বিশ্বাস হয় না।
মাস্টার—কেন, টেলিস্কোপ দিয়ে ঠিক দেখা যায়।
গিরিশ—কেমন করে বলব, ঠিক দেখেছে। পৃথিবী আর চাঁদের মাঝখানে যদি আর কোন জিনিস থাকে, তার মধ্যে দিয়ে আলো আসতে আসতে হয়তো অমন দেখায়।
বাগানে ছোকরা ভক্তেরা ঠাকুরের সেবার জন্য সর্বদা থাকেন। নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, শরৎ, শশী, বাবুরাম, কালী, যোগীন, লাটু ইত্যাদি; তাঁহারা থাকেন। যে ভক্তেরা সংসার করিয়াছেন, কেহ কেহ প্রত্যহ আসেন ও মাঝে মাঝে রাত্রেও থাকেন। কেহ বা মধ্যে মধ্যে আসেন। আজ নরেন্দ্র, কালী ও তারক দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ির বাগানে গিয়াছেন। নরেন্দ্র সেখানে পঞ্চবটী বৃক্ষমূলে বসিয়া ঈশ্বরচিন্তা করিবেন; সাধন করিবেন। তাই দুই-একটি গুরুভাই সঙ্গে গিয়াছেন।
৫৪.১৪ চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর গিরিশ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে—ভক্তের প্রতি ঠাকুরের স্নেহ
[গিরিশ, লাটু, মাস্টার, বাবুরাম, নিরঞ্জন, রাখাল]
গিরিশ, লাটু, মাস্টার উপরে গিয়া দেখেন, ঠাকুর শয্যায় বসিয়া আছেন। শশী ও আরও দু-একটি ভক্ত সেবার্থ ওই ঘরে ছিলেন, ক্রমে বাবুরাম, নিরঞ্জন, রাখাল, ইঁহারাও আসিলেন।
ঘরটি বড়। ঠাকুরের শয্যার নিকট ঔষধাদি ও নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসাদি রহিয়াছে। ঘরের উত্তরে একটি দ্বার আছে, সিঁড়ি হইতে উঠিয়া সেই দ্বার দিয়া ঘরে প্রবেশ করিতে হয়। সেই দ্বারের সামনাসামনি ঘরের দক্ষিণ গায়ে আর-একটি দ্বার আছে। সেই দ্বার দিয়া দক্ষিণের ছোট ছাদটিতে যাওয়া যায়। সেই ছাদের উপর দাঁড়াইলে বাগানের গাছপালা, চাঁদের আলো, অদূরে রাজপথ ইত্যাদি দেখা যায়।
ভক্তদের রাত্রি জাগরণ করিতে হয়, তাঁহারা পালা করিয়া জাগেন। মশারি টাঙ্গাইয়া ঠাকুরকে শয়ন করাইয়া যে ভক্তটি ঘরে থাকিবেন, তিনি ঘরের পূর্বধারে মাদুর পাতিয়া কখনও বসিয়া, কখনও শুইয়া থাকেন। অসুস্থতানিবন্ধন ঠাকুরের প্রায় নিদ্রা নাই! তাই যিনি থাকেন, তিনি কয়েক ঘণ্টা প্রায় বসিয়া কাটাইয়া দেন।
আজ ঠাকুরের অসুখ কিছু কম। ভক্তেরা আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন এবং ঠাকুরের সম্মুখে মেঝের উপর বসিলেন।
ঠাকুর আলোটি কাছে আনিতে মাস্টারকে আদেশ করিলেন। ঠাকুর গিরিশকে সস্নেহ সম্ভাষণ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি)—ভাল আছ? (লাটুর প্রতি) এঁকে তামাক খাওয়া। আর পান এনে দে।
কিয়ত্ক্ষণ পরে আবার বলিলেন, “কিছু জলখাবার এনে দে।”
লাটু—পানটান দিয়েছি। দোকান থেকে জলখাবার আনতে যাচ্ছে।
ঠাকুর বসিয়া আছেন। একটি ভক্ত কয়গাছি ফুলের মালা আনিয়া দিলেন। ঠাকুর নিজের গলায় একে একে সেগুলি ধারণ করিলেন। ঠাকুরের হৃদয়মধ্যে হরি আছেন, তাঁকেই বুঝি পূজা করিলেন। ভক্তেরা অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন। দুইগাছি মালা গলা হইতে লইয়া গিরিশকে দিলেন।
ঠাকুর মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “জলখাবার কি এলো?”
মণি ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন। ঠাকুরের কাছে একটি ভক্তপ্রদত্ত চন্দনকাষ্ঠের পাখা ছিল। ঠাকুর সেই পাখাখানি মণির হাতে দিলেন। মণি সেই পাখা লইয়া বাতাস করিতেছেন। মণি পাখা করিতেছেন, ঠাকুর দুইগাছি মালা গলা হইতে লইয়া তাঁহাকেও দিলেন।
লাটু ঠাকুরকে একটি ভক্তের কথা বলিতেছেন। তাঁহার একটি সাত-আট বত্সরের সন্তান প্রায় দেড় বৎসর হইল দেহত্যাগ করিয়াছে। সে ছেলেটি ঠাকুরকে কখন ভক্তসঙ্গে কখন কীর্তনানন্দে অনেকবার দর্শন করিয়াছিল।
লাটু (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—ইনি এঁর ছেলেটির বই দেখে কাল রাত্রে বড় কেঁদেছিলেন। পরিবারও ছেলের শোকে পাগলের মতো হয়ে গেছে। নিজের ছেলেপুলেকে মারে, আছড়ায়। ইনি এখানে মাঝে মাঝে থাকেন তাই বলে ভারী হেঙ্গাম করে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই শোকের কথা শুনিয়া যেন চিন্তিত হইয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
গিরিশ—অর্জুন অত গীতা-টীতা পড়ে অভিমন্যুর শোকে একেবারে মূর্চ্ছিত। তা এঁর ছেলের জন্য শোক কিছু আশ্চর্য নয়।
[সংসারে কি হলে ঈশ্বরলাভ হয়?]
গিরিশের জন্য জলখাবার আসিয়াছে। ফাগুর দোকানের গরম কচুরি, লুচি ও অন্যান্য মিষ্টান্ন। বরাহনগরে ফাগুর দোকান। ঠাকুর নিজে সেই সমস্ত খাবার সম্মুখে রাখাইয়া প্রসাদ করিয়া দিলেন। তারপর নিজে হাতে করিয়া খাবার গিরিশের হাতে দিলেন। বলিলেন, বেশ কচুরি।
গিরিশ সম্মুখে বসিয়া খাইতেছেন। গিরিশকে খাইবার জল দিতে হইবে। ঠাকুরের শয্যার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে কুঁজায় করিয়া জল আছে। গ্রীষ্মকাল, বৈশাখ মাস। ঠাকুর বলিলেন, “এখানে বেশ জল আছে।”
ঠাকুর অতি অসুস্থ। দাঁড়াইবার শক্তি নাই।
ভক্তেরা অবাক্ হইয়া কি দেখিতেছেন? দেখিতেছেন—ঠাকুরের কোমরে কাপড় নাই। দিগম্বর! বালকের ন্যায় শয্যা হইতে এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। নিজে জল গড়াইয়া দিবেন। ভক্তদের নিশ্বাসবায়ু স্থির হইয়া গিয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জল গড়াইলেন। গেলাস হইতে একটু জল হাতে লইয়া দেখিতেছেন, ঠাণ্ডা কিনা। দেখিতেছেন জল তত ঠাণ্ডা নয়। অবশেষে অন্য ভাল জল পাওয়া যাইবে না বুঝিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওই জলই দিলেন।
গিরিশ খাবার খাইতেছেন। ভক্তগুলি চতুর্দিকে বসিয়া আছেন। মণি ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন।
গিরিশ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—দেবেনবাবু সংসারত্যাগ করবেন।
ঠাকুর সর্বদা কথা কহিতে পারেন না, বড় কষ্ট হয়। নিজের ওষ্ঠাধর অঙ্গুলি দ্বারা স্পর্শ করিয়া ইঙ্গিত করিলেন, “পরিবারদের খাওয়া-দাওয়া কিরূপে হবে—তাদের কিসে চলবে?”
গিরিশ—তা কি করবেন জানি না।
সকলে চুপ করিয়া আছেন। গিরিশ খাবার খাইতে খাইতে কথা আরম্ভ করিলেন।
গিরিশ—আচ্ছা, মহাশয়—কোন্টা ঠিক! কষ্টে সংসার ছাড়া না সংসারে থেকে তাঁকে ডাকা?
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাষ্টারের প্রতি)—গীতায় দেখনি? অনাসক্ত হয়ে সংসারে থেকে কর্ম করলে, সব মিথ্যা জেনে জ্ঞানের পর সংসারে থাকলে, ঠিক ঈশ্বরলাভ হয়।
“যারা কষ্টে ছাড়ে, তারা হীন থাকের লোক।
“সংসারী জ্ঞানী কিরকম জানো? যেমন সার্সীর ঘরে কেউ আছে। ভিতর বার দুই দেখতে পায়।”
আবার সকলে চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—কচুরি গরম আর খুব ভাল।
মাস্টার (গিরিশের প্রতি)—ফাগুর দোকানের কচুরি! বিখ্যাত।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বিখ্যাত!
গিরিশ (খাইতে খাইতে, সহাস্যে)—বেশ কচুরি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—লুচি থাক, কচুরি খাও। (মাস্টারকে) কচুরি কিন্তু রজোগুণের।
গিরিশ খাইতে খাইতে আবার কথা তুলিলেন।
[সংসারীর মন ও ঠিক ঠিক ত্যাগীর মনের প্রভেদ]
গিরিশ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আচ্ছা মহাশয়, মনটা এত উঁচু আছে, আবার নিচু হয় কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সংসারে থাকতে গেলেই ও-রকম হয়। কখনও উঁচু, কখনও নিচু। কখনও বেশ ভক্তি হচ্ছে, আবার কমে যায়। কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকতে হয় কিনা, তাই হয়। সংসারে ভক্ত কখন ঈশ্বরচিন্তা, হরিনাম করে; কখন বা কামিনী-কাঞ্চনে মন দিয়ে ফেলে। যেমন সাধারণ মাছি—কখন সন্দেশে বসছে, কখন বা পচা ঘা বা বিষ্ঠাতেও বসে।
“ত্যাগীদের আলাদা কথা। তারা কামিনী-কাঞ্চন থেকে মন সরিয়ে এনে কেবল ঈশ্বরকে দিতে পারে; কেবল হরিরস পান করতে পারে। ঠিক ঠিক ত্যাগী হলে ঈশ্বর বই তাদের আর কিছু ভাল লাগে না। বিষয়কথা হলে উঠে যায়; ঈশ্বরীয় কথা হলে শুনে। ঠিক ঠিক ত্যাগী হলে নিজেরা ঈশ্বরকথা বই আর অন্যবাক্য মুখে আনে না।
“মৌমাছি কেবল ফুলে বসে—মধু খাবে বলে। অন্য কোন জিনিস মৌমাছির ভাল লাগে না।”
গিরিশ দক্ষিণের ছোট ছাদটির উপর হাত ধুইতে গেলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাই, তবে তাঁতে সব মন হয়। অনেকগুলো কচুরি খেলে, ওকে বলে এসো আজ আর কিছু না খায়।
৫৪.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – অবতার বেদবিধির পার—বৈধীভক্তি ও ভক্তি উন্মাদ
গিরিশ পুনর্বার ঘরে আসিয়া ঠাকুরের সম্মুখে বসিয়াছেন ও পান খাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি)—রাখাল-টাখাল এখন বুঝেছে কোন্টা ভাল, কোন্টা মন্দ; কোন্টা সত্য, কোন্টা মিথ্যা। ওরা যে সংসারে গিয়ে থাকে, সে জেনেশুনে। পরিবার আছে, ছেলেও হয়েছে—কিন্তু বুঝেছে যে সব মিথ্যা। অনিত্য। রাখাল-টাখাল এরা সংসারে লিপ্ত হবে না।
“যেমন পাঁকাল মাছ। পাঁকের ভিতর বাস, কিন্তু গায়ে পাঁকের দাগটি পর্যন্ত নাই!”
গিরিশ—মহাশয়, ও-সব আমি বুঝি না। মনে করলে সব্বাইকে নির্লিপ্ত আর শুদ্ধ করে দিতে পারেন। কি সংসারী কি ত্যাগী সব্বাইকে ভাল করে দিতে পারেন! মলয়ের হাওয়া বইলে, আমি বলি, সব কাঠ চন্দন হয়—
শ্রীরামকৃষ্ণ—সার না থাকলে চন্দন হয় না। শিমূল আরও কয়টি গাছ, এরা চন্দন হয় না।
গিরিশ—তা শুনি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আইনে এরূপ আছে।
গিরিশ—আপনার সব বে-আইনি!
ভক্তেরা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন। মণির হাতের পাখা এক-একবার স্থির হইয়া যাইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, তা হতে পারে; ভক্তি-নদী ওথলালে ডাঙ্গায় একবাঁশ জল।
“যখন ভক্তি উন্মাদ হয়, তখন বেদবিধি মানে না। দূর্বা তোলে; তা বাছে না! যা হাতে আসে, তাই লয়। তুলসী তোলে, পড়পড় করে ডাল ভাঙে! আহা কি অবস্থাই গেছে!
(মাস্টারের প্রতি)—“ভক্তি হলে আর কিছুই চাই না!”
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ।
[সীতা ও শ্রীরাধা—রামাবতার ও কৃষ্ণাবতারের বিভিন্ন ভাব]
শ্রীরামকৃষ্ণ—একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়। রামাবতারে শান্ত, দাস্য, বাত্সল্য, সখ্য ফখ্য। কৃষ্ণাবতারে ও-সবও ছিল, আবার মধুরভাব।
“শ্রীমতীর মধুরভাব—ছেনালি আছে। সীতার শুদ্ধ সতীত্ব—ছেনালি নাই।
“তাঁরই লীলা। যখন যে ভাব।”
বিজয়ের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে একটি পাগলের মতো স্ত্রীলোক ঠাকুরকে গান শুনাইতে যাইত। শ্যামাবিষয়ক গান ও ব্রহ্ম সঙ্গীত। সকলে পাগলী বলে। সে কাশীপুরের বাগানেও সর্বদা আসে ও ঠাকুরের কাছে যাবার জন্য বড় উপদ্রব করে। ভক্তদের সেই জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশাদি ভক্তের প্রতি)—পাগলীর মধুরভাব। দক্ষিণেশ্বরে একদিন গিছল। হঠাৎ কান্না। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কেন কাঁদছিস? তা বলে, মাথাব্যথা করছে। (সকলের হাস্য)
“আর-একদিন গিছল। আমি খেতে বসেছি। হঠাৎ বলছে, ‘দয়া করলেন না?’ আমি উদারবুদ্ধিতে খাচ্চি। তারপর বলছে, ‘মনে ঠেল্লেন কেন?’ জিজ্ঞাসা করলুম, ‘তোর কি ভাব?’ তা বললে, ‘মধুরভাব!’ আমি বললাম, ‘আরে আমার যে মাতৃযোনি! আমার যে সব মেয়েরা মা হয়!’ তখন বলে, ‘তা আমি জানি না।’ তখন রামলালকে ডাকলাম। বললাম, ‘ওরে রামলাল, কি মনে ঠ্যালাঠেলি বলছে শোন দেখি।’ ওর এখনও সেই ভাব আছে।”
গিরিশ—সে পাগলী—ধন্য! পাগল হোক আর ভক্তদের কাছে মারই খাক আপনার তো অষ্টপ্রহর চিন্তা করছে! সে যে ভাবেই করুক, তার কখনও মন্দ হবে না!
“মহাশয়, কি বলব! আপনাকে চিন্তা করে আমি কি ছিলাম, কি হয়েছি! আগে আলস্য ছিল, এখন সে আলস্য ঈশ্বরে নির্ভর হয়ে দাঁড়িয়েছে! পাপ ছিল, তাই এখন নিরহংকার হয়েছি! আর কি বলব!”
ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন। রাখাল পাগলীর কথা উল্লেখ করিয়া দুঃখ করিতেছেন। বললেন, দুঃখ হয়, সে উপদ্রব করে আর তার জন্য অনেকে কষ্টও পায়।
নিরঞ্জন (রাখালের প্রতি)—তোর মাগ আছে তাই তোর মন কেমন করে। আমরা তাকে বলিদান দিতে পারি।
রাখাল (বিরক্ত হইয়া)—কি বাহাদুরি! ওঁর সামনে ওই সব কথা!
[গিরিশকে উপদেশ—টাকায় আসক্তি—সদ্ব্যবহার—ডাক্তার কবিরাজের দ্রব্য]
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি)—কামিনী-কাঞ্চনই সংসার। অনেকে টাকা গায়ের রক্ত মনে করে। কিন্তু টাকাকে বেশি যত্ন করলে একদিন হয়তো সব বেরিয়ে যায়।
“আমাদের দেশে মাঠে আল বাঁধে। আল জানো? যারা খুব যত্ন করে চারিদিকে আল দেয়, তাদের আল জলের তোড়ে ভেঙে যায়। যারা একদিক খুলে ঘাসের চাপড়া দিয়ে রাখে, তাদের কেমন পলি পড়ে, কত ধান হয়।
“যারা টাকার সদ্ব্যবহার করে, ঠাকুরসেবা, সাধু ভক্তের সেবা করে, দান করে তাদেরই কাজ হয়। তাদেরই ফসল হয়।
“আমি ডাক্তার কবিরাজের জিনিস খেতে পারি না। যারা লোকের কষ্ট থেকে টাকা রোজগার করে! ওদের ধন যেন রক্ত-পুঁজ!”
এই বলিয়া ঠাকুর দুইজন চিকিত্সকের নাম করিলেন।
গিরিশ—রাজেন্দ্র দত্তের খুব দরাজ মন; কারু কাছে একটি পয়সা লয় না। তার দান-ধ্যান আছে।
৫৪.১৬ ষোড়শ পরিচ্ছেদ – কাশীপুর উদ্যানে নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুর বাগানে ভক্তসঙ্গে বাস করিতেছেন। শরীর খুব অসুস্থ—কিন্তু ভক্তদের মঙ্গলের জন্য সর্বদাই ব্যাকুল। আজ শনিবার, ৫ই বৈশাখ, চৈত্র শুক্লা চতুর্দশী (১৭ই এপ্রিল, ১৮৮৬)। পূর্ণিমাও পড়িয়াছে।
কয়দিন ধরিয়া প্রায় প্রত্যহ নরেন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে যাইতেছেন—পঞ্চবটীতে ঈশ্বরচিন্তা করেন—সাধনা করেন। আজ সন্ধ্যার সময় ফিরিলেন। সঙ্গে শ্রীযুক্ত তারক ও কালী।
রাত আটটা হইয়াছে। জ্যোত্স্না ও দক্ষিণে হাওয়া বাগানটিকে সুন্দর করিয়াছে। ভক্তেরা অনেকে নিচের ঘরে ধ্যান করিতেছেন। নরেন্দ্র মণিকে বলিতেছেন—“এরা ছাড়াচ্ছে” (অর্থাৎ ধ্যান করিতে করিতে উপাধি বর্জন করিতেছে)।
কিয়ত্ক্ষণ পরে মণি উপরের হলঘরে ঠাকুরের কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুর তাঁহাকে ডাবর ও গামছা পরিষ্কার করিয়া আনিতে আজ্ঞা করিলেন। তিনি পশ্চিমের পুষ্করিণীর ঘাট হইতে চাঁদের আলোতে ওইগুলি ধুইয়া আনিলেন।
পরদিন সকালে (১৮ই এপ্রিল, ৬ই বৈশাখ, ১২৯৩, পূর্ণিমা) ঠাকুর মণিকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তিনি গঙ্গাস্নানের পর ঠাকুরকে দর্শন করিয়া হলঘরের ছাদে গিয়াছিলেন।
মণির পরিবার পুত্রশোকে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়াছেন। ঠাকুর তাঁহাকে বাগানে আসিবার কথা ও এখানে আসিয়া প্রসাদ পাইতে বলিলেন।
ঠাকুর ইশারা করিয়া বলিতেছেন—“এখানে আসতে বলবে—দুদিন থাকবে;—কোলের ছেলেটিকে যেন নিয়ে আসে;—আর এখানে এসে খাবে।”
মণি—যে আজ্ঞা। খুব ঈশ্বরে ভক্তি হয়, তাহলে বেশ হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ ইশারা করিয়া বলিতেছেন—“উহুঁঃ—(শোক) ঠেলে দেয় (ভক্তিকে)। আর এত বড় ছেলে!
“কৃষ্ণকিশোরের ভবনাথের মতো দুই ছেলে। দুটো আড়াইটে পাস। মারা গেল। অত বড় জ্ঞানী!—প্রথম প্রথম সামলাতে পারলে না। আমায় ভাগ্যিস ঈশ্বর দেন নি!
“অর্জুন অত বড় জ্ঞানী। সঙ্গে কৃষ্ণ। তবু অভিমন্যুর শোকে একেবারে অধীর! কিশোরী আসে না কেন?”
একজন ভক্ত—সে রোজ গঙ্গাস্নানে যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখানে আসে না কেন?
ভক্ত—আজ্ঞে আসতে বলব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (লাটুর প্রতি)—হরিশ আসে না কেন?
[মেয়েদের লজ্জাই ভূষণ—পূর্বকথা—মাস্টারের বাড়িতে শুভাগমন]
মাস্টারের বাটীর নয়-দশ বছরের দুইটি মেয়ে ঠাকুরের কাছে কাশীপুর বাগানে আসিয়া ‘দুর্গানাম জপ সদা’, ‘মজলো আমার মন ভ্রমরা’ ইত্যাদি গান শুনাইতেছিল। ঠাকুর যখন মাস্টারের শ্যামপুকুরের তেলিপাড়ার বাটীতে শুভাগমন করেন (৩০শে অক্টোবর, ১৮৮৪; ১৫ই কার্তিক, বৃহস্পতিবার, উত্থান একাদশীর দিন) তখন এই দুটি মেয়ে ঠাকুরকে গান শুনাইয়াছিল। ঠাকুর গান শুনিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। যখন ঠাকুরের কাছে কাশীপুর বাগানে আজ তাহারা উপরে গান গাহিতেছিল, ভক্তেরা নিচে হইতে শুনিয়াছিলেন। তাঁহারা আবার তাহাদের নিচে ডাকাইয়া গান শুনিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—তোমার মেয়েদের আর গান শিখিও না। আপনা-আপনি গায় সে এক। যার তার কাছে গাইলে লজ্জা ভেঙে যাবে, লজ্জা মেয়েদের বড় দরকার।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আত্মপূজা—ভক্তদের প্রসাদ প্রদান]
ঠাকুরের সম্মুখে পুষ্পপাত্রে ফুল-চন্দন আনিয়া দেওয়া হইয়াছে। ঠাকুর শয্যায় বসিয়া আছেন। ফুল-চন্দন দিয়া আপনাকেই পূজা করিতেছেন। সচন্দন পুষ্প কখনও মস্তকে, কখনও কণ্ঠে, কখনও হৃদয়ে, কখনও নাভিদেশে, ধারণ করিতেছেন।
মনোমোহন কোন্নগর হইতে আসিলেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া উপবিষ্ট হইলেন। ঠাকুর আপনাকে এখনও পূজা করিতেছেন। নিজের গলায় পুষ্পমালা দিলেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে যেন প্রসন্ন হইয়া মনোমোহনকে নির্মাল্য প্রদান করিলেন। মণিকে একটি চম্পক দিলেন।
৫৪.১৭ সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – বুদ্ধদেব কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানিতেন? নরেন্দ্রকে শিক্ষা
বেলা নয়টা হইয়াছে, ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন, ঘরে শশীও আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—নরেন্দ্র আর শশী কি বলছিল—কি বিচার করছিল?
মাস্টার (শশীর প্রতি)—কি কথা হচ্ছিল গা?
শশী—নিরঞ্জন বুঝি বলেছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—‘ঈশ্বর নাস্তি অস্তি’, এই সব কি কথা হচ্ছিল?
শশী (সহাস্যে)—নরেন্দ্রকে ডাকব?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ডাক। [নরেন্দ্র আসিয়া উপবেশন করিলেন।]
(মাস্টারের প্রতি)—“তুমি কিছু জিজ্ঞাসা কর। কি কথা হচ্ছিল, বল।”
নরেন্দ্র—পেট গরম হয়েছে। ও আর কি বলবো।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সেরে যাবে।
মাস্টার (সহাস্যে)—বুদ্ধ অবস্থা কিরকম?
নরেন্দ্র—আমার কি হয়েছে, তাই বলবো।
মাস্টার—ঈশ্বর আছেন—তিনি কি বলেন?
নরেন্দ্র—ঈশ্বর আছেন কি করে বলছেন? তুমিই জগৎ সৃষ্টি করছো। Berkeley কি বলেছেন, জানো তো?
মাস্টার—হাঁ, তিনি বলেছেন বটে—Their esse is percipii (The existence of external objects depends upon their perception.)—‘যতক্ষণ ইন্দ্রিয়ের কাজ চলেছে, ততক্ষণই জগৎ!’
[পূর্বকথা—তোতাপুরীর ঠাকুরকে উপদেশ—“মনেই জগৎ”]
শ্রীরামকৃষ্ণ—ন্যাংটা বলত, ‘মনেই জগৎ, আবার মনেতেই লয় হয়।’
“কিন্তু যতক্ষণ আমি আছে, ততক্ষণ সেব্য-সেবকই ভাল।”
নরেন্দ্র (মাস্টারের প্রতি)—বিচার যদি কর, তাহলে ঈশ্বর আছেন, কেমন করে বলবে? আর বিশ্বাসের উপর যদি যাও, তাহলে সেব্য-সেবক মানতেই হবে। তা যদি মানো—আর মানতেই হবে—তাহলে দয়াময়ও বলতে হবে।
“তুমি কেবল দুঃখটাই মনে করে রেখেছো। তিনি যে এত সুখ দিয়েছেন—তা ভুলে যাও কেন? তাঁর কত কৃপা! তিনটি বড় বড় জিনিস আমাদের দিয়েছেন—মানুষজন্ম, ঈশ্বরকে জানবার ব্যাকুলতা, আর মহাপুরুষের সঙ্গ দিয়েছেন। মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ।”
সকলে চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—আমার কিন্তু বেশ বোধ হয়, ভিতরে একটি আছে।
রাজেন্দ্রলাল দত্ত আসিয়া বসিলেন। হোমিওপ্যাথিক মতে ঠাকুরের চিকিত্সা করিতেছেন। ঔষধাদির কথা হইয়া গেলে, ঠাকুর অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া মনোমোহনকে দেখাইতেছেন।
ডাক্তার রাজেন্দ্র—উনি আমার মামাতো ভায়ের ছেলে।
নরেন্দ্র নিচে আসিয়াছেন। আপনা-আপনি গান গাহিতেছেন :
সব দুঃখ দূর করিলে দরশন দিয়ে; মোহিলে প্রাণ ।
সপ্তলোক ভুলে শোক, তোমারে পাইয়ে,
কোথা আমি অতি দীন-হীন ।
নরেন্দ্রের একটু পেটের অসুখ করিয়াছে। মাস্টারকে বলিতেছেন—“প্রেম-ভক্তির পথে থাকলে দেহে মন আসে। তা না হলে আমি কে? মানুষও নই—দেবতাও নই—আমার সুখও নাই, দুঃখও নাই।”
[ঠাকুরের আত্মপূজা—সুরেন্দ্রকে প্রসাদ—সুরেন্দ্রের সেবা]
রাত্রি নয়টা হইল। সুরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা ঠাকুরের কাছে পুষ্পমালা আনিয়া নিবেদন করিয়াছেন! ঘরে বাবুরাম, সুরেন্দ্র, লাটু, মাস্টার প্রভৃতি আছেন।
ঠাকুর সুরেন্দ্রের মালা নিজে গলায় ধারণ করিয়াছেন, সকলেই চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। যিনি অন্তরে আছেন, ঠাকুর তাঁহারই বুঝি পূজা করিতেছেন!
হঠাৎ সুরেন্দ্রকে ইঙ্গিত করিয়া ডাকিতেছেন। সুরেন্দ্র শয্যার কাছে আসিলে প্রসাদীমালা (যে মালা নিজে পরিয়াছিলেন) লইয়া নিজে তাঁহার গলায় পরাইয়া দিলেন!
সুরেন্দ্র মালা পাইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর আবার তাঁহাকে ইঙ্গিত করিয়া পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে বলিতেছেন। সুরেন্দ্র কিয়ত্ক্ষণ ঠাকুরের পদসেবা করিলেন।
[কাশীপুর উদ্যানে ভক্তগণের সংকীর্তন]
ঠাকুর যে ঘরে আছেন, তাহার পশ্চিমদিকে একটি পুষ্করিণী আছে। এই পুষ্করিণীর ঘাটের চাতালে কয়েকটি ভক্ত খোল-করতাল লইয়া গান গাইতেছেন। ঠাকুর লাটুকে দিয়া বলিয়া পাঠাইলেন—“তোমরা একটু হরিনাম কর।”
মাস্টার, বাবুরাম প্রভৃতি এখনও ঠাকুরের কাছে বসিয়া আছেন। তাঁহারা শুনিতেছেন, ভক্তেরা গাইতেছেন ঃ
হরি বোলে আমার গৌর নাচে ।
ঠাকুর গান শুনিতে শুনিতে বাবুরাম, মাস্টার প্রভৃতিকে ইঙ্গিত করিয়া বলিতেছেন—“তোমরা নিচে যাও। ওদের সঙ্গে গান কর,—আর নাচবে।”
তাঁহারা নিচে আসিয়া কীর্তনে যোগদান করিলেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর আবার লোক পাঠাইয়াছেন। বলেছেন, এই আখরগুলি দেবে—“গৌর নাচতেও জানে রে! গৌরের ভাবের বালাই যাই রে! গৌর আমার নাচে দুই বাহু তুলে!”
কীর্তন সমাপ্ত হইল। সুরেন্দ্র ভাবাবিষ্টপ্রায় হইয়া গাইতেছেন—
আমার পাগল বাবা, পাগলী আমার মা ।
আমি তাদের পাগল ছেলে, আমার মায়ের নাম শ্যামা ॥
বাবা বব বম্ বলে, মদ খেয়ে মা গায়ে পড়ে ঢলে,
শ্যামার এলোকেশ দোলে;
রাঙা পায়ে ভ্রমর গাজে, ওই নূপুর বাজে শুন না ।
৫৪.১৮ অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্র ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব—ভবনাথ, পূর্ণ, সুরেন্দ্র
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়া হীরানন্দ গাড়িতে উঠিতেছেন। গাড়ির কাছে নরেন্দ্র, রাখাল দাঁড়াইয়া তাঁহার সহিত মিষ্টালাপ করিতেছেন। বেলা দশটা। হীরানন্দ আবার কাল আসিবেন।
আজ বুধবার, ৯ই বৈশাখ, চৈত্র কৃষ্ণা তৃতীয়া। ২১শে এপ্রিল, ১৮৮৬। নরেন্দ্র উদ্যানপথে বেড়াইতে বেড়াইতে মণির সহিত কথা কহিতেছেন। বাটীতে মা ও ভাইদের বড় কষ্ট—এখনও সুবন্দোবস্ত করিয়া দিতে পারেন নাই। তজ্জন্য চিন্তিত আছেন।
নরেন্দ্র—বিদ্যাসাগরের ইস্কুলের কর্ম আর আমার দরকার নাই। গয়াতে যাব মনে করেছি। একটা জমিদারীর ম্যানেজারের কর্মের কথা একজন বলেছে। ঈশ্বর-টীশ্বর নাই।
মণি (সহাস্যে)—সে তুমি এখন বলছ; পরে বলবে না। Scepticism ঈশ্বরলাভের পথের একটা স্টেজ; এই সব স্টেজ পার হলে আরও এগিয়ে পড়লে তবে ভগবানকে পাওয়া যায়,—পরমহংসদেব বলেছেন।
নরেন্দ্র—যেমন গাছ দেখছি, অমনি করে কেউ ভগবানকে দেখেছে?
মণি—হাঁ, ঠাকুর দেখেছেন।
নরেন্দ্র—সে মনের ভুল হতে পারে।
মণি—যে যে অবস্থায় যা দেখে, সেই অবস্থায় তা তার পক্ষে রীয়্যালিটি (সত্য)। যতক্ষণ স্বপন দেখছ। একটা বাগানে গিয়েছ, ততক্ষণ বাগানটি তোমার পক্ষে রীয়্যালিটি; কিন্তু তোমার অবস্থা বদলালে—যেমন জাগরণ অবস্থায়—তোমার ওটা ভুল বলে বোধ হতে পারে! যে অবস্থায় ঈশ্বরদর্শন করা যায়,—সে অবস্থা হলে তখন রীয়্যালিটি (সত্য) বোধ হবে।
নরেন্দ্র—আমি ট্রুথ চাই। সেদিন পরমহংস মহাশয়ের সঙ্গেই খুব তর্ক করলাম।
মণি (সহাস্যে)—কি হয়েছিল?
নরেন্দ্র—উনি আমায় বলছিলেন, ‘আমাকে কেউ কেউ ঈশ্বর বলে।’ আমি বললাম, ‘হাজার লোকে ঈশ্বর বলুক, আমার যতক্ষণ সত্য বলে না বোধ হয়, ততক্ষণ বলব না।’
“তিনি বললেন—‘অনেকে যা বলবে, তাই তো সত্য—তাই তো ধর্ম!’
“আমি বললাম, ‘নিজে ঠিক না বুঝলে অন্য লোকের কথা শুনব না’।”
মণি (সহাস্যে)—তোমার ভাব Copernicus, Berkeley—এদের মতো। জগতের লোক বলছে,—সূর্য চলছে, Copernicus তা শুনলে না;—জগতের লোক বলছে External World (জগৎ) আছে, Berkeley তা শুনলে না। তাই Lewis বলেছেন, ‘Why was not Berkeley a philosophical Copernicus?’
নরেন্দ্র—একখানা History of philosophy দিতে পারেন?
মণি—কি, Lewis?
নরেন্দ্র—না, Ueberweg;—German পড়তে হবে।
মণি—তুমি বলছো, সামনে গাছের মতন কেউ কি দেখেছে? তা ঈশ্বর মানুষ হয়ে যদি এসে বলেন, ‘আমি ঈশ্বর!’ তাহলে তুমি কি বিশ্বাস করবে? তুমি ল্যাজারাস্-এর গল্প তো জান? যখন ল্যাজারাস্ পরলোকে গিয়ে এব্রাহাম-কে বললে যে, আমি আত্মীয়বন্ধুদের বলে আসি যে, সত্যই পরলোক আর নরক আছে। এব্রাহাম বললেন, তুমি গিয়ে বললে কি তারা বিশ্বাস করবে? তারা বলবে, কে একটা জোচ্চোর এসে এই সব কথা বলছে।
“ঠাকুর বলেছেন, তাঁকে বিচার করে জানা যায় না। বিশ্বাসেই সমস্ত হয়,—জ্ঞান, বিজ্ঞান। দর্শন, আলাপ,—সব।”
ভবনাথ বিবাহ করিয়াছেন। তাঁহার অন্নচিন্তা হইয়াছে। তিনি মাস্টারের কাছে আসিয়া বলিতেছেন, “বিদ্যাসাগরের নূতন ইস্কুল হবে, শুনলাম। আমারও তো খ্যাঁটের যোগাড় করতে হবে। ইস্কুলের একটা কাজ করলে হয় না?”
[রামলাল—পূর্ণের গাড়িভাড়া—সুরেন্দ্রের খসখসের পরদা]
বেলা তিনটে-চারটে। ঠাকুর শুইয়া আছেন। রামলাল পদসেবা করিতেছেন। ঘরে সিঁথির গোপাল ও মণি আছেন। রামলাল দক্ষিণেশ্বর হইতে আজ ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছেন।
ঠাকুর মণিকে জানালা বন্ধ করিয়া দিতে—ও পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে বলিতেছেন।
শ্রীযুক্ত পূর্ণকে গাড়িভাড়া করিয়া কাশীপুরের উদ্যানে আসিতে বলিয়াছিলেন। তিনি দর্শন করিয়া গিয়াছেন। গাড়িভাড়া মণি দিবেন। ঠাকুর গোপালকে ইঙ্গিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “এঁর কাছে (টাকা) পেয়েছ?”
গোপাল—আজ্ঞা, হাঁ।
রাত নয়টা হইল। সুরেন্দ্র, রাম প্রভৃতি কলিকাতায় ফিরিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন।
বৈশাখ মাসের রৌদ্র—দিনের বেলা ঠাকুরের ঘর বড়ই গরম হয়। সুরেন্দ্র তাই খসখস আনিয়া দিয়াছেন। পরদা করিয়া জানালায় টাঙ্গাইয়া দিলে ঘর বেশ ঠাণ্ডা হইবে।
সুরেন্দ্র—কই, খসখস কেউ পরদা করে টাঙ্গিয়ে দিলে না?—কেউ মনোযোগ করে না।
একজন ভক্ত (সহাস্যে)—ভক্তদের এখন ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা। এখন ‘সোঽহম্’—জগৎ মিথ্যা। আবার ‘তুমি প্রভু, আমি দাস’ এই ভাব যখন আসবে তখন এই সব সেবা হবে! (সকলের হাস্য)
৫৪.১৯ ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – রাখাল, শশী, মাস্টার, নরেন্দ্র, ভবনাথ, সুরেন্দ্র, রাজেন্দ্র, ডাক্তার
কাশীপুরের বাগান। রাখাল, শশী ও মাস্টার সন্ধ্যার সময় উদ্যানপথে পাদচারণ করিতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পীড়িত—বাগানে চিকিত্সা করাইতে আসিয়াছেন। তিনি উপরে দ্বিতলের ঘরে আছেন, ভক্তেরা তাঁহার সেবা করিতেছেন। আজ বৃহস্পতিবার, ২২শে এপ্রিল ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ, গুড ফ্রাইডে-এর পূর্বদিন।
মাস্টার—তিনি তো গুণাতীত বালক।
শশী ও রাখাল—ঠাকুর বলেছেন, তাঁর ওই অবস্থা।
রাখাল—যেমন একটা টাওয়ার। সেখানে বসে সব খবর পাওয়া যায়, দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু কেউ যেতে পারে না, কেউ নাগাল পায় না।
মাস্টার—ইনি বলেছেন, এ-অবস্থায় সর্বদা ঈশ্বরদর্শন হতে পারে। বিষয়রস নাই, তাই শুষ্ক কাঠ শীঘ্র ধরে যায়।
শশী—বুদ্ধি কত রকম, চারুকে বলছিলেন। যে বুদ্ধিতে ভগবানলাভ হয়, সেই ঠিক বুদ্ধি। যে বুদ্ধিতে টাকা হয়, বাড়ি হয়, ডেপুটির কর্ম হয়, উকিল হয় সে বুদ্ধি চিঁড়েভেজা বুদ্ধি। সে বুদ্ধিতে জোলো দইয়ের মতো চিঁড়েটা ভেজে মাত্র। শুকো দইয়ের মতো উঁচুদরের দই নয়। যে বুদ্ধিতে ভগবানলাভ হয়, সেই বুদ্ধিই শুকো দইয়ের মতো উত্কৃষ্ট দই।
মাস্টার—আহা! কি কথা!
শশী—কালী তপস্বী ঠাকুরের কাছে বলছিলেন, ‘কি হবে আনন্দ? ভীলদের তো আনন্দ আছে। অসভ্য হো-হো নাচছে-গাইছে।’
রাখাল—উনি বললেন, সে কি? ব্রহ্মানন্দ আর বিষয়ানন্দ এক? জীবেরা বিষয়ানন্দ নিয়ে আছে। বিষয়াসক্তি সব না গেলে ব্রহ্মানন্দ হয় না। একদিকে টাকার আনন্দ, ইন্দ্রিয়সুখের আনন্দ, আর-একদিকে ঈশ্বরকে পেয়ে আনন্দ। এই দুই কখন সমান হতে পারে? ঋষিরা এ ব্রহ্মানন্দ ভোগ করেছিলেন।
মাস্টার—কালী এখন বুদ্ধদেবকে চিন্তা করেন কিনা তাই সব আনন্দের পারের কথা বলছেন।
রাখাল—তাঁর কাছেও বুদ্ধদেবের কথা তুলেছিল। পরমহংসদেব বললেন, “বুদ্ধদেব অবতার, তাঁর সঙ্গে কি ধরা? বড় ঘরের বড় কথা।” কালী বলেছিল, “তাঁর শক্তি তো সব। সেই শক্তিতেই ঈশ্বরের আনন্দ আর সেই শক্তিতেই তো বিষয়ানন্দ হয়—”
মাস্টার—ইনি কি বললেন?
রাখাল—ইনি বললেন, সে কি? সন্তান উত্পাদনের শক্তি আর ঈশ্বরলাভের শক্তি কি এক?
[শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে—“কামিনী-কাঞ্চন বড় জঞ্জাল”]
বাগানের সেই দোতলার ‘হল’ ঘরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। শরীর উত্তরোত্তর অসুস্থ হইতেছে, আজ আবার ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার ও ডাক্তার রাজেন্দ্র দত্ত দেখিতে আসিয়াছেন—যদি চিকিত্সার দ্বারা কোন উপকার হয়। ঘরে নরেন্দ্র, রাখাল, শশী, সুরেন্দ্র, মাস্টার, ভবনাথ ও অন্যান্য অনেক ভক্তেরা আছেন।
বাগানটি পাকপাড়ার বাবুদের। ভাড়া দিতে হয়—প্রায় ৬০-৬৫ টাকা। ছোকরা ভক্তেরা প্রায় বাগানেই থাকেন। তাঁহারাই নিশিদিন ঠাকুরের সেবা করেন। গৃহী ভক্তেরা সর্বদা আসেন ও মাঝে মাঝে রাত্রেও থাকেন। তাঁহাদেরও নিশিদিন ঠাকুরের সেবা করিবার ইচ্ছা। কিন্তু সকলে কর্মে বদ্ধ—কোন না কোন কর্ম করিতে হয়। সর্বদা ওখানে থাকিয়া সেবা করিতে পারেন না। বাগানের খরচ চালাইবার জন্য যাহার যাহা শক্তি ঠাকুরের সেবার্থ প্রদান করেন; অধিকাংশ খরচ সুরেন্দ্র দেন! তাঁহারই নামে বাগানভাড়ার লেখাপড়া হইয়াছে। একটি পাচক ব্রাহ্মণ ও একটি দাসী সর্বদা নিযুক্ত আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তার সরকার ইত্যাদির প্রতি)—বড় খরচা হচ্ছে।
ডাক্তার (ভক্তদিগকে দেখাইয়া)—তা এরা সব প্রস্তুত। বাগানের খরচ সমস্ত দিতে এদের কোন কষ্ট নাই। (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—এখন দেখ, কাঞ্চন চাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—বল্ না?
ঠাকুর নরেন্দ্রকে উত্তর দিতে আদেশ করিলেন। নরেন্দ্র চুপ করিয়া আছেন। ডাক্তার আবার কথা কহিতেছেন।
ডাক্তার—কাঞ্চন চাই। আবার কামিনীও চাই।
রাজেন্দ্র ডাক্তার—এঁর পরিবার রেঁধে বেড়ে দিচ্ছেন।
ডাক্তার সরকার (ঠাকুরের প্রতি)—দেখলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈষৎ হাস্য করিয়া)—বড় জঞ্জাল!
ডাক্তার সরকার—জঞ্জাল না থাকলে তো সবাই পরমহংস।
শ্রীরামকৃষ্ণ—স্ত্রীলোক গায়ে ঠেকলে অসুখ হয়; যেখানে ঠেকে সেখানটা ঝনঝন করে, যেন শিঙি মাছের কাঁটা বিঁধলো।
ডাক্তার—তা বিশ্বাস হয়,—তবে না হলে চলে কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ—টাকা হাতে করলে হাত বেঁকে যায়! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। টাকাতে যদি কেউ বিদ্যার সংসার করে,—ঈশ্বরের সেবা—সাধু-ভক্তের সেবা করে—তাতে দোষ নাই।
“স্ত্রীলোক নিয়ে মায়ার সংসার করা! তাতে ঈশ্বরকে ভুলে যায়। যিনি জগতের মা, তিনিই এই মায়ার রূপ—স্ত্রীলোকের রূপ ধরেছেন। এটি ঠিক জানলে আর মায়ার সংসার করতে ইচ্ছা হয় না। সব স্ত্রীলোককে ঠিক মা বোধ হলে তবে বিদ্যার সংসার করতে পারে। ঈশ্বর দর্শন না হলে স্ত্রীলোক কি বস্তু বোঝা যায় না।”
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ খাইয়া ঠাকুর কয়দিন একটু ভাল আছেন।
রাজেন্দ্র—সেরে উঠে আপনার হোমিওপ্যাথি মতে ডাক্তারি করতে হবে। আর তা না হলে বেঁচে বা কি ফল? (সকলের হাস্য)
নরেন্দ্র—Nothing like leather (যে মুচির কাজ করে, সে বলে, চামড়ার মতো উত্কৃষ্ট জিনিস এ জগতে আর কিছু নাই।) (সকলের হাস্য)
কিয়ত্ক্ষণ পরে ডাক্তারেরা চলিয়া গেলেন।
৫৪.২০ বিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ কেন কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করেছেন?
ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। ‘কামিনী’ সম্বন্ধে আপনার অবস্থা বলিতেছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এরা কামিনী-কাঞ্চন না হলে চলে না, বলছে। আমার যে কি অবস্থা তা জানে না।
“মেয়েদের গায়ে হাত লাগলে হাত আড়ষ্ট, ঝনঝন করে।
“যদি আত্মীয়তা করে কাছে গিয়ে কথা কইতে যাই, মাঝে যেন কি একটা আড়াল থাকে, সে আড়ালের ওদিকে যাবার জো নাই।
“ঘরে একলা বসে আছি, এমন সময়ে যদি কোন মেয়ে এসে পড়ে, তাহলে একেবারে বালকের অবস্থা হয়ে যাবে; আর সেই মেয়েকে মা বলে জ্ঞান হবে।”
মাস্টার অবাক্ হইয়া ঠাকুরের বিছানার কাছে বসিয়া এই সকল কথা শুনিতেছেন। বিছানা হইতে একটু দূরে ভবনাথের সহিত নরেন্দ্র কথা কহিতেছেন। ভবনাথ বিবাহ করিয়াছেন;—কর্ম কাজের চেষ্টা করিতেছেন। কাশীপুরের বাগানে ঠাকুরকে দেখিতে আসিতে বেশি পারেন না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভবনাথের জন্য বড় চিন্তিত থাকেন, কেন না ভবনাথ সংসারে পড়িয়াছেন। ভবনাথের বয়স ২৩।২৪ হইবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—ওকে খুব সাহস দে।
নরেন্দ্র ও ভবনাথ ঠাকুরের দিকে তাকাইয়া একটু হাসিতে লাগিলেন। ঠাকুর ইশারা করিয়া আবার ভবনাথকে বলিতেছেন—“খুব বীরপুরুষ হবি। ঘোমটা দিয়ে কান্নাতে ভুলিসনে। শিকনি ফেলতে ফেলতে কান্না! (নরেন্দ্র, ভবনাথ ও মাস্টারের হাস্য)
“ভগবানেতে মন ঠিক রাখবি; যে বীরপুরুষ সে রমণীর সঙ্গে থাকে, না করে রমণ! পরিবারের সঙ্গে কেবল ঈশ্বরীয় কথা কবি।”
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর আবার ইশারা করিয়া ভবনাথকে বলিতেছেন, “আজ এখানে খাস।”
ভবনাথ—যে আজ্ঞা। আমি বেশ আছি।
সুরেন্দ্র আসিয়া বসিয়াছেন। বৈশাখ মাস। ভক্তেরা ঠাকুরকে সন্ধ্যার পর প্রত্যহ মালা আনিয়া দেন। সেই মালাগুলি ঠাকুর এক-একটি করিয়া গলায় ধারণ করেন। সুরেন্দ্র নিঃশব্দে বসিয়া আছেন। ঠাকুর প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে দুইগাছি মালা দিলেন। সুরেন্দ্রও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া সেই মালা মস্তকে ধারণ করিয়া গলায় পরিলেন।
সকলেই চুপ করিয়া বসিয়া আছেন ও ঠাকুরকে দেখিতেছেন। এইবার সুরেন্দ্র ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন; তিনি বিদায় গ্রহণ করিবেন। যাইবার সময় ভবনাথকে ডাকিয়া বলিলেন, খসখসের পর্দা টাঙিয়ে দিও। বড় গ্রীষ্ম পড়িয়াছে। ঠাকুরের উপরের হলঘর দিনের বেলায় বড় গরম হয়। তাই সুরেন্দ্র খসখসের পর্দা করিয়া আনিয়াছেন।
৫৪.২১ একবিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ হীরানন্দ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানে
[ঠাকুরের উপদেশ—“যো কুছ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়”—নরেন্দ্র ও হীরানন্দের চরিত্র]
কাশীপুরের বাগান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উপরের হলঘরে বসিয়া আছেন। সম্মুখে হীরানন্দ, মাস্টার, আরও দু-একটি ভক্ত, আর হীরানন্দের সঙ্গে দুইজন বন্ধু আসিয়াছেন। হীরানন্দ সিন্ধুদেশবাসী। কলিকাতার কলেজে পড়াশুনা করিয়া দেশে ফিরিয়া গিয়া সেখানে এতদিন ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখ হইয়াছে শুনিয়া তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছেন। সিন্ধুদেশ কলিকাতা হইতে প্রায় এগার শত ক্রোশ হইবে। হীরানন্দকে দেখিবার জন্য ঠাকুর ব্যস্ত হইয়াছিলেন।
ঠাকুর হীরানন্দের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া মাস্টারকে ইঙ্গিত করিলেন,—যেন বলিতেছেন, ছোকরাটি খুব ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আলাপ আছে?
মাস্টার—আজ্ঞে আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দ ও মাস্টারের প্রতি)—তোমরা একটু কথা কও, আমি শুনি।
মাস্টার চুপ করিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “নরেন্দ্র আছে? তাকে ডেকে আন।”
নরেন্দ্র উপরে আসিলেন ও ঠাকুরের কাছে বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্র ও হীরানন্দকে)—একটু দুজনে কথা কও।
হীরানন্দ চুপ করিয়া আছেন। অনেক ইতস্তত করিয়া তিনি কথা আরম্ভ করিলেন।
হীরানন্দ (নরেন্দ্রের প্রতি)—আচ্ছা, ভক্তের দুঃখ কেন?
হীরানন্দের কথাগুলি যেন মধুর ন্যায় মিষ্ট। কথাগুলি যাঁহারা শুনিলেন তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন যে, এঁর হৃদয় প্রেমপূর্ণ।
নরেন্দ্র—The scheme of the Universe is devilish! I could have created a better world! (এ জগতের বন্দোবস্ত দেখে বোধ হয় যে, শয়তানে করেছে, আমি এর চেয়ে ভাল জগৎ সৃষ্টি করতে পারতাম।)
হীরানন্দ—দুঃখ না থাকলে কি সুখ বোধ হয়?
নরেন্দ্র—I am giving no scheme of the universe but simply my opinion of the present scheme. (জগৎ কি উপাদানে সৃষ্টি করতে হবে, আমি তা বলছি না। আমি বলছি—যে বন্দোবস্ত সামনে দেখছি, সে বন্দোবস্ত ভাল নয়।)
“তবে একটা বিশ্বাস করলে সব চুকে যায়। Our only refuge is in pantheism ঃ সবই ঈশ্বর,—এই বিশ্বাস হলেই চুকে যায়! আমিই সব করেছি।”
হীরানন্দ—ও-কথা বলা সোজা।
নরেন্দ্র নির্বাণষট্কম্ সুর করিয়া বলিতেছেন :
ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে ।
ন চ ব্যোম ভূমির্ন তেজো ন বায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥১
ন চ প্রাণসংজ্ঞো ন বৈ পঞ্চবায়ুর্ন বা সপ্তধাতুর্ন বা পঞ্চকোষাঃ ।
ন বাক্পাণিপাদং ন চোপস্থপায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥২
ন মে দ্বেষরাগৌ ন মে লোভমোহৌ মদো নৈব মে নৈব মাত্সর্যভাবঃ ।
ন ধর্মো ন চার্থো ন কামো ন মোক্ষশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥৩
ন পুণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং ন মন্ত্রো ন তীর্থং ন বেদা ন যজ্ঞাঃ ।
অহং ভোজনং নৈব ভোজ্যং ন ভোক্তা চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥৪
ন মৃত্যুর্ন শঙ্কা ন মে জাতিভেদঃ পিতা নৈব মে নৈব মাতা ন জন্ম ।
ন বন্ধুর্নমিত্রং গুরুর্নৈব শিষ্যশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥৫
অহং নির্বিকল্পো নিরাকাররূপো বিভুত্বাচ্চ সর্বত্র সর্বেন্দ্রিয়াণাম্ ।
ন চাসঙ্গতং নৈব মুক্তির্নমেয়শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥৬
হীরানন্দ—বেশ।
ঠাকুর হীরানন্দকে ইশারা করিলেন, ইহার জবাব দাও।
হীরানন্দ—এককোণ থেকে ঘর দেখাও যা, ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘর দেখাও তা। হে ঈশ্বর! আমি তোমার দাস—তাতেও ঈশ্বরানুভব হয়, আর সেই আমি, সোঽহম্—তাতেও ঈশ্বরানুভব। একটি দ্বার দিয়েও ঘরে যাওয়া যায়, আর নানা দ্বার দিয়েও ঘরে যাওয়া যায়।
সকলে চুপ করিয়া আছেন। হীরানন্দ নরেন্দ্রকে বলিলেন, একটু গান বলুন।
নরেন্দ্র সুর করিয়া কৌপীনপঞ্চকম্ গাইতেছেন ঃ
বেদান্তবাক্যেষু সদা রমন্তো, ভিক্ষান্নমাত্রেণ চ তুষ্টিমন্তঃ ।
অশোকমন্তঃকরণে চরন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ॥ ১
মূলং তরোঃ কেবলমাশ্রয়ন্তঃ, পাণিদ্বয়ং ভোক্তুমামন্ত্রয়ন্তঃ ।
কন্থামিব শ্রীমপি কুত্সয়ন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ॥ ২
স্বানন্দভাবে পরিতুষ্টিমন্তঃ, সুশান্তসর্বেন্দ্রিয়বৃত্তিমন্তঃ ।
অহর্নিশং ব্রহ্মণি যে রমন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ॥ ৩
ঠাকুর যেই শুনিলেন—অহর্নিশং ব্রহ্মণি যে রমন্তঃ—অমনি আস্তে আস্তে বলিতেছেন, আহা! আর ইশারা করিয়া দেখাইতেছেন, “এইটি যোগীর লক্ষণ।”
নরেন্দ্র কৌপীনপঞ্চকম্ শেষ করিতেছেন ঃ
দেহাদিভাবং পরিবর্তয়ন্তঃ, স্বাত্মানমাত্মন্যবলোকয়ন্তঃ ।
নান্তং ন মধ্যং ন বহিঃ স্মরন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ॥ ৪
ব্রহ্মাক্ষরং পাবনমুচ্চরন্তো, ব্রহ্মাহমস্মীতি বিভাবয়ন্তঃ ।
ভিক্ষাশিনো দিক্ষু পরিভ্রমন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ॥ ৫
নরেন্দ্র আবার গাইতেছেন :
পরিপূর্ণমানন্দম্ ।
অঙ্গ বিহীনং স্মর জগন্নিধানম্ ।
শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্বাচোঽবাচং ।
বাগতীতং প্রাণস্য প্রাণং পরং বরেণ্যম্ ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—আর ওইটে, “যো কুছ্ হ্যায় সব্ তুঁহি হ্যায়!”
নরেন্দ্র ওই গানটি গাইতেছেন :
তুঝ্সে হাম্নে দিল্কো লাগায়া, যো কুছ্ হ্যায় সব্ তুঁহি হ্যায় ।
এক তুঝ্কো আপ্না পায়া, যো কুছ্ হ্যায় সব্ তুঁহি হ্যায় ।
দিল্কা মঁকা সব্কী মকীঁ তু, কৌন্সা দিল্ হ্যায় জিস্মে নহি তুঁ,
হরিয়েক্ দিল্মে তুনে সমায়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায় ।
কেয়া মলায়েক্ কেয়া ইন্সান্, কেয়া হিন্দু কেয়া মুসলমান্,
জায়্সা চাহা তুনে বানায়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায় ।
কাবা মে কেয়া অওর্ দায়ের্ মে কেয়া, তেরী পারাস্তিস্ হায়গী সাব জাঁ,
আগে তেরে সির সভোঁনে ঝুকায়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায় ।
আর্স্ সে লে ফার্স জমী তাক্, আওর জমীন সে আর্স্ বারী তক্,
যাহাঁ মায় দেখা তুহি নজর মে আয়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায় ।
সোচা সম্ঝা দেখা ভালা, তু জায়সা না কোই ঢুঁড়্ নিকালা,
আব ইয়ে সমঝ্ মে জাফার কী আয়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায় ।
“হরিয়েক্ দিল্মে” এই কথাগুলি শুনিয়া ঠাকুর ইশারা করিয়া বলিতেছেন যে, তিনি প্রত্যেকের হৃদয়ে আছেন, তিনি অন্তর্যামী। “যাহাঁ মায় দেখা তুহি নজর মে আয়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়!” হীরানন্দ এইটি শুনিয়া নরেন্দ্রকে বলিতেছেন,—সব্ তুঁহি হ্যায়; এখন তুঁহুঁ তুঁহুঁ। আমি নয়; তুমি!
নরেন্দ্র—Give me one and I will give you a million (আমি যদি এক পাই, তাহলে নিযুত কোটি এ-সব অনায়াসে করতে পারি—অর্থাৎ ১-এর পর শূন্য বসাইয়া।) তুমিও আমি, আমিও তুমি, আমি বই আর কিছু নাই।
এই বলিয়া নরেন্দ্র অষ্টাবক্রসংহিতা হইতে কতকগুলি শ্লোক আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। আবার সকলে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি, নরেন্দ্রকে দেখাইয়া)—যেন খাপখোলা তরোয়াল নিয়ে বেড়াচ্চে।
(মাস্টারের প্রতি, হীরানন্দকে দেখাইয়া)—“কি শান্ত! রোজার কাছে জাতসাপ যেমন ফণা ধরে চুপ করে থাকে!”
৫৪.২২ দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ – ঠাকুরের আত্মপূজা—গুহ্যকথা—মাস্টার, হীরানন্দ প্রভৃতি সঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তর্মুখ। কাছে হীরানন্দ ও মাস্টার বসিয়া আছেন। ঘর নিস্তব্ধ। ঠাকুরের শরীরে অশ্রুতপূর্ব যন্ত্রণা; ভক্তেরা যখন এক-একবার দেখেন, তখন তাঁহাদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়। ঠাকুর কিন্তু সকলকেই ভুলাইয়া রাখিয়াছেন। বসিয়া আছেন সহাস্যবদন!
ভক্তেরা ফুল ও মালা আনিয়া দিয়াছেন। ঠাকুরের হৃদয়মধ্যে নারায়ণ, তাঁহারই বুঝি পূজা করিতেছেন। এই যে ফুল লইয়া মাথায় দিতেছেন! কণ্ঠে, হৃদয়ে, নাভিদেশে। একটি বালক ফুল লইয়া খেলা করিতেছে।
ঠাকুরের যখন ঈশ্বরীয়ভাব উপস্থিত হয়, তখন বলেন যে, শরীরের মধ্যে মহাবায়ু ঊর্ধগামী হইয়াছে। মহাবায়ু উঠিলে ঈশ্বরের অনুভূতি হয়,—সর্বদা বলেন। এইবার মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—বায়ু কখন উঠেছে জানি না।
“এখন বালকভাব। তাই ফুল নিয়ে এই রকম কচ্ছি। কি দেখছি জানো? শরীরটা যেন বাঁখারিসাজানো কাপড়মোড়া, সেইটে নড়ছে। ভিতরে একজন আছে বলে তাই নড়ছে।
“যেন কুমড়ো-শাঁসবিচি ফেলা। ভিতরে কামাদি-আসক্তি কিছুই নাই। ভিতর সব পরিষ্কার। আর—”
ঠাকুরের বলিতে কষ্ট হইতেছে। বড় দুর্বল। মাস্টার তাড়াতাড়ি ঠাকুর কি বলিতে যাইতেছেন একটা আন্দাজ করিয়া বলিতেছেন, “আর অন্তরে ভগবান দেখছেন।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—অন্তরে বাহিরে, দুই দেখছি। অখণ্ড সচ্চিদানন্দ! সচ্চিদানন্দ কেবল একটা খোল আশ্রয় করে এই খোলের অন্তরে-বাহিরে রয়েছেন! এইটি দেখছি।
মাস্টার ও হীরানন্দ এই ব্রহ্মদর্শনকথা শুনিতেছেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর তাঁহাদের দিকে দৃষ্টি করিয়া কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও হীরানন্দের প্রতি)—তোমাদের সব আত্মীয়বোধ হয়। কেউ পর বোধ হয় না।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও যোগাবস্থা—অখণ্ডদর্শন]
“সব দেখছি একটা একটা খোল নিয়ে মাথা নাড়ছে ।
“দেখছি, যখন তাঁতে মনের যোগ হয়, তখন কষ্ট একধারে পড়ে থাকে ।2
“এখন কেবল দেখছি একটা চামড়া ঢাকা অখণ্ড, আর-একপাশে গলার ঘা-টা পড়ে রয়েছে।”
ঠাকুর আবার চুপ করিলেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে আবার বলিতেছেন, জড়ের সত্তা চৈতন্য লয়, আর চৈতন্যের সত্তা জড় লয়। শরীরের রোগ হলে বোধ হয় আমার রোগ হয়েছে।
হীরানন্দ ওই কথাটি বুঝিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। তাই মাস্টার বলিতেছেন—“গরম জলে হাত পুড়ে গেলে বলে, জলে হাত পুড়ে গেল। কিন্তু তা নয়, হীট (Heat)-এতে হাত পুড়ে গেছে।
হীরানন্দ (ঠাকুরের প্রতি)—আপনি বলুন, কেন ভক্ত কষ্ট পায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেহের কষ্ট।
ঠাকুর আবার কি বলিবেন। উভয়ে অপেক্ষা করিতেছেন।
ঠাকুর বলিতেছেন—“বুঝতে পারলে?”
মাস্টার আস্তে আস্তে হীরানন্দকে কি বলিতেছেন—
মাস্টার—লোকশিক্ষার জন্য। নজির। এত দেহের কষ্টমধ্যে ঈশ্বরে মনের ষোল আনা যোগ!
হীরানন্দ—হাঁ, যেমন Christ-এর Crucifixion। তবে এই Mystery, এঁকে কেন যন্ত্রণা?
মাস্টার—ঠাকুর যেমন বলেন, মার ইচ্ছা। এখানে তাঁর এইরূপই খেলা।
ইঁহারা দুজন আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন। ঠাকুর ইশারা করিয়া হীরানন্দকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন। হীরানন্দ ইশারা বুঝিতে না পারাতে ঠাকুর আবার ইশারা করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “ও কি বলছে?”
হীরানন্দ—ইনি লোকশিক্ষার কথা বলছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও-কথা অনুমানের বই তো নয়। (মাস্টার ও হীরানন্দের প্রতি)—অবস্থা বদলাচ্ছে, মনে করিছি চৈতন্য হউক, সকলকে বলব না। কলিতে পাপ বেশি, সেই সব পাপ এসে পড়ে।
মাস্টার (হীরানন্দের প্রতি)—সময় না দেখে বলবেন না। যার চৈতন্য হবার সময় হবে, তাকে বলবেন।
৫৪.২৩ ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ – প্রবৃত্তি না নিবৃত্তি? হীরানন্দকে উপদেশ—নিবৃত্তিই ভাল
হীরানন্দ ঠাকুরের পায়ে হাত বুলাইতেছেন। কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন। লাটু ও আর দু-একটি ভক্ত ঘরে মাঝে মাঝে আসিতেছেন। শুক্রবার, ২৩শে এপ্রিল, ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দ। আজ গুড্ ফ্রাইডে, বেলা প্রায় দুই প্রহর একটা হইয়াছে। হীরানন্দ আজ এখানেই অন্নপ্রসাদ পাইয়াছেন। ঠাকুরের একান্ত ইচ্ছা হইয়াছিল যে, হীরানন্দ এখানে থাকেন।
হীরানন্দ পায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে ঠাকুরের সহিত কথা কহিতেছেন। সেই মিষ্ট কথা আর মুখ হাসি হাসি। যেন বালককে বুঝাইতেছেন। ঠাকুর অসুস্থ। ডাক্তার সর্বদা দেখিতেছেন।
হীরানন্দ—তা অত ভাবেন কেন? ডাক্তারে বিশ্বাস করলেই নিশ্চিন্ত। আপনি তো বালক।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—ডাক্তারে বিশ্বাস কই? সরকার (ডাক্তার) বলেছিল, “সারবে না”।
হীরানন্দ—তা অত ভাবনা কেন? যা হবার হবে।
মাস্টার (হীরানন্দের প্রতি, জনান্তিকে)—উনি আপনার জন্য ভাবছেন না। ওঁর শরীররক্ষা ভক্তের জন্য।
বড় গ্রীষ্ম। আর মধ্যাহ্নকাল। খসখসের পর্দা টাঙ্গানো হইয়াছে। হীরানন্দ উঠিয়া পর্দাটি ভাল করিয়া টাঙ্গাইয়া দিতেছেন। ঠাকুর দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি)—তবে পাজামা পাঠিয়ে দিও।
হীরানন্দ বলিয়াছেন, তাদের দেশের পাজামা পরিলে ঠাকুর আরামে থাকিবেন। তাই ঠাকুর স্মরণ করাইয়া দিতেছেন, যেন তিনি পাজামা পাঠাইয়া দেন।
হীরানন্দের খাওয়া ভাল হয় নাই। ভাত একটু চাল চাল ছিল। ঠাকুর শুনিয়া বড় দুঃখিত হইলেন, আর বার বার তাঁহাকে বলিতেছেন, জলখাবার খাবে? এত অসুখ, কথা কহিতে পারিতেছেন না; তথাপি বারবার জিজ্ঞাসা করিতেছেন।
আবার লাটুকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তোদেরও কি ওই ভাত খেতে হয়েছিল?
ঠাকুর কোমরে কাপড় রাখিতে পারিতেছেন না। প্রায় বালকের মতো দিগম্বর হইয়াই থাকেন। হীরানন্দের সঙ্গে দুইটি ব্রাহ্ম ভক্ত আসিয়াছেন। তাই কাপড়খানি এক-একবার কোমরের কাছে টানিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি)—কাপড় খুলে গেলে তোমরা কি অসভ্য বল?
হীরানন্দ—আপনার তাতে কি? আপনি তো বালক।
শ্রীরামকৃষ্ণ (একটি ব্রাহ্ম ভক্ত প্রিয়নাথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া)—উনি বলেন।
হীরানন্দ এইবার বিদায় গ্রহণ করিবেন। তিনি দু-একদিন কলিকাতায় থাকিয়া আবার সিন্ধুদেশে গমন করিবেন। সেখানে তাঁহার কাজ আছে। দুইখানি সংবাদপত্রের তিনি সম্পাদক। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ হইতে চার বত্সর ধরিয়া ওই কার্য করিয়াছিলেন। সংবাদপত্রের নাম, সিন্ধু টাইমস্ (Sind Times) এবং সিন্ধু সুধার (Sind Sudhar); হীরানন্দ ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে বি. এ. উপাধি পাইয়াছিলেন। হীরানন্দ সিন্ধুবাসী। কলিকাতায় পড়াশুনা করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত কেশব সেনকে সর্বদা দর্শন ও তাঁহার সহিত সর্বদা আলাপ করিতেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে কালীবাড়িতে মাঝে মাঝে আসিয়া থাকিতেন।
[হীরানন্দের পরীক্ষা—প্রবৃত্তি না নিবৃত্তি]
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি)—সেখানে নাই বা গেলে?
হীরানন্দ (সহাস্যে)—বাঃ! আর যে সেখানে কেউ নাই! আর সব যে চাকরি করি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি মাহিনা পাও?
হীরানন্দ (সহাস্যে)—এ-সব কাজে কম মাহিনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কত?
হীরানন্দ হাসিতে লাগিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখানে থাক না?
[হীরানন্দ চুপ করিয়া আছেন।]
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি হবে কর্মে?
হীরানন্দ চুপ করিয়া আছেন।
হীরানন্দ আর একটু কথাবার্তার পর বিদায় গ্রহণ করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কবে আসবে?
হীরানন্দ—পরশু সোমবার দেশে যাব। সোমবার সকালে এসে দেখা করব।
৫৪.২৪ চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ – মাস্টার, নরেন্দ্র, শরৎ প্রভৃতি
মাস্টার ঠাকুরের কাছে বসিয়া। হীরানন্দ এইমাত্র চলিয়া গেলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—খুব ভাল; না?
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ; স্বভাবটি বড় মধুর।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বললে এগার শো ক্রোশ। অত দূর থেকে দেখতে এসেছে।
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ, খুব ভালবাসা না থাকলে এরূপ হয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বড় ইচ্ছা, আমায় সেই দেশে নিয়ে যায়।
মাস্টার—যেতে বড় কষ্ট হবে। রেলে ৪।৫ দিনের পথ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনটে পাস!
মাস্টার—আজ্ঞে, হাঁ।
ঠাকুর একটু শ্রান্ত হইয়াছেন। বিশ্রাম করিবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—পাখি খুলে দাও আর মাদুরটা পেতে দাও।
ঠাকুর খড়খড়ির পাখি খুলিয়া দিতে বলিতেছেন। আর বড় গরম, তাই বিছানার উপর মাদুর পাতিয়া দিতে বলিতেছেন।
মাস্টার হাওয়া করিতেছেন। ঠাকুরের একটু তন্দ্রা আসিয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (একটু নিদ্রার পর, মাস্টারের প্রতি)—ঘুম কি হয়েছিল?
মাস্টার—আজ্ঞে, একটু হয়েছিল।
নরেন্দ্র, শরৎ ও মাস্টার নিচে হলঘরের পূর্বদিকে কথা কহিতেছেন।
নরেন্দ্র—কি আশ্চর্য! এত বত্সর পড়ে তবু বিদ্যা হয় না; কি করে লোকে বলে যে, দু-তিনদিন সাধন করেছি, ভগবানলাভ হবে! ভগবানলাভ কি এত সোজা! (শরতের প্রতি) তোর শান্তি হয়েছে; মাস্টার মহাশয়ের শান্তি হয়েছে, আমার কিন্তু হয় নাই।
মাস্টার—তাহলে তুমি বরং জাব দাও, আমরা রাজবাড়ি যাই; না হয় আমরা রাজবাড়ি যাই আর তুমি জাব দাও! (সকলের হাস্য)
নরেন্দ্র (সহাস্যে)—ওই গল্প উনি (পরমহংসদেব) শুনেছিলেন—আর শুনতে শুনতে হেসেছিলেন।3
৫৪.২৫ পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রাদি ভক্তের মজলিস
[সুরেন্দ্র, শরৎ, শশী, লাটু, নিত্যগোপাল, কেদার, গিরিশ, রাম, মাস্টার]
বৈকাল হইয়াছে। উপরের হলঘরে অনেকগুলি ভক্ত বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র, শরৎ, শশী, লাটু, নিত্যগোপাল, কেদার, গিরিশ, রাম, মাস্টার, সুরেশ অনেকেই আছেন।
সকলের অগ্রে নিত্যগোপাল আসিয়াছেন ও ঠাকুরকে দেখিবামাত্র তাঁহার চরণে মস্তক দিয়া বন্দনা করিয়াছেন। উপবেশনানন্তর নিত্যগোপাল বালকের ন্যায় বলিতেছেন কেদারবাবু এসেছে।
কেদার অনেকদিন পরে ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। তিনি বিষয়কর্ম উপলক্ষে ঢাকায় ছিলেন। সেখানে ঠাকুরের অসুখের কথা শুনিয়া আসিয়াছেন। কেদার ঘরে প্রবেশ করিয়াই ঠাকুরের ভক্তসম্ভাষণ দেখিতেছেন।
কেদার ঠাকুরের পদধূলি নিজে মস্তকে গ্রহণ করিলেন ও আনন্দে সেই ধূলি লইয়া সকলকে বিতরণ করিতেছেন। ভক্তেরা মস্তক অবনত করিয়া সেই ধূলি গ্রহণ করিতেছেন।
শরৎকে দিতে যাইতেছেন, এমন সময় তিনি নিজেই ঠাকুরের চরণধূলি লইলেন। মাস্টার হাসিলেন। ঠাকুরও মাস্টারের দিকে চাহিয়া হাসিলেন। ভক্তেরা নিঃশব্দে বসিয়া আছেন। ঠাকুরের ভাব-লক্ষণ দেখা যাইতেছে। মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস ত্যাগ করিতেছেন, যেন ভাব চাপিতেছেন। অবশেষে কেদারকে ইঙ্গিত করিতেছেন—গিরিশ ঘোষের সহিত তর্ক কর। গিরিশ কান-নাক মলিতেছেন আর বলিতেছেন, “মহাশয় নাক-কান মলছি! আগে জানতাম না, আপনি কে! তখন তর্ক করেছি; সে এক!” (ঠাকুরের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কেদারকে দেখাইতেছেন ও বলিতেছেন, “সব ত্যাগ করেছে! (ভক্তদের প্রতি) কেদার নরেন্দ্রকে বলেছিল, এখন তর্ক কর বিচার কর; কিন্তু শেষে হরিনামে গড়াগড়ি দিতে হবে। (নরেন্দ্রের প্রতি)—কেদারের পায়ের ধুলা নাও।”
কেদার (নরেন্দ্রকে)—ওঁর পায়ের ধুলা নাও; তাহলেই হবে।
সুরেন্দ্র ভক্তদের পশ্চাতে বসিয়া আছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঈষৎ হাস্য করিয়া তাঁহার দিকে তাকাইলেন। কেদারকে বলিতেছেন, আহা, কি স্বভাব! কেদার ঠাকুরের ইঙ্গিত বুঝিয়া সুরেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হইয়া বসিলেন।
সুরেন্দ্র একটু অভিমানী। ভক্তেরা কেহ কেহ বাগানের খরচের জন্য বাহিরের ভক্তদের কাছে অর্থ সংগ্রহ করিতে গিয়াছিলেন। তাই বড় অভিমান হইয়াছে। সুরেন্দ্র বাগানের অধিকাংশ খরচ দেন।
সুরেন্দ্র (কেদারের প্রতি)—অত সাধুদের কাছে কি আমি বসতে পারি! আবার কেউ কেউ (নরেন্দ্র) কয়েকদিন হইল, সন্ন্যাসীর বেশে বুদ্ধগয়া দর্শন করিতে গিয়াছিলেন। বড় বড় সাধু দেখতে!
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সুরেন্দ্রকে ঠাণ্ডা করিতেছেন। বলছেন, হাঁ, ওরা ছেলেমানুষ, ভাল বুঝতে পারে না।
সুরেন্দ্র (কেদারের প্রতি)—গুরুদেব কি জানেন না, কার কি ভাব। উনি টাকাতে তুষ্ট নন; উনি ভাব নিয়ে তুষ্ট!
ঠাকুর মাথা নাড়িয়া সুরেন্দ্রের কথায় সায় দিতেছেন। “ভাব নিয়ে তুষ্ট”, এই কথা শুনিয়া কেদারও আনন্দ প্রকাশ করিতেছেন।
ভক্তেরা খাবার আনিয়াছেন ও ঠাকুরের সামনে রাখিয়াছেন। ঠাকুর জিহ্বাতে কণিকামাত্র ঠেকাইলেন। সুরেন্দ্রের হাতে প্রসাদ দিতে বলিলেন ও অন্য সকলকে দিতে বলিলেন।
সুরেন্দ্র নিচে গেলেন। নিচে প্রসাদ বিতরণ হইবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেদারের প্রতি)—তুমি বুঝিয়ে দিও। যাও একবার—বকাবকি করতে মানা করো।
মণি হাওয়া করিতেছেন। ঠাকুর বলিলেন, “তুমি খাবে না?” মণিকেও নিচে প্রসাদ পাইতে পাঠাইলেন।
সন্ধ্যা হয় হয়! গিরিশ ও শ্রীম—পুকুরধারে বেড়াইতেছেন।
গিরিশ—ওহে তুমি ঠাকুরের বিষয়—কি নাকি লিখেছো?
শ্রীম—কে বললে?
গিরিশ—আমি শুনেছি। আমায় দেবে?
শ্রীম—না; আমি নিজে না বুঝে কারুকে দেব না—ও আমি নিজের জন্য লিখেছি। অন্যের জন্য নয়!
গিরিশ—বল কি!
শ্রীম—আমার দেহ যাবার সময় পাবে।
[ঠাকুর অহেতুক-কৃপাসিন্ধু—ব্রাহ্মভক্ত শ্রীযুক্ত অমৃত]
সন্ধ্যার পর ঠাকুরের ঘরে আলো জ্বালা হইয়াছে। ব্রাহ্মভক্ত শ্রীযুক্ত অমৃত (বসু) দেখিতে আসিয়াছেন। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন। মাস্টার ও দুই-চারিজন ভক্ত বসিয়া আছেন। ঠাকুরের সম্মুখে কলাপাতায় বেল ও জুঁই ফুলের মালা রহিয়াছে। ঘর নিস্তব্ধ। যেন একটি মহাযোগী নিঃশব্দে যোগে বসিয়া আছেন। ঠাকুর মালা লইয়া এক-একবার তুলিতেছেন। যেন গলায় পরিবেন।
অমৃত (স্নেহপূর্ণস্বরে)—মালা পরিয়ে দেব?
মালা পরা হইলে, ঠাকুর অমৃতের সহিত অনেক কথা কহিলেন। অমৃত বিদায় লইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি আবার এসো।
অমৃত—আজ্ঞে, আসবার খুব ইচ্ছা। অনেক দূর থেকে আসতে হয়—তাই সব সময় পারি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি এসো। এখান থেকে গাড়িভাড়া নিও।
অমৃতের প্রতি ঠাকুরের অহেতুক স্নেহ দেখিয়া সকলে অবাক্।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তের স্ত্রী পুত্র]
পরদিন শনিবার, ২৪শে এপ্রিল। একটি ভক্ত আসিয়াছেন। সঙ্গে পরিবার ও একটি সাত বছরের ছেলে। একবত্সর হইল একটি অষ্টমবর্ষীয় সন্তান দেহত্যাগ করিয়াছে। পরিবারটি সেই অবধি পাগলের মতো হইয়াছেন। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে মাঝে মাঝে আসিতে বলেন।
রাত্রে শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী উপরের হলঘরে ঠাকুরকে খাওয়াইতে আসিলেন। ভক্তটির বউ, আলো লইয়া সঙ্গে সঙ্গে আসিলেন।
খাইতে খাইতে, ঠাকুর তাঁহাকে ঘরকন্নার কথা অনেক জিজ্ঞাসা করিলেন ও কিছুদিন ওই বাগানে আসিয়া শ্রীশ্রীমার কাছে থাকিতে বলিলেন। তাহা হইলে শোক অনেক কম পড়িবে। তাঁহার একটি কোলের মেয়ে ছিল। পরে শ্রীশ্রীমা তাহাকে মানময়ী বলিয়া ডাকিতেন। ঠাকুর ইঙ্গিত করিয়া বলিলেন, তাকেও আনবে।
ঠাকুরের খাওয়ার পর ভক্তটির পরিবার স্থানটি পরিষ্কার করিয়া লইলেন। ঠাকুরের সঙ্গে কিয়ত্ক্ষণ কথাবার্তার পর, শ্রীশ্রীমা যখন নিচের ঘরে গেলেন, তিনি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া সেই সঙ্গে গমন করিলেন।
রাত্রি প্রায় নয়টা হইল। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে সেই ঘরে বসিয়া আছেন। ফুলের মালা পরিয়াছেন। মণি হাওয়া করিতেছেন।
ঠাকুর গলদেশ হইতে মালা লইয়া হাতে করিয়া আপন মনে কি বলিতেছেন। তারপর যেন প্রসন্ন হইয়া মণিকে মালা দিলেন।
শোকসন্তপ্তা ভক্তের পত্নীকে ঠাকুর শ্রীশ্রীমার কাছে ওই বাগানে আসিয়া কিছুদিন থাকিতে বলিয়াছেন, মণি সমস্ত শুনিলেন।
*****
- মথুরের চৌদ্দ বৎসর সেবা। ১৮৫৮ হইতে ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দ। মথুরের মৃত্যু—১লা শ্রাবণ, ১২৭৮; ১৪ই জুলাই, ১৮৭১। ↩︎
- যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ ।
যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ॥ [BG 6.22] ↩︎ - কথাটি প্রহ্লাদচরিত্রের। প্রহ্লাদের বাবা, ষণ্ড আর অমর্ক, দুই গুরু মহাশয়কে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রাজা জিজ্ঞাসা করিবেন, প্রহ্লাদকে তারা কেন হরিনাম শিখাইয়াছে? তাদের রাজার কাছে যেতে ভয় হয়েছিল। তাই ষণ্ড অমর্ককে ওই কথা বলছে। ↩︎