৫৩.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরের বাটীতে ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরের বাটীতে ভক্তসঙ্গে
শ্রীশ্রীবিজয়া দশমী। ১৮ই অক্টোবর, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ (৩রা কার্তিক, ১২৯২, রবিবার)। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরের বাটীতে আছেন। শরীর অসুস্থ—কলিকাতায় চিকিত্সা করিতে আসিয়াছেন। ভক্তেরা সর্বদাই থাকেন, ঠাকুরের সেবা করেন। ভক্তদের মধ্যে এখন কেহ সংসারত্যাগ করেন নাই—তাঁহারা নিজেদের বাটী হইতে যাতায়াত করেন।
[সুরেন্দ্রের ভক্তি—‘মা হৃদয়ে থাকুন’]
শীতকাল সকাল বেলা ৮টা। ঠাকুর অসুস্থ, বিছানায় বসিয়া আছেন। কিন্তু পঞ্চমবর্ষীয় বালকের মতো, মা বই কিছু জানেন না। সুরেন্দ্র আসিয়া বসিলেন। নবগোপাল, মাস্টার ও আরও কেহ কেহ উপস্থিত আছেন। সুরেন্দ্রের বাটীতে ৺দুর্গাপূজা হইয়াছিল। ঠাকুর যাইতে পারেন নাই, ভক্তদের প্রতিমা দর্শন করিতে পাঠাইয়াছিলেন। আজ বিজয়া, তাই সুরেন্দ্রের মন খারাপ হইয়াছে।
সুরেন্দ্র—বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে)—তাহলেই বা। মা হৃদয়ে থাকুন!
সুরেন্দ্র মা মা করিয়া পরমেশ্বরীর উদ্দেশে কত কথা কহিতে লাগিলেন।
ঠাকুর সুরেন্দ্রকে দেখিতে দেখিতে অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন। মাস্টারের দিকে তাকাইয়া গদ্গদস্বরে বলিতেছেন, কি ভক্তি! আহা, এর যা ভক্তি আছে!
শ্রীরামকৃষ্ণ—কাল ৭টা-৭॥টার সময় ভাবে দেখলাম, তোমাদের দালান। ঠাকুর প্রতিমা রহিয়াছেন, দেখলাম সব জ্যোতির্ময়। এখানে-ওখানে এক হয়ে আছে। যেন একটা আলোর স্রোত দু-জায়গার মাঝে বইছে!—এবাড়ি আর তোমাদের সেই বাড়ি!
সুরেন্দ্র—আমি তখন ঠাকুর দালানে মা মা বলে ডাকছি, দাদারা ত্যাগ করে উপরে চলে গেছে। মনে উঠলো মা বললেন, ‘আমি আবার আসব’।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভগবদ্গীতা]
বেলা এগারটা বাজিবে। ঠাকুর পথ্য পাইলেন। মণি হাতে আঁচাবার জল দিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—ছোলার ডাল খেয়ে রাখালের অসুখ হয়েছে। সাত্ত্বিক আহার করা ভাল। তুমি গীতা দেখ নাই? তুমি গীতা পড় না?
মণি—আজ্ঞা হাঁ, যুক্তাহারের কথা আছে। সাত্ত্বিক আহার, রাজসিক আহার, তামসিক আহার। আবার সাত্ত্বিক দয়া, রাজসিক দয়া, তামসিক দয়া। সাত্ত্বিক অহং ইত্যাদি সব আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—গীতা তোমার আছে?
মণি—আজ্ঞা, আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওতে সর্বশাস্ত্রের সার আছে।
মণি—আজ্ঞা, ঈশ্বরকে নানারকমে দেখার কথা আছে; আপনি যেমন বলেন, নানা পথ দিয়ে তাঁর কাছে যাওয়া—জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম, ধ্যান।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কর্মযোগ মানে কি জান? সকল কর্মের ফল ভগবানে সমর্পণ করা।
মণি—আজ্ঞা, দেখেছি, ওতে আছে। কর্ম আবার তিনরকমে করা যেতে পারে, আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি কি রকম?
মণি—প্রথম—জ্ঞানের জন্য। দ্বিতীয়—লোকশিক্ষার জন্য। তৃতীয়—স্বভাবে।
ঠাকুর আচমনান্তে পান খাইতেছেন। মণিকে মুখ হইতে পান প্রসাদ দিলেন।
৫৩.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ—Sir Humphrey Davy ও অবতারবাদ
ঠাকুর মাস্টারের সহিত ডাক্তার সরকারের কথা কহিতেছেন। পূর্বদিনে ঠাকুরের সংবাদ লইয়া মাস্টার ডাক্তারের কাছে গিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার সঙ্গে কি কি কথা হল?
মাস্টার—ডাক্তারের ঘরে অনেক বই আছে। আমি একখানা বই সেখানে বসে বসে পড়ছিলাম। সেই সব পড়ে আবার ডাক্তারকে শোনাতে লাগলাম। Sir Humphrey Davy-র বই। তাতে অবতারের প্রয়োজন এ-কথা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বটে? তুমি কি কথা বলেছিলে?
মাস্টার—একটি কথা আছে, ঈশ্বরের বাণী মানুষের ভিতর দিয়ে না এলে মানুষ বুঝতে পারে না। (Divine Truth must be made human Truth to be appreciated by us)। তাই অবতারাদির প্রয়োজন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বাঃ, এ-সব তো বেশ কথা!
মাস্টার—সাহেব উপমা দিয়েছে, যেমন সূর্যের দিকে চাওয়া যায় না, কিন্তু সূর্যের আলো যেখানে পড়ে, (Reflected rays) সেদিকে চাওয়া যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বেশ কথা, আর কিছু আছে?
মাস্টার—আর এক জায়গায় ছিল, যথার্থ জ্ঞান হচ্ছে বিশ্বাস।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ তো খুব ভাল কথা। বিশ্বাস হল তো সবই হয়ে গেল।
মাস্টার—সাহেব আবার স্বপ্ন দেখেছিলেন রোমানদের দেবদেবী।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এমন সব বই হয়েছে? তিনিই (ঈশ্বর) সেখানে কাজ করছেন। আর কিছু কথা হল?
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও ‘জগতের উপকার’ বা কর্মযোগ]
মাস্টার—ওরা বলে জগতের উপকার করব। তাই আমি আপনার কথা বললাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কি কথা?
মাস্টার—শম্ভু মল্লিকের কথা। সে আপনাকে বলেছিল, ‘আমার ইচ্ছা যে, টাকা দিয়ে কতকগুলি হাসপাতাল, ডিস্পেনসারি, স্কুল, এইসব করে দিই; হলে অনেকের উপকার হবে। আপনি তাকে যা বলেছিলেন, তাই বললুম, ‘যদি ঈশ্বর সম্মুখে আসেন, তবে তুমি কি বলবে, আমাকে কতকগুলি হাসপাতাল, ডিস্পেনসারি, স্কুল করে দাও!’ আর-একটি কথা বললাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, থাক আলাদা আছে, যারা কর্ম করতে আসে। আর কি কথা?
মাস্টার—বললাম, কালীদর্শন যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে রাস্তায় কেবল কাঙ্গালী বিদায় করলে কি হবে? বরং জো-সো করে একবার কালীদর্শন করে লও;—তারপর যত কাঙ্গালী বিদায় করতে ইচ্ছা হয় করো।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর কিছু কথা হলো?
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত ও কামজয়]
মাস্টার—আপনার কাছে যারা আসে তাদের অনেকে কামজয় করেছেন, এই কথা হল। ডাক্তার তখন বললে, ‘আমারও কামটাম উঠে গেছে, জানো?’ আমি বললাম, আপনি তো বড় লোক। আপনি যে কাম জয় করেছেন বলছেন তাতো আশ্চর্য নয়। ক্ষুদ্র প্রাণীদের পর্যন্ত তাঁর কাছে থেকে ইন্দ্রিয় জয় হচ্ছে, এই আশ্চর্য! তারপর আমি বললাম, আপনি যা গিরিশ ঘোষকে বলেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কি বলেছিলাম?
মাস্টার—আপনি গিরিশ ঘোষকে বলেছিলেন, ‘ডাক্তার তোমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নাই।’ সেই অবতারের কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি অবতারের কথা তাকে (ডাক্তারকে) বলবে। অবতার—যিনি তারণ করেন। তা দশ অবতার আছে, চব্বিশ অবতার আছে আবার অসংখ্য অবতার আছে।
[মদ্যপান ক্রমে ক্রমে একেবারে ত্যাগ]
মাস্টার—গিরিশ ঘোষের ভারী খবর নেয়। কেবল জিজ্ঞাসা করেন, গিরিশ ঘোষ কি সব মদ ছেড়েছে? তার উপর বড় চোখ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি গিরিশ ঘোষকে ও-কথা বলেছিলে?
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ, বলেছিলাম। আর সব মদ ছাড়বার কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে কি বললে?
মাস্টার—তিনি বললেন, তোমরা যে কালে বলছো সেকালে ঠাকুরের কথা বলে মানি—কিন্তু আর জোর করে কোনও কথা বলব না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (আনন্দের সহিত)—কালীপদ বলেছে, সে একেবারে সব ছেড়েছে।
৫৩.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নিত্যলীলা যোগ
[Identity of the Absolute or the Universal Ego and the Phenomenal World]
বৈকাল হইয়াছে, ডাক্তার আসিয়াছেন। অমৃত (ডাক্তারের ছেলে) ও হেম, ডাক্তারের সঙ্গে আসিয়াছেন। নরেন্দ্রাদি ভক্তেরাও উপস্থিত আছেন। ঠাকুর নিভৃতে অমৃতের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “তোমার কি ধ্যান হয়?” আর বলিতেছেন, “ধ্যানের অবস্থা কিরকম জানো? মনটি হয়ে যায় তৈলধারার ন্যায়। এক চিন্তা, ঈশ্বরের; অন্য কোন চিন্তা তার ভিতর আসবে না।” এইবার ঠাকুর সকলের সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—তোমার ছেলে অবতার মানে না। তা বেশ। নাই বা মানলে।
“তোমার ছেলেটি বেশ। তা হবে না? বোম্বাই আমের গাছে কি টোকো আম হয়? তার ঈশ্বরে কেমন বিশ্বাস! যার ঈশ্বরে মন সেই তো মানুষ। মানুষ—আর মানহুঁশ। যার হুঁশ আছে, চৈতন্য আছে, যে নিশ্চিত জানে, ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য—সেই মানহুঁশ। তা অবতার মানে না, তাতে দোষ কি?
“ঈশ্বর; আর এ-সব জীবজগৎ, তাঁর ঐশ্বর্য। এ মানলেই হল। যেমন বড় মানুষ আর তার বাগান।
“এরকম আছে, দশ অবতার,—চব্বিশ অবতার,—আবার অসংখ্য অবতার। যেখানে তাঁর বিশেষ শক্তি প্রকাশ, সেখানেই অবতার! তাই তো আমার মত।
“আর-এক আছে, যা কিছু দেখছো এ-সব তিনি হয়েছেন। যেমন বেল,—বিচি, খোলা, শাঁস—তিন জড়িয়ে এক। যাঁর নিত্য তাঁরই লীলা; যাঁরই লীলা তাঁরই নিত্য। নিত্যকে ছেড়ে শুধু লীলা বুঝা যায় না। লীলা আছে বলেই ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে নিত্যে পৌঁছানো যায়।
“অহং বুদ্ধি যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ লীলা ছাড়িয়ে যাবার জো নাই। নেতি নেতি করে ধ্যানযোগের ভিতর দিয়ে নিত্যে পৌঁছানো যেতে পারে। কিন্তু কিছু ছাড়বার জো নাই। যেমন বললাম,—বেল।”
ডাক্তার—ঠিক কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কচ নির্বিকল্পসমাধিতে রয়েছেন। যখন সমাধিভঙ্গ হচ্ছে একজন জিজ্ঞাসা করলে, তুমি এখন কি দেখছো? কচ বললেন, দেখছি যে জগৎ যেন তাঁতে জরে রয়েছে! তিনিই পরিপূর্ণ! যা কিছু দেখছি সব তিনিই হয়েছেন। এর ভিতর কোন্টা ফেলব, কোন্টা লব, ঠিক করতে পাচ্ছি না।
“কি জানো—নিত্য আর লীলা দর্শন করে, দাসভাবে থাকা। হনুমান সাকার-নিরাকার সাক্ষাত্কার করেছিলেন। তারপরে, দাসভাবে—ভক্তের ভাবে—ছিলেন।”
মণি (স্বগতঃ)—নিত্য, লীলা দুই নিতে হবে। জার্মানিতে বেদান্ত যাওয়া অবধি ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাহারও কাহারও এই মত। কিন্তু ঠাকুর বলেছেন, সব ত্যাগ—কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ—না হলে নিত্য-লীলার সাক্ষাত্কার হয় না। ঠিক ঠিক ত্যাগী। সম্পূর্ণ অনাসক্তি। এইটুকু হেগেল প্রভৃতি পণ্ডিতদের সঙ্গে বিশেষ তফাত দেখছি।
৫৩.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও অবতারবাদ
[Reconciliation of Free will and Predestination]
ডাক্তার বলছেন, ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আর আমাদের সকলের আত্মা (Soul) অনন্ত উন্নতি করবে। একজন আর একজনের চেয়ে বড়, একথা তিনি মানতে চাহিতেছেন না। তাই অবতার মানছেন না।
ডাক্তার—‘Infinite Progress’ তা যদি না হল তাহলে পাঁচ বছর সাত বছর আর বেঁচেই বা কি হবে! গলায় দড়ি দেব!
“অবতার আবার কি! যে মানুষ হাগে মোতে তার পদানত হব! হাঁ, তবে Reflection of God’s light (ঈশ্বরের জ্যোতি) মানুষে প্রকাশ হয়ে থাকে তা মানি।”
গিরিশ (সহাস্যে)—আপনি God’s Light দেখেন নি—
ডাক্তার উত্তর দিবার পূর্বে একটু ইতস্ততঃ করিতেছেন। কাছে একজন বন্ধু বসিয়াছিলেন—আস্তে আস্তে কি বলিলেন।
ডাক্তার—আপনিও তো প্রতিবিম্ব বই কিছু দেখেন নাই।
গিরিশ—I see it, I see the Light! শ্রীকৃষ্ণ যে অবতার Prove (প্রমাণ) করব—তা না হলে জিব কেটে ফেলব।
[বিকারী রোগীরই বিচার—পূর্ণজ্ঞানে বিচার বন্ধ হয়]
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ-সব যা কথা হচ্ছে, এ কিছুই নয়।
“এ-সব বিকারের রোগীর খেয়াল। বিকারের রোগী বলেছিল,—এক জালা জল খাব, এক হাঁড়ি ভাত খাব! বদ্যি বললে, আচ্ছা আচ্ছা খাবি। পথ্য পেয়ে যা বলবি তখন করা যাবে।
“যতক্ষণ কাঁচা ঘি, ততক্ষণই কলকলানি শোনা যায়। পাকা হলে আর শব্দ থাকে না। যার যেমন মন, ঈশ্বরকে সেইরূপ দেখে। আমি দেখেছি, বড়মানুষের বাড়ির ছবি—কুইন-এর ছবি—এই সব আছে। আবার ভক্তের বাড়ি—ঠাকুরদের ছবি!
“লক্ষ্মণ বলেছিলেন, রাম, যিনি স্বয়ং বশিষ্ঠদেব, তাঁর আবার পুত্রশোক! রাম বললেন, ভাই যার জ্ঞান আছে তার অজ্ঞানও আছে। যার আলোবোধ আছে, তার অন্ধকারবোধও আছে। তাই জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও। ঈশ্বরকে বিশেষরূপে জানলে সেই অবস্থা হয়। এরই নাম বিজ্ঞান।
“পায়ে কাঁটা ফুটলে আর-একটি কাঁটা যোগাড় করে আনতে হয়। এনে সেই কাঁটাটি তুলতে হয়। তোলার পর দুটি কাঁটাই ফেলে দেয়। জ্ঞান কাঁটা দিয়ে অজ্ঞান কাঁটা তুলে, জ্ঞান অজ্ঞান দুই কাঁটাই ফেলে দিতে হয়।
“পূর্ণজ্ঞানের লক্ষণ আছে। বিচার বন্ধ হয়ে যায়। যা বললুম, কাঁচা থাকলেই ঘিয়ের কলকলানি।”
ডাক্তার—পূর্ণজ্ঞান থাকে কই? সব ঈশ্বর! তবে তুমি পরমহংসগিরি করছো কেন? আর এরাই বা এসে তোমার সেবা করছে কেন? চুপ করে থাক না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—জল স্থির থাকলেও জল, হেললে দুললেও জল, তরঙ্গ হলেও জল।
[Voice of God or Conscience—মাহুত নারায়ণ]
“আর একটি কথা। মাহুত নারায়ণের কথাই বা না শুনি কেন? গুরু শিষ্যকে বলে দিছলেন, সব নারায়ণ। পাগলা হাতি আসছিল। শিষ্য গুরুবাক্য বিশ্বাস করে সেখান থেকে সরে নাই। হাতিও নারায়ণ। মাহুত কিন্তু চেঁচিয়ে বলছিল, সব সরে যাও, সব সরে যাও; শিষ্যটি সরে নাই। হাতি তাকে আছাড় দিয়ে চলে গেল। প্রাণ যায় নাই। মুখে জল দিতে দিতে জ্ঞান হয়েছিল। যখন জিজ্ঞাসা করলে কেন তুমি সরে যাও নাই, সে বললে, ‘কেন, গুরুদেব যে বলেছেন—সব নারায়ণ!’ গুরু বললেন, বাবা, মাহুত নারায়ণের কথা তবে শুন নাই কেন? তিনিই শুদ্ধমন শুদ্ধবুদ্ধি হয়ে ভিতরে আছেন। আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। আমি ঘর, তিনি ঘরণী। তিনিই মাহুত নারায়ণ।”
ডাক্তার—আর একটা বলি; তবে কেন বল, এটা সারিয়ে দাও?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যতক্ষণ আমি ঘট রয়েছে, ততক্ষণ এইরূপ হচ্ছে। মনে করো মহাসমুদ্র—অধঃ ঊর্ধ্ব পরিপূর্ণ। তার ভিতর একটি ঘট রয়েছে। ঘটের অন্তরে-বাহিরে জল। কিন্তু না ভাঙলে ঠিক একাকার হচ্ছে না। তিনিই এই আমি-ঘট রেখে দিয়েছেন।
[আমি কে?]
ডাক্তার—তবে এই ‘আমি’ যা বলছ, এগুলো কি? এর তো মানে বলতে হবে। তিনি কি আমাদের সঙ্গে চালাকি খেলছেন?
গিরিশ—মহাশয়, কেমন করে জানলেন, চালাকি নয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—এই ‘আমি’ তিনিই রেখে দিয়েছেন। তাঁর খেলা—তাঁর লীলা! এক রাজার চার বেটা। রাজার ছেলে।—কিন্তু খেলা করছে—কেউ মন্ত্রী, কেউ কোটাল হয়েছে, এই সব। রাজার বেটা হয়ে কোটাল কোটাল খেলছে!
(ডাক্তারের প্রতি)—“শোন! তোমার যদি আত্মার সাক্ষাত্কার হয়, তবে এই সব মানতে হবে। তাঁর দর্শন হলে সব সংশয় যায়।”
[Sonship and the Father—জ্ঞানযোগ ও শ্রীরামকৃষ্ণ]
ডাক্তার—সব সন্দেহ যায় কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার কাছে এই পর্যন্ত শুনে যাও। তারপর বেশি কিছু শুনতে চাও, তাঁর কাছে একলা একলা বলবে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করবে, কেন তিনি এমন করেছেন।
“ছেলে ভিখারীকে এক কুনকে চাল দিতে পারে। রেলভাড়া যদি দিতে হয় তো কর্তাকে জানাতে হয়। [ডাক্তার চুপ করিয়া আছেন।]
“আচ্ছা, তুমি বিচার ভালবাস। কিছু বিচার করি, শোন। জ্ঞানীর মতে অবতার নাই। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন,—তুমি আমাকে অবতার অবতার বলছ, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই—দেখবে এস। অর্জুন সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। খানিক দূরে গিয়ে অর্জুনকে বললেন, ‘কি দেখতে পাচ্ছ?’ অর্জুন বললেন, ‘একটি বৃহৎ গাছ, কালো জাম থোলো থোলো হয়ে আছে।’ শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘ও কালো জাম নয়। আর একটু এগিয়ে দেখ।’ তখন অর্জুন দেখলেন, থোলো থোলো কৃষ্ণ ফলে আছে। কৃষ্ণ বললেন, ‘এখন দেখলে? আমার মতো কত কৃষ্ণ ফলে রয়েছে!’
“কবীর দাস শ্রীকৃষ্ণের কথায় বলেছিল, তুমি গোপীদের হাততালিতে বানর নাচ নেচেছিলে!
“যত এগিয়ে যাবে ততই ভগবানের উপাধি কম দেখতে পাবে। ভক্ত প্রথমে দর্শন করলে দশভুজা। আরও এগিয়ে গিয়ে দেখলে ষড়ভুজ। আরও এগিয়ে গিয়ে দেখছে দ্বিভুজ গোপাল! যত এগুচ্ছে ততই ঐশ্বর্য কমে যাচ্ছে। আরও এগিয়ে গেল, তখন জ্যোতিঃদর্শন কল্লে—কোনও উপাধি নাই।
“একটু বেদান্তের বিচার শোন। এক রাজার সামনে একজন ভেলকি দেখাতে এসেছিল। একটু সরে যাওয়ার পর রাজা দেখলে, একজন সওয়ার আসছে। ঘোড়ার উপর চড়ে, খুব সাজগোজ—হাতে অস্ত্রশস্ত্র। সভাশুদ্ধ লোক আর রাজা বিচার কচ্ছে, এর ভিতর সত্য কি? ঘোড়া তো সত্য নয়, সাজগোজ, অস্ত্রশস্ত্রও সত্য নয়। শেষে সত্য সত্য দেখলে যে সওয়ার একলা দাঁড়িয়ে রয়েছে! কিনা, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা—বিচার করতে গেলে কিছুই টেকে না।”
ডাক্তার—এতে আমার আপত্তি নাই।
[The World (সংসার) and the Scare-Crow]
শ্রীরামকৃষ্ণ—তবে এ-ভ্রম সহজে যায় না। জ্ঞানের পরও থাকে। স্বপনে বাঘকে দেখেছে, স্বপন ভেঙে গেল, তবু বুক দুড়দুড় করছে!
“ক্ষেতে চুরি করতে চোর এসেছে। খড়ের ছবি মানুষের আকার করে রেখে দিয়েছে—ভয় দেখাবার জন্য। চোরেরা কোনও মতে ঢুকতে পারছে না। একজন কাছে গিয়ে দেখলে—খড়ের ছবি। এসে ওদের বললে,—ভয় নাই। তবু ওরা আসতে চায় না—বলে বুক দুড়দুড় করছে। তখন ভূঁয়ে ছবিটাকে শুইয়ে দিলে, আর বলতে লাগল এ-কিছু নয়, এ-কিছু নয়, ‘নেতি’ ‘নেতি’।”
ডাক্তার—এ-সব বেশ কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ! কেমন কথা?
ডাক্তার—বেশ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—একটা ‘Thank you’ দাও।
ডাক্তার—তুমি কি বুঝছো না, মনের ভাব? আর কত কষ্ট করে তোমায় এখানে দেখতে আসছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—না গো, মূর্খের জন্য কিছু বল। বিভীষণ লঙ্কার রাজা হতে চায় নাই—বলেছিল, রাম তোমাকে পেয়েছি আবার রাজা হয়ে কি হবে! রাম বললেন, বিভীষণ, তুমি মূর্খদের জন্য রাজা হও। যারা বলছে, তুমি এত রামের সেবা করলে, তোমার কি ঐশ্বর্য হল? তাদের শিক্ষার জন্য রাজা হও।
ডাক্তার—এখানে তেমন মূর্খ কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—না গো, শাঁকও আছে আবার গেঁড়ি-গুগলিও আছে। (সকলের হাস্য)
৫৩.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – পুরুষ-প্রকৃতি—অধিকারী
ডাক্তার ঠাকুরের জন্য ঔষধ দিলেন—দুটি Globule; বলিতেছেন, এই দুইটি গুলি দিলাম—পুরুষ আর প্রকৃতি। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ, ওরা এক সঙ্গেই থাকে। পায়রাদের দেখ নাই, তফাতে থাকতে পারে না। যেখানে পুরুষ সেখানেই প্রকৃতি, যেখানে প্রকৃতি সেইখানেই পুরুষ।
আজ বিজয়া। ঠাকুর ডাক্তারকে মিষ্টমুখ করিতে বলিলেন। ভক্তেরা মিষ্টান্ন আনিয়া দিতেছেন।
ডাক্তার (খাইতে খাইতে)—খাবার জন্য ‘Thank you’ দিচ্ছি। তুমি যে অমন উপদেশ দিলে, তার জন্য নয়। সে ‘Thank you’ মুখে বলব কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তাঁতে মন রাখা। আর কি বলব? আর একটু একটু ধ্যান করা। (ছোট নরেনকে দেখাইয়া) দেখ দেখ এর মন ঈশ্বরে একেবারে লীন হয়ে যায়। যে-সব কথা তোমায় বলছিলাম।—
ডাক্তার—এদের সব বলো।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যার যা পেটে সয়। ওসব কথা কি সব্বাই লতে পারে? তোমাকে বললাম, সে এক। মা বাড়িতে মাছ এনেছে। সকলের পেট সমান নয়। কারুকে পোলোয়া করে দিলে, কারুকে আবার মাছের ঝোল। পেট ভাল নয়। (সকলের হাস্য)
ডাক্তার চলিয়া গেলেন। আজ বিজয়া। ভক্তেরা সকলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলেন। তত্পরে পরস্পর কোলাকুলি করিতে লাগিলেন। আনন্দের সীমা নাই। ঠাকুরের অত অসুখ, সব ভুলাইয়া দিয়াছেন! প্রেমালিঙ্গন ও মিষ্টমুখ অনেকক্ষণ ধরিয়া হইতেছে। ঠাকুরের কাছে ছোট নরেন, মাস্টার ও আরও দু’চারিটি ভক্ত বসিয়া আছেন। ঠাকুর আনন্দে কথা কহিতেছেন। ডাক্তারের কথা পড়িল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ডাক্তারকে আর বেশি কিছু বলতে হবে না।
“গাছটা কাটা শেষ হয়ে এলে, যে ব্যক্তি কাটে সে একটু সরে দাঁড়ায়। খানিকক্ষণ পরে গাছটা আপনিই পড়ে যায়।”
ছোট নরেন (সহাস্যে)—সবই Principle!
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে)—ডাক্তার অনেক বদলে গেছে না?
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ। এখানে এলে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। কি ঔষধ দিতে হবে আদপেই সে কথা তোলেন না। আমরা মনে করে দিলে তবে বলেন, হাঁ হাঁ ঔষধ দিতে হবে।
বৈঠকখানা ঘরে ভক্তেরা কেহ কেহ গান গাহিতেছিলেন।
ঠাকুর যে ঘরে আছেন, সেই ঘরে তাঁহারা ফিরিয়া আসিলে পর ঠাকুর বলিতেছেন, “তোমরা গান গাচ্ছিলে,—তাল হয় না কেন? কে একজন বেতালসিদ্ধ ছিল—এ তাই!” (সকলের হাস্য)
ছোট নরেনের আত্মীয় ছোকরা আসিয়াছেন। খুব সাজগোজ, আর চক্ষে চশমা। ঠাকুর ছোট নরেনের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখ, এই রাস্তা দিয়ে একজন ছোকরা যাচ্ছিল, প্লেটওলা জামা পরা। চলবার যে ঢঙ। প্লেটটা সামনে রেখে সেইখানটা চাদর খুলে দেয়—আবার এদিক-ওদিক চায়,—কেউ দেখছে কিনা। চলবার সময় কাঁকাল ভাঙা। (সকলের হাস্য) একবার দেখিস না।
“ময়ূর পাখা দেখায়। কিন্তু পাগুলো বড় নোংরা। (সকলের হাস্য) উট বড় কুত্সিত,—তার সব কুত্সিত।”
নরেনের আত্মীয়—কিন্তু আচরণ ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভাল। তবে কাঁটা ঘাস খায়—মুখ দে রক্ত পড়ে, তবুও খাবে! সংসারী, এই ছেলে মরে, আবার ছেলে ছেলে করে!
৫৩.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তসঙ্গে শ্যামপুকুরের বাটীতে আনন্দ ও কথোপকথন
শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশান, ডাক্তার সরকার, গিরিশ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে শ্যামপুকুরের বাটীতে আনন্দ ও কথোপকথন গৃহস্থাশ্রম কথাপ্রসঙ্গে
আশ্বিন শুক্লাচতুর্দশী। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিনদিন মহামায়ার পূজা মহোত্সব হইয়া গিয়াছে। দশমীতে বিজয়া; তদুপলক্ষে পরস্পরের প্রেমালিঙ্গন ব্যাপার সম্পন্ন হইয়াছে। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কলিকাতার অন্তর্বর্তী সেই শ্যামপুকুর নামক পল্লীতে বাস করিতেছেন। শরীরে কঠিন ব্যাধি, গলায় ক্যান্সার। বলরামের বাড়িতে যখন ছিলেন কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ দেখিতে আসিয়াছিলেন। তাঁহাকে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, এ-রোগ সাধ্য না অসাধ্য। কবিরাজ এ প্রশ্নের উত্তর দেন নাই, চুপ করিয়াছিলেন। ইংরেজ ডাক্তারেরাও রোগটি অসাধ্য, এ-কথা ইঙ্গিত করিয়াছিলেন। এক্ষণে ডাক্তার সরকার চিকিত্সা করিতেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার, ২২শে অক্টোবর, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ (৭ই কার্তিক, ১২৯২, শুক্লা চতুর্দশী)। শ্যামপুকুরস্থিত একটি দ্বিতল গৃহমধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ—দুতলা ঘরের মধ্যে শয্যা রচনা হইয়াছে, তাহাতে উপবিষ্ট। ডাক্তার সরকার, শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও ভক্তেরা সম্মুখে এবং চারিদিকে সমাসীন। ঈশান বড় দানী, পেনশন লইয়াও দান করেন, ঋণ করিয়া দান করেন আর সর্বদাই ঈশ্বরচিন্তায় থাকেন। পীড়া শুনিয়া তিনি দেখিতে আসিয়াছেন। ডাক্তার সরকার চিকিত্সা করিতে আসিয়া ছয়-সাত ঘণ্টা করিয়া থাকেন, শ্রীরামকৃষ্ণকে সাতিশয় ভক্তিশ্রদ্ধা করেন ও ভক্তদের সহিত পরম আত্মীয়ের ন্যায় ব্যবহার করেন।
রাত্রি প্রায় ৭টা হইয়াছে। বাহিরে জ্যোত্স্না—পূর্ণাবয়ব নিশানাথ যেন চারিদিকে সুধা ঢালিয়াছেন। ভিতরে দীপালোক, ঘরে অনেক লোক। অনেকে মহাপুরুষ দর্শন করিতে আসিয়াছেন। সকলেই একদৃষ্টে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিয়াছেন। শুনিবেন তিনি কি বলেন ও দেখিবেন তিনি কি করেন। ঈশানকে দেখিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন—
[নির্লিপ্ত সংসারী—নির্লিপ্ত হবার উপায়]
“যে সংসারী ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি রেখে সংসার করে, সে ধন্য, সে বীরপুরুষ! যেমন কারু মাথায় দুমন বোঝা আছে, আর বর যাচ্ছে, মাথায় বোঝা—তবু সে বর দেখছে। খুব শক্তি না থাকলে হয় না। যেমন পাঁকাল মাছ পাঁকে থাকে, কিন্তু গায়ে একটুকুও পাঁক নাই। পানকৌটি জলে সর্বদা ডুব মারে, কিন্তু পাখা একবার ঝাড়া দিলেই আর গায়ে জল থাকে না।
“কিন্তু সংসারে নির্লিপ্তভাবে থাকতে গেলে কিছু সাধন করা চাই। দিনকতক নির্জনে থাকা দরকার; তা একবছর হোক, ছয়মাস হোক তিনমাস হোক বা একমাস হোক। সেই নির্জনে ঈশ্বরচিন্তা করতে হয়। সর্বদা তাঁকে ব্যাকুল হয়ে ভক্তির জন্য প্রার্থনা করতে হয়। আর মনে মনে বলতে হয়, ‘আমার এ-সংসারে কেউ নাই, যাদের আপনার বলি, তারা দুদিনের জন্য। ভগবান আমার একমাত্র আপনার লোক, তিনিই আমার সর্বস্ব; হায়! কেমন করে তাঁকে পাব!’
“ভক্তিলাভের পর সংসার করা যায়। যেমন হাতে তেল মেখে কাঁটাল ভাঙলে হাতে আর আঠা লাগে না। সংসার জলের স্বরূপ আর মানুষের মনটি যেন দুধ। জলে যদি দুধ রাখতে যাও, দুধে-জলে এক হয়ে যাবে। তাই নির্জন স্থানে দই পাততে হয়। দই পেতে মাখন তুলতে হয়। মাখন তুলে যদি জলে রাখ, তাহলে জলে মিশবে না; নির্লিপ্ত হয়ে ভাসতে থাকবে।
“ব্রহ্মজ্ঞানীরা আমায় বলেছিল, মহাশয়! আমাদের জনক রাজার মত। তাঁর মতো নির্লিপ্তভাবে আমরা সংসার করব। আমি বললুম, ‘নির্লিপ্তভাবে সংসার করা বড় কঠিন। মুখে বললেই জনক রাজা হওয়া যায় না। জনক রাজা হেঁটমুণ্ড হয়ে ঊর্ধ্বপদ করে কত তপস্যা করেছিলেন! তোমাদের হেঁটমুণ্ড বা ঊর্ধ্বপদ হতে হবে না, কিন্তু সাধন চাই। নির্জনে বাস চাই! নির্জনে জ্ঞানলাভ, ভক্তিলাভ করে তবে গিয়ে সংসার করতে হয়। দই নির্জনে পাততে হয়। ঠেলাঠেলি নাড়ানাড়ি করলে দই বসে না।’
“জনক নির্লিপ্ত বলে তাঁর একটি নাম বিদেহ;—কিনা, দেহে দেহবুদ্ধি নাই। সংসারে থেকেও জীবন্মুক্ত হয়ে বেড়াতেন। কিন্তু দেহবুদ্ধি যাওয়া অনেক দূরের কথা! খুব সাধন চাই!
“জনক ভারী বীরপুরুষ। দুখানা তরবার ঘুরাতেন। একখানা জ্ঞান একখানা কর্ম।”
[সংসার আশ্রমের জ্ঞান ও সন্ন্যাস আশ্রমের জ্ঞান]
“যদি বল, সংসার আশ্রমের জ্ঞানী আর সন্ন্যাস আশ্রমের জ্ঞানী, এ-দুয়ের তফাত আছে কিনা? তার উত্তর এই যে দুই-ই এক জিনিস। এটিও জ্ঞানী উটিও জ্ঞানী—এক জিনিস। তবে সংসারে জ্ঞানীরও ভয় আছে। কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর থাকতে গেলেই একটু না একটু ভয় আছে। কাজলের ঘরে থাকতে গেলে যত সিয়ানাই হও না কেন কালো দাগ একটু না একটু গায়ে লাগবেই।
“মাখন তুলে যদি নূতন হাঁড়িতে রাখ, মাখন নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে না। যদি ঘোলের হাঁড়িতে রাখ, সন্দেহ হয়। (সকলের হাস্য)
“খই যখন ভাজা হয় দু চারটে খই খোলা থেকে টপ্ টপ্ করে লাফিয়ে পড়ে। সেগুলি যেন মল্লিকা ফুলের মতো, গায়ে একটু দাগ থাকে না। খোলার উপর যে-সব খই থাকে, সেও বেশ খই, তবে অত ফুলের মতো হয় না, একটু গায়ে দাগ থাকে। সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী যদি জ্ঞানলাভ করে, তবে ঠিক এই মল্লিকা ফুলের মতো দাগশূন্য হয়। আর জ্ঞানের পর সংসার খোলায় থাকলে একটু গায়ে লালচে দাগ হতে পারে। (সকলের হাস্য)
“জনক রাজার সভায় একটি ভৈরবী এসেছিল। স্ত্রীলোক দেখে জনক রাজা হেঁটমুখ হয়ে চোখ নিচু করেছিলেন। ভৈরবী তাই দেখে বলেছিলেন, ‘হে জনক, তোমার এখনও স্ত্রীলোক দেখে ভয়!’ পূর্ণজ্ঞান হলে পাঁচ বছরের ছেলের স্বভাব হয়—তখন স্ত্রী-পুরুষ বলে ভেদবুদ্ধি থাকে না।
“যাই হোক যদিও সংসারের জ্ঞানীর গায়ে দাগ থাকতে পারে, সে দাগে কোন ক্ষতি হয় না। চন্দ্রে কলঙ্ক আছে বটে কিন্তু আলোর ব্যাঘাত হয় না।”
[জ্ঞানের পর কর্ম—লোকসংগ্রহার্থ]
“কেউ কেউ জ্ঞানলাভের পর লোকশিক্ষার জন্য কর্ম করে, যেমন জনক ও নারদাদি। লোকশিক্ষার জন্য শক্তি থাকা চাই। ঋষিরা নিজের নিজের জ্ঞানের জন্য ব্যস্ত ছিলেন। নারদাদি আচার্য লোকের হিতের জন্য বিচরণ করে বেড়াতেন। তাঁরা বীরপুরুষ।
“হাবাতে কাঠ যখন ভেসে যায়, পাখি একটি বসলে ডুবে যায়, কিন্তু বাহাদুরী কাঠ যখন ভেসে যায়, তখন গরু, মানুষ, এমন কি হাতি পর্যন্ত তার উপর যেতে পারে। স্টীমবোট আপনিও পারে যায়, আবার কত মানুষকে পার করে দেয়।
“নারদাদি আচার্য বাহাদুরী কাঠের মতো, স্টীমবোট-এর মতো।
“কেউ খেয়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছে বসে থাকে, পাছে কেউ টের পায়। (সকলের হাস্য) আবার কেউ কেউ একটি আম পেলে কেটে একটু একটু সকলকে দেয়, আর আপনিও খায়।
“নারদাদি আচার্য সকলের মঙ্গলের জন্য জ্ঞানলাভের পরও ভক্তি লয়ে ছিলেন।”
৫৩.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – যুগধর্ম কথাপ্রসঙ্গে—জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ
ডাক্তার—জ্ঞানে মানুষ অবাক্ হয়, চক্ষু বুজে যায়, আর চক্ষে জল আসে। তখন ভক্তি দরকার হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভক্তি মেয়েমানুষ, তাই অন্তঃপুর পর্যন্ত যেতে পারে। জ্ঞান বারবাড়ি পর্যন্ত যায়। (সকলের হাস্য)
ডাক্তার—কিন্তু অন্তঃপুরে যাকে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বেশ্যারা ঢুকতে পারে না। জ্ঞান চাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঠিক পথ জানে না, কিন্তু ঈশ্বরে ভক্তি আছে, তাঁকে জানবার ইচ্ছা আছে—এরূপ লোক কেবল ভক্তির জোরে ঈশ্বরলাভ করে। একজন ভারী ভক্ত জগন্নাথদর্শন করতে বেরিয়েছিল। পুরীর কোন্ পথ সে জানত না, দক্ষিণদিকে না গিয়ে পশ্চিমদিকে গিছিল। পথ ভুলেছিল বটে, কিন্তু ব্যাকুল হয়ে লোকদের জিজ্ঞাসা করত। তারা বলে দিলে, ‘এ পথ নয়, ওই পথে যাও।’ ভক্তটি শেষে পুরীতে গিয়ে জগন্নাথদর্শন করলে। দেখ, না জানলেও কেউ না কেউ বলে দেয়।
ডাক্তার—সে ভুলে তো গিছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, তা হয় বটে, কিন্তু শেষে পায়।
একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ঈশ্বর সাকার না নিরাকার।’
শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি সাকার আবার নিরাকার। একজন সন্ন্যাসী জগন্নাথদর্শন করতে গিছিল। জগন্নাথদর্শন করে সন্দেহ হল ঈশ্বর সাকার না নিরাকার। হাতে দণ্ড ছিল, সেই দণ্ড দিয়ে দেখতে লাগল, জগন্নাথের গায়ে ঠেকে কিনা। একবার এ-ধার থেকে ও-ধারে দণ্ডটি নিয়ে যাবার সময় দেখলে যে, জগন্নাথের গায়ে ঠেকল না—দেখে যে সেখানে ঠাকুরের মূর্তি নাই। আবার দণ্ড এ-ধার থেকে ও-ধারে লয়ে যাবার সময় বিগ্রহের গায়ে ঠেকল; তখন সন্ন্যাসী বুঝলে যে ঈশ্বর নিরাকার, আবার সাকার।
“কিন্তু এটি ধারণা করা বড় শক্ত। যিনি নিরাকার, তিনি আবার সাকার কিরূপে হবেন? এ-সন্দেহ মনে উঠে। আবার যদি সাকার হন, তো নানারূপ কেন?”
ডাক্তার—যিনি আকার করেছেন, তিনি সাকার। তিনি আবার মন করেছেন, তাই তিনি নিরাকার। তিনি সবই হতে পারেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঈশ্বরকে লাভ না করতে পারলে, এ-সব বুঝা যায় না। সাধকের জন্য তিনি নানাভাবে নানারূপে দেখা দেন। একজনের এক গামলা রঙ ছিল। অনেকে তার কাছে কাপড় রঙ করাতে আসত। সে লোকটি জিজ্ঞাসা করত, তুমি কি রঙে ছোপাতে চাও। একজন হয়তো বললে, ‘আমি লাল রঙে ছোপাতে চাই।’ অমনি সেই লোকটি গামলার রঙে সেই কাপড়খানি ছুপিয়ে বলত, ‘এই লও, তোমার লাল রঙে ছোপানো কাপড়।’ আর-একজন হয়তো বললে, ‘আমার হলদে রঙে ছোপানো চাই।’ অমনি সেই লোকটি সেই গামলায় কাপড়খানি ডুবিয়ে বলত, ‘এই লও তোমার হলদে রঙ।’ নীল রঙে ছোপাতে চাইলে আবার সেই একই গামলায় ডুবিয়ে সেই কথা, ‘এই লও তোমার নীল রঙে ছোপানো কাপড়।’ এইরকমে যে যে রঙে ছোপাতে চাইত, তার কাপড় সেই রঙে সেই একই গামলা হতে ছোপানো হত। একজন লোক এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখছিল। যার গামলা, সে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কেমন হে! তোমার কি রঙে ছোপাতে হবে?’ তখন সে বললে, ‘ভাই! তুমি যে রঙে রঙেছ, আমায় সেই রঙ দাও!’ (সকলের হাস্য)
“একজন বাহ্যে গিছিল—দেখলে, গাছের উপর একটি সুন্দর জানোয়ার রয়েছে। সে ক্রমে আর একজনকে বললে, ‘ভাই! অমুক গাছে আমি একটি লাল রঙের জানোয়ার দেখে এলুম।’ সে লোকটি বললে, ‘আমিও দেখেছি, তা সে লাল রঙ হতে যাবে কেন? সে যে সবুজ রঙ।’ আর একজন বললে, না, না; সে সবুজ হতে যাবে কেন, কালো ইত্যাদি। শেষে ঝগড়া। তখন তারা গাছতলায় গিয়ে দেখে একজন লোক বসে। জিজ্ঞাসা করায়, সে বললে, ‘আমি এই গাছতলায় থাকি, আমি সে জানোয়ারটিকে বেশ জানি। তোমরা যা যা বলছো সব সত্য, সে কখনও লাল, কখনও সবুজ, কখনও হলদে, কখনও নীল, আরও সব কত কি হয়। আবার কখনও দেখি কোন রঙই নাই!’
“যে ব্যক্তি সদাসর্বদা ঈশ্বরচিন্তা করে, সেই জানতে পারে, তাঁর স্বরূপ কি। সে ব্যক্তিই জানে যে ঈশ্বর নানারূপে দেখা দেন। নানাভাবে দেখা দেন। তিনি সগুণ আবার নির্গুণ। গাছতলায় যে থাকে সেই জানে যে, বহুরূপীর নানারঙ, আবার কখন কখন কোন রঙই থাকে না। অন্য লোকে কেবল তর্ক ঝগড়া করে কষ্ট পায়।
“তিনি সাকার, তিনি নিরাকার। কিরকম জানো? যেন সচ্চিদানন্দ-সমুদ্র। কূল-কিনারা নাই। ভক্তিহিমে সেই সমুদ্রের স্থানে স্থানে জল বরফ হয়ে যায়, যেন জল বরফ আকারে জমাট বাঁধে; অর্থাৎ ভক্তের কাছে তিনি সাক্ষাৎ হয়ে কখন কখন সাকাররূপ হয়ে দেখা দেন। আবার জ্ঞানসূর্য উঠলে সে বরফ গলে যায়।”
ডাক্তার—সূর্য উঠলে বরফ গলে জল হয়; আবার জানেন, জল আবার নিরাকার বাষ্প হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—অর্থাৎ ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’ এই বিচারের পর সমাধি হলে রূপ-টুপ উড়ে যায়। তখন আর ঈশ্বরকে ব্যক্তি (Person) বলে বোধ হয় না। কি তিনি মুখে বলা যায় না। কে বলবে? যিনি বলবেন তিনিই নাই। তিনি তাঁর ‘আমি’ আর খুঁজে পান না। তখন ব্রহ্ম নির্গুণ (Absolute)। তখন তিনি কেবল বোধে বোধ হন। মন-বুদ্ধি দ্বারা তাঁকে ধরা যায় না। (Unknown and Unknowable)
“তাই বলে, ভক্তি—চন্দ্র; জ্ঞান—সূর্য। শুনেছি, খুব উত্তরে আর দক্ষিণে সমুদ্র আছে। এত ঠাণ্ডা যে, জল জমে মাঝে মাঝে বরফের চাঁই হয়। জাহাজ চলে না। সেখানে গিয়ে আটকে যায়।”
ডাক্তার—ভক্তিপথে মানুষ আটকে যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, তা যায় বটে, কিন্তু তাতে হানি হয় না, সেই সচ্চিদানন্দ-সাগরের জলই জমাট বেঁধে বরফ হয়েছে। যদি আরও বিচার করতে চাও, যদি ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ এই বিচার কর, তাতেও ক্ষতি নাই। জ্ঞানসূর্যেই বরফ গলে যাবে; তবে সেই সচ্চিদানন্দ-সাগরই রইল।
[কাঁচা আমি ও পাকা আমি—ভক্তের আমি—বালকের আমি]
“জ্ঞানবিচারের শেষে সমাধি হলে, আমি-টামি কিছু থাকে না। কিন্তু সমাধি হওয়া বড় কঠিন। ‘আমি’ কোন মতে যেতে চায় না। আর যেতে চায় না বলে, ফিরে এই সংসারে আসতে হয়।
“গরু হাম্বা হাম্বা (আমি, আমি) করে তাই এত দুঃখ! সমস্ত দিন লাঙল দিতে হয়—গ্রীষ্ম নাই, বর্ষা নাই। কিম্বা তাকে কসাইয়ে কাটে। তাতেও নিস্তার নাই। চামারে চামড়া করে, জুতা তৈয়ারি করে। অবশেষে নাড়ীভুঁড়ি থেকে তাঁত হয়। ধুনুরীর হাতে পড়ে যখন তুঁহু তুঁহু (তুমি তুমি) করে, তখন নিস্তার হয়।
“যখন জীব বলে, ‘নাহং’ ‘নাহং’ ‘নাহং’ আমি কেহ নই, হে ঈশ্বর! তুমি কর্তা; আমি দাস তুমি প্রভু—তখন নিস্তার; তখনই মুক্তি।”
ডাক্তার—কিন্তু ধুনুরীর হাতে পড়া চাই। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ—যদি একান্ত ‘আমি’ না যাস, থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে। (সকলের হাস্য)
“সমাধির পর কাহারও কাহারও ‘আমি’ থাকে—‘দাস আমি’, ‘ভক্তের আমি’। শঙ্করাচার্য ‘বিদ্যার আমি’ লোকশিক্ষার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। ‘দাস আমি’, ‘বিদ্যার আমি’, ‘ভক্তের আমি’—এরই নাম ‘পাকা আমি’। কাঁচা আমি কি জান? আমি কর্তা, আমি এত বড়লোকের ছেলে, বিদ্বান, আমি ধনবান আমাকে এমন কথা বলে!—এই সব ভাব। যদি কেউ বাড়িতে চুরি করে, তাকে যদি ধরতে পারে, প্রথমে সব জিনিসপত্র কেড়ে লয়; তারপর উত্তম-মধ্যম মারে, তারপর পুলিসে দেয়! বলে, ‘কি! জানে না, কার চুরি করেছে!’
“ঈশ্বরলাভ হলে পাঁচ বছরের বালকের স্বভাব হয়। ‘বালকের আমি’ আর ‘পাকা আমি’। বালক কোন গুণের বশ নয়। ত্রিগুণাতীত। সত্ত্ব রজঃ তমঃ কোন গুণের বশ নয়। দেখ, ছেলে তমোগুণের বশ নয়। এইমাত্র ঝগড়া মারামারি করলে, আবার তত্ক্ষণাৎ তারই গলা ধরে কত ভাব, কত খেলা! রজোগুণেরও বশ নয়। এই খেলাঘর পাতলে কত বন্দোবস্ত, কিছুক্ষণ পরেই সব পড়ে রইল; মার কাছে ছুটেছে। হয়তো একখানি সুন্দর কাপড় পরে বেড়াচ্ছে। খানিকক্ষণ পরে কাপড় খুলে পড়ে গেছে। হয় কাপড়ের কথা একেবারে ভুলে গেল—নয় বগলদাবা করে বেড়াচ্ছে! (হাস্য)
“যদি ছেলেটিকে বল, ‘বেশ কাপড়খানি, কার কাপড় রে?’ সে বলে, ‘আমার কাপড়, আমার বাবা দিয়েছে।’ যদি বল, ‘লক্ষ্মী ছেলে, আমায় কাপড়খানি দাও না।’ সে বলে, ‘না, আমার কাপড়, আমার বাবা দিয়েছে, না আমি দেবো না।’ তারপর ভুলিয়ে একটি পুতুল কি আর একটি বাঁশি যদি হাতে দাও তাহলে পাঁচটাকা দামের কাপড়খানা তোমায় দিয়ে চলে যাবে। আবার পাঁচ বছরের ছেলের সত্ত্বগুণেরও আঁট নাই। এই পাড়ার খেলুড়েদের সঙ্গে কত ভালবাসা, একদণ্ড না দেখলে থাকতে পারে না। কিন্তু বাপ-মার সঙ্গে যখন অন্য জায়গায় চলে গেল, তখন নূতন খেলুড়ে হল। তাদের উপর তখন সব ভালবাসা পড়ল; পুরানো খেলুড়েদের একেবারে ভুলে গেল। তারপর জাত অভিমান নাই। মা বলে দিয়েছে, ও তোর দাদা হয়, তা সে ষোল আনা জানে যে, এ আমার ঠিক দাদা। তা একজন যদি বামুনের ছেলে হয় আর-একজন যদি কামারের ছেলে হয়, তো একপাতে বসে ভাত খাবে। আর শুচি-অশুচি নাই, হেগোপোঁদে খাবে! আবার লোকলজ্জা নাই, ছোঁচাবার পর যাকে-তাকে পেছন ফিরে বলে—দেখ দেখি, আমার ছোঁচানো হয়েছে কি না?
“আবার, ‘বুড়োর আমি’ আছে। (ডাক্তারের হাস্য) বুড়োর অনেকগুলি পাশ। জাতি, অভিমান, লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, বিষয়বুদ্ধি, পাটোয়ারী, কপটতা। যদি কারুর উপর আকোছ হয়, তো সহজে যায় না—হয়তো যতদিন বাঁচে ততদিন যায় না। তারপর পাণ্ডিত্যের অহংকার, ধনের অহংকার। ‘বুড়োর আমি’ কাঁচা আমি।”
[জ্ঞান কাহাদের হয় না]
(ডাক্তারের প্রতি)—“চার-পাঁচজনের জ্ঞান হয় না। যার বিদ্যার অহংকার, যার পাণ্ডিত্যের অহংকার, যার ধনের অহংকার, তার জ্ঞান হয় না। এ সব লোককে যদি বলা যায় যে, অমুক জায়গায় বেশ একটি সাধু আছে, দেখতে যাবে? তারা অমনি নানা ওজর করে বলে, যাব না। আর মনে মনে বলে, আমি এত বড় লোক, আমি যাব?”
[তিনগুণ—সত্ত্বগুণে ঈশ্বরলাভ—ইন্দ্রিয় সংযমের উপায়]
“তমোগুণের স্বভাব অহংকার। অহংকার অজ্ঞান, তমোগুণ থেকে হয়।
“পুরাণে আছে রাবণের রজোগুণ, কুম্ভকর্ণের তমোগুণ, বিভীষণের সত্ত্বগুণ। তাই বিভীষণ রামচন্দ্রকে লাভ করেছিলেন। তমোগুণের আর একটি লক্ষণ—ক্রোধ। ক্রোধে দিক-বিদিক জ্ঞান থাকে না; হনুমান লঙ্কা পুড়ালেন, এ-জ্ঞান নাই যে সীতার কুটির নষ্ট হবে।
“আবার তমোগুণের আর একটি লক্ষণ—কাম। পাথুরেঘাটার গিরীন্দ্র ঘোষ বলেছিল, কাম-ক্রোধাদি রিপু এরা তো যাবে না, এদের মোড় ফিরিয়ে দাও। ঈশ্বরের কামনা কর। সচ্চিদানন্দের সহিত রমণ কর। ক্রোধ যদি না যায়, ভক্তির তমঃ আন। কি! আমি দুর্গানাম করেছি, উদ্ধার হব না? আমার আবার পাপ কি? বন্ধন কি? তারপর ঈশ্বরলাভ করবার লোভ কর। ঈশ্বরের রূপে মুগ্ধ হও। আমি ঈশ্বরের দাস, আমি ঈশ্বরের ছেলে, যদি অহংকার করতে হয়, তো এই অহংকার কর। এইরকমে ছয় রিপুর মোড় ফিরিয়ে দিতে হয়।”
ডাক্তার—ইন্দ্রিয়সংযম করা বড় শক্ত। ঘোড়ার চক্ষের দুদিকে ঠুলি দাও। কোন কোন ঘোড়ার চক্ষু একেবারে বন্ধ করতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁর যদি একবার কৃপা হয়, ঈশ্বরের যদি একবার দর্শনলাভ হয়, আত্মার যদি একবার সাক্ষাত্কার হয়, তাহলে আর কোন ভয় নাই—তখন ছয় রিপু আর কিছু করতে পারবে না।
“নারদ, প্রহ্লাদ এই সব নিত্যসিদ্ধ মহাপুরুষদের অত করে চক্ষের দুদিকে ঠুলি দিতে হয় না। যে ছেলে নিজে বাপের হাত ধরে মাঠের আলপথে চলছে সে ছেলে বরং অসাবধান হয়ে বাপের হাত ছেড়ে দিয়ে খানায় পড়তে পারে। কিন্তু বাপ যে ছেলের হাত ধরে, সে কখনও খানায় পড়ে না।”
ডাক্তার—কিন্তু বাপ ছেলের হাত ধরা ভাল নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা নয়। মহাপুরুষদের বালক স্বভাব। ঈশ্বরের কাছে তারা সর্বদাই বালক, তাদের অহংকার থাকে না। তাদের সব শক্তি ঈশ্বরের শক্তি, বাপের শক্তি, নিজের কিছুই নয়। এইটি তাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
[বিচারপথ ও আনন্দপথ—জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ]
ডাক্তার—আগে ঘোড়ার চক্ষের দুইদিকে ঠুলি না দিলে, ঘোড়া কি এগুতে চায়? রিপু বশ না হলে কি ঈশ্বরকে পাওয়া যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি যা বলছো, ওকে বিচারপথ বলে—জ্ঞানযোগ বলে। ও-পথেও ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। জ্ঞানীরা বলে, আগে চিত্তশুদ্ধি হওয়া দরকার। আগে সাধন চাই, তবে জ্ঞান হবে।
“ভক্তিপথেও তাঁকে পাওয়া যায়। যদি ঈশ্বরের পাদপদ্মে একবার ভক্তি হয়, যদি তাঁর নামগুণগান করতে ভাল লাগে, ইন্দ্রিয় সংযম আর চেষ্টা করে করতে হয় না। রিপুবশ আপনা-আপনি হয়ে যায়।
“যদি কারও পুত্রশোক হয়, সেদিন সে কি আর লোকের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে, না, নিমন্ত্রণে গিয়ে খেতে পারে? সে কি লোকের সামনে অহংকার করে বেড়াতে পারে, না, সুখ-সম্ভোগ করতে পারে?
“বাদুলে পোকা যদি একবার আলো দেখতে পায়, তাহলে কি সে আর অন্ধকারে থাকে?”
ডাক্তার (সহাস্যে)—তা পুড়েই মরুক সেও স্বীকার।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না গো! ভক্ত কিন্তু বাদুলে পোকার মতো পুড়ে মরে না। ভক্ত যে আলো দেখে ছুটে যায়, সে যে মণির আলো! মণির আলো খুব উজ্জ্বল বটে, কিন্তু স্নিগ্ধ আর শীতল। এ-আলোতে গা পুড়ে না, এ-আলোতে শান্তি হয়, আনন্দ হয়।
[জ্ঞানযোগ বড় কঠিন]
“বিচারপথে জ্ঞানযোগের পথে, তাঁকে পাওয়া যায়। কিন্তু এ-পথ বড় কঠিন। আমি শরীর নই, মন নই, বুদ্ধি নই। আমার রোগ নাই, শোক নাই, অশান্তি নাই; আমি সচ্চিদানন্দস্বরূপ, আমি সুখ-দুঃখের অতীত, আমি ইন্দ্রিয়ের বশ নই, এ-সব কথা মুখে বলা খুব সোজা। কাজে করা, ধারণা হওয়া বড় কঠিন। কাঁটাতে হাত কেটে যাচ্ছে, দরদর করে রক্ত পড়ছে, অথচ বলছি, কই কাঁটায় আমার হাত কাটে নাই, আমি বেশ আছি। এ-সব বলা সাজে না। আগে ওই কাঁটাকে জ্ঞানাগ্নিতে পোড়াতে হবে তো।”
[বইপড়া জ্ঞান বা পাণ্ডিত্য—ঠাকুরের শিক্ষাপ্রণালী]
“অনেকে মনে করে, বই না পড়ে বুঝি জ্ঞান হয় না, বিদ্যা হয় না। কিন্তু পড়ার চেয়ে শুনা ভাল, শুনার চেয়ে দেখা ভাল। কাশীর বিষয় পড়া, কাশীর বিষয় শুনা, আর কাশীদর্শন অনেক তফাত।
“আবার যারা নিজে সতরঞ্চ খেলে, তারা চাল তত বুঝে না, কিন্তু যারা না খেলে, উপর চাল বলে দেয়, তাদের চাল ওদের চেয়ে অনেকটা ঠিক ঠিক হয়। সংসারী লোক মনে করে, আমরা বড় বুদ্ধিমান কিন্তু তারা বিষয়াসক্ত। নিজে খেলছে। নিজেদের চাল ঠিক বুঝতে পারে না। কিন্তু সংসারত্যাগী সাধুলোক বিষয়ে অনাসক্ত। তারা সংসারীদের চেয়ে বুদ্ধিমান। নিজে খেলে না, তাই উপর চাল ঠিক বলে দিতে পারে।”
ডাক্তার (ভক্তদিগের প্রতি)—বই পড়লে এ-ব্যক্তির (পরমহংসদেবের) এত জ্ঞান হত না। Faraday communed with Nature. প্রকৃতিকে ফ্যারাডে নিজে দর্শন করত, তাই অত Scientific truth discover করতে পেরেছিল। বই পড়ে বিদ্যা হলে অত হত না। Mathematical formulae only throw the brain into confusion—Original inquiry-র পথে বড় বিঘ্ন এনে দেয়।
[ঈশ্বর-প্রদত্ত জ্ঞান—Divine wisdom and Book learning]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—যখন পঞ্চবটীতে মাটিতে পড়ে পড়ে মাকে ডাকতুম, আমি মাকে বলেছিলাম, মা, আমায় দেখিয়ে দাও কর্মীরা কর্ম করে যা পেয়েছে, যোগীরা যোগ করে যা দেখেছে, জ্ঞানীরা বিচার করে যা জেনেছে। আরও কত কি তা কি বলব!
“আহা! কি অবস্থাই গেছে! ঘুম যায়!”
এই বলিয়া পরমহংসদেব গান করিয়া বলিতে লাগিলেন—
“ঘুম ভেঙেছে আর কি ঘুমাই, যোগে-যাগে জেগে আছি।
এখন যোগনিদ্রা তোরে দিয়ে মা, ঘুমেরে ঘুম পাড়ায়েছি!
“আমি তো বই-টই কিছুই পড়িনি, কিন্তু দেখ মার নাম করি বলে আমায় সবাই মানে। শম্ভু মল্লিক আমায় বলেছিল, ঢাল নাই, তরোয়াল নাই, শান্তিরাম সিং?” (সকলের হাস্য)
শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষের বুদ্ধদেবচরিত অভিনয় কথা হইতে লাগিল। তিনি ডাক্তারকে নিমন্ত্রণ করিয়া ওই অভিনয় দেখাইয়াছিলেন। ডাক্তার উহা দেখিয়া যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছিলেন।
ডাক্তার (গিরিশের প্রতি)—তুমি বড় বদলোক! আমায় রোজ থিয়েটারে যেতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—কি বলছে, আমি বুঝতে পারছি না।
মাস্টার—ওঁর থিয়েটার বড় ভাল লেগেছে।
৫৩.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – অবতারকথাপ্রসঙ্গে—অবতার ও জীব
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি)—তুমি কিছু বল না; এ (ডাক্তার) অবতার মানছে না।
ঈশান—আজ্ঞা, কি আর বিচার করব। বিচার আর ভাল লাগে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত হইয়া)—কেন? সঙ্গত কথা বলবে না?
ঈশান (ডাক্তারের প্রতি)—অহংকারের দরুন আমাদের বিশ্বাস কম। কাকভূষণ্ডী রামচন্দ্রকে প্রথমে অবতার বলে মানে নাই। শেষে যখন চন্দ্রলোক, দেবলোক, কৈলাস ভ্রমণ করে দেখলে যে রামের হাত থেকে কোনরূপেই নিস্তার নাই, তখন নিজে ধরা দিলে, রামের শরণাগত হল। রাম তখন তাকে ধরে মুখের ভিতর নিয়ে গিলে ফেললেন। ভূষণ্ডী তখন দেখে যে, সে তার গাছে বসে রয়েছে। অহংকার চূর্ণ হলে কাকভূষণ্ডী জানতে পারলে যে, রামচন্দ্র দেখতে আমাদের মতো মানুষ বটে, কিন্তু তাঁরই উদরে ব্রহ্মাণ্ড। তাঁরই উদরের ভিতর আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, সমুদ্র, পর্বত, জীব, জন্তু, গাছ ইত্যদি।
[জীবের ক্ষুদ্র বুদ্ধি—Limited Powers of the conditioned]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—ওইটুকু বুঝা শক্ত, তিনিই স্বরাট তিনিই বিরাট। যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা। তিনি মানুষ হতে পারেন না, এ-কথা জোর করে আমরা ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কি বলতে পারি? আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এ-সব কথা কি ধারণা হতে পারে? একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে?
“তাই সাধু মহাত্মা যাঁরা ঈশ্বরলাভ করেছেন, তাঁদের কথা বিশ্বাস করতে হয়। সাধুরা ঈশ্বরচিন্তা লয়ে থাকেন, যেমন উকিলরা মোকদ্দমা লয়ে থাকে। তোমার কাকভূষণ্ডীর কথা কি বিশ্বাস হয়?”
ডাক্তার—যেটুকু ভাল, বিশ্বাস করলুম। ধরা দিলেই চুকে যায়, কোন গোল থাকে না। রামকে অবতার কেমন করে বলি? প্রথমে দেখ বালীবধ। লুকিয়ে চোরের মত বাণ মেরে তাকে মেরে ফেলা হলো। এ তো মানুষের কাজ, ঈশ্বরের নয়।
গিরিশ ঘোষ—মহাশয়, এ-কাজ ঈশ্বরই পারেন।
ডাক্তার—তারপর দেখ সীতাবর্জন।
গিরিশ—মহাশয়, এ-কাজও ঈশ্বরই পারেন, মানুষ পারে না।
[সায়েন্স—না মহাপুরুষের বাক্য?]
ঈশান (ডাক্তারের প্রতি)—আপনি অবতার মানছেন না কেন? এই বললেন, যিনি আকার করেছেন তিনি সাকার, যিনি মন করেছেন তিনি নিরাকার। এই আপনি বললেন, ঈশ্বরের কাণ্ড সব হতে পারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—ঈশ্বর অবতার হতে পারেন, এ-কথা যে ওঁর সায়েন্স-এ (ইংরাজী বিজ্ঞানশাস্ত্রে) নাই! তবে কেমন করে বিশ্বাস হয়? (সকলের হাস্য)
“একটা গল্প শোন—একজন এসে বললে, ওহে! ও-পাড়ায় দেখে এলুম অমুকের বাড়ি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গেছে। যাকে ও-কথা বললে, সে ইংরাজী লেখা-পড়া জানে। সে বললে দাঁড়াও, একবার খপরের কাগজখানা দেখি। খপরের কাগজ পড়ে দেখে যে, বাড়ি ভাঙার কথা কিছুই নাই। তখন সে ব্যক্তি বললে, ওহে তোমার কথায় আমি বিশ্বাস করি না। কই, বাড়ি ভাঙার কথা তো খপরের কাগজে লেখা নাই। ও-সব মিছে কথা।” (সকলের হাস্য)
গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি)—আপনার শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মানতে হবে। আপনাকে মানুষ মানতে দেব না। বলতে হবে Demon or God (হয় শয়তান, নয় ঈশ্বর)।
[সরলতা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস]
শ্রীরামকৃষ্ণ—সরল না হলে ঈশ্বরে চট করে বিশ্বাস হয় না। বিষয়বুদ্ধি থেকে ঈশ্বর অনেক দূর। বিষয়বুদ্ধি থাকলে নানা সংশয় উপস্থিত হয়, আর নানারকম অহংকার এসে পড়ে—পাণ্ডিত্যের অহংকার, ধনের অহংকার—এই সব। ইনি (ডাক্তার) কিন্তু সরল।
গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি)—মহাশয়! কি বলেন? কুরুটের কি জ্ঞান হয়?
ডাক্তার—রাম বলো! তাও কখন হয়!
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেশব সেন কি সরল ছিল! একদিন ওখানে (রাসমণির কালীবাড়িতে) গিছিল। অতিথিশালা দেখে বেলা চারটের সময় বলে, হাঁগা অতিথি-কাঙালদের কখন খাওয়া হবে?
“বিশ্বাস যত বাড়বে, জ্ঞানও তত বাড়বে। যে গরু বেছে বেছে খায় সে ছিড়িক ছিড়িক করে দুধ দেয়। যে গরু শাকপাতা, খোসা, ভুষি, যা দাও, গবগব করে খায়, সে গরু হুড়হুড় করে দুধ দেয়। (সকলের হাস্য)
“বালকের মতো বিশ্বাস না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। মা বলেছেন, ‘ও তোর দাদা’, বালকের অমনি বিশ্বাস যে, ও আমার ষোল আনা দাদা। মা বলেছেন, ‘জুজু আছে।’ ষোল আনা বিশ্বাস যে, ও-ঘরে জুজু আছে। এইরূপ বালকের ন্যায় বিশ্বাস দেখলে ঈশ্বরের দয়া হয়। সংসার বুদ্ধিতে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।”
ডাক্তার (ভক্তদের প্রতি)—গরুর কিন্তু যা তা খেয়ে খুব দুধ হওয়া ভাল নয়। আমার একটা গরুকে ওইরকম যা তা খেতে দিত। শেষে আমার ভারী ব্যারাম। তখন ভাবলুম, এর কারণ কি? অনেক অনুসন্ধান করে টের পেলুম, গরু খুদ ও আরও কি কি খেয়েছিল। তখন মহা মুশকিল! লখনউ যেতে হল। শেষে বার হাজার টাকা খরচ! (সকলের হো-হো করিয়া হাস্য)
“কিসে কি হয় বলা যায় না। পাকপাড়ার বাবুদের বাড়িতে সাত মাসের মেয়ের অসুখ করেছিল—ঘুঙরী কাশি (Whooping Cough)—আমি দেখতে গিছিলাম। কিছুতেই অসুখের কারণ ঠিক করতে পারি নাই। শেষে জানতে পারলুম, গাধা ভিজেছিল, যে গাধার দুধ সে মেয়েটি খেত।” (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি বলে গো! তেঁতুলতলায় আমার গাড়ি গিছিল, তাই আমার অম্বল হয়েছে! (ডাক্তার ও সকলের হাস্য)
ডাক্তার (হাসিতে হাসিতে)—জাহাজের ক্যাপ্তেনের বড় মাথা ধরেছিল। তা ডাক্তারেরা পরামর্শ করে জাহাজের গায়ে বেলেস্তারা (blister) লাগিয়ে দিল। (সকলের হাস্য)
[সাধুসঙ্গ ও ভোগবিলাস ত্যাগ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—সাধুসঙ্গ সর্বদাই দরকার। রোগ লেগেই আছে। সাধুরা যা বলেন, সেইরূপ করতে হয়। শুধু শুনলে কি হবে? ঔষধ খেতে হবে, আবার আহারের কটকেনা করতে হবে। পথ্যের দরকার।
ডাক্তার—পথ্যতেই সারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বৈদ্য তিনপ্রকার—উত্তম বৈদ্য, মধ্যম বৈদ্য, অধম বৈদ্য। যে বৈদ্য এসে নাড়ী টিপে ‘ঔষধ খেও হে’ এই কথা বলে চলে যায়, সে অধম বৈদ্য—রোগী খেলে কিনা, এ-খবর সে লয় না। আর যে বৈদ্য রোগীকে ঔষধ খেতে অনেক করে বুঝায়, মিষ্ট কথাতে বলে, ‘ওহে ঔষধ না খেলে কেমন করে ভাল হবে? লক্ষ্মীটি খাও, আমি নিজে ঔষধ মেড়ে দিচ্ছি খাও’, সে মধ্যম বৈদ্য। আর যে বৈদ্য রোগী কোন মতে খেলে না দেখে, বুকে হাঁটু দিয়ে জোর করে ঔষধ খাইয়ে দেয়, সে উত্তম বৈদ্য।
ডাক্তার—আবার এমন ঔষধ আছে, যাতে বুকে হাঁটু দিতে হয় না। যেমন হোমিওপ্যাথিক।
শ্রীরামকৃষ্ণ—উত্তম বৈদ্য বুকে হাঁটু দিলে কোন ভয় নাই।
“বৈদ্যের মতো আচার্যও তিনপ্রকার। যিনি ধর্ম উপদেশ দিয়ে শিষ্যদের আর কোন খবর লন না, তিনি অধম আচার্য। যিনি শিষ্যদের মঙ্গলের জন্য তাদের বারবার বুঝান, যাতে উপদেশগুলি ধারণা করতে পারে, অনেক অনুনয় বিনয় করেন, ভালবাসা দেখান—তিনি মধ্যম আচার্য। আর যখন শিষ্যেরা কোনও মতে শুনছে না দেখে, কোনও আচার্য জোর পর্যন্ত করেন, তাঁকে বলি উত্তম আচার্য।”
[স্ত্রীলোক ও সন্ন্যাসী—সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম]
(ডাক্তারের প্রতি)—“সন্ন্যাসীর পক্ষে কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ। স্ত্রীলোকের পট পর্যন্ত সন্ন্যাসী দেখবে না। স্ত্রীলোক কিরূপ জান? যেমন আচার তেঁতুল। মনে করলে, মুখে জল সরে। আচার তেঁতুল সম্মুখে আনতে হয় না।
“কিন্তু এ-কথা আপনাদের পক্ষে নয়,—এ সন্ন্যাসীর পক্ষে। আপনারা যতদূর পার স্ত্রীলোকের সঙ্গে অনাসক্ত হয়ে থাকবে। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তা করবে। সেখানে যেন ওরা কেউ না থাকে। ঈশ্বরেতে বিশ্বাস ভক্তি এলে, অনেকটা অনাসক্ত হয়ে থাকতে পারবে। দুই-একটি ছেলে হলে স্ত্রী-পুরুষ দুইজনে ভাই-বোনের মতো থাকবে, আর ঈশ্বরকে সর্বদা প্রার্থনা করবে, যাতে ইন্দ্রিয় সুখেতে মন না যায়,—ছেলেপুলে আর না হয়।”
গিরিশ (সহাস্যে, ডাক্তারের প্রতি)—আপনি এখানে তিন-চার ঘণ্টা রয়েছেন; কই, রোগীদের চিকিত্সা করতে যাবেন না?
ডাক্তার—আর ডাক্তারী আর রোগী! যে পরমহংস হয়েছে, আমার সব গেল! (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখ কর্মনাশা বলে একটি নদী আছে। সে নদীতে ডুব দেওয়া এক মহাবিপদ। কর্মনাশ হয়ে যায়—সে ব্যক্তি আর কোন কর্ম করতে পারে না। (ডাক্তারের ও সকলের হাস্য)
ডাক্তার (মাস্টার, গিরিশ ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি)—দেখ, আমি তোমাদেরই রইলুম। ব্যারামের জন্য যদি মনে কর, তাহলে নয়। তবে আপনার লোক বলে যদি মনে কর, তাহলে আমি তোমাদের।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—একটি আছে অহৈতুকী ভক্তি। এটি যদি হয়, তাহলে খুব ভাল। প্রহ্লাদের অহৈতুকী ভক্তি ছিল। সেরূপ ভক্ত বলে, হে ঈশ্বর! আমি ধন, মান, দেহসুখ, এ-সব কিছুই চাই না। এই কর যেন তোমার পাদপদ্মে আমার শুদ্ধাভক্তি হয়।
ডাক্তার—হাঁ, কালীতলায় লোকে প্রণাম করে থাকে দেখেছি; ভিতরে কেবল কামনা—আমার চাকরি করে দাও, আমার রোগ ভাল করে দাও,—এই সব।
(শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—“যে অসুখ তোমার হয়েছে, লোকেদের সঙ্গে কথা কওয়া হবে না। তবে আমি যখন আসব, কেবল আমার সঙ্গে কথা কইবে।” (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ—এই অসুখটা ভাল করে দাও। তাঁর নামগুণ করতে পাই না।
ডাক্তার—ধ্যান করলেই হল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে কি কথা! আমি একঘেয়ে কেন হব? আমি পাঁচরকম করে মাছ খাই। কখন ঝোলে, কখন ঝালে অম্বলে, কখন বা ভাজায়। আমি কখন পূজা, কখন জপ, কখন বা ধ্যান, কখন বা তাঁর নামগুণগান করি, কখন তাঁর নাম করে নাচি।
ডাক্তার—আমিও একঘেয়ে নই।
[অবতার না মানিলে কি দোষ আছে?]
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার ছেলে অমৃত—অবতার মানে না। তাতে দোষ কি? ঈশ্বরকে নিরাকার বলে বিশ্বাস থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায়। আবার সাকার বলে বিশ্বাস থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায়। তাঁতে বিশ্বাস থাকা আর শরণাগত হওয়া, এই দুটি দরকার। মানুষ তো অজ্ঞান, ভুল হতেই পারে। একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে? তবে যে পথেই থাকো, ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকা চাই। তিনি তো অন্তর্যামী—সে আন্তরিক ডাক শুনবেনই শুনবেন। ব্যাকুল হয়ে সাকারবাদীর পথেই যাও, আর নিরাকারবাদীর পথেই যাও, তাঁকেই (ঈশ্বরকেই) পাবে।
“মিছরির রুটি সিধে করেই খাও, আর আড় করেই খাও; মিষ্ট লাগবে। তোমার ছেলে অমৃতটি বেশ।”
ডাক্তার—সে তোমার চেলা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, ডাক্তারের প্রতি)—আমার কোন শালা চেলা নাই। আমিই সকলের চেলা! সকলেই ঈশ্বরের ছেলে, সকলেই ঈশ্বরের দাস—আমিও ঈশ্বরের ছেলে; আমিও ঈশ্বরের দাস।
“চাঁদা মামা সকলেরই মামা।” (সভাস্থ সকলের আনন্দ ও হাস্য।)
৫৩.৯ নবম পরিচ্ছেদ – শ্যামপুকুর বাটীতে ডাক্তার সরকার, নরেন্দ্র, শশী, প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
[পূর্বকথা—উন্মাদাবস্থায় কুঠির পেছনে যেন গায়ে হোমাগ্নি জ্বলন। পণ্ডিত পদ্মলোচনের বিশ্বাস ও তাঁহার মৃত্যু]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুর বাটীতে চিকিত্সার্থ ভক্তসঙ্গে বাস করিতেছেন। আজ কোজাগর পূর্ণিমা, শুক্রবার (৮ই কার্তিক, ১২৯২)। ২৩শে অক্টোবর, ১৮৮৫, বেলা ১০টা। ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।
মাস্টার তাঁহার পায়ে মোজা পরাইয়া দিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কম্ফর্টার্টা কেটে পায় পরলে হয় না? বেশ গরম। [মাস্টার হাসিতেছেন।]
গতকল্য বৃহস্পতিবার রাত্রে ডাক্তার সরকারের সহিত অনেক কথা হইয়া গিয়াছে। ঠাকুর সে সকল কথা উল্লেখ করিয়া মাস্টারকে হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন—“কাল কেমন তুঁহু তুঁহু বললুম!”
ঠাকুর কাল বলিয়াছিলেন,—“জীবেরা ত্রিতাপে জ্বলছে, তবু বলে বেশ আছি। বেঁকা কাঁটা দিয়ে হাত কেটে যাচ্ছে। দরদর করে রক্ত পড়ছে—তবু বলে, ‘আমার হাতে কিছু হয় নাই।’ জ্ঞানাগ্নি দিয়ে এই কাঁটা তো পোড়াতে হবে।”
ছোট নরেন ওই কথা স্মরণ করিয়া বলিতেছেন—‘কালকের বাঁকা কাঁটার কথাটি বেশ! জ্ঞানাগ্নিতে জ্বালিয়ে দেওয়া।’
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার সাক্ষাৎ ওই সব অবস্থা হত।
“কুঠির পেছন দিয়ে যেতে যেতে—গায়ে যেন হোমাগ্নি জ্বলে গেল!
“পদ্মলোচন বলেছিল, ‘তোমার অবস্থা সভা করে লোকদের বলব!’ তারপর কিন্তু তার মৃত্যু হল।”
বেলা এগারটার সময় ঠাকুরের সংবাদ লইয়া ডাক্তার সরকারের বাটীতে মণি আসিয়াছেন।
ডাক্তার ঠাকুরের সংবাদ লইয়া তাঁহারই বিষয় কথাবার্তা কহিতেছেন—তাঁহার কথা শুনিতে ঔত্সুক্য প্রকাশ করিতেছেন।
ডাক্তার (সহাস্যে)—আমি কাল কেমন বললাম, ‘তুঁহু তুঁহু’ বলতে গেলে তেমনি ধুনুরির হাতে পড়তে হয়!
মণি—আজ্ঞা হাঁ, তেমন গুরুর হাতে না পড়লে অহংকার যায় না।
“কাল ভক্তির কথা কেমন বললেন!—ভক্তি মেয়েমানুষ, অন্তঃপুর পর্যন্ত যেতে পারে।”
ডাক্তার—হাঁ ওটি বেশ কথা; কিন্তু তা বলে জ্ঞান তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না।
মণি—পরমহংসদেব তা তো বলেন না। তিনি জ্ঞান-ভক্তি দুই-ই লন—নিরাকার-সাকার। তিনি বলেন, ভক্তি হিমে জলের খানিকটা বরফ হল, আবার জ্ঞানসূর্য উদয় হলে বরফ গলে গেল। অর্থাৎ ভক্তিযোগে সাকার, জ্ঞানযোগে নিরাকার।
“আর দেখেছেন, ঈশ্বরকে এত কাছে দেখছেন যে তাঁর সঙ্গে সর্বদা কথা কচ্ছেন। ছোট ছেলেটির মতো বলছেন, ‘মা, বড় লাগছে!’
“আর কি অব্জর্ভেশন (দর্শন)! মিউজিয়াম-এ (যাদুঘরে) ফসিল (জানোয়ার পাথর) হয়ে গেছে দেখেছিলেন। অমনি সাধুসঙ্গের উপমা হয়ে গেল! পাথরের কাছে থেকে থেকে পাথর হয়ে গেছে, তেমনি সাধুর কাছে থাকতে থাকতে সাধু হয়ে যায়।”
ডাক্তার—ঈশানবাবু কাল অবতার অবতার করছিলেন। অবতার আবার কি!—মানুষকে ঈশ্বর বলা!
মণি—ওঁদের যা যা বিশ্বাস, তা আর ইন্টারফিয়ার (তাতে হস্তক্ষেপ) করে কি হবে?
ডাক্তার—হাঁ, কাজ কি!
মণি—আর ও-কথাটিতে কেমন হাসিয়েছেন!—‘একজন দেখে গেল, একটা বাড়ি পড়ে গেছে কিন্তু খপরের কাগজে ওটি লিখা নাই। অতএব ও-বিশ্বাস করা যাবে না।’
ডাক্তার চুপ করিয়া আছেন—কেননা ঠাকুর বলিয়াছিলেন, ‘তোমার সাইয়েন্স-এ অবতারের কথা নাই, অতএব অবতার নাই!’
বেলা দ্বিপ্রহর হইল। ডাক্তার মণিকে লইয়া গাড়িতে উঠিলেন। অন্যান্য রোগী দেখিয়া অবশেষে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিতে যাইবেন।
ডাক্তার সেদিন গিরিশের নিমন্ত্রণে ‘বুদ্ধলীলা’ অভিনয় দেখিতে গিয়াছিলেন। তিনি গাড়িতে বসিয়া মণিকে বলিতেছেন, “বুদ্ধকে দয়ার অবতার বললে ভাল হত—বিষ্ণুর অবতার কেন বললে?”
ডাক্তার মণিকে হেদুয়ার চৌমাথায় নামাইয়া দিলেন।
৫৩.১০ দশম পরিচ্ছেদ – ঠাকুরের পরমহংস অবস্থা—চতুর্দিকে আনন্দের কোয়াসাদর্শন—ভগবতীর রূপদর্শন—যেন বলছে, ‘লাগ্ ভেলকি’
বেলা ৩টা। ঠাকুরের কাছে ২/১টি ভক্ত বসিয়া আছেন। তিনি ‘ডাক্তার কখন আসিবে’ আর ‘কটা বেজেছে’ বালকের ন্যায় অধৈর্য হইয়া বারবার জিজ্ঞাসা করিতেছেন। ডাক্তার আজ সন্ধ্যার পর আসিবেন।
হঠাৎ ঠাকুরের বালকের ন্যায় অবস্থা হইয়াছে। বালিশ কোলে করিয়া যেন বাত্সল্যরসে আপ্লুত হইয়া ছেলেকে দুধ খাওয়াইতেছেন! ভাবাবিষ্ট বালকের ন্যায় হাসিতেছেন—আর-একরকম করিয়া কাপড় পরিতেছেন!
মণি প্রভৃতি অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ভাব উপশম হইল। ঠাকুরের খাবার সময় হইয়াছে, তিনি একটু সুজি খাইলেন।
মণির কাছে নিভৃতে অতি গুহ্যকথা বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি একান্তে)—এতক্ষণ ভাবাবস্থায় কি দেখছিলাম জান?—তিন-চার ক্রোশ ব্যাপী সিওড়ে যাবার রাস্তার মাঠ। সেই মাঠে আমি একাকী!—সেই যে পনের-ষোল বছরের ছোকরার মতো পরমহংস বটতলায় দেখেছিলাম, আবার ঠিক সেইরকম দেখলাম!
“চতুর্দিকে আনন্দের কোয়াসা!—তারই ভিতর থেকে ১৩/১৪ বছরের একটি ছেলে উঠলো মুখটি দেখা যাচ্ছে। পূর্ণর রূপ। দুইজনেই দিগম্বর!—তারপর আনন্দে মাঠে দুইজনে দৌড়াদৌড়ি আর খেলা!
“দৌড়াদৌড়ি করে পূর্ণর জলতৃষ্ণা পেল। সে একটা পাত্রে করে জল খেলে। জল খেয়ে আমায় দিতে আসে। আমি বললাম, ‘ভাই, তোর এঁটো খেতে পারবো না।’ তখন সে হাসতে হাসতে গিয়ে গ্লাসটি ধুয়ে আর-একগ্লাস জল এনে দিলে।”
[‘ভয়ঙ্করা কালকামিনী’—দেখাচ্ছেন, সব ভেলকি]
ঠাকুর আবার সমাধিস্থ। কিয়ত্ক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হইয়া আবার মণির সহিত কথা কহিতেছেন—
“আবার অবস্থা বদলাচ্ছে!—প্রসাদ খাওয়া উঠে গেল!—সত্য-মিথ্যা এক হয়ে যাচ্ছে!—আবার কি দেখছিলাম জান? ঈশ্বরীয় রূপ! ভগবতী মূর্তি—পেটের ভিতর ছেলে—তাকে বার করে আবার গিলে ফেলছে!—ভিতরে যতটা যাচ্ছে, ততটা শূন্য হয়ে! আমায় দেখাচ্ছে যে, সব শূন্য!
“যেন বলছে, লাগ্! লাগ্! লাগ্! ভেলকি! লাগ্!”
মণি ঠাকুরের কথা ভাবিতেছেন! ‘বাজিকরই সত্য আর সব মিথ্যা।’
[সিদ্ধাই ভাল নয়—নিচু ঘরের সিদ্ধাই]
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, তখন পূর্ণকে আকর্ষণ কল্লাম, তা হল না কেন? এইতে একটু বিশ্বাস কমে যাচ্ছে!
মণি—ও-সব তো সিদ্ধাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঘোর সিদ্ধাই!
মণি—সেই অধর সেনের বাড়ি থেকে গাড়ি করে আপনার সঙ্গে আমরা যখন দক্ষিণেশ্বরে আসছিলাম—বোতল ভেঙে গেল। একজন বললেন যে, এতে কি হানি হবে, আপনি একবার দেখুন। আপনি বললেন, দায় পড়েছে, দেখবার জন্য—ও-সব তো সিদ্ধাই!
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওইরকম হরির লুটের ছেলে—রোগ ভাল করা—এ-সব সিদ্ধাই। যারা অতি নিচু ঘর, তারাই ঈশ্বরকে ডাকে রোগ ভালর জন্য।
৫৩.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – পূর্ণজ্ঞান—দেহ ও আত্মা আলাদা—শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত
সন্ধ্যা হইল। শ্রীরামকৃষ্ণ শয্যায় বসিয়া মার চিন্তা ও নাম করিতেছেন। ভক্তেরা অনেকে তাঁহার কাছে নিঃশব্দে বসিয়া আছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ডাক্তার সরকার আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঘরে লাটু, শশী, শরৎ, ছোট নরেন, পল্টু, ভূপতি, গিরিশ প্রভৃতি অনেক ভক্তেরা আসিয়াছেন। গিরিশের সঙ্গে থিয়েটারের শ্রীযুক্ত রামতারণ আসিয়াছেন—গান গাইবেন।
ডাক্তার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—কাল রাত তিনটার সময় আমি তোমার জন্য বড় ভেবেছিলুম। বৃষ্টি হল, ভাবলুম দোর-টোর খুলে রেখেছে—না কি করেছে, কে জানে!
শ্রীরামকৃষ্ণ ডাক্তারের স্নেহ দেখিয়া প্রসন্ন হইয়াছেন। আর বলিতেছেন, বল কিগো!
“যতক্ষণ দেহটা আছে ততক্ষণ যত্ন করতে হয়।
“কিন্তু দেখছি যে এটা আলাদা। কামিনী-কাঞ্চনের উপর ভালবাসা যদি একেবারে চলে যায়, তাহলে ঠিক বুঝতে পারা যায় যে দেহ আলাদা আর আত্মা আলাদা। নারকেলের জল সব শুকিয়ে গেলে মালা আলাদা, শাঁস আলাদা হয়ে যায়। তখন নারকেল টের পাওয়া যায়—ঢপর ঢপর করছে। যেমন খাপ আর তরবার—খাপ আলাদা, তরবার আলাদা।
“তাই দেহের অসুখের জন্য তাঁকে বেশি বলতে পারি না।”
গিরিশ—পণ্ডিত শশধর বলেছিলেন, ‘আপনি সমাধি অবস্থায় দেহের উপর মনটা আনবেন,—তাহলে অসুখ সেরে যাবে।’ ইনি ভাবে দেখলেন যে শরীরটা যেন ধ্যাড় ধ্যাড় করছে।
[পূর্বকথা—মিউজিয়াম দর্শন ও পীড়ার সময় প্রার্থনা]
শ্রীরামকৃষ্ণ—অনেকদিন হল,—আমার তখন খুব ব্যামো। কালীঘরে বসে আছি,—মার কাছে প্রার্থনা করতে ইচ্ছা হল! কিন্তু ঠিক আপনি বলতে পাল্লাম না। বললুম,—মা হৃদে বলে তোমার কাছে ব্যামোর কথা বলতে। আর বেশি বলতে পাল্লাম না—বলতে বলতে অমনি দপ্ করে মনে এলো সুসাইট্ (Asiatic Society’s Museum)। সেখানকার তারে বাঁধা মানুষের হাড়ের দেহ (Skeleton) অমনি বললুম, মা, তোমার নামগুণ করে বেড়াব—দেহটা একটু তার দিয়ে এঁটে দাও, সেখানকার মতো! সিদ্ধাই চাইবার জো নাই!
“প্রথম প্রথম হৃদে বলেছিল,—হৃদের অণ্ডার (under) ছিলাম কি না—‘মার কাছে একটু ক্ষমতা চেও।’ কালীঘরে ক্ষমতা চাইতে গিয়ে দেখলাম—ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের রাঁড়—কাপড় তুলে ভড়ভড় করে হাগছে। তখন হৃদের উপর রাগ হল,—কেন সে সিদ্ধাই চাইতে শিখিয়ে দিলে।”
[শ্রীযুক্ত রামতারণের গান—ঠাকুরের ভাবাবস্থা]
গান :
আমার এই সাধের বীণে, যত্নে গাঁথা তারের হার ।
যে যত্ন জানে, বাজায় বীণে, উঠে সুধা অনিবার ॥
তানে মানে বাঁধলে ডুরী, শত ধারে বয় মাধুরী ।
বাজে না আলগা তারে, টানে ছিঁড়ে কোমল তার ॥
ডাক্তার (গিরিশের প্রতি)—গান এ-সব কি অরিজিন্যাল (নূতন)?
গিরিশ—না, Edwin Arnold-এর thought (আর্নল্ড সাহেবের ভাব লয়ে গান)।
রামতারণ প্রথমে বুদ্ধচরিত হইতে গান গাইতেছেন :
জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই ।
ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি,
কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই ॥
কর হে চেতন, কে আছ চেতন,
কত দিনে আর ভাঙিবে স্বপন?
কে আছ চেতন, ঘুমায়ো না আর,
দারুণ এ-ঘোর নিবিড় আঁধার,
কর তম নাশ, হও হে প্রকাশ,
তোমা বিনা আর নাহিক উপায়,
তব পদে তাই শরণ চাই ॥
এই গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন।
গান—কোঁ কোঁ কোঁ বহরে ঝড়।
[সূর্যের অন্তর্যামী দেবতাদর্শন]
এই গানটি সমাপ্ত হইলে ঠাকুর বলিতেছেন, “এ কি করলে!—পায়েসের পর নিম ঝোল!—
“যাই গাইলে—‘কর তম নাশ’, অমনি দেখলাম সূর্য—উদয় হবা মাত্র চারদিকের অন্ধকার ঘুচে গেল! আর সেই সূর্যের পায়ে সব শরণাগত হয়ে পড়ছে!”
রামতারণ আবার গাইতেছেন :
(১) দীনতারিণী দূরিতবারিণী, সত্ত্বরজঃতমঃ ত্রিগুণধারিণী,
সৃজন পালন নিধনকারিণী, সগুণা নির্গুণা সর্বস্বরূপিণী ।
(২) ধরম করম সকলি গেল, শ্যামাপূজা বুঝি হল না!
মন নিবারিতে নারি কোন মতে, ছি, ছি, কি জ্বালা বল না ॥
এই গান শুনিয়া ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট হইলেন।
রাঙা জবা কে দিলে তোর পায়ে মুঠো মুঠো।
৫৩.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – ছোট নরেন প্রভৃতির ভাবাবস্থা—সন্ন্যাসী ও গৃহস্থের কর্তব্য
গান সমাপ্ত হইল। ভক্তেরা অনেকে ভাবাবিষ্ট। নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছেন। ছোট নরেন ধ্যানে মগ্ন। কাষ্ঠের ন্যায় বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ছোট নরেনকে দেখাইয়া, ডাক্তারকে)—এ অতি শুদ্ধ। বিষয়-বুদ্ধির লেশ এতে লাগে নাই।
ডাক্তার নরেনকে দেখিতেছেন। এখনও ধ্যানভঙ্গ হয় নাই।
মনোমোহন (ডাক্তারের প্রতি, সহাস্যে)—আপনার ছেলের কথায় বলেন, ‘ছেলেকে যদি পাই, বাপকে চাই না।’
ডাক্তার—অই তো!—তাইতো বলি, তোমরা ছেলে নিয়েই ভোলো! (অর্থাৎ ঈশ্বরকে ছেড়ে অবতার বা ভক্তকে নিয়ে ভোলো।)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—বাপকে চাই না—তা বলছি না।
ডাক্তার—তা বুঝিছি!—এরকম দু-একটা না বললে হবে কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার ছেলেটি বেশ সরল। শম্ভু রাঙামুখ করে বলেছিল, ‘সরলভাবে ডাকলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।’ ছোকরাদের অত ভালবাসি কেন, জান? ওরা খাঁটি দুধ, একটু ফুটিয়ে নিলেই হয়—ঠাকুর সেবায় চলে।
“জোলো দুধ অনেক জ্বাল দিতে হয়—অনেক কাঠ পুড়ে যায়।
“ছোকরারা যেন নূতন হাঁড়ি—পাত্র ভাল—দুধ নিশ্চিন্ত হয়ে রাখা যায়। তাদের জ্ঞানোপদেশ দিলে শীঘ্র চৈতন্য হয়। বিষয়ী লোকদের শীঘ্র হয় না। দই পাতা হাঁড়িতে দুধ রাখতে ভয় হয়, পাছে নষ্ট হয়!
“তোমার ছেলের ভিতর বিষয়বুদ্ধি—কামিনী-কাঞ্চন—ঢোকে নাই।”
ডাক্তার—বাপের খাচ্চেন, তাই!—
“নিজের করতে হলে দেখতুম, বিষয়বুদ্ধি ঢোকে কি না!”
[সন্ন্যাসী ও নারীত্যাগ—সন্ন্যাসী ও কাঞ্চনত্যাগ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা বটে, তা বটে। তবে কি জানো, তিনি বিষয়বুদ্ধি থেকে অনেক দূর, তা না হলে হাতের ভিতর। (সরকার ও ডাক্তার দোকড়ির প্রতি) কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ আপনাদের পক্ষে নয়। আপনারা মনে ত্যাগ করবে। গোস্বামীদের তাই বললাম—তোমরা ত্যাগের কথা কেন বলছো?—ত্যাগ করলে তোমাদের চলবে না—শ্যামসুন্দরের সেবা রয়েছে।
“সন্ন্যাসীর পক্ষে ত্যাগ। তারা স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। মেয়েমানুষ তাদের পক্ষে বিষবৎ। অন্ততঃ দশহাত অন্তরে, একান্তপক্ষে একহাত অন্তরে থাকবে। হাজার ভক্ত স্ত্রীলোক হলেও তাদের সঙ্গে বেশি আলাপ করবে না।
“এমনকি সন্ন্যাসীর এরূপ স্থানে থাকা উচিত, যেখানে স্ত্রীলোকের মুখ দেখা যায় না;—বা অনেক কাল পরে দেখা যায়।
“টাকাও সন্ন্যাসীর পক্ষে বিষ। টাকা কাছে থাকলেই ভাবনা, অহংকার, দেহের সুখের চেষ্টা, ক্রোধ,—এই সব এসে পড়ে। রজোগুণ বৃদ্ধি করে। আবার রজোগুণ থাকলেই তমোগুণ। তাই সন্ন্যাসী কাঞ্চন স্পর্শ করে না। কামিনী-কাঞ্চন ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়।”
[ডাক্তারকে উপদেশ—টাকার ঠিক ব্যবহার—গৃহস্থের পক্ষে স্বদারা]
“তোমরা জানবে যে, টাকাতে ডাল-ভাত হয়, পরবার কাপড়,—থাকবার একটি স্থান হয়, ঠাকুরের সেবা—সাধু-ভক্তের সেবা হয়।
“জমাবার চেষ্টা মিথ্যা। অনেক কষ্টে মৌমাছি চাক তৈয়ার করে—আর-একজন এসে ভেঙে নিয়ে যায়।”
ডাক্তার—জমাচ্ছেন কার জন্য?—না একটা বদ ছেলের জন্য!
শ্রীরামকৃষ্ণ—বদ ছেলে!—পরিবারটা হয়তো নষ্ট—উপপতি করে। তোমারই ঘড়ি, তোমারই চেন তাকে দেবে!
“তোমাদের পক্ষে স্ত্রীলোক একেবারে ত্যাগ নয়। স্ব-দারায় গমন দোষের নয়। তবে ছেলেপুলে হয়ে গেলে, ভাই-ভগ্নীর মতো থাকতে হয়।
“কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি থাকলেই বিদ্যার অহংকার, টাকার অহংকার, উচ্চপদের অহংকার—এই সব হয়।”
৫৩.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – ডাক্তার সরকারকে উপদেশ—অহংকার ভাল নয় বিদ্যার আমি ভাল
শ্রীরামকৃষ্ণ—অহংকার না গেলে জ্ঞানলাভ করা যায় না। উঁচু ঢিপিতে জল জমে না। খাল জমিতে চারিদিককার জল হুড়হুড় করে আসে।
ডাক্তার—কিন্তু খাল জমিতে যে চারদিকের জল আসে, তার ভিতর ভাল জলও আছে, খারাপ জলও আছে,—ঘোলা জল, হেগো জল, এ-সবও আছে। পাহাড়ের উপরও খাল জমি আছে। নৈনিতাল, মানস সরোবর—যেখানে কেবল আকাশের শুদ্ধ জল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেবল আকাশের জল,—বেশ।
ডাক্তার—আর উঁচু জায়গার জল চারিদিকে দিতে পারবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—একজন সিদ্ধমন্ত্র পেয়েছিল। সে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে চিত্কার করে বলে দিলে—তোমরা এই মন্ত্র জপে ঈশ্বরকে লাভ করবে।
ডাক্তার—হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তবে একটি কথা আছে, যখন ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়, ভাল জল—হেগো জল—এ-সব হিসাব থাকে না। তাঁকে জানবার জন্য কখন ভাল লোকের কাছেও যায় কখন কাঁচা লোকের কাছেও যায়। কিন্তু তাঁর কৃপা হলে ময়লা জলে কিছু হানি করে না। যখন তিনি জ্ঞান দেন, কোন্টা ভাল কোন্টা মন্দ, সব জানিয়ে দেন।
“পাহাড়ের উপর খাল জমি থাকতে পারে, কিন্তু বজ্জাৎ-আমি-রূপ পাহাড়ে থাকে না। বিদ্যার আমি, ভক্তের আমি, যদি হয়,—তবেই আকাশের শুদ্ধ জল এসে জমে।
“উঁচু জায়গার জল চারিদিকে দিতে পারা যায় বটে। সে বিদ্যার আমি-রূপ পাহাড় থেকে হতে পারে।
“তাঁর আদেশ না হলে লোকশিক্ষা হয় না। শঙ্করাচার্য জ্ঞানের পর ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন—লোকশিক্ষার জন্য। তাঁকে লাভ না করে লেকচার! তাতে লোকের কি উপকার হবে?”
[পূর্বকথা—সামাধ্যায়ীর লেকচার—নন্দনবাগান সমাজ দর্শন]
“নন্দনবাগান ব্রাহ্মসমাজে গিছলাম। তাদের উপাসনার পর বেদীতে বসে লেকচার দিলে।—লিখে এনেছে।—পড়বার সময় আবার চারদিকে চায়।—ধ্যান কচ্ছে, তা এক-একবার আবার চায়!
“যে ঈশ্বরদর্শন করে নাই, তার উপদেশ ঠিক ঠিক হয় না। একটা কথা যদি ঠিক হল, তো আর-একটা গোলমেলে হয়ে যায়।
“সামাধ্যায়ী লেকচার দিলে। বলে,—ঈশ্বর বাক্য মনের অতীত—তাঁতে কোন রস নাই—তোমরা প্রেমভক্তিরূপ রস দিয়ে তাঁর ভজনা কর। দেখো যিনি রসস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ, তাঁকে এইরূপ বলছে। এ-লেকচারে কি হবে? এতে কি লোকশিক্ষা হয়?
“একজন বলেছিল—আমার মামার বাড়িতে এক গোয়াল ঘোড়া আছে। গোয়ালে আবার ঘোড়া! (সকলের হাস্য) তাতে বুঝতে হবে ঘোড়া নাই।”
ডাক্তার (সহাস্যে)—গরুও নাই। (সকলের হাস্য)
ভক্তদের মধ্যে যাহারা ভাবাবিষ্ট হইয়াছিলেন, সকলে প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। ভক্তদের দেখিয়া ডাক্তার আনন্দ করিতেছেন।
মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, ‘ইনি কে’ ‘ইনি কে’। পল্টু, ছোট নরেন, ভূপতি, শরৎ, শশী প্রভৃতি ছোকরা ভক্তদিগকে মাস্টার এক-একটি করিয়া দেখাইয়া ডাক্তারের কাছে পরিচয় দিতেছেন।
শ্রীযুক্ত শশী1 সম্বন্ধে মাস্টার বলিতেছেন—“ইনি বি. এ. পরীক্ষা দিবেন।”
ডাক্তার একটু অন্যমনস্ক হইয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—দেখো গো! ইনি কি বলছেন।
ডাক্তার শশীর পরিচয় শুনিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে দেখাইয়া, ডাক্তারের প্রতি)—ইনি সব ইস্কুলের ছেলেদের উপদেশ দেন।
ডাক্তার—তা শুনেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি আশ্চর্য, আমি মূর্খ!—তবু লেখাপড়াওয়ালারা এখানে আসে, এ কি আশ্চর্য! এতে তো বলতে হবে ঈশ্বরের খেলা!
আজ কোজাগর পূর্ণিমা। রাত প্রায় নয়টা হইবে। ডাক্তার ছয়টা হইতে বসিয়া আছেন ও এই সকল ব্যাপার দেখিতেছেন।
গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি)—আচ্ছা, মশায় এরকম কি আপনার হয়?—এখানে আসব না আসব না করছি,—যেন কে টেনে আনে—আমার নাকি হয়েছে, তাই বলছি।
ডাক্তার—তা এমন বোধ হয় না। তবে হার্ট-এর (হৃদয়ের) কথা হার্ট্ই (হৃদয়ই) জানে। (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) আর এ-সব বলাও কিছু নয়।
৫৩.১৪ চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – শ্যামপুকুর বাটীতে নরেন্দ্র, ডাক্তার সরকার প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
[ডাক্তার সরকার ও সর্বধর্ম পরীক্ষা (Comparative Religion)]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্র, মহিমাচরণ, মাস্টার, ডাক্তার সরকার প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে শ্যামপুকুরের বাটীতে দ্বিতলার ঘরে বসিয়া আছেন। বেলা প্রায় একটা। ২৪শে অক্টোবর, ১৮৮৫, ৯ই কার্তিক (শনিবার, কৃষ্ণা প্রতিপদ)।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার এ (হোমিওপ্যাথিক) চিকিত্সা বেশ।
ডাক্তার—এতে রোগীর অবস্থা বইয়ের সঙ্গে মেলাতে হয়। যেমন ইংরেজি বাজনা,—দেখে পড়া আর গাওয়া।
“গিরিশ ঘোষ কই?—থাক্ থাক্ কাল জেগেছে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, সিদ্ধির নেশার মতো ভাবাবস্থায় হয়, ওটা কি?
ডাক্তার (মাস্টারকে)—Nervous centre—action বন্ধ হয়, তাই অসাড়—এ-দিকে পা টলে, যত energies brain-এর দিকে যায়। এই nervous system নিয়ে Life। ঘাড়ের কাছে আছে—Medulla Oblongata; তার হানি হলে Life extinct হতে পারে।
শ্রীযুক্ত মহিমা চক্রবর্তী সুষুম্না নাড়ীর ভিতরে কুলকুণ্ডলিনী শক্তির কথা বলিতেছেন,—“স্পাইন্যাল্ কর্ড-এর ভিতর সুষুম্না নাড়ী সূক্ষ্মভাবে আছে—কেউ দেখতে পায় না। মহাদেবের বাক্য।”
ডাক্তার—মহাদেব man in the maturity-কে examine করেছে। European-রা Embryo থেকে maturity পর্যন্ত সমস্ত stage দেখেছে। Comparative History সব জানা ভাল। সাঁওতালদের history পড়ে জানা গেছে যে, কালী একজন সাঁওতালী মাগী ছিল—খুব লড়াই করেছিল। (সকলের হাস্য)
“তোমরা হেসো না। আবার Comparative anatomy-তে কত উপকার হয়েছে, শোনো। প্রথমে pancreatic juice ও bile-এর (পিত্তের) action-এর (ক্রিয়ার) তফাত বোঝা যাচ্ছিল না। তারপর Claude Bernard খরগোশের stomach, liver প্রভৃতি examine করে দেখালে যে, bile-এর action আর ওই juice-এর action আলাদা।
“তাহলেই দাঁড়ালো যে, lower animal-দের আমাদের দেখা উচিত—শুধু মানুষকে দেখলে হবে না।
“সেইরূপ Comparative Religion-তে বিশেষ উপকার!
“এই যে ইনি (পরমহংসদেব) যা বলেন, তা অত অন্তরে লাগে কেন? এঁর সব ধর্ম দেখা আছে—হিঁদু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, শাক্ত, বৈষ্ণব,—এ-সব ইনি নিজে করে দেখেছেন। মধুকর নানা ফুলে বসে মধু সঞ্চয় করলে তবেই চাকটি বেশ হয়।”
মাস্টার (ডাক্তারকে)—ইনি (মহিমা) খুব সাইয়েন্স্ পড়েছেন।
ডাক্তার (সহাস্যে)—কি Maxmuller’s Science of Religion?
মহিমা (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আপনার অসুখ, ডাক্তারেরা আর কি করবে? যখন শুনলাম যে আপনার অসুখ করেছে, তখন ভাবলাম যে ডাক্তারের অহংকার বাড়াচ্ছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ইনি খুব ভাল ডাক্তার। আর খুব বিদ্যা।
মহিমাচরণ—আজ্ঞা হাঁ, উনি জাহাজ, আর আমরা সব ডিঙ্গি।
ডাক্তার বিনীত হইয়া হাতজোড় করিতেছেন।
মহিমা—তবে ওখানে (ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে) সবাই সমান।
ঠাকুর নরেন্দ্রকে গান গাইতে বলিতেছেন।
নরেন্দ্রের গান :
(১) তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা ।
(২) অহংকারে মত্ত সদা, অপার বাসনা ।
(৩) চমত্কার অপার, জগৎ রচনা তোমার!
শোভার আগার বিশ্ব সংসার!
(৪) মহা সিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিতঃ ।
তোমারি রচিত ছন্দ মহান বিশ্বের গীত ।
মর্ত্যের মৃত্তিকা হয়ে, ক্ষুদ্র এই কণ্ঠ লয়ে,
আমিও দুয়ারে তব, হয়েছি হে উপনীত ।
কিছু নাহি চাহি দেব, কেবল দর্শন মাগি,
তোমারে শোনাব গীতি এসেছি তাহারি লাগি ।
গায় যথা রবি শশী, সেই সভা মাঝে বসি,
একান্তে গাইতে চাহে এই ভকতের চিত ।
(৫) ওহে রাজরাজেশ্বর, দেখা দাও!
করুণাভিখারী আমি করুণা কটাক্ষে চাও ॥
চরণে উত্সর্গ দান, করিতেছি এই প্রাণ,
সংসার-অনলকুণ্ডে ঝলসি গিয়াছে তাও ॥
কলুষ-কলঙ্কে তাহে আবরিত এ-হৃদয়;
মোহে মুগ্ধ মৃতপ্রায়, হয়ে আছি দয়াময়,
মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রে শোধন করিয়ে লও ॥
(৬) হরি-রস-মদিরা পিয়ে মম মানস মাতোরে!
লুটায়ে অবনীতল হরি হরি বলি কাঁদোরে ॥
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর ‘যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।’
ডাক্তার—আহা!
গান সমাপ্ত হইল। ডাক্তার মুগ্ধপ্রায় হইয়াছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ডাক্তার অতি ভক্তিভাবে হাতজোড় করিয়া ঠাকুরকে বলিতেছেন, ‘তবে আজ যাই,—আবার কাল আসব।’
শ্রীরামকৃষ্ণ—একটু থাকো না! গিরিশ ঘোষকে খপর দিয়েছে। (মহিমাকে দেখাইয়া) ইনি বিদ্বান হরিনামে নাচেন, অহংকার নাই। কোন্নগরে চলে গিছলেন—আমরা গিছলাম বলে; আবার স্বাধীন, ধনবান, কারু চাকরি করতে হয় না! (নরেন্দ্রকে দেখাইয়া) এ কেমন?
ডাক্তার—খুব ভাল!
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর ইনি—
ডাক্তার—আহা!
মহিমাচরণ—হিন্দুদের দর্শন না পড়লে দর্শন পড়াই হয় না। সাংখ্যের চতুর্বিংশতি তত্ত্ব ইউরোপ জানে না—বুঝতেও পারে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কি তিন পথ তুমি বলো?
মহিমা—সত্পথ—জ্ঞানের পথ। চিত্পথ, যোগের। কর্মযোগ। তাই চার আশ্রমের ক্রিয়া, কি কি কর্তব্য, এর ভিতর আসছে। আনন্দপথ—ভক্তিপ্রেমের পথ। —আপনাতে তিন পথেরই ব্যাপার—আপনি তিন পথেরই খপর বাতলে দেন! (ঠাকুর হাসিতেছেন)
“আমি আর কি বলব? জনক বক্তা, শুকদেব শ্রোতা!”
ডাক্তার বিদায় গ্রহণ করিলেন।
[সন্ধ্যার পর সমাধিস্থ—নিত্যগোপাল ও নরেন্দ্র—‘জপাৎ সিদ্ধি’]
সন্ধ্যার পর চাঁদ উঠিয়াছে। আজ কোজাগর পূর্ণিমার পরদিন, শনিবার, ৯ই কার্তিক। ঠাকুর সমাধিস্থ! দাঁড়াইয়া আছেন। নিত্যগোপালও তাঁহার কাছে ভক্তিভাবে দাঁড়াইয়া আছেন।
ঠাকুর উপবিষ্ট হইয়াছেন—নিত্যগোপাল পদসেবা করিতেছেন। দেবেন্দ্র কালীপদ প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্ত কাছে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (দেবেন্দ্র প্রভৃতির প্রতি)—এমনি মনে উঠছে, নিত্যগোপালের এ-অবস্থাগুলো এখন যাবে,—ওর সব মন কুড়িয়ে আমাতেই আসবে—যিনি এর ভিতর আছেন, তাঁতে।
“নরেন্দ্রকে দেখছো না?—সব মনটা ওর আমারই উপর আসছে!”
ভক্তেরা অনেকে বিদায় লইতেছেন। ঠাকুর দাঁড়াইয়া আছেন। একজন ভক্তকে জপের কথা বলিতেছেন—“জপ করা কি না নির্জনে নিঃশব্দে তাঁর নাম করা। একমনে নাম করতে করতে—জপ করতে করতে—তাঁর রূপদর্শন হয়—তাঁর সাক্ষাত্কার হয়। শিকলে বাঁধা কড়িকাঠ গঙ্গার গর্ভে ডুবান আছে—শিকলের আর-একদিক তীরে বাঁধা আছে। শিকলের এক-একটি পাপ (Link) ধরে ধরে গিয়ে ক্রমে ডুব মেরে শিকল ধরে যেতে যেতে ওই কড়ি-কাঠ স্পর্শ করা যায়! ঠিক সেইরূপ জপ করতে করতে মগ্ন হয়ে গেলে ক্রমে ভগবানের সাক্ষাত্কার হয়।”
কালীপদ (সহাস্যে, ভক্তদের প্রতি)—আমাদের এ খুব ঠাকুর!—জপ-ধ্যান, তপস্যা করতে হয় না!
এই সময় ঠাকুর হঠাৎ বলিতেছেন—“এটা কেমন কচ্ছে।”
ঠাকুরের গলায় অসুখ করিতেছে। দেবেন্দ্র বলিতেছেন—“এ কথায় আর ভুলি না।” দেবেন্দ্রের এই মনের ভাব যে ঠাকুর কেবল ভক্তদের ভুলাইবার জন্য অসুখ দেখাইতেছেন।
ভক্তেরা বিদায় গ্রহণ করিলেন। রাত্রে কয়েকটি ছোকরা ভক্ত পালা করিয়া থাকিবেন। আজ মাস্টারও রাত্রে থাকিবেন।
৫৩.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত ভক্তের কথোপকথন ও আনন্দ
আজ রবিবার, ১০ই কার্তিক; কৃষ্ণাদ্বিতীয়া—২৫শে অক্টোবর, ১৮৮৫। শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতাস্থ শ্যামপুকুরের বাড়িতে অবস্থান করিতেছেন। গলার পীড়া (ক্যান্সার) চিকিত্সা করাইতে আসিয়াছেন। আজকাল ডাক্তার সরকার দেখিতেছেন।
ডাক্তারের কাছে পরমহংসদেবের অবস্থা জানাইবার জন্য মাস্টারকে প্রত্যহ পাঠানো হইয়া থাকে। আজ সকালে বেলা ৬॥ টার সময় তাঁহাকে প্রণাম করিয়া মাস্টার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কেমন আছেন?” শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “ডাক্তারকে বলবে, শেষ রাত্রে একমুখ জল হয়; কাশি আছে; ইত্যাদি। জিজ্ঞাসা করবে নাইব কিনা?”
মাস্টার ৭-টার পর ডাক্তার সরকারের সঙ্গে দেখা করিলেন ও সমস্ত অবস্থা বলিলেন। ডাক্তারের বৃদ্ধ শিক্ষক ও দুই-একজন বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। ডাক্তার বৃদ্ধ শিক্ষককে বলিতেছেন, মহাশয়! রাত তিনটে থেকে পরমহংসের ভাবনা আরম্ভ হয়েছে—ঘুম নাই। এখনও পরমহংস চলছে। (সকলের হাস্য)
ডাক্তারের একজন বন্ধু ডাক্তারকে বলিতেছেন, মহাশয়, শুনতে পাই পরমহংসকে কেউ কেউ অবতার বলে। আপনি তো রোজ দেখছেন, আপনার কি বোধ হয়?
ডাক্তার—As man I have the greatest regard for him.
মাস্টার (ডাক্তারের বন্ধুর প্রতি)—ডাক্তার মহাশয় তাঁকে অনুগ্রহ করে অনেক দেখছেন।
ডাক্তার—অনুগ্রহ!
মাস্টার—আমাদের উপর, পরমহংসদেবের উপর বলছি না।
ডাক্তার—তা নয় হে। তোমরা জান না, আমার actual loss হচ্ছে, রোজ রোজ দুই-তিনটে call-এ যাওয়াই হচ্ছে না। তার পরদিন আপনিই রোগীদের বাড়ি যাই, আর ফি লই না;—আপনি গিয়ে ফি নেবো কেমন করে?
শ্রীযুক্ত মহিমা চক্রবর্তীর কথা হইল। শনিবারে যখন ডাক্তার পরমহংসদেবকে দেখিতে যান, তখন চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন; ডাক্তারকে দেখিয়া তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে বলিয়াছিলেন, ‘মহাশয়, আপনি ডাক্তারের অহংকার বাড়াবার জন্য রোগ করেছেন।’
মাস্টার (ডাক্তারের প্রতি)—মহিমা চক্রবর্তী আপনার এখানে আগে আসতেন। আপনি বাড়িতে ডাক্তারী সায়েন্স-এর লেক্চার দিতেন, তিনি শুনতে আসতেন।
ডাক্তার—বটে? লোকটার কি তমো! দেখলে—আমি নমস্কার করলুম as God’s Lower Third? আর ঈশ্বরের ভিতর তো (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) সব গুণই আছে। ও কথাটা mark করেছিলে, ‘আপনি ডাক্তারের অহংকার বাড়াবার জন্য রোগ করে বসেছেন?’
মাস্টার—মহিমা চক্রবর্তীর বিশ্বাস যে, পরমহংসদেব মনে করলে নিজে ব্যারাম আরাম করতে পারেন।
ডাক্তার—ওঃ। তা কি হয়? আপনি ব্যারাম ভাল করা! আমরা ডাক্তার, আমরা তো জানি ও ক্যান্সার-এর ভিতর কি আছে!—আমরাই আরাম করতে পারি না। উনি তো কিছু জানেন না, উনি কিরকম করে আরাম করবেন! (বন্ধুদের প্রতি)—দেখুন, রোগ দুঃসাধ্য বটে, কিন্তু এরা সকলে তেমনি devotee-র মতো সেবা করছে!
৫৩.১৬ ষোড়শ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ সেবকসঙ্গে
মাস্টার ডাক্তারকে আসিতে বলিয়া প্রত্যাগমন করিলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর বেলা তিনটার সময় শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়া সমস্ত নিবেদন করিলেন। বলিলেন, ডাক্তার আজ বড় অপ্রতিভ করেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি হয়েছে?
মাস্টার—‘আপনি হতভাগা ডাক্তারদের অহংকার বাড়াবার জন্য রোগ করে বসেছেন’—এ-কথা শুনে গিছলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কে বলেছিল?
মাস্টার—মহিমা চক্রবর্তী।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তারপর?
মাস্টার—তা মহিমা চক্রবর্তীকে বলে ‘তমোগুণী ঈশ্বর’ (God’s Lower Third)। এখন ডাক্তার বলছেন, ঈশ্বরের সব গুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) আছে! (পরমহংসদেবের হাস্য) আবার আমায় বললেন, রাত তিনটের সময় ঘুম ভেঙে গেছে আর পরমহংসের ভাবনা। বেলা আটটার সময় বলেন, ‘এখনও পরমহংস চলছে।’
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—ও ইংরাজী পড়েছে, ওকে বলবার জো নাই আমাকে চিন্তা কর; তা আপনিই করছে।
মাস্টার—আবার বলেন, As man I have the greatest regard for him, এর মানে এই, আমি তাঁকে অবতার বলি না। কিন্তু মানুষ বলে যতদূর সম্ভব ভক্তি আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর কিছু কথা হল?
মাস্টার—আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আজ ব্যারামের কি বন্দোবস্ত হবে?’ ডাক্তার বললেন, ‘বন্দোবস্ত আর আমার মাথা আর মুণ্ডু; আবার আজ যেতে হবে, আর কি বন্দোবস্ত!’ (শ্রীরামকৃষ্ণের হাস্য) আরও বললেন, ‘তোমরা জান না যে আমার কত টাকা রোজ লোকসান হচ্ছে—দুই-তিন জায়গায় রোজ যেতে সময় হয় না।’
৫৩.১৭ সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – বিজয়াদি ভক্তসঙ্গে প্রেমানন্দে
কিয়ত্ক্ষণ পরে শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী পরমহংসদেবকে দর্শন করিতে আসিলেন। সঙ্গে কয়েকটি ব্রাহ্মভক্ত। বিজয়কৃষ্ণ ঢাকায় অনেক দিবস ছিলেন। আপাততঃ পশ্চিমে অনেক তীর্থ ভ্রমণের পর সবে কলিকাতায় পৌঁছিয়াছেন। আসিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। অনেকে উপস্থিত ছিলেন,—নরেন্দ্র, মহিমা চক্রবর্তী, নবগোপাল, ভূপতি, লাটু, মাস্টার, ছোট নরেন্দ্র ইত্যাদি অনেকগুলি ভক্ত।
মহিমা চক্রবর্তী (বিজয়ের প্রতি)—মহাশয়, তীর্থ করে এলেন, অনেক দেশ দেখে এলেন, এখন কি দেখলেন বলুন।
বিজয়—কি বলব! দেখছি, যেখানে এখন বসে আছি, এইখানেই সব। কেবল মিছে ঘোরা! কোন কোন জায়গায় এঁরই এক আনা কি দুই আনা, কোথাও চারি আনা, এই পর্যন্ত। এইখানেই পূর্ণ ষোল আনা দেখছি!
মহিমা চক্রবর্তী—ঠিক বলেছেন, আবার ইনিই ঘোরান, ইনিই বসান!
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—দেখ, বিজয়ের অবস্থা কি হয়েছে। লক্ষণ সব বদলে গেছে, যেন সব আউটে গেছে। আমি পরমহংসের ঘাড় ও কপাল দেখে চিনতে পারি। বলতে পারি, পরমহংস কি না।
মহিমা চক্রবর্তী—মহাশয়! আপনার আহার কমে গেছে?
বিজয়—হাঁ, বোধ হয় গিয়েছে। (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আপনার পীড়ার কথা শুনে দেখতে এলাম। আবার ঢাকা থেকে—
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি?
বিজয় কোন উত্তর দিলেন না। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন।
বিজয়—ধরা না দিলে ধরা শক্ত। এইখানেই ষোল আনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেদার2 বললে, অন্য জায়গায় খেতে পাই না—এখানে এসে পেট ভরা পেলুম!
মহিমা চক্রবর্তী—পেট ভরা কি? উপচে পড়ছে!
বিজয় (হাতজোড় করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—বুঝেছি আপনি কে! আর বলতে হবে না!
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবস্থ)—যদি তা হয়ে থাকে, তো তাই।
বিজয়—বুঝেছি।
এই বলিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের পাদমূলে পতিত হইলেন ও নিজের বক্ষে তাঁহার চরণ ধারণ করিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন ঈশ্বরাবেশে বাহ্যশূন্য চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন।
এই প্রেমাবেশ, এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখিয়া উপস্থিত ভক্তেরা কেহ কাঁদিতেছেন, কেহ স্তব করিতেছেন। যাঁহার যে মনের ভাব তিনি সেই ভাবে একদৃষ্টে শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে চাহিয়া রহিলেন! কেহ তাঁহাকে পরমভক্ত, কেহ সাধু, কেহ বা সাক্ষাৎ দেহধারী ঈশ্বরাবতার দেখিতেছেন, যাঁহার যেমন ভাব।
মহিমাচরণ সাশ্রুনয়নে গাহিলেন—দেখ দেখ প্রেমমূর্তি—ও মাঝে মাঝে যেন ব্রহ্মদর্শন করিতেছেন, এই ভাবে বলিতেছেন—
“তুরীয়ং সচ্চিদানন্দম্ দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জিতম্।”
নবগোপাল কাঁদিতেছেন। আর একটি ভক্ত ভূপতি গাহিলেন :
জয় জয় পরব্রহ্ম অপার তুমি অগম্য,
পরাত্পর তুমি সারাত্সার ।
সত্যের আলোক তুমি প্রেমের আকর ভূমি,
মঙ্গলের তুমি মূলাধার ।
নানা রসযুত ভব, গভীর রচনা তব,
উচ্ছ্বসিত শোভায় শোভায়,
মহাকবি আদিকবি, ছন্দে উঠে শশী রবি,
ছন্দে পুনঃ অস্তাচলে যায় ।
তারকা কনক কুচি, জলদ অক্ষর রুচি,
গীত লেখা নীলাম্বর পাতে ।
ছয় ঋতু সম্বত্সরে, মহিমা কীর্তন করে,
সুখপূর্ণ চরাচর সাথে ।
কুসুমে তোমার কান্তি, সলিলে তোমার শান্তি,
বজ্ররবে রুদ্র তুমি ভীম;
তব ভাব গূঢ় অতি, কি জানিবে মূঢ়মতি,
ধ্যায় যুগযুগান্ত অসীম ।
আনন্দে সবে আনন্দে, তোমার চরণ বন্দে,
কোটি চন্দ্র কোটি সূর্য তারা!
তোমারি এ রচনারি, ভাব লয়ে নরনারী,
হাহাকারে নেত্রে বহে ধারা ।
মিলি সুর, নর, ঋভু, প্রণমে তোমায় বিভু,
তুমি সর্ব মঙ্গল-আলয়;
দেও জ্ঞান, দেও প্রেম, দেও ভক্তি, দেও ক্ষেম,
দেও দেও ওপদে আশ্রয় ।
ভূপতি আবার গাহিতেছেন :
[ঝিঁঝিট—(খয়রা) কীর্তন]
চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী ।
মহাভাব রসলীলা কি মাধুরী মরি মরি
বিবিধ বিলাস রসপ্রসঙ্গ, কত অভিনব ভাবতরঙ্গ,
ডুবিছে উঠিছে করিছে রঙ্গ, নবীন নবীন রূপ ধরি,
(হরি হরি বলে)
মহাযোগে সমুদায় একাকার হইল,
দেশ-কাল ব্যবধান ভেদাভেদ ঘুচিল,
(আশা পুরিল রে, আমার সকল সাধ মিটে গেল!)
এখন আনন্দে মাতিয়া দুবাহু তুলিয়া, বলরে মন হরি হরি ।
[ঝাঁপতাল]
টুটল ভরম ভীতি ধরম করম নীতি
দূর ভেল জাতি কুল মান;
কাঁহা হাম, কাঁহা হরি, প্রাণমন চুরি করি,
বঁধূয়া করিলা পয়ান;
(আমি কেনই বা এলাম গো, প্রেমসিন্ধুতটে),
ভাবেতে হল ভোর, অবহিঁ হৃদয় মোর
নাহি যাত আপনা পসান,
প্রেমদাস কহে হাসি, শুন সাধু জগবাসী,
এয়সাহি নূতন বিধান ।
(কিছু ভয় নাই! ভয় নাই!)
অনেকক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতিস্থ হইলেন।
[ব্রহ্মজ্ঞান ও ‘আশ্চর্য গণিত’—অবতারের প্রয়োজন]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—কি একটা হয় আবেশে; এখন লজ্জা হচ্ছে। যেন ভূতে পায়, আমি আর আমি থাকি না।
“এ-অবস্থার পর গণনা হয় না। গণতে গেলে ১-৭-৮ এইরকম গণনা হয়।”
নরেন্দ্র—সব এক কিনা!
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, এক দুয়ের পার!3
মহিমাচরণ—আজ্ঞা হাঁ, দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জিতম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হিসাব পচে যায়! পাণ্ডিত্যের দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না। তিনি শাস্ত্র,—বেদ, পুরাণ, তন্ত্রের—পার। হাতে একখানা বই যদি দেখি, জ্ঞানী হলেও তাঁকে রাজর্ষি বলে কই। ব্রহ্মর্ষির কোন চিহ্ন থাকে না। শাস্ত্রের কি ব্যবহার জানো? একজন চিঠি লিখেছিল, পাঁচ সের সন্দেশ ও একখানা কাপড় পাঠাইবে। যে চিঠি পেলে সে চিঠি পড়ে, পাঁচ সের সন্দেশ ও একখানা কাপড়, এই কথা মনে রেখে চিঠিখানা ফেলে দিলে! আর চিঠির কি দরকার?
বিজয়—সন্দেশ পাঠানো হয়েছে, বোঝা গেছে!
শ্রীরামকৃষ্ণ—মানুষদেহ ধারণ করে ঈশ্বর অবতীর্ণ হন। তিনি সর্বস্থানে সর্বভূতে আছেন বটে, কিন্তু অবতার না হলে জীবের আকাঙ্ক্ষা পুরে না, প্রয়োজন মেটে না। কিরকম জানো? গরুর যেখানটা ছোঁবে, গরুকে ছোঁয়াই হয় বটে। শিঙটা ছুঁলেও গাইটাকে ছোঁয়া হল; কিন্তু গাইটার বাঁট থেকেই দুধ হয়। (সকলের হাস্য)
মহিমা—দুধ যদি দরকার হয়, গাইটার শিঙে মুখ দিলে কি হবে? বাঁটে মুখ দিতে হবে। (সকলের হাস্য)
বিজয়—কিন্তু বাছুর প্রথম প্রথম এদিক-ওদিক ঢুঁ মারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—আবার কেউ হয়তো বাছুরকে ওইরকম করতে দেখে বাঁটটা ধরিয়ে দেয়। (সকলের হাস্য)
৫৩.১৮ অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – ভক্তসঙ্গে প্রেমানন্দে
এই সকল কথা হইতেছে, এমন সময়ে ডাক্তার তাঁহাকে দেখিবার জন্য আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও আসন গ্রহণ করিলেন। তিনি বলিতেছেন, “কাল রাত তিনটে থেকে আমার ঘুম ভেঙেছে। কেবল তোমার জন্য ভাবছিলাম, পাছে ঠাণ্ডা লেগে থাকে। আরও কত কি ভাবছিলাম।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—কাশি হয়েছে, টাটিয়েছে; শেষ রাত্রে একমুখ জল, আর যেন কাঁটা বিঁধছে।
ডাক্তার—সকালে সব খবর পেয়েছি।
মহিমাচরণ তাঁহার ভারতবর্ষ ভ্রমণের কথা বলিতেছেন। বলিলেন যে, লঙ্কাদ্বীপে ‘ল্যাফিং ম্যান্’ নাই। ডাক্তার সরকার বলিলেন, তা হবে, ওটা এন্কোয়ার করতে হবে। (সকলের হাস্য)
[ডাক্তারের ব্যবসা ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ]
ডাক্তারী কর্মের কথা পড়িল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—ডাক্তারী কর্ম খুব উঁচু কর্ম বলে অনেকের বোধ আছে। যদি টাকা না লয়ে পরের দুঃখ দেখে দয়া করে কেউ চিকিত্সা করে তবে সে মহৎ, কাজটিও মহৎ। কিন্তু টাকা লয়ে এ-সব কাজ করতে করতে মানুষ নির্দয় হয়ে যায়। ব্যবসার ভাবে টাকার জন্য হাগা, বাহ্যের রঙ এই সব দেখা—নীচের কাজ।
ডাক্তার—তা যদি শুধু করে, কাজ খারাপ বটে। তোমার কাছে বলা গৌরব করা—
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, ডাক্তারী কাজে নিঃস্বার্থভাবে যদি পরের উপকার করা হয়, তাহলে খুব ভাল।
“তা যে কর্মই লোকে করুক না কেন, সংসারী ব্যক্তির মাঝে মাঝে সাধুসঙ্গ বড় দরকার। ঈশ্বরে ভক্তি থাকলে লোকে সাধুসঙ্গ আপনি খুঁজে লয়। আমি উপমা দিই—গাঁজাখোর গাঁজাখোরের সঙ্গে থাকে, অন্য লোক দেখলে মুখ নিচু করে চলে যায়, বা লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু আর-একজন গাঁজাখোর দেখলে মহা আনন্দ। হয়তো কোলাকুলি করে। (সকলের হাস্য) আবার শকুনি শকুনির সঙ্গে থাকে।”
[সাধুর সর্বজীবে দয়া]
ডাক্তার—আবার কাকের ভয়ে শকুনি পালায়। আমি বলি শুধু মানুষ কেন, সব জীবেরই সেবা করা উচিত। আমি প্রায়ই চড়ুই পাখিকে ময়দা দিই। ছোট ছোট ময়দার গুলি করে ছুঁড়ে ফেলি, আর ছাদে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখি এসে খায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বাঃ, এটা খুব কথা। জীবকে খাওয়ানো সাধুর কাজ; সাধুরা পিঁপড়েদের চিনি দেয়।
ডাক্তার—আজ গান হবে না?
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—একটু গান কর না।
নরেন্দ্র গাহিতেছেন, তানপুরা সঙ্গে। অন্য বাজনাও হইতে লাগিল—
সুন্দর তোমার নাম দীন-শরণ হে,
বরিষে অমৃতধার, জুড়ায় শ্রবণ ও প্রাণরমণ হে ।
এক তব নাম ধন, অমৃত-ভবন হে,
অমর হয় সেইজন, যে করে কীর্তন হে ।
গভীর বিষাদরাশি নিমেষে বিনাশে,
যখনি তব নামসুধা শ্রবণে পরশে;
হৃদয় মধুময় তব নাম গানে,
হয় হে হৃদয়নাথ, চিদানন্দ ঘন হে ।
গান—আমায় দে মা পাগল করে ।
আর কাজ নাই মা জ্ঞান বিচারে ॥
(ব্রহ্মময়ী দে মা পাগল ক’রে)
(ওমা) তোমার প্রেমের সুরা, পানে কর মাতোয়ারা,
ওমা ভক্তচিত্তহরা ডুবাও প্রেমসাগরে ॥
তোমার এ পাগলাগারদে, কেহ হাসে কেহ কাঁদে,
কেহ নাচে আনন্দ ভরে;
ঈশা বুদ্ধ শ্রীচৈতন্য ওমা প্রেমের ভরে অচৈতন্য,
হায় কবে হব মা ধন্য, (ওমা) মিশে তার ভিতরে ॥
গানের পর আবার অদ্ভুত দৃশ্য। সকলেই ভাবে উন্মত্ত। পণ্ডিত পাণ্ডিত্যাভিমান ত্যাগ করিয়া দাঁড়াইয়াছেন। বলছেন, “আমায় দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞান বিচারে।” বিজয় সর্বপ্রথমে আসনত্যাগ করিয়া ভাবোন্মত্ত হইয়া দাঁড়াইয়াছেন। তাহার পরে শ্রীরামকৃষ্ণ। ঠাকুর দেহের কঠিন অসাধ্য ব্যাধি একেবারে ভুলিয়া গিয়াছেন। ডাক্তার সম্মুখে। তিনিও দাঁড়াইয়াছেন। রোগীরও হুঁশ নাই; ডাক্তারেরও হুঁশ নাই। ছোট নরেনেরও ভাবসমাধি হইল। লাটুরও ভাবসমাধি হইল। ডাক্তার সায়েন্স্ পড়িয়াছেন, কিন্তু অবাক্ হইয়া এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন, যাঁহাদের ভাব হইয়াছে, তাঁহাদের বাহ্য চৈতন্য কিছুই নাই, সকলেই স্থির, নিস্পন্দ; ভাব উপশম হইলে কেহ কাঁদিতেছেন, কেহ কেহ হাসিতেছেন। যেন কতকগুলি মাতাল একত্র হইয়াছে।
৫৩.১৯ ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – ভক্তসঙ্গে—শ্রীরামকৃষ্ণ ও ক্রোধজয়
এই কাণ্ডের পর সকলে আবার আসন গ্রহণ করিলেন। রাত আটটা হইয়া গিয়াছে। আবার কথাবার্তা হইতে লাগিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—এই যা ভাব-টাব দেখলে তোমার সায়েন্স কি বলে? তোমার কি এ-সব ঢঙ বোধ হয়?
ডাক্তার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—যেখানে এত লোকের হচ্ছে সেখানে natural (আন্তরিক) বোধ হয়, ঢঙ বোধ হয় না। (নরেন্দ্রের প্রতি) যখন তুমি গাচ্ছিলে ‘দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই মা জ্ঞান বিচারে’ তখন আর থাকতে পারি নাই। দাঁড়াই আর কি! তারপর অনেক কষ্টে ভাব চাপলুম; ভাবলুম যে display করা হবে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি, সহাস্যে)—তুমি যে অটল অচল সুমেরুবৎ। (সকলের হাস্য) তুমি গম্ভীরাত্মা, রূপসনাতনের ভাব কেউ টের পেতো না—যদি ডোবাতে হাতি নামে, তাহলেই তোলপাড় হয়ে যায়, কিন্তু সায়ের দীঘিতে নামলে তোলপাড় হয় না। কেউ হয়তো টেরও পায় না। শ্রীমতী সখীকে বললেন, ‘সখি, তোরা তো কৃষ্ণের বিরহে কত কাঁদছিস। কিন্তু দেখ, আমি কি কঠিন, আমার চক্ষে একবিন্দুও জল নাই।’ তখন বৃন্দা বললেন, সখি, তোর চক্ষে জল নাই, তার অনেক মানে আছে। তোর হৃদয়ে বিরহ অগ্নি সদা জ্বলছে; চক্ষে জল উঠছে আর সেই অগ্নির তাপে শুকিয়ে যাচ্ছে!
ডাক্তার—তোমার সঙ্গে তো কথায় পারবার জো নাই। (হাস্য)
ক্রমে অন্য কথা পড়িল। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের প্রথম ভাবাবস্থা বর্ণনা করিতেছিলেন। আর কাম-ক্রোধাদি কিরূপে বশ করিতে হয়।
ডাক্তার—তুমি ভাবে পড়েছিলে, আর-একজন দুষ্ট লোক তোমায় বুট জুতার গোঁজা মেরেছিল—সে-সব কথা শুনেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে কালীঘাটের চন্দ্র হালদার। সেজোবাবুর কাছে প্রায় আসত। আমি ঈশ্বরের আবেশে মাটিতে অন্ধকারে পড়ে আছি। চন্দ্র হালদার ভাবত, আমি ঢঙ করে ওইরকম হয়ে থাকি, বাবুর প্রিয়পাত্র হব বলে। সে অন্ধকারে এসে বুট জুতার গোঁজা দিতে লাগল। গায়ে দাগ হয়েছিল। সবাই বললে, সেজোবাবুকে বলে দেওয়া যাক। আমি বারণ করলুম।
ডাক্তার—এও ঈশ্বরের খেলা; ওতেও লোক শিখবে, ক্রোধ কিরকম করে বশীভূত করতে হয়। ক্ষমা কাকে বলে, লোক শিখবে।
[বিজয় ও নরেন্দ্রের ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন]
ইতিমধ্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সম্মুখে বিজয়ের সঙ্গে ভক্তদের অনেক কথাবার্তা হইতেছে।
বিজয়—কে একজন আমার সঙ্গে সদা-সর্বদা থাকেন, আমি দূরে থাকলেও তিনি জানিয়ে দেন, কোথায় কি হচ্ছে।
নরেন্দ্র—Guardian angel-এর মতো।
বিজয়—ঢাকায় এঁকে (পরমহংসদেবকে) দেখেছি! গা ছুঁয়ে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—সে তবে আর-একজন!
নরেন্দ্র—আমিও এঁকে নিজে অনেকবার দেখেছি! (বিজয়ের প্রতি) তাই কি করে বলব—আপনার কথা বিশ্বাস করি না।
৫৩.২০ বিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ—গিরিশ, মাস্টার প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
পরদিন আশ্বিনের কৃষ্ণা তৃতীয়া তিথি, সোমবার, ১১ই কার্তিক—২৬শে অক্টোবর, ১৮৮৫। শ্রীশ্রীপরমহংসদেব কলিকাতায় ওই শ্যামপুকুরের বাটীতে চিকিত্সার্থ রহিয়াছেন। ডাক্তার সরকার চিকিত্সা করিতেছেন। প্রায় প্রত্যহ আসেন, আর তাঁহার নিকট পীড়ার সংবাদ লইয়া লোক সর্বদা যাতায়াত করে।
শরত্কাল। কয়েকদিন হইল শারদীয়া দুর্গাপূজা হইয়া গিয়াছে। এ মহোত্সব শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যমণ্ডলী হর্ষ-বিষাদে অতিবাহিত করিয়াছেন। তিন মাস ধরিয়া গুরুদেবের কঠিন পীড়া—কণ্ঠদেশে—ক্যান্সার। সরকার ইত্যাদি ডাক্তার ইঙ্গিত করিয়াছেন, পীড়া চিকিত্সার অসাধ্য। হতভাগ্য শিষ্যেরা এ-কথা শুনিয়া একান্তে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করেন। এক্ষণে এই শ্যামপুকুরের বাটীতে আছেন। শিষ্যরা প্রাণপণে শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা করিতেছেন। নরেন্দ্রাদি কৌমারবৈরাগ্যযুক্ত শিষ্যগণ এই মহতী সেবা উপলক্ষে কামিনী-কাঞ্চন-ত্যাগপ্রদর্শী সোপান আরোহণ করিতে সবে শিখিতেছেন।
এত পীড়া কিন্তু দলে দলে লোক দর্শন করিতে আসিতেছেন—শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসিলেই শান্তি ও আনন্দ হয়। অহেতুক-কৃপাসিন্ধু! দয়ার ইয়ত্তা নাই—সকলের সঙ্গেই কথা কহিতেছেন, কিসে তাহাদের মঙ্গল হয়। শেষে ডাক্তারেরা, বিশেষতঃ ডাক্তার সরকার, কথা কহিতে একেবারে নিষেধ করিলেন। কিন্তু ডাক্তার নিজে ৬।৭ ঘণ্টা করিয়া থাকেন। তিনি বলেন, “আর কাহারও সহিত কথা কওয়া হবে না, কেবল আমার সঙ্গে কথা কইবে।”
শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃত পান করিয়া ডাক্তার একেবারে মুগ্ধ হইয়া যান। তাই এতক্ষণ ধরিয়া বসিয়া থাকেন।
বেলা দশটার সময় ডাক্তারকে সংবাদ দিবার জন্য মাস্টার যাইবেন, তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত কথাবার্তা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—অসুখটা খুব হাল্কা হয়েছে। খুব ভাল আছি। আচ্ছা, তবে ঔষধে কি এরূপ হয়েছে? তাহলে ওই ঔষধটা খাই না কেন?
মাস্টার—আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, তাঁকে সব বলব; তিনি যা ভাল হয় তাই বলবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখ, পূর্ণ4 দুই-তিনদিন আসে নাই, বড় মন কেমন কচ্ছে।
মাস্টার—কালীবাবু, তুমি যাও না পূর্ণকে ডাকতে।
কালী—এই যাব।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—ডাক্তারের ছেলেটি বেশ! একবার আসতে বলো।
৫৩.২১ একবিংশ পরিচ্ছেদ – মাস্টার ও ডাক্তার সংবাদ
মাস্টার ডাক্তারের বাড়ি উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ডাক্তার দুই-একজন বন্ধু সঙ্গে বসিয়া আছেন।
ডাক্তার (মাস্টারের প্রতি)—এই একমিনিট হল তোমার কথা কচ্ছিলাম। দশটায় আসবে বললে, দেড় ঘণ্টা বসে। ভাবলুম, কেমন আছেন, কি হল। (বন্ধুকে) ‘ওহে সেই গানটা গাও তো’।
বন্ধু গাহিতেছেন :
কর তাঁর নাম গান, যতদিন দেহে রহে প্রাণ ।
যাঁর মহিমা জ্বলন্ত জ্যোতিঃ, জগৎ করে হে আলো;
স্রোত বহে প্রেমপীযূষ-বারি, সকল জীব সুখকারী হে ।
করুণা স্মরিয়ে তনু হয় পুলকিত বাক্যে বলিতে কি পারি ।
যাঁর প্রসাদে এক মুহূর্তে সকল শোক অপসারি হে ।
উচ্চে নিচে দেশ দেশান্তে, জলগর্ভে, কি আকাশে;
অন্ত কোথা তাঁর, অন্ত কোথা তাঁর, এই সবে সদা জিজ্ঞাসে হে ।
চেতন নিকেতন পরশ রতন সেই নয়ন অনিমেষ,
নিরঞ্জন সেই, যাঁর দরশনে, নাহি রহে দুঃখ লেশ হে ।
ডাক্তার (মাস্টারকে)—গানটি খুব ভাল,—নয়? ওইখানটি কেমন?
‘অন্ত কোথা তাঁর, অন্ত কোথা তাঁর, এই সবে সদা জিজ্ঞাসে।’
মাস্টার—হাঁ, ও-খানটি বড় চমত্কার! খুব অনন্তের ভাব।
ডাক্তার (সস্নেহে)—অনেক বেলা হয়েছে, তুমি খেয়েছো তো? আমার দশটার মধ্যে খাওয়া হয়ে যায়, তারপর আমি ডাক্তারী করতে বেরুই। না খেয়ে বেরুলে অসুখ করে। ওহে, একদিন তোমাদের খাওয়াব মনে করেছি।
মাস্টার—তা বেশ তো, মহাশয়।
ডাক্তার—আচ্ছা, এখানে না সেখানে? তোমরা যা বল।—
মাস্টার—মহাশয়, এইখানেই হোক, আর সেইখানেই হোক, সকলে আহ্লাদ করে খাব।
এইবার মা কালীর কথা হইতেছে।
ডাক্তার—কালী তো একজন সাঁওতালী মাগী। (মাস্টারের উচ্চহাস্য)
মাস্টার—ও-কথা কোথায় আছে?
ডাক্তার—শুনেছি এইরকম। (মাস্টারের হাস্য)
পূর্বদিন শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ ও অন্যান্য ভক্তের ভাবসমাধি হইয়াছিল। ডাক্তারও উপস্থিত ছিলেন। সেই কথা হইতেছে।
ডাক্তার—ভাব তো দেখলুম। বেশি ভাব কি ভাল?
মাস্টার—পরমহংসদেব বলেন যে, ঈশ্বরচিন্তা করে যে ভাব হয় তা বেশি হলে কোন ক্ষতি হয় না। তিনি বলেন যে মণির জ্যোতিতে আলো হয় আর শরীর স্নিগ্ধ হয়, কিন্তু গা পুড়ে যায় না!
ডাক্তার—মণির জ্যোতিঃ; ও যে Reflected light!
মাস্টার—তিনি আরও বলেন, অমৃতসরোবরে ডুবলে মানুষ মরে যায় না। ঈশ্বর অমৃতের সরোবর। তাঁতে ডুবলে মানুষের অনিষ্ট হয় না; বরং মানুষ অমর হয়। অবশ্য যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকে।
ডাক্তার—হাঁ, তা বটে।
ডাক্তার গাড়িতে উঠিলেন, দু-চারিটি রোগী দেখিয়া পরমহংসদেবকে দেখিতে যাইবেন। পথে আবার মাস্টারের সঙ্গে কথা হইতে লাগিল। ‘চক্রবর্তীর অহংকার’ ডাক্তার এই কথা তুলিলেন।
মাস্টার—পরমহংসদেবের কাছে তাঁর যাওয়া-আসা আছে। অহংকার যদি থাকে, কিছুদিনের মধ্যে আর থাকবে না। তাঁর কাছে বসলে জীবের অহংকার পলায়ন করে, অহংকার চূর্ণ হয়। ওখানে অহংকার নাই কি না, তাই। নিরহংকারের নিকট আসলে অহংকার পালিয়ে যায়। দেখুন, বিদ্যাসাগর মহাশয় অত বড়লোক, কত বিনয় আর নম্রতা দেখিয়েছেন। পরমহংসদেব তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন, বাদুড়বাগানের বাড়িতে। যখন বিদায় লন, রাত তখন ৯টা। বিদ্যাসাগর লাইব্রেরীঘর থেকে বরাবর সঙ্গে সঙ্গে, নিজে এক-একবার বাতি ধরে, এসে গাড়িতে তুলে দিলেন; আর বিদায়ের সময় হাতজোড় করে রহিলেন।
ডাক্তার—আচ্ছা, এঁর বিষয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কি মত?
মাস্টার—সেদিন খুব ভক্তি করেছিলেন। তবে কথা কয়ে দেখেছি, বৈষ্ণবেরা যাকে ভাব-টাব বলে, সে বড় ভালবাসেন না। আপনার মতের মতো।
ডাক্তার—হাতজোড় করা, পায়ে মাথা দেওয়া, আমি ও-সব ভালবাসি না। মাথাও যা, পাও তা। তবে যার পা অন্য জ্ঞান আছে, সে করুক।
মাস্টার—আপনি ভাব-টাব ভালবাসেন না। পরমহংসদেব আপনাকে ‘গম্ভীরাত্মা’ মাঝে মাঝে বলেন, বোধ হয় মনে আছে। তিনি কাল আপনাকে বলছিলেন যে, ডোবাতে হাতি নামলে জল তোলপাড় হয়, কিন্তু সায়ের দীঘি বড়, তাতে হাতি নামলে জল নড়েও না। গম্ভীরাত্মার ভিতর ভাবহস্তী নামলে তার কিছু করতে পারে না। তিনি বলেন, আপনি ‘গম্ভীরাত্মা’।
ডাক্তার—I don’t deserve the Compliment, ভাব আর কি? feelings; ভক্তি, আর অন্যান্য feelings—বেশি হলে কেউ চাপতে পারে, কেউ পারে না।
মাস্টার—Explanation কেউ দিতে পারে একরকম করে—কেউ পারে না; কিন্তু মহাশয়, ভাবভক্তি জিনিসটা অপূর্ব সামগ্রী। Stebbing on Darwinism আপনার library-তে দেখলাম। Stebbing বলেন, Human mind যার দ্বারাই হউক—evolution দ্বারাই হোক বা ঈশ্বর আলাদা বসে সৃষ্টিই করুন—equally wonderful. তিনি একটি বেশ উপমা দিয়েছেন—theory of light. Whether you know the undulatory theory of light or not, light in either case is equally wonderful.
ডাক্তার—হাঁ; আর দেখেছো, Stebbing Darwinism মানে, আবার God মানে।
আবার পরমহংসদেবের কথা পড়িল।
ডাক্তার—ইনি (পরমহংসদেব) দেখছি কালীর উপাসক।
মাস্টার—তাঁর ‘কালী’ মানে আলাদা। বেদ যাঁকে পরমব্রহ্ম বলে, তিনি তাঁকেই কালী বলেন। মুসলমান যাঁকে আল্লা বলে, খ্রীষ্টান যাঁকে গড্ বলে, তিনি তাঁকেই কালী বলেন। তিনি অনেক ঈশ্বর দেখেন না, এক দেখেন। পুরাতন ব্রহ্মজ্ঞানীরা যাঁকে ব্রহ্ম বলে গেছেন, যোগীরা যাঁকে আত্মা বলেন, ভক্তেরা যাঁকে ভগবান বলেন, পরমহংসদেব তাঁকেই কালী বলেন।
“তাঁর কাছে শুনেছি, একজনের একটি গামলা ছিল, তাতে রঙ ছিল। কারু কাপড় ছোপাবার দরকার হলে তার কাছে যেত। সে জিজ্ঞাসা করত, তুমি কি রঙে ছোপাতে চাও। লোকটি যদি বলত সবুজ রঙ, তাহলে কাপড়খানি গামলার রঙে ডুবিয়ে ফিরিয়ে দিত; ও বলত, এই লও তোমার সবুজ রঙে ছোপানো কাপড়। যদি কেহ বলত লাল রঙ, সেই গামলায় কাপড়খানি ছুপিয়ে সে বলত, এই লও তোমার লালে ছোপানো কাপড়। এই এক গামলার রঙে সবুজ, নীল, হলদে, সব রঙের কাপড় ছোপানো হত। এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে একজন লোক বললে, বাবু আমি কি রঙ চাই বলব? তুমি নিজে যে রঙে ছুপেছো আমায় সেই রঙ দাও। সেইরূপ পরমহংসদেবের ভিতরে সব ভাব আছে,—সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের লোক তাঁর কাছে শান্তি পায় ও আনন্দ পায়। তাঁর যে কি ভাব, কি গভীর অবস্থা, তা কে বুঝবে?”
ডাক্তার—All things to all men! তাও ভাল নয়, although St. Paul says it.
মাস্টার—পরমহংসদেবের অবস্থা কে বুঝবে? তাঁর মুখে শুনেছি, সুতার ব্যবসা না করলে ৪০ নং সুতা আর ৪১ নং সুতার প্রভেদ বুঝা যায় না। পেন্টার না হলে পেন্টার-এর আর্ট বুঝা যায় না। মহাপুরুষের গভীর ভাব। ক্রাইস্ট-এর ন্যায় না হলে ক্রাইস্ট-এর সব ভাব বুঝা যায় না। পরমহংসদেবের এই গভীর ভাব হয়তো ক্রাইস্ট যা বলেছিলেন তাই—Be perfect as your Father in heaven is perfect.
ডাক্তার—আচ্ছা, তাঁর অসুখের তদারক তোমরা কিরূপ কর?
মাস্টার—আপাততঃ, প্রত্যহ একজন সুপার্ইন্টেণ্ড করেন, যাঁহাদের বয়স বেশি। কোনদিন গিরিশবাবু, কোনদিন রামবাবু, কোনদিন বলরামবাবু, কোনদিন সুরেশবাবু, কোনদিন নবগোপাল, কোনদিন কালীবাবু, এইরকম।
৫৩.২২ দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ – ভক্তসঙ্গে—শুধু পাণ্ডিত্যে কি আছে?
এই সকল কথা হইতে হইতে শ্রীশ্রীঠাকুর পরমহংসদেব শ্যামপুকুরে যে বাড়িতে চিকিত্সার্থ অবস্থান করিতেছেন, সেই বাড়ির সম্মুখে ডাক্তারের গাড়ি আসিয়া লাগিল। তখন বেলা ১টা। ঠাকুর দোতলার ঘরে বসিয়া আছেন। অনেকগুলি ভক্ত সম্মুখে উপবিষ্ট; তন্মধ্যে শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষ, ছোট নরেন্দ্র, শরৎ ইত্যাদি। সকলের দৃষ্টি সেই মহাযোগী সদানন্দ মহাপুরুষের দিকে। সকলে যেন মন্ত্রমুগ্ধ সর্পের ন্যায় রোজার সম্মুখে বসিয়া আছেন। অথবা বরকে লইয়া বরযাত্রীরা যেন আনন্দ করিতেছেন। ডাক্তার ও মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন।
ডাক্তারকে দেখিয়া হাসিতে হাসিতে শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “আজ বেশ ভাল আছি।”
ক্রমে ভক্তসঙ্গে ঈশ্বর সম্বন্ধীয় অনেক কথাবার্তা চলিতে লাগিল।
[পূর্বকথা—রামনারায়ণ ডাক্তার—বঙ্কিম সংবাদ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—শুধু পণ্ডিত কি হবে, যদি বিবেক-বৈরাগ্য না থাকে। ঈশ্বরের পাদপদ্ম চিন্তা করলে আমার একটি অবস্থা হয়। পরনের কাপড় পড়ে যায়, শিড়্ শিড় করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কি একটা উঠে। তখন সকলকে তৃণজ্ঞান হয়। পণ্ডিতের যদি দেখি বিবেক নাই, ঈশ্বরে ভালবাসা নাই, খড়কুটো মনে হয়।
“রামনারায়ণ ডাক্তার আমার সঙ্গে তর্ক করছিল; হঠাৎ সেই অবস্থাটা হল। তারপর তাঁকে বললুম, তুমি কি বলছো? তাঁকে তর্ক করে কি বুঝবে! তাঁর সৃষ্টিই বা কি বুঝবে। তোমার তো ভারী তেঁতে বুদ্ধি। আমার অবস্থা দেখে সে কাঁদতে লাগল—আর আমার পা টিপতে লাগল।”
ডাক্তার—রামনারায়ণ ডাক্তার হিন্দু কি না! আবার ফুল-চন্দন লয়! সত্য হিন্দু কি না।
মাস্টার (স্বগতঃ)—ডাক্তার বলেছিলেন, আমি শাঁকঘণ্টায় নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বঙ্কিম তোমাদের একজন পণ্ডিত। বঙ্কিমের১ সঙ্গে দেখা হয়েছিল—আমি জিজ্ঞাসা করলুম, মানুষের কর্তব্য কি? তা বলে, ‘আহার, নিদ্রা আর মৈথুন।’ এই সকল কথাবার্তা শুনে আমার ঘৃণা হল। বললুম যে, তোমার এ কিরকম কথা! তুমি তো বড় ছ্যাঁচ্ড়া। যা সব রাতদিন চিন্তা করছো, কাজে করছো, তাই আবার মুখ দিয়ে বেরুচ্চে। মূলো খেলেই মূলোর ঢেঁকুর উঠে। তারপর অনেক ঈশ্বরীয় কথা হল। ঘরে সংকীর্তন হল। আমি আবার নাচলুম। তখন বলে, মহাশয়! আমাদের ওখানে একবার যাবেন। আমি বললুম, সে ঈশ্বরের ইচ্ছা। তখন বলে, আমাদের সেখানেও ভক্ত আছে, দেখবেন। আমি হাসতে হাসতে বললুম, কি রকম ভক্ত আছে গো? ‘গোপাল!’ ‘গোপাল!’ যারা বলেছিল, সেইরকম ভক্ত নাকি?
ডাক্তার—‘গোপাল!’ ‘গোপাল।’ সে ব্যাপারটা কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—একটি স্যাকরার দোকান ছিল। বড় ভক্ত, পরম বৈষ্ণব—গলায় মালা, কপালে তিলক, হস্তে হরিনামের মালা। সকলে বিশ্বাস করে ওই দোকানেই আসে, ভাবে এরা পরমভক্ত, কখনও ঠকাতে যাবে না। একদল খদ্দের এলে দেখত কোনও কারিগর বলছে ‘কেশব!’ ‘কেশব!’ আর-একজন কারিগর খানিক পরে নাম করছে ‘গোপাল!’ ‘গোপাল!’ আবার খানিকক্ষণ পরে একজন কারিগর বলছে, ‘হরি’ ‘হরি’, তারপর কেউ বলছে ‘হর! হর!’ কাজে কাজেই এত ভগবানের নাম দেখে খরিদ্দারেরা সহজেই মনে করত, এ-স্যাকরা অতি উত্তম লোক।—কিন্তু ব্যাপারটা কি জানো? যে বললে, ‘কেশব, কেশব!’ তার মনের ভাব, এ-সব (খদ্দের) কে? যে বললে ‘গোপাল! গোপাল!’ তার অর্থ এই যে আমি এদের চেয়ে চেয়ে দেখলুম, এরা গরুর পাল। (হাস্য) যে বললে ‘হরি হরি’—তার অর্থ এই যে, যদি গরুর পাল, তবে হরি অর্থাৎ হরণ করি। (হাস্য) যে বললে, ‘হর হর!’—তার মানে এই—তবে হরণ কর, হরণ কর; এরা তো গরুর পাল! (হাস্য)
“সেজোবাবুর সঙ্গে আর-একজায়গায় গিয়েছিলাম; অনেক পণ্ডিত আমার সঙ্গে বিচার করতে এসেছিল। আমি তো মুখ্যু! (সকলের হাস্য) তারা আমার সেই অবস্থা দেখলে, আর আমার সঙ্গে কথাবার্তা হলে বললে, মহাশয়! আগে যা পড়েছি, তোমার সঙ্গে কথা কয়ে সে সব পড়া বিদ্যা সব থু হয়ে গেল! এখন বুঝেছি, তাঁর কৃপা হলে জ্ঞানের অভাব থাকে না, মূর্খ বিদ্বান হয়, বোবার কথা ফুটে! তাই বলছি, বই পড়লেই পণ্ডিত হয় না।”১ কলিকাতা বেনেটোলা নিবাসী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পরমভক্ত শ্রীঅধরলাল সেনের বাটীতে শ্রীযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চাটুজ্যের সহিত শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের দেখা হইয়াছিল। বঙ্কিমবাবু তাঁহাকে এই একবার মাত্র দর্শন করিয়াছিলেন।
[পূর্বকথা—প্রথম সমাধি—আবির্ভাব ও মূর্খের কণ্ঠে সরস্বতী]
“হাঁ, তাঁর কৃপা হলে জ্ঞানের কি আর অভাব থাকে? দেখ না, আমি তো মুখ্যু, কিছুই জানি না, তবে এ-সব কথা বলে কে? আবার এ-জ্ঞানের ভাণ্ডার অক্ষয়। ও-দেশে ধান মাপে, ‘রামে রাম, রামে রাম’, বলতে বলতে। একজন মাপে, আর যাই ফুরিয়ে আসে, আর-একজন রাশ ঠেলে দেয়। তার কর্মই ওই, ফুরালেই রাশ ঠেলে। আমিও যা কথা কয়ে যাই, ফুরিয়ে আসে আসে হয়, মা আমার অমনি তাঁর অক্ষয় জ্ঞান-ভাণ্ডারের রাশ ঠেলে দেন!
“ছেলেবেলায় তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। এগারো বছরের সময় মাঠের উপর কি দেখলুম! সবাই বললে, বেহুঁশ হয়ে গিছলুম, কোন সাড় ছিল না। সেই দিন থেকে আর-একরকম হয়ে গেলুম। নিজের ভিতর আর-একজনকে দেখতে লাগলাম! যখন ঠাকুর পূজা করতে যেতুম, হাতটা অনেক সময় ঠাকুরের দিকে না গিয়ে নিজের মাথার উপর আসত, আর ফুল মাথায় দিতুম! যে ছোকরা আমার কাছে থাকত, সে আমার কাছে আসত না; বলত, তোমার মুখে কি এক জ্যোতিঃ দেখছি, তোমার বেশি কাছে যেতে ভয় হয়!”
৫৩.২৩ ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ – FREE WILL OR GOD’S WILL? ‘যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া’
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি তো মুখ্যু, আমি কিছু জানি না, তবে এ-সব বলে কে? আমি বলি, ‘মা, আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি ঘর, তুমি ঘরণী; আমি রথ, তুমি রথী; যেমন করাও তেমনি করি, যেমন বলাও তেমনি বলি, যেমন চালাও তেমনি চলি; নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু।’ তাঁরই জয়; আমি তো কেবল যন্ত্র মাত্র! শ্রীমতী যখন সহস্রধারা কলসী লয়ে যাচ্ছিলেন, জল একটুকুও পড়ে নাই, সকলে তাঁর প্রশংসা করতে লাগল; বলে এমন সতী হবে না। তখন শ্রীমতী বললেন, ‘তোমরা আমার জয় কেন দাও; বল, কৃষ্ণের জয়, কৃষ্ণের জয়! আমি তাঁর দাসী মাত্র।’ ওই অবস্থায় ভাবে বিজয়ের বুকে পা দিলুম; এদিকে তো বিজয়কে এত ভক্তি করি, সেই বিজয়ের গায়ে পা দিলুম, তার কি বল দেখি!
ডাক্তার—তারপর সাবধান হওয়া উচিত।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাতজোড় করে)—আমি কি করব? সেই অবস্থাটা এলে বেহুঁশ হয়ে যাই! কি করি, কিছুই জানতে পারি না।
ডাক্তার—সাবধান হওয়া উচিত, হাতজোড় করলে কি হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তখন কি আমি কিছু করতে পারি?—তবে তুমি আমার অবস্থা কি মনে কর? যদি ঢঙ মনে কর তাহলে তোমার সায়েন্স-মায়েন্স সব ছাই পড়েছো।
ডাক্তার—মহাশয়, যদি ঢঙ মনে করি তাহলে কি এত আসি? এই দেখ, সব কাজ ফেলে এখানে আসি; কত রোগীর বাড়ি যেতে পারি না, এখানে এসে ছয়-সাত ঘণ্টা ধরে থাকি।
[‘ন যোৎস্যে’—ভগবদ্গীতা—ঈশ্বরই কর্তা, অর্জুন যন্ত্র]
শ্রীরামকৃষ্ণ—সেজোবাবুকে বলেছিলাম, তুমি মনে করো না, তুমি একটা বড়মানুষ, আমায় মানছো বলে আমি কৃতার্থ হয়ে গেলুম! তা তুমি মানো আর নাই মানো। তবে একটি কথা আছে—মানুষ কি করবে, তিনিই মানাবেন। ঈশ্বরীয় শক্তির কাছে মানুষ খড়কুটো!
ডাক্তার—তুমি কি মনে করেছো অমুক মাড় তোমায় মেনেছে বলে আমি তোমায় মানব? তবে তোমায় সম্মান করি বটে, তোমায় রিগার্ড করি, মানুষকে যেমন রিগার্ড করে—
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি কি মানতে বলছি গা?
গিরিশ ঘোষ—উনি কি আপনাকে মানতে বলছেন?
ডাক্তার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—তুমি কি বলছো—ঈশ্বরের ইচ্ছা?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তবে আর কি বলছি! ঈশ্বরীয় শক্তির কাছে মানুষ কি করবে? অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বললেন, আমি যুদ্ধ করতে পারব না, জ্ঞাতি বধ করা আমার কর্ম নয়। শ্রীকৃষ্ণ বললেন—‘অর্জুন! তোমায় যুদ্ধ করতেই হবে, তোমার স্বভাবে করাবে!’ শ্রীকৃষ্ণ সব দেখিয়ে দিলেন, এই এই সব লোক মরে রয়েছে।১ শিখরা ঠাকুর বাড়িতে এসেছিল; তাঁদের মতে অশ্বত্থ গাছে যে পাতা নড়ছে, সেও ঈশ্বরের ইচ্ছায়—তাঁর ইচ্ছা বই একটি পাতাও নড়বার জো নাই!১ ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্বমেব, নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্। [গীতা, ১১|৩৩]
[Liberty or Necessity?—Influence of Motives]
ডাক্তার—যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা, তবে তুমি বকো কেন? লোকদের জ্ঞান দেবার জন্য অত কথা কও কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—বলাচ্ছেন, তাই বলি। ‘আমি যন্ত্র—তুমি যন্ত্রী।’
ডাক্তার—যন্ত্র তো বলছো; হয় তাই বল, নয় চুপ করে থাকো। সবই ঈশ্বর।
গিরিশ—মশাই, যা মনে করুন। কিন্তু তিনি করান তাই করি। A single step against the Almighty will (তাঁর ইচ্ছার প্রতিকূলে এক পা) কেউ যেতে পারে?
ডাক্তার—Free Will তিনিই দিয়েছেন তো। আমি মনে করলে ঈশ্বর চিন্তা করতে পারি, আবার না করলে না করতে পারি।
গিরিশ—আপনার ঈশ্বরচিন্তা বা অন্য কোন সত্কাজ ভাল লাগে বলে করেন। আপনি করেন না, সেই ভাল লাগাটা করায়।
ডাক্তার—কেন, আমি কর্তব্য কর্ম বলে করি—
গিরিশ—সেও কর্তব্য কর্ম করতে ভাল লাগে বলে!
ডাক্তার—মনে কর একটি ছেলে পুড়ে যাচ্ছে; তাকে বাঁচাতে যাওয়া কর্তব্য বোধে—
গিরিশ—ছেলেটিকে বাঁচাতে আনন্দ হয়, তাই আগুনের ভিতর যান; আনন্দ আপনাকে নিয়ে যায়। চাটের লোভে গুলি খাওয়া! (সকলের হাস্য)
[“জ্ঞানং জ্ঞেয়ং পরিজ্ঞাতা ত্রিবিধা কর্মচোদনা”]১
শ্রীরামকৃষ্ণ—কর্ম করতে গেলে আগে একটি বিশ্বাস চাই, সেই সঙ্গে জিনিসটি মনে করে আনন্দ হয়, তবে সে ব্যক্তি কাজে প্রবৃত্ত হয়। মাটির নিচে একঘড়া মোহর আছে—এই জ্ঞান, এই বিশ্বাস, প্রথমে চাই। ঘড়া মনে করে সেই সঙ্গে আনন্দ হয়—তারপর খোঁড়ে। খুঁড়তে খুঁড়তে ঠং শব্দ হলে আনন্দ বাড়ে। তারপর ঘড়ার কানা দেখা যায়। তখন আনন্দ আরও বাড়ে। এইরকম ক্রমে ক্রমে আনন্দ বাড়তে থাকে। আমি নিজে ঠাকুরবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছি,—সাধু গাঁজা তয়ের করছে আর সাজতে সাজতে আনন্দ।
ডাক্তার—কিন্তু আগুন ‘হীট’ও (উত্তাপ) দেয়, আর ‘লাইট’ও (আলো) দেয়। আলোতে দেখা যায় বটে; কিন্তু উত্তাপে গা পুড়ে যায়। ডিউটি (কর্তব্য কর্ম) করতে গেলে কেবল আনন্দ হয় তা নয়, কষ্টও আছে!
মাস্টার (গিরিশের প্রতি)—পেটে খেলে পিঠে সয়। কষ্টতেও আনন্দ।
গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি)—ডিউটি শুষ্ক।
ডাক্তার—কেন?
গিরিশ—তবে সরস। (সকলের হাস্য)
মাস্টার—বেশ, এইবার লোভে গুলি খাওয়া এসে পড়ল।
গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি)—সরস; নচেৎ ডিউটি কেন করেন?
ডাক্তার—এইরূপ মনের ইনক্লিনেসন (মনের ওইদিকে গতি)।
মাস্টার (গিরিশের প্রতি)—‘পোড়া স্বভাবে টানে!’ (হাস্য) যদি একদিকে ঝোঁকই (ইনক্লিনেসন) হল Free Will কোথায়?
ডাক্তার—আমি Free (স্বাধীন) একেবারে বলছি না। গরু খুঁটিতে বাঁধা আছে, দড়ি যতদূর যায়, তার ভিতর ফ্রি। দড়ি টান পড়লে আবার—১ গীতা, [১৮|১৮]
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও Free Will]
শ্রীরামকৃষ্ণ—এই উপমা যদু মল্লিকও বলেছিল। (ছোট নরেন্দ্রের প্রতি) একি ইংরাজীতে আছে?
(ডাক্তারের প্রতি)—“দেখ, ঈশ্বর সব করছেন, তিনি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র। এ-বিশ্বাস যদি কারু হয়, সে তো জীবন্মুক্ত—‘তোমার কর্ম তুমি কর, লোকে বলে করি আমি।’ কিরকম জানো? বেদান্তের একটি উপমা আছে—একটা হাঁড়িতে ভাত চড়িয়েছ, আলু, বেগুন সব ভাতে দিয়েছ; খানিক পরে আলু, বেগুন, চাল লাফাতে থাকে, যেন অভিমান করছে ‘আমি নড়ছি’, ‘আমি লাফাচ্ছি।’ ছোট ছেলেরা ভাবে, আলু, পটল, বেগুন ওরা বুঝি জীয়ন্ত, তাই লাফাচ্ছে। যাদের জ্ঞান হয়েছে তারা কিন্তু বুঝিয়ে দেয় যে, এই সব আলু, বেগুন, পটল এরা জীয়ন্ত নয়, নিজে লাফাচ্ছে না। হাঁড়ির নিচে আগুন জ্বলছে, তাই ওরা লাফাচ্ছে। যদি কাঠ টেনে লওয়া যায়, তাহলে আর নড়ে না। জীবের ‘আমি কর্তা’ এই অভিমান অজ্ঞান থেকে হয়। ঈশ্বরের শক্তিতে সব শক্তিমান। জ্বলন্ত কাঠ টেনে নিলে সব চুপ।—পুতুলনাচের পুতুল বাজিকরের হাতে বেশ নাচে, হাত থেকে পড়ে গেলে আর নড়ে না চড়ে না!
“যতক্ষণ না ঈশ্বরদর্শন হয়, যতক্ষণ সেই পরশমণি ছোঁয়া না হয়, ততক্ষণ আমি কর্তা এই ভুল থাকবে; আমি সৎ কাজ করেছি, অসৎ কাজ করেছি, এই সব ভেদ বোধ থাকবেই থাকবে। এ-ভেদবোধ তাঁরই মায়া—তাঁর মায়ার সংসার চালাবার জন্য বন্দোবস্ত। বিদ্যামায়া আশ্রয় করলে, সত্পথ ধরলে তাঁকে লাভ করা যায়। যে লাভ করে, যে ঈশ্বরকে দর্শন করে, সেই মায়া পার হয়ে যেতে পারে। তিনিই একমাত্র কর্তা, আমি অকর্তা,এ-বিশ্বাস যার, সেই জীবন্মুক্ত, এ-কথা কেশব সেনকে বলেছিলাম।”
গিরিশ—Free Will কেমন করে আপনি জানলেন?
ডাক্তার—Reason (বিচার)-এর দ্বারা নয়—I feel it!
গিরিশ—Then I and others feel it to be the reverse.
(আমরা সকলে ঠিক উলটো বোধ করি যে, আমরা পরতন্ত্র)। (সকলের হাস্য)
ডাক্তার—ডিউটির ভিতর দুটো এলিমেন্ট—(১) ডিউটি বলে কর্তব্য কর্ম করতে যাই, (২) পরে আহ্লাদ হয়। কিন্তু initial stage-এ (গোড়াতে) আনন্দ হবে বলে যাই না। ছেলেবেলায় দেখতুম পুরুত সন্দেশে পিঁপড়ে হলে বড় ভাবিত হত। পুরুতের প্রথমেই সন্দেশ-চিন্তা করে আনন্দ হয় না। (হাস্য) প্রথমে বড় ভাবনা।
মাস্টার (স্বগত)—পরে আনন্দ, কি সঙ্গে সঙ্গে মনে আনন্দ হয়, বলা কঠিন। আনন্দের জোরে কার্য হলে, Free Will কোথায়?
৫৩.২৪ চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ – অহৈতুকী ভক্তি—পূর্বকথা—শ্রীরামকৃষ্ণের দাসভাব
শ্রীরামকৃষ্ণ—ইনি (ডাক্তার) যা বলেছেন, তার নাম অহৈতুকী ভক্তি। মহেন্দ্র সরকারের কাছে আমি কিছু চাই না—কোন প্রয়োজন নাই, মহেন্দ্র সরকারকে দেখতে ভাল লাগে, এরই নাম অহৈতুকী ভক্তি। একটু আনন্দ হয় তা কি করব?
“অহল্যা বলেছিল, হে রাম! যদি শূকরযোনিতে জন্ম হয় তাতেও আমার আপত্তি নাই, কিন্তু যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি থাকে—আমি আর কিছু চাই না।
“রাবণ বধের কথা স্মরণ করাবার জন্য নারদ অযোধ্যায় রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি সীতারাম দর্শন করে স্তব করতে লাগলেন। রামচন্দ্র স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘নারদ! আমি তোমার স্তবে সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি কিছু বর লও।’ নারদ বললেন, ‘রাম! যদি একান্ত আমায় বর দেবে, তো এই বর দাও যেন তোমার পাদপদ্মে আমার শুদ্ধাভক্তি থাকে, আর এই করো যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই!’ রাম বললেন, ‘আরও কিছু বর লও।’ নারদ বললেন, ‘আর কিছুই আমি চাই না, কেবল চাই তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি।’
“এঁর তাই। যেমন ঈশ্বরকে শুধু দেখতে চায়, আর কিছু ধন মান দেহসুখ—কিছুই চায় না। এরই নাম শুদ্ধাভক্তি।
“আনন্দ একটু হয় বটে, কিন্তু বিষয়ের আনন্দ নয়। ভক্তির, প্রেমের আনন্দ। শম্ভু (মল্লিক) বলেছিল—যখন আমি তার বাড়িতে প্রায় যেতুম—‘তুমি এখানে এস; অবশ্য আমার সঙ্গে আলাপ করে আনন্দ পাও তাই এস’—ওইটুকু আনন্দ আছে।
“তবে ওর উপর আর-একটি অবস্থা আছে! বালকের মতো যাচ্ছে—কোনও ঠিক নাই; হয়তো একটা ফড়িং ধরছে।
(ভক্তদের প্রতি)—“এঁর (ডাক্তারের) মনের ভাব কি বুঝেছ? ঈশ্বরকে প্রার্থনা করা হয়, হে ঈশ্বর, আমায় সৎ ইচ্ছা দাও যেন অসৎ কাজে মতি না হয়।
“আমারও ওই অবস্থা ছিল। একে দাস্য বলে। আমি ‘মা, মা’ বলে এমন কাঁদতুম যে, লোক দাঁড়িয়ে যেত। আমার এই অবস্থার পর আমাকে বীড়বার জন্য আর আমার পাগলামি সারাবার জন্য, তারা একজন রাঁড় এনে ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেল—সুন্দর, চোখ ভাল। আমি মা! মা! বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম, আর হলধারীকে ডেকে দিয়ে বললুম, ‘দাদা দেখবে এসো ঘরে কে এসেছে।’ হলধারীকে, আর সব লোককে বলে দিলুম। এই অবস্থায় ‘মা, মা’ বলে কাঁদতুম, কেঁদে কেঁদে বলতুম, ‘মা! রক্ষা কর। মা! আমায় নিখাদ কর, যেন সৎ থেকে অসতে মন না যায়।’ (ডাক্তারের প্রতি) তোমার এ-ভাব তো বেশ—ঠিক ভক্তিভাব, দাসভাব।”
[জগতের উপকার ও সামান্য জীব—নিষ্কামকর্ম ও শুদ্ধসত্ত্ব]
“যদি কারো শুদ্ধসত্ত্ব (গুণ) আসে, সে কেবল ঈশ্বরচিন্তা করে, তার আর কিছুই ভাল লাগে না। কেউ কেউ প্রারব্ধের গুণে জন্ম থেকে শুদ্ধসত্ত্বগুণ পায়। কামনাশূন্য হয়ে কর্ম করতে চেষ্টা করলে, শেষে শুদ্ধসত্ত্বলাভ হয়। রজমিশানো সত্ত্বগুণ থাকলে ক্রমে নানাদিকে মন হয়, তখন জগতের উপকার করব এই সব অভিমান এসে জোটে। জগতের উপকার এই সামান্য জীবের পক্ষে করতে যাওয়া বড় কঠিন। তবে যদি কেউ জীবের সেবার জন্য কামনাশূন্য হয়ে কর্ম করে, তাতে দোষ নাই; একে নিষ্কাম কর্ম বলে। এরূপ কর্ম করতে চেষ্টা করা খুব ভাল। কিন্তু সকলে পারে না। বড় কঠিন। সকলেরই কর্ম করতে হবে; দু-একটি লোক কর্ম ত্যাগ করতে পারে। দু-একজন লোকের শুদ্ধসত্ত্ব দেখতে পাওয়া যায়। এই নিষ্কাম কর্ম করতে করতে রজমিশানো সত্ত্বগুণ ক্রমে শুদ্ধসত্ত্ব হয়ে দাঁড়ায়।
“শুদ্ধসত্ত্ব হলেই ঈশ্বরলাভ তাঁর কৃপায় হয়।
“সাধারণ লোকে এই শুদ্ধসত্ত্বের অবস্থা বুঝতে পারে না; হেম আমায় বলেছিল, কেমন ভট্টাচার্য মহাশয়! জগতে মানলাভ করা মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য, কেমন?”
৫৩.২৫ পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ – শ্যামপুকুর বাটীতে নরেন্দ্র, মণি প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
অসুখ কেন? নরেন্দ্রের প্রতি সন্ন্যাসের উপদেশ
ঠাকুর শ্যামপুকুর বাটীতে নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বেলা দশটা। আজ ২৭শে অক্টোবর, ১৮৮৫, মঙ্গলবার, আশ্বিন কৃষ্ণা চতুর্থী, ১২ই কার্তিক।
ঠাকুর নরেন্দ্র, মণি প্রভৃতির সহিত কথা কহিতেছেন।
নরেন্দ্র—ডাক্তার কাল কি করে গেল।
একজন ভক্ত—সুতোয় মাছ গিঁথেছিল, ছিঁড়ে গেল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—বঁড়শি বেঁধা আছে,—মরে ভেসে উঠবে।
নরেন্দ্র একটু বাহিরে গেলেন, আবার আসিবেন। ঠাকুর মণির সহিত পূর্ণ সম্বন্ধে কথা কহিতেছেন—
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমায় বলছি—এ-সব জীবের শুনতে নাই—প্রকৃতিভাবে পুরুষকে (ঈশ্বরকে) আলিঙ্গন, চুম্বন করতে ইচ্ছা হয়।
মণি—নানারকম খেলা—আপনার রোগ পর্যন্ত খেলার মধ্যে। এই রোগ হয়েছে বলে এখানে নূতন নূতন ভক্ত আসছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ভূপতি বলে, রোগ না হলে শুধু বাড়িভাড়া করলে লোকে কি বলত—আচ্ছা, ডাক্তারের কি হল?
মণি—এদিকে দাস্য মানা আছে—‘আমি দাস, তুমি প্রভু।’ আবার বলে—মানুষ-উপমা আনো কেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখলে! আজ কি আর তুমি তার কাছে যাবে?
মণি—খপর দিতে যদি হয়, তবে যাব।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বঙ্কিম ছেলেটি কেমন? এখানে যদি আসতে না পারে, তুমি না হয় তারে সব বলবে।—চৈতন্য হবে।
[আগে সংসারের গোছগাছ, না ঈশ্বর? কেশব ও নরেন্দ্রকে ইঙ্গিত]
নরেন্দ্র আসিয়া কাছে বসিলেন। নরেন্দ্রের পিতার পরলোকপ্রাপ্তি হওয়াতে বড়ই ব্যতিব্যস্ত হইয়াছেন। মা ও ভাই এরা আছেন, তাহাদের ভরণপোষণ করিতে হইবে। নরেন্দ্র আইন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। মধ্যে বিদ্যাসাগরের বউবাজারের স্কুলে কয়েক মাস শিক্ষকতা করিয়াছিলেন। বাটীর একটা ব্যবস্থা করিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইবেন—এই চেষ্টা কেবল করিতেছেন।
ঠাকুর সমস্তই অবগত আছেন—নরেন্দ্রকে একদৃষ্টে সস্নেহে দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে)—আচ্ছা, কেশব সেনকে বললাম,—যদৃচ্ছালাভ। যে বড় ঘরের ছেলে, তার খাবার জন্য ভাবনা হয় না—সে মাসে মাসে মুসোহারা পায়। তবে নরেন্দ্রের অত উঁচু ঘর, তবু হয় না কেন? ভগবানে মন সব সমর্পণ করলে তিনি তো সব জোগাড় করে দিবেন!
মাস্টার—আজ্ঞা হবে; এখনও তো সব সময় যায় নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু তীব্র বৈরাগ্য হলে ও-সব হিসাব থাকে না। ‘বাড়ির সব বন্দোবস্ত করে দিব, তারপরে সাধনা করব’—তীব্র বৈরাগ্য হলে এরূপ মনে হয় না। (সহাস্যে) গোঁসাই লেকচার দিয়েছিল। তা বলে, দশ হাজার টাকা হলে ওই থেকে খাওয়া-দাওয়া এই সব হয়—তখন নিশ্চিন্ত হয়ে ঈশ্বরকে বেশ ডাকা যেতে পারে।
“কেশব সেনও ওই ইঙ্গিত করেছিল। বলেছিল,—‘মহাশয়, যদি কেউ বিষয়-আশয় ঠিকঠাক করে, ঈশ্বরচিন্তা করে—তা পারে কিনা? তার তাতে কিছু দোষ হতে পারে কি?’
“আমি বললাম, তীব্র বৈরাগ্য হলে সংসার পাতকুয়া, আত্মীয় কাল সাপের মতো, বোধ হয়। তখন, ‘টাকা জমাব’, ‘বিষয় ঠিকঠাক করব’, এ-সব হিসাব আসে না। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু—ঈশ্বরকে ছেড়ে বিষয়চিন্তা!
“একটা মেয়ের ভারী শোক হয়েছিল। আগে নত্টা কাপড়ের আঁচলে বাঁধলে,—তারপর, ‘ওগো! আমার কি হলো গো।’ বলে আছড়ে পড়লো কিন্তু খুব সাবধান, নত্টা না ভেঙে যায়।”
সকলে হাসিতেছেন।
নরেন্দ্র এই সকল কথা শুনিয়া বাণবিদ্ধের ন্যায় একটু কাত হইয়া শুইয়া পড়িলেন। তাঁর মনের অবস্থা বুঝিয়া—
মাস্টার (নরেন্দ্রের প্রতি, সহাস্যে)—শুয়ে পড়লে যে!
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি, সহাস্যে)—“আমি তো আপনার ভাশুরকে নিয়ে আছি তাইতেই লজ্জায় মরি, এরা সব (অন্য মাগীরা) পরপুরুষ নিয়ে কি করে থাকে?”
মাস্টার নিজে সংসারে আছেন, লজ্জিত হওয়া উচিত। নিজের দোষ, কেহ দেখে না—অপরের দেখে। ঠাকুর এই কথা বলিতেছেন। একজন স্ত্রীলোক ভাশুরের সঙ্গে নষ্ট হইয়াছিল। সে নিজের দোষ কম, অন্য নষ্ট স্ত্রীলোকদের দোষ বেশি, মনে করিতেছে। বলে, ‘ভাশুর তো আপনার লোক, তাইতেই লজ্জায় মরি।’
[মুক্তহস্ত কে? চাকরি ও খোশামোদের টাকায় বেশি মায়া]
নিচে একজন বৈষ্ণব গান গাইতেছিল। ঠাকুর শুনিয়া অতিশয় আনন্দিত হইলেন। বৈষ্ণবকে কিছু পয়সা দিতে বলিলেন। একজন ভক্ত কিছু দিতে গেলেন। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “কি দিলে?” একজন ভক্ত বলিলেন—“তিনি দুপয়সা দিয়েছেন।”
ঠাকুর—চাকরি করা টাকা কিনা।—অনেক কষ্টের টাকা—খোশামোদের টাকা! মনে করেছিলাম, চার আনা দিবে!
[Electricity—তাড়িতযন্ত্র ও বাগচী চিত্রিত ষড়্ভুজ ও রামচন্দ্রের আলেখ্য দর্শন—পূর্বকথা—দক্ষিণেশ্বরে দীর্ঘকেশ সন্ন্যাসী]
ছোট নরেন ঠাকুরকে যন্ত্র আনিয়া তাড়িতের প্রকৃতি দেখাইবেন বলিয়াছিলেন। আজ আনিয়া দেখাইলেন।
বেলা দুইটা—ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। অতুল একটি বন্ধু মুনসেফকে আনিয়াছেন। শিকদারপাড়ার প্রসিদ্ধ চিত্রকর বাগচী আসিয়াছেন। কয়েকখানি চিত্র ঠাকুরকে উপহার দিলেন।
ঠাকুর আনন্দের সহিত পট দেখিতেছেন। ষড়্ভুজ মূর্তি দর্শন করিয়া ভক্তদের বলিতেছেন—“দেখো, কেমন হয়েছে!”
ভক্তদের আবার দেখাইবার জন্য ‘অহল্যা পাষাণীর পট’ আনিতে বলিলেন। পটে শ্রীরামচন্দ্রকে দেখিয়া আনন্দ করিতেছেন।
শ্রীযুক্ত বাগচীর মেয়েদের মতো লম্বা চুল। ঠাকুর বলিতেছেন, “অনেককাল হল দক্ষিণেশ্বরে একটি সন্ন্যাসী দেখেছিলাম। ন হাত লম্বা চুল। সন্ন্যাসীটি ‘রাধে রাধে’ করত। ঢঙ নাই।”
কিয়ত্ক্ষণ পরে নরেন্দ্র গান গাইতেছেন। গানগুলি বৈরাগ্যপূর্ণ। ঠাকুরের মুখে তীব্র বৈরাগ্যের কথা ও সন্ন্যাসের উপদেশ শুনিয়া কি নরেন্দ্রের উদ্দীপন হইল?
নরেন্দ্রের গান :
(১) যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে ।
(২) অন্তরে জাগিছ ওমা অন্তরযামিনী ।
(৩) কি সুখ জীবনে মম ওহে নাথ দয়াময় হে,
যদি চরণ-সরোজে পরাণ-মধুপ, চির মগন না রয় হে!
৫৩.২৬ ষড়্বিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ—নরেন্দ্র, গিরিশপ্রভৃতি ভক্তসঙ্গে ভজনানন্দে—সমাধিমন্দিরে
২৭শে অক্টোবর, ১৮৮৫, মঙ্গলবার, বেলা সাড়ে পাঁচটা। আজ নরেন্দ্র, ডাক্তার সরকার, শ্যাম বসু, গিরিশ, ডাক্তার দোকড়ি, ছোট নরেন্দ্র, রাখাল, মাস্টার ইত্যাদি অনেকে উপস্থিত। ডাক্তার আসিয়া হাত দেখিলেন ও ঔষধের ব্যবস্থা করিলেন।
পীড়াসম্বন্ধীয় কথার পর ও শ্রীরামকৃষ্ণের ঔষধ সেবনের পর ডাক্তার বলিলেন, ‘তবে শ্যামবাবুর সঙ্গে তুমি কথা কও, আমি আসি।’
শ্রীরামকৃষ্ণ ও একজন ভক্ত বলিয়া উঠিলেন, ‘গান শুনবেন?”
ডাক্তার—তুমি যে তিড়িং মিড়িং করে ওঠো। ভাব চেপে রাখতে হবে।
ডাক্তার আবার বসিলেন। তখন নরেন্দ্র মধুরকণ্ঠে গান করিতেছেন। তত্সঙ্গে তানপুরা ও মৃদঙ্গ ঘন ঘন বাজিতেছে। গাহিতেছেন :
(১) চমত্কার অপার জগৎ রচনা তোমার,
শোভার আগার বিশ্ব সংসার ।
অযুত তারকা চমকে রতন-কাঞ্চন-হার
কত চন্দ্র কত সূর্য নাহি অন্ত তার ।
শোভে বসুন্ধরা ধনধান্যময়, হায়, পূর্ণ তোমার ভাণ্ডার
হে মহেশ, অগণনলোক গায় ধন্য ধন্য এ গীতি অনিবার ।
(২) নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি ।
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরি-গুহাবাসী ।
অনন্ত আঁধার কোলে, মহানির্বাণ হিল্লোলে,
চিরশান্তি পরিমল, অবিরল যায় ভাসি ।
মহাকাল রূপ ধরি, আঁধার বসন পরি,
সমাধিমন্দিরে ও মা কে তুমি গো একা বসি;
অভয়-পদ-কমলে, প্রেমের বিজলী জ্বলে
চিন্ময় মুখমণ্ডলে শোভে অট্ট অট্ট হাসি ।
ডাক্তার মাস্টারকে বলিলেন, “It is dangerous to him!”
(এ-গান ঠাকুরের পক্ষে ভাল নয়, ভাব হইলে অনর্থ ঘটিতে পারে)।
শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলছে?” তিনি উত্তর করিলেন, “ডাক্তার ভয় করছেন, পাছে আপনার ভাবসমাধি হয়।” বলিতে বলিতে শ্রীরামকৃষ্ণ একটু ভাবস্থ হইয়াছেন; ডাক্তারের মুখপানে তাকাইয়া করজোড়ে বলিতেছেন, “না, না, কেন ভাব হবে?” কিন্তু বলিতে বলিতে তিনি গভীর ভাব-সমাধিতে মগ্ন হইলেন। শরীর স্পন্দহীন, নয়ন স্থির! অবাক্! কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় উপবিষ্ট! বাহ্যশূন্য! মন বুদ্ধি অহংকার চিত্ত সমস্তই অন্তর্মুখ। আর সে মানুষ নয়। নরেন্দ্রের মধুরকণ্ঠে মধুর গান চলিতেছে :
এ কি এ সুন্দর শোভা, কি মুখ হেরি এ!
আজি মোর ঘরে আইল হৃদয়নাথ, প্রেম উত্স উথলিল আজি—
বল হে প্রেমময় হৃদয়ের স্বামী, কি ধন তোমারে দিব উপহার?
হৃদয় প্রাণ লহ লহ তুমি, কি বলিব;
যাহা কিছু আছে মম, সকলি লও হে নাথ ।
গান—কি সুখ জীবনে মম ওহে নাথ দয়াময় হে
যদি চরণ-সরোজে পরাণ-মধুপ চিরমগন না রয় হে ।
অগণন ধনরাশি তায় কিবা ফলোদয় হে
যদি লভিয়ে সে ধনে, পরম রতনে যতন না করয় হে ।
সুকুমার কুমার মুখ দেখিতে না চাই হে
যদি সে চাঁদবয়ানে তব প্রেমমুখ দেখিতে না পাই হে ।
কি ছার শশাঙ্কজ্যোতিঃ, দেখি আঁধারময় হে;
যদি সে চাঁদ প্রকাশে তব প্রেম চাঁদ নাহি হয় উদয় হে ।
সতীর পবিত্র প্রেম তাও মলিনতাময় হে,
যদি সে প্রেমকনকে, তব প্রেমমণি নাহি জড়িত রয় হে ।
তীক্ষ্ণ বিষা ব্যালী সম সতত দংশয় হে,
যদি মোহ পরমাদে নাথ তোমাতে ঘটায় সংশয় হে ।
কি আর বলিব নাথ, বলিব তোমায় হে;
তুমি আমার হৃদয়রতন মণি, আনন্দনিলয় হে ।
“সতীর পবিত্র প্রেম” গানের এই অংশ শুনিতে শুনিতে ডাক্তার অশ্রুপূর্ণলোচনে বলিয়া উঠিলেন, আহা! আহা!
নরেন্দ্র গাহিলেন :
কতদিনে হবে সে প্রেম সঞ্চার ।
হয়ে পূর্ণকাম বলব হরিনাম, নয়নে বহিবে প্রেম অশ্রুধার ॥
কবে হবে আমার শুদ্ধ প্রাণমন, কবে যাব আমি প্রেমের বৃন্দাবন,
সংসার বন্ধন হইবে মোচন, জ্ঞানাঞ্জনে যাবে লোচন আঁধার ॥
কবে পরশমণি করি পরশন লৌহময় দেহ হইবে কাঞ্চন
হরিময় বিশ্ব করিব দর্শন, লুটাইব ভক্তিপথে অনিবার ॥
(হায়) কবে যাবে আমার ধরম করম, কমে যাবে জাতি কুলের ভরম,
কবে যাবে ভয় ভাবনা সরম, পরিহরি অভিমান লোকাচার ॥
মাখি সর্ব অঙ্গে ভক্তপদধূলি, কাঁধে লয়ে চির বৈরাগ্যের ঝুলি,
পিব প্রেমবারি দুই হাতে তুলি, অঞ্জলি অঞ্জলি প্রেমযমুনার ॥
প্রেমে পাগল হয়ে হাসিব কাঁদিব সচ্চিদানন্দ সাগরে ভাসিব,
আপনি মাতিয়ে সকলে মাতাব, হরিপদে নিত্য করিব বিহার ।
৫৩.২৭ সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ – জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিচারে—ব্রহ্মদর্শন
ইতিমধ্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বাহ্যসংজ্ঞালাভ করিয়াছেন। গান সমাপ্ত হইল। তখন পণ্ডিত ও মূর্খের—বালক ও বৃদ্ধের—পুরুষ ও স্ত্রীর—আপামর সাধারণের—সেই মনোমুগ্ধকরী কথা হইতে লাগিল। সভাসুদ্ধ লোক নিস্তব্ধ। সকলেই সেই মুখপানে চাহিয়া রহিয়াছেন। এখন সেই কঠিন পীড়া কোথায়? মুখ এখনও যেন প্রফুল্ল অরবিন্দ,—যেন ঐশ্বরিক জ্যোতিঃ বহির্গত হইতেছে। তখন তিনি ডাক্তারকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “লজ্জা ত্যাগ কর, ঈশ্বরের নাম করবে, তাতে আবার লজ্জা কি? লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—তিন থাকতে নয়। ‘আমি এত বড় লোক, আমি ‘হরি হরি’ বলে নাচব? বড় বড় লোক এ-কথা শুনলে আমায় কি বলবে? যদি বলে, ওহে ডাক্তারটা ‘হরি হরি’ বলে নেচেছে। লজ্জার কথা!’ এ-সব ভাব ত্যাগ কর।”
ডাক্তার—আমার ওদিক দিয়েই যাওয়া নাই; লোকে কি বলবে, আমি তার তোয়াক্কা রাখি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার উটি খুব আছে। (সকলের হাস্য)
“দেখ, জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও, তবে তাঁকে জানতে পারা যায়। নানা জ্ঞানের নাম অজ্ঞান। পাণ্ডিত্যের অহংকারও অজ্ঞান। এক ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন, এই নিশ্চয় বুদ্ধির নাম জ্ঞান। তাঁকে বিশেষরূপে জানার নাম বিজ্ঞান। যেমন পায়ে কাঁটা বিঁধেছে, সে কাঁটাটা তোলবার জন্য আর-একটি কাঁটার প্রয়োজন। কাঁটাটা তোলবার পর দুটি কাঁটাই ফেলে দেয়। প্রথমে অজ্ঞান কাঁটা দূর করবার জন্য জ্ঞান কাঁটাটি আনতে হয়। তারপর জ্ঞান-অজ্ঞান দুইটিই ফেলে দিতে হয়। তিনি যে জ্ঞান-অজ্ঞানের পার। লক্ষ্মণ বলেছিলেন, ‘রাম! এ কি আশ্চর্য! এত বড় জ্ঞানী স্বয়ং বশিষ্ঠদেব পুত্রশোকে অধীর হয়ে কেঁদেছিলেন।’ রাম বললেন, ‘ভাই, যার জ্ঞান আছে, তার অজ্ঞানও আছে, যার এক জ্ঞান আছে, তার অনেক জ্ঞানও আছে। যার আলোবোধ আছে, তার অন্ধকারবোধও আছে। ব্রহ্ম—জ্ঞান-অজ্ঞানের পার, পাপ-পুণ্যের পার, ধর্মাধর্মের পার, শুচি-অশুচির পার।”
এই বলিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ রামপ্রসাদের গান আবৃত্তি করিয়া বলিতেছেন—
আয় মন বেড়াতে যাবি ।
কালীকল্পতরুমূলে রে চারিফল কুড়ায়ে পাবি ॥
[অবাঙ্মনসোগোচরম্—ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝান যায় না]
শ্যাম বসু—দুই কাঁটা ফেলে দেওয়ার পর কি থাকবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—নিত্যশুদ্ধবোধরূপম্। তা তোমায় কেমন করে বুঝাব? যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘ঘি কেমন খেলে?’ তাকে এখন কি করে বুঝাবে? হদ্দ বলতে পার, ‘কেমন ঘি না যেমন ঘি।’ একটি মেয়েকে তার একটি সঙ্গী জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোর স্বামী এসেছে, আচ্ছা ভাই, স্বামী এলে কিরূপ আনন্দ হয়?’ মেয়েটি বললে, ‘ভাই, তোর স্বামী হলে তুই জানবি; এখন তোরে কেমন করে বুঝাব।’ পুরাণে আছে ভগবতী যখন হিমালয়ের ঘরে জন্মালেন, তখন তাঁকে মা নানারূপে দর্শন দিলেন। গিরিরাজ সব রূপ দর্শন করে শেষে ভগবতীকে বললেন, মা, বেদে যে ব্রহ্মের কথা আছে, এইবার আমার যেন ব্রহ্মদর্শন হয়। তখন ভগবতী বললেন, বাবা, ব্রহ্মদর্শন যদি করতে চাও, তবে সাধুসঙ্গ কর।
“ব্রহ্ম কি জিনিস—মুখে বলা যায় না। একজন বলেছিল—সব উচ্ছিষ্ট হয়েছে, কেবল ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হন নাই। এর মানে এই যে, বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, আর সব শাস্ত্র, মুখে উচ্চারণ হওয়াতে উচ্ছিষ্ট হয়েছে বলা যেতে পারে; কিন্তু ব্রহ্ম কি বস্তু, কেউ এ-পর্যন্ত মুখে বলতে পারে নাই। তাই ব্রহ্ম এ পর্যন্ত উচ্ছিষ্ট হন নাই! আর সচ্চিদানন্দের সঙ্গে ক্রীড়া, রমণ—যে কি আনন্দের তা মুখে বলা যায় না। যার হয়েছে সে জানে।”
৫৩.২৮ অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ – পণ্ডিতের অহংকার—পাপ ও পুণ্য
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার ডাক্তারকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “দেখ, অহংকার না গেলে জ্ঞান হয় না। ‘মুক্ত হব কবে, “আমি” যাবে যবে’। ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই দুইটি অজ্ঞান। ‘তুমি’ ও ‘তোমার’ এই দুইটি জ্ঞান। যে ঠিক ভক্ত, সে বলে—হে ঈশ্বর! তুমিই কর্তা, তুমিই সব করছো, আমি কেবল যন্ত্র, আমাকে যেমন করাও তেমনি করি। আর এ-সব তোমার ধন, তোমার ঐশ্বর্য, তোমার জগৎ। তোমারই গৃহ পরিজন, আমার কিছু নয়। আমি দাস। তোমার যেমন হুকুম, সেইরূপ সেবা করবার আমার অধিকার।
“যারা একটু বই-টই পড়েছে, অমনি তাদের অহংকার এসে জোটে। কা-ঠাকুরের সঙ্গে ঈশ্বরীয় কথা হয়েছিল। সে বলে, ‘ও-সব আমি জানি।’ আমি বললুম, যে দিল্লী গিছিল, সে কি বলে বেড়ায় আমি দিল্লী গেছি, আর জাঁক করে? যে বাবু, সে কি বলে আমি বাবু!”
শ্যাম বসু—তিনি (কা-ঠাকুর) আপনাকে খুব মানেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওগো বলব কি! দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে একটি মেথরাণীর যে অহংকার! তার গায়ে ২/১ খানা গহনা ছিল। সে যে পথ দিয়ে আসছিল, সেই পথে দু-একজন লোক তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। মেথরাণী তাদের বলে উঠল, ‘এই! সরে যা।’ তা অন্য লোকের অহংকারের কথা আর কি বলব?
শ্যাম বসু—মহাশয়! পাপের শাস্তি আছে অথচ ঈশ্বর সব করছেন, এ কিরকম কথা?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি, তোমার সোনার বেনে বুদ্ধি!
নরেন্দ্র—সোনার বেনে বুদ্ধি অর্থাৎ calculating বুদ্ধি!
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওরে পোদো, তুই আম খেয়ে নে! বাগানে কত শত গাছ আছে, কত হাজার ডাল আছে, কত কোটি পাতা আছে, এ-সব হিসাবে তোর কাজ কি? তুই আম খেতে এসেছিস, আম খেয়ে যা। (শ্যাম বসুর প্রতি) তুমি এ সংসারে ঈশ্বর-সাধন জন্য মানব জন্ম পেয়েছ। ঈশ্বরের পাদপদ্মে কিরূপে ভক্তি হয়, তাই চেষ্টা কর। তোমার এত শত কাজ কি? ফিলজফী লয়ে বিচার করে তোমার কি হবে? দেখ, আধপো মদে তুমি মাতাল হতে পার। শুঁড়ির দোকানে কত মন মদ আছে, এ হিসাবে তোমার কি দরকার?
ডাক্তার—আর ঈশ্বরের মদ Infinite! সে মদের শেষ নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্যাম বসুর প্রতি)—আর ঈশ্বরকে আমমোক্তারী দাও না। তাঁর উপর সব ভার দাও। সৎ লোককে যদি কেউ ভার দেয়, তিনি কি অন্যায় করেন? পাপের শাস্তি দিবেন, কি না দিবেন, সে তিনি বুঝবেন।
ডাক্তার—তাঁর মনে কি আছে, তিনিই জানেন। মানুষ হিসাব করে কি বলবে? তিনি হিসাবের পার!
শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্যাম বসুর প্রতি)—তোমাদের ওই এক। কলকাতার লোকগুলো বলে, ‘ঈশ্বরের বৈষম্যদোষ।’ কেননা, তিনি একজনকে সুখে রেখেছেন, আর-একজনকে দুঃখে রেখেছেন। শালাদের নিজের ভিতরও যেমন, ঈশ্বরের ভিতরও তেমনি দেখে।
[‘লোকমান্য’ কি জীবনের উদ্দেশ্য?]
“হেম দক্ষিণেশ্বরে যেত। দেখা হলেই আমায় বলত, ‘কেমন ভট্টাচার্য মশাই! জগতে এক বস্তু আছে;—মান? ঈশ্বরলাভ যে মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য, তা কম লোকই বলে।”
৫৩.২৯ ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ – স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ ও মহাকারণ
শ্যাম বসু—সূক্ষ্মশরীর কেউ কি দেখিয়ে দিতে পারে? কেউ কি দেখাতে পারে যে, সেই শরীর বাহিরে চলে যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যারা ঠিক ভক্ত, তাদের দায় পড়েছে তোমায় দেখাতে! কোন্ শালা মানবে আর না মানবে, তাদের দায় কি! একটা বড়লোক হাতে থাকবে, এ-সব ইচ্ছা তাদের থাকে না।
শ্যাম বসু—আচ্ছা, স্থূলদেহ, সূক্ষ্মদেহ, এ-সব প্রভেদ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—পঞ্চভূত লয়ে যে দেহ, সেইটি স্থূলদেহ। মন, বুদ্ধি, অহংকার আর চিত্ত, এই লয়ে সূক্ষ্মশরীর। যে শরীরে ভগবানের আনন্দলাভ হয়, আর সম্ভোগ হয়, সেইটি কারণ শরীর। তন্ত্রে বলে, ‘ভাগবতী তনু।’ সকলের অতীত ‘মহাকারণ’ (তুরীয়) মুখে বলা যায় না।
[সাধনের প্রয়োজন—ঈশ্বরে একমাত্র ভক্তিই সার]
“কেবল শুনলে কি হবে? কিছু করো।
“সিদ্ধি সিদ্ধি মুখে বললে কি হবে? তাতে কি নেশা হয়?
“সিদ্ধি বেটে গায়ে মাখলেও নেশা হয় না। কিছু খেতে হয়। কোন্টা একচল্লিশ নম্বরের সুতা, কোন্টা চল্লিশ নম্বরের—সুতার ব্যবসা না করলে এ-সব কি বলা যায়? যাদের সুতার ব্যবসা আছে, তাদের পক্ষে অমুক নম্বরের সুতা দেওয়া কিছু শক্ত নয়! তাই বলি, কিছু সাধন কর। তখন স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ মহাকারণ কাকে বলে সব বুঝতে পারবে। যখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে, তাঁর পাদপদ্মে একমাত্র ভক্তি প্রার্থনা করবে।
“অহল্যার শাপ মোচনের পর শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে বললেন, তুমি আমার কাছে বর লও। অহল্যা বললেন, রাম যদি বর দিবে তবে এই বর দাও—আমার যদি শূকরযোনিতেও জন্ম হয় তাতেও ক্ষতি নাই; কিন্তু হে রাম! যেন তোমার পাদপদ্মে আমার মন থাকে।
“আমি মার কাছে একমাত্র ভক্তি চেয়েছিলাম। মার পাদপদ্মে ফুল দিয়ে হাতজোড় করে বলেছিলাম, ‘মা, এই লও তোমার অজ্ঞান, এই লও তোমার জ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার শুচি, এই লও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার ভাল, এই লও তোমার মন্দ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও। এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’
“ধর্ম কিনা দানাদি কর্ম। ধর্ম নিলেই অধর্ম লতে হবে। পুণ্য নিলেই পাপ লতে হবে। জ্ঞান নিলেই অজ্ঞান লতে হবে। শুচি নিলেই অশুচি লতে হবে। যেমন যার আলোবোধ আছে, তার অন্ধকারবোধও আছে। যার একবোধ আছে, তার অনেকবোধও আছে। যার ভালবোধ আছে তার মন্দবোধও আছে।
“যদি কারও শূকর মাংস খেয়ে ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি থাকে, সে পুরুষ ধন্য; আর হবিষ্য খেয়ে যদি সংসারে আসক্তি থাকে—”
ডাক্তার—তবে সে অধম! এখানে একটি কথা বলি—বুদ্ধ শূকর মাংস খেয়েছিল। শূকর মাংস খাওয়া আর কলিক্ (পেটে শূলবেদনা) হওয়া। এ ব্যারামের জন্য বুদ্ধ Opium (আফিং) খেত। নির্বাণ-টির্বাণ কি জান? আফিং খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকত, বাহ্যজ্ঞান থাকত না;—তাই নির্বাণ!
বুদ্ধদেবের নির্বাণ সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যা শুনিয়া সকলে হাসিতে লাগিলেন; আবার কথাবার্তা চলিতে লাগিল।
৫৩.৩০ ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – গৃহস্থ ও নিষ্কাম কর্ম—Theosophy
শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্যাম বসুর প্রতি)—সংসারধর্ম; তাতে দোষ নাই। কিন্তু ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন রেখে, কামনাশূন্য হয়ে কাজকর্ম করবে। এই দেখ না, যদি কারু পিঠে একটা ফোঁড়া হয়, সে যেমন সকলের সঙ্গে কথাবার্তা কয়, হয়তো কাজকর্মও করে, কিন্তু যেমন ফোঁড়ার দিকে তার মন পড়ে থাকে, সেইরূপ।
“সংসারে নষ্ট মেয়ের মতো থাকবে। মন উপপতির দিকে, কিন্তু সে সংসারের সব কাজ করে। (ডাক্তারের প্রতি) বুঝেছ?”
ডাক্তার—ও-ভাব যদি না থাকে, বুঝব কেমন করে?
শ্যাম বসু—কিছু বোঝ বইকি! (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—আর ওই ব্যবসা অনেকদিন ধরে করছেন! কি বল? (সকলের হাস্য)
শ্যাম বসু—মহাশয়, থিয়সফি কিরকম বলেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—মোট কথা এই, যারা শিষ্য করে বেড়ায়, তারা হালকা থাকের লোক। আর যারা সিদ্ধাই অর্থাৎ নানারকম শক্তি চায়, তারাও হালকা থাক। যেমন গঙ্গা হেঁটে পার হয়ে যাব, এই শক্তি। অন্য দেশে একজন কি কথা বলছে তাই বলতে পারা, এই এক শক্তি। ঈশ্বরে শুদ্ধাভক্তি হওয়া এই সব লোকের ভারী কঠিন।
শ্যাম বসু—কিন্তু তারা (থিয়সফিস্ট্রা) হিন্দুধর্ম পুনঃস্থাপিত করবার চেষ্টা করছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি তাদের বিষয় ভাল জানি না।
শ্যাম বসু—মরবার পর জীবাত্মা কোথায় যায়—চন্দ্রলোকে, নক্ষত্রলোকে ইত্যাদি—এ-সব থিয়সফিতে জানা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা হবে। আমার ভাব কিরকম জান? হনুমানকে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, আজ কি তিথি? হনুমান বললে, ‘আমি বার, তিথি, নক্ষত্র এ-সব কিছু জানি না; কেবল এক রামচিন্তা করি।’ আমার ঠিক ওই ভাব।
শ্যাম বসু—তারা বলে, মহাত্মা সব আছেন। আপনার কি বিশ্বাস?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার কথা বিশ্বাস করেন তো আছে। এ-সব কথা এখন থাক। আমার অসুখটা কমলে তুমি আসবে। যাতে তোমার শান্তি হয়, যদি আমায় বিশ্বাস কর—উপায় হয়ে যাবে। দেখছো তো, আমি টাকা লই না, কাপড় লই না। এখানে প্যালা দিতে হয় না, তাই অনেকে আসে! (সকলের হাস্য)
(ডাক্তারের প্রতি)—“তোমাকে এই বলা, রাগ করো না; ও-সব তো অনেক করলে—টাকা, মান, লেকচার;—এখন মনটা দিনকতক ঈশ্বরেতে দাও; আর এখানে মাঝে মাঝে আসবে, ঈশ্বরের কথা শুনলে উদ্দীপন হবে!”
কিয়ত্কাল পরে ডাক্তার বিদায় লইতে গাত্রোত্থান করিলেন। এমন সময় শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ আসিলেন ও ঠাকুরের চরণধূলি লইয়া উপবিষ্ট হইলেন। ডাক্তার তাঁহাকে দেখিয়া আনন্দিত হইলেন ও আবার আসন গ্রহণ করিলেন।
ডাক্তার—আমি থাকতে উনি (গিরিশবাবু) আসবেন না! যাই চলে যাব যাব হয়েছি অমনি এসে উপস্থিত। (সকলের হাস্য)
গিরিশের সঙ্গে ডাক্তারের বিজ্ঞানসভার (Science Association) কথা হইতে লাগিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমায় একদিন সেখানে লয়ে যাবে?
ডাক্তার—তুমি সেখানে গেলে অজ্ঞান হয়ে যাবে—ঈশ্বরের আশ্চর্য কাণ্ড সব দেখে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বটে?
৫৩.৩১ একত্রিংশ পরিচ্ছেদ
ডাক্তার (গিরিশের প্রতি)—আর সব কর—but do not worship him as God (ঈশ্বর বলে পূজা করো না।) এমন ভাল লোকটার মাথা খাচ্ছ?
গিরিশ—কি করি মহাশয়? যিনি এ সংসার-সমুদ্র ও সন্দেহ-সাগর থেকে পার করলেন, তাঁকে আর কি করব বলুন। তাঁর গু কি গু বোধ হয়?
ডাক্তার—গুর জন্য হচ্ছে না। আমারও ঘৃণা নাই! একটা দোকানীর ছেলে এসেছিল, তা বাহ্যে করে ফেললে! সকলে নাকে কাপড় দিলে! আমি তার কাছে আধঘণ্টা বসে! নাকে কাপড় দিই নাই। আর মেথর যতক্ষণ মাথায় করে নিয়ে যায়, ততক্ষণ আমার নাকে কাপড় দেবার জো নাই। আমি জানি সেও যা, আমিও তা, কেন তাকে ঘৃণা করব? আমি কি এঁর পায়ের ধুলা নিতে পারি না?—এই দেখ নিচ্ছি। (শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলি গ্রহণ।)
গিরিশ—Angles (দেবগণ) এই মুহূর্তকে ধন্য ধন্য করছেন।
ডাক্তার—তা পায়ের ধুলা লওয়া কি আশ্চর্য! আমি যে সকলেরই নিতে পারি।—এই দাও! এই দাও! (সকলের পায়ের ধুলা গ্রহণ।)
নরেন্দ্র (ডাক্তারের প্রতি)—এঁকে আমরা ঈশ্বরের মতো মনে করি। কিরকম জানেন? যেমন ভেজিটেবল্ ক্রিয়েসন্ (উদ্ভিদ) ও অ্যানিম্যাল ক্রিয়েসন্ (জীবজন্তুগণ)। এদের মাঝামাঝি এমন একটি পয়েন্ট্ (স্থান) আছে, যেখানে এটা উদ্ভিদ কি প্রাণী, স্থির করা ভারী কঠিন। সেইরূপ Man-world (নরলোক) ও God-world (দেবলোক) এই দুয়ের মধ্যে একটি স্থান আছে, যেখানে বলা কঠিন, এ ব্যক্তি মানুষ, না ঈশ্বর।
ডাক্তার—ওহে, ঈশ্বরের কথায় উপমা চলে না।
নরেন্দ্র—আমি God (ঈশ্বর) বলছি না, God like man (ঈশ্বর তুল্য ব্যক্তি) বলছি।
ডাক্তার—ও-সব নিজের নিজের ভাব চাপতে হয়। প্রকাশ করা ভাল নয়। আমার ভাব কেউ বুঝলে না। My best friends (যারা আমার পরম বন্ধু) আমায় কঠোর নির্দয় মনে করে। এই তোমরা হয়তো আমায় জুতো মেরে তাড়াবে!
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—সেকি!—এরা তোমায় কত ভালবাসে! তুমি আসবে বলে বাসকসজ্জা করে জেগে থাকে।
গিরিশ—Every one has the greatest respect for you. (সকলেই আপনাকে যত্পরোনাস্তি শ্রদ্ধা করে।)
ডাক্তার—আমার ছেলে—আমার স্ত্রী পর্যন্ত—আমায় মনে করে hard-hearted (স্নেহমমতা শূন্য),—কেননা, আমার দোষ এই যে, আমি ভাব কারু কাছে প্রকাশ করি না।
গিরিশ—তবে মহাশয়! আপনার মনের কবাট খোলা তো ভাল—at least out of pity for your friends (বন্ধুদের প্রতি অন্ততঃ কৃপা করে)—এই মনে করে যে, তারা আপনাকে বুঝতে পারছে না।
ডাক্তার—বলব কি হে! তোমাদের চেয়েও আমার feelings worked-up হয় (অর্থাৎ আমার ভাব হয়)। (নরেন্দ্রের প্রতি) I shed tears in solitude (আমি একলা একলা বসে কাঁদি।)
[মহাপুরুষ ও জীবের পাপ গ্রহণ—অবতারাদি ও নরেন্দ্র]
ডাক্তার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—ভাল, তুমি ভাব হলে লোকের গায়ে পা দাও, সেটা ভাল নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি কি জানতে পারি গা, কারু গায়ে পা দিচ্ছি কিনা!
ডাক্তার—ওটা ভাল নয়—এটুকু তো বোধ হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার ভাবাবস্থায় আমার কি হয় তা তোমায় কি বলব? সে অবস্থার পর এমন ভাবি, বুঝি রোগ হচ্ছে ওই জন্য! ঈশ্বরের ভাবে আমার উন্মাদ হয়। উন্মাদে এরূপ হয়, কি করব?
ডাক্তার—ইনি মেনেছেন। He expresses regret for what he does; কাজটা sinful (অন্যায়) এটি বোধ আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি)—তুই তো খুব শঠ (বুদ্ধিমান), তুই বল না; একে বুঝিয়ে দে না।
গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি)—মহাশয়! আপনি ভুল বুঝেছেন। উনি সে জন্য দুঃখিত হননি। এঁর দেহ শুদ্ধ—অপাপবিদ্ধ। ইনি জীবের মঙ্গলের জন্য তাদের স্পর্শ করেন। তাদের পাপ গ্রহণ করে এঁর রোগ হবার খুব সম্ভাবনা, তাই কখনও কখনও ভাবেন। আপনার যখন কলিক (শূলবেদনা) হয়েছিল তখন আপনার কি রিগ্রেট (দুঃখ) হয় নাই, কেন রাত জেগে এত পড়তুম? তা বলে রাত জেগে পড়াটা কি অন্যায় কাজ? রোগের জন্য রিগ্রেট (দুঃখ-কষ্ট) হতে পারে। তা বলে জীবের মঙ্গলসাধনের জন্য স্পর্শ করাকে অন্যায় কাজ মনে করবেন না।
ডাক্তার (অপ্রতিভ হইয়া, গিরিশের প্রতি)—তোমার কাছে হেরে গেলুম, দাও পায়ের ধুলা দাও। (গিরিশের পদধূলি গ্রহণ)। (নরেন্দ্রের প্রতি)—আর কিছু নয় হে, his intellectual power (গিরিশের বুদ্ধিমত্তা) মানতে হবে।
নরেন্দ্র (ডাক্তারের প্রতি)—আর-এককথা দেখুন। একটা Scientific discovery (জড় বিজ্ঞানের সত্য বাহির) করবার জন্য আপনি life devote (জীবন উত্সর্গ) করতে পারেন—শরীর, অসুখ ইত্যাদি কিছুই মানেন না। আর ঈশ্বরকে জানা grandest of all sciences (শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান)-এর জন্য ইনি health risk (শরীর নষ্ট হয় হউক, এরূপ মনের ভাব) করবেন না?
ডাক্তার—যত religious reformer (ধর্মাচার্য) হয়েছে, Jesus (যীশু), চৈতন্য, বুদ্ধ, মহম্মদ শেষে সব অহংকারে পরিপূর্ণ—বলে, ‘আমি যা বললুম, তাই ঠিক!’ এ কি কথা!
গিরিশ (ডাক্তারের প্রতি)—মহাশয়, সে দোষ আপনারও হচ্ছে! আপনি একলা তাদের সকলের অহংকার আছে, এ দোষ ধরাতে ঠিক সেই দোষ আপনারও হচ্ছে।
ডাক্তার নীরব হইলেন।
নরেন্দ্র (ডাক্তারের প্রতি)—We offer to him Worship bordering on Divine Worship (এঁকে আমরা পূজা করি—সে পূজা ঈশ্বরের পূজার প্রায় কাছাকাছি)—
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দে বালকের ন্যায় হাসিতেছেন।
৫৩.৩২ দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ – ডাক্তার ও মাস্টার—সার কি?
আজ বৃহস্পতিবার, আশ্বিন কৃষ্ণা ষষ্ঠী, ২৯শে অক্টোবর, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ। বেলা দশটা। ঠাকুর পীড়িত। কলিকাতার অন্তর্গত শ্যামপুকুরে রহিয়াছেন। ডাক্তার তাঁহাকে চিকিত্সা করিতেছেন, ডাক্তারের বাড়ি শাঁখারিটোলা। ডাক্তারের সঙ্গে এখানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একটি সেবক কথা কহিতেছেন। ঠাকুর রোজ রোজ কেমন থাকেন, সেই সংবাদ লইয়া তাঁহাকে প্রত্যহ আসিতে হয়।
ডাক্তার—দেখ, বিহারীর (ভাদুড়ীর) এক কথা! বলে Goethe’s spirit (সূক্ষ্মশরীর) বেরিয়ে গেল, আবার Goethe তাই দেখছে! কি আশ্চর্য কথা!
মাস্টার—পরমহংসদেব বলেন, ও-সব কথায় আমাদের কি দরকার? আমরা পৃথিবীতে এসেছি, যাতে ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি হয়। তিনি বলেন, একজন একটা বাগানে আম খেতে গিছল। সে একটা কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে কত গাছ, কত ডাল, কত পাতা গুণে গুণে লিখতে লাগল। বাগানের একজন লোকের সঙ্গে দেখা হলে সে বললে, তুমি কি করছ—আর এখানে এসেছই বা কেন? তখন সে লোকটি বললে, এখানে কত গাছ, কত ডাল, কত পাতা তাই গুণছি—এখানে আম খেতে এসেছি! বাগানের লোকটি বললে, আম খেতে এসেছ তো আম খেয়ে যাও, তোমার অত শত, কত পাতা, কত ডাল এ-সব কাজ কি?
ডাক্তার—পরমহংস সারটা নিয়েছে দেখছি।
অতঃপর ডাক্তার তাঁহার হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল সম্বন্ধে অনেক গল্প করিতে লাগিলেন—কত রোগী রোজ আসে, তাদের ফর্দ দেখালেন; বললেন, ডাক্তার সাল্জার এবং অন্যান্য অনেকে তাঁহাকে প্রথমে নিরুত্সাহ করিয়াছিলেন। তাঁহারা অনেক মাসিক পত্রিকায় তাঁহার বিরুদ্ধে লিখিতেন ইত্যাদি।
ডাক্তার গাড়িতে উঠিলেন, মাস্টারও সঙ্গে উঠিলেন। ডাক্তার নানা রোগী দেখিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। প্রথমে চোরবাগান, তারপর মাথাঘষার গলি, তারপর পাথুরিয়াঘাটা। সব রোগী দেখা হইলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিতে যাইবেন। ডাক্তার পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদের একটি বাড়িতে গেলেন। সেখানে কিছু বিলম্ব হইল। গাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া আবার গল্প করিতে লাগিলেন।
ডাক্তার—এই বাবুটির সঙ্গে পরমহংসের কথা হল। থিয়সফির কথা—কর্ণেল অল্কটের কথা হল। পরমহংস ওই বাবুটির উপর চটা! কেন জান? এ বলে, আমি সব জানি।
মাস্টার—না, চটা হবেন কেন? তবে শুনেছি, একবার দেখা হয়েছিল। তা পরমহংসদেব ঈশ্বরের কথা বলছিলেন। তখন ইনি বলেছিলেন বটে যে ‘হাঁ ও-সব জানি’।
ডাক্তার—এ বাবুটি সায়েন্স এসোসিয়েশনে ৩২,৫০০ টাকা দিয়াছেন।
গাড়ি চলিতে লাগিল। বড়বাজার হইয়া ফিরিতেছে। ডাক্তার ঠাকুরের সেবা সম্বন্ধে কথা কহিতে লাগিলেন।
ডাক্তার—তোমাদের কি ইচ্ছা এঁকে দক্ষিণেশ্বরে পাঠানো?
মাস্টার—না, তাতে ভক্তদের বড় অসুবিধা। কলকাতায় থাকলে সর্বদা যাওয়া আসা যায়—দেখতে পারা যায়।
ডাক্তার—এতে তো অনেক খরচ হচ্ছে।
মাস্টার—ভক্তদের সে জন্য কোন কষ্ট নাই। তাঁরা যাতে সেবা করতে পারেন, এই চেষ্টা করছেন। খরচ তো এখানেও আছে, সেখানেও আছে। সেখানে গেলে সর্বদা দেখতে পাবেন না, এই ভাবনা।
৫৩.৩৩ ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ, ডাক্তার সরকার, ভাদুড়ী প্রভৃতি সঙ্গে
[ডাক্তার সরকার, ভাদুড়ী, দোকড়ি, ছোট নরেন, মাস্টার, শ্যাম বসু]
ডাক্তার ও মাস্টার শ্যামপুকুরে আসিয়া একটি দ্বিতল গৃহে উপস্থিত হইলেন। সেই গৃহের বাহিরের উপরে বারান্দাওয়ালা দুটি ঘর আছে। একটি পূর্ব-পশ্চিমে ও অপরটি উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। তাহার প্রথম ঘরটিতে গিয়া দেখেন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়া আছেন। ঠাকুর সহাস্য। কাছে ডাক্তার ভাদুড়ী ও অনেকগুলি ভক্ত।
ডাক্তার হাত দেখিলেন ও পীড়ার অবস্থা সমস্ত অবগত হইলেন। ক্রমে ঈশ্বর সম্বন্ধীয় কথা হইতে লাগিল।
ভাদুড়ী—কথাটা কি জান? সব স্বপ্নবৎ।
ডাক্তার—সবই ডিলিউসন্ (ভ্রম)? তবে কার ডিলিউসন্ আর কেন ডিলিউসন্? আর সব্বাই কথাই বা কয় কেন, ডিলিউসন্ জেনেও? I cannot believe that God is real and creation is unreal. (ঈশ্বর সত্য, আর তাঁর সৃষ্টি মিথ্যা, এ বিশ্বাস করিতে পারি না।)
[সোঽহম্ ও দাসভাব—জ্ঞান ও ভক্তি]
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ বেশ ভাব—তুমি প্রভু, আমি দাস। যতক্ষণ দেহ সত্য বলে বোধ আছে, আমি তুমি আছে, ততক্ষণ সেব্য সেবকভাবই ভাল; আমি সেই, এ-বুদ্ধি ভাল নয়।
“আর কি জান? একপাশ থেকে ঘরকে দেখছি, এও যা, আর ঘরের মধ্যে থেকে ঘরকে দেখছি, সেও তাই।”
ভাদুড়ী (ডাক্তারের প্রতি)—এ-সব কথা যা বললুম, বেদান্তে আছে। শাস্ত্র-টাস্ত্র দেখ, তবে তো।
ডাক্তার—কেন, ইনি কি শাস্ত্র দেখে বিদ্বান হয়েছেন? আর ইনিও তো ওই কথা বলেন। শাস্ত্র না পড়লে হবে না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওগো, আমি শুনেছি কত?
ডাক্তার—শুধু শুনলে কত ভুল থাকতে পারে। তুমি শুধু শোন নাই।
আবার অন্য কথা চলিতে লাগিল।
[‘ইনি পাগল’—ঠাকুরের পায়ের ধুলা দেওয়া]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—আপনি নাকি বলেছো, ‘ইনি পাগল’? তাই এরা (মাস্টার ইত্যাদির দিকে দেখাইয়া) তোমার কাছে যেতে চায় না।
ডাক্তার (মাস্টারের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া)—কই? তবে অহংকার বলেছি। তুমি লোককে পায়ের ধুলা নিতে দাও কেন?
মাস্টার—তা না হলে লোকে কাঁদে।
ডাক্তার—তাদের ভুল—বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।
মাস্টার—কেন, সর্বভূতে নারায়ণ?
ডাক্তার—তাতে আমার আপত্তি নাই। সব্বাইকে কর।
মাস্টার—কোন কোন মানুষে বেশি প্রকাশ! জল সব জায়গায় আছে, কিন্তু পুকুরে, নদীতে, সমুদ্রে,—প্রকাশ। আপনি Faraday-কে যত মানবেন, নূতন Bachelor of Science-কে কি তত মানবেন?
ডাক্তার—তাতে আমি রাজী আছি। তবে গড্ (God) বল কেন?
মাস্টার—আমরা পরস্পর নমস্কার করি কেন? সকলের হৃদয়মধ্যে নারায়ণ আছেন। আপনি ও-সব বিষয় বেশি দেখেন নাই, ভাবেন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—কোন কোন জিনিসে বেশি প্রকাশ। আপনাকে তো বলেছি, সূর্যের রশ্মি মাটিতে একরকম পড়ে, গাছে একরকম পড়ে, আবার আরশিতে আর একরকম। আরশিতে কিছু বেশি প্রকাশ। এই দেখ না, প্রহ্লাদাদি আর এরা কি সমান? প্রহ্লাদের মন প্রাণ সব তাঁতে সমর্পণ হয়েছিল!
ডাক্তার চুপ করিয়া রহিলেন। সকলে চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—দেখ, তোমার এখানের উপর টান আছে। তুমি আমাকে বলেছো, তোমায় ভালবাসি।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও সংসারী জীব—“তুমি লোভী, কামী, অহংকারী”]
ডাক্তার—তুমি Child of Nature, তাই অত বলি। লোক পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করে, এতে আমার কষ্ট হয়। মনে করি এমন ভাল লোকটাকে খারাপ করে দিচ্ছে। কেশব সেনকে তার চেলারা ওইরকম করেছিল। তোমায় বলি শোন—
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার কথা কি শুনব? তুমি লোভী, কামী, অহংকারী।
ভাদুড়ী (ডাক্তারের প্রতি)—অর্থাৎ তোমার জীবত্ব আছে। জীবের ধর্মই ওই, টাকা-কড়ি, মান-সম্ভ্রমেতে লোভ, কাম, অহংকার। সকল জীবেরই এই ধর্ম।
ডাক্তার—তা বল তো তোমার গলার অসুখটি কেবল দেখে যাব। অন্য কোন কথায় কাজ নাই। তর্ক করতে হয় তো সব ঠিকঠাক বলব।
সকলে চুপ করিয়া রহিলেন।
[অনুলোম ও বিলোম—Involution and Evolution—তিন ভক্ত]
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর আবার ভাদুড়ীর সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি জানো? ইনি (ডাক্তার) এখন নেতি নেতি করে অনুলোমে যাচ্ছে। ঈশ্বর জীব নয়, জগৎ নয়, সৃষ্টির ছাড়া তিনি, এই সব বিচার ইনি কচ্ছে। যখন বিলোমে আসবে সব মানবে।
“কলাগাছের খোলা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে গেলে, মাঝ পাওয়া যায়।
“খোলা একটি আলাদা জিনিস, মাঝ একটি আলাদা জিনিস। মাঝ কিছু খোলা নয়, খোলাও মাঝ নয়। কিন্তু শেষে মানুষ দেখে যে খোলেরই মাঝ, মাঝেরই খোল। তিনি চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন, তিনিই মানুষ হয়েছেন। (ডাক্তারের প্রতি)—ভক্ত তিনরকম। অধম ভক্ত, মধ্যম ভক্ত, উত্তম ভক্ত। অধম ভক্ত বলে, ওই ঈশ্বর। তারা বলে সৃষ্টি আলাদা, ঈশ্বর আলাদা। মধ্যম ভক্ত বলে, ঈশ্বর অন্তর্যামী। তিনি হৃদয়মধ্যে আছেন। সে হৃদয়মধ্যে ঈশ্বরকে দেখে। উত্তম ভক্ত দেখে, তিনি এই সব হয়েছেন। তিনিই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। সে দেখে ঈশ্বর অধঃ ঊর্ধ্বে পরিপূর্ণ।
“তুমি গীতা, ভাগবত, বেদান্ত এ-সব পড়,—তবে এ-সব বুঝতে পারবে!
“ঈশ্বর কি সৃষ্টিমধ্যে নাই?”
ডাক্তার—না, সব জায়গায় আছেন, আর আছেন বলেই খোঁজা যায় না।
কিয়ত্ক্ষণ পরে অন্য কথা পড়িল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশ্বরীয় ভাব সর্বদা হয়, তাহাতে অসুখ বাড়িবার সম্ভাবনা।
ডাক্তার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—ভাব চাপবে। আমার খুব ভাব হয়। তোমাদের চেয়ে নাচতে পারি।
ছোট নরেন (সহাস্যে)—ভাব যদি আর একটু বাড়ে, কি করবেন?
ডাক্তার—Controlling Power-ও (চাপবার শক্তি) বাড়বে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও মাস্টার—সে আপনি বলছো (বলছেন।)
মাস্টার—ভাব হলে কি হবে, আপনি বলতে পারেন?
কিয়ত্ক্ষণ পরে টাকা-কড়ির কথা পড়িল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—আমার তাতে ইচ্ছা নাই, তা তো জান?—কি? ঢঙ্ নয়!
ডাক্তার—আমারই তাতে ইচ্ছা নাই—তা আবার তুমি! বাক্স খোলা টাকা পড়ে থাকে—
শ্রীরামকৃষ্ণ—যদু মল্লিকও ওইরকম অন্যমনস্ক,—যখন খেতে বসে, এত অন্যমনস্ক যে, যা তা ব্যান্নুন, ভাল মন্দ খেয়ে যাচ্ছে। কেউ হয়তো বললে, ‘ওটা খেও না, ওটা খারাপ হয়েছে’। তখন বলে, ‘অ্যাঁ, এ ব্যান্নুনটা খারাপ? হাঁ, সত্যই তো!’
ঠাকুর কি ইঙ্গিতে বলিতেছেন, ঈশ্বরচিন্তা করে অন্যমনস্ক, আর বিষয় চিন্তা করে অন্যমনস্ক, অনেক প্রভেদ?
আবার ভক্তদিগের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ডাক্তারকে দেখাইয়া সহাস্যে বলিতেছেন, “দেখ, সিদ্ধ হলে জিনিস নরম হয়—ইনি (ডাক্তার) খুব শক্ত ছিলেন, এখন ভিতর থেকে একটু নরম হচ্চেন।”
ডাক্তার—সিদ্ধ হলে উপর থেকেই নরম হয়, কিন্তু আমার আর এ যাত্রায় তা হল না। (সকলের হাস্য)
ডাক্তার বিদায় লইবেন, আবার ঠাকুরের সহিত কথা কহিতেছেন।
ডাক্তার—লোকে পায়ে ধুলা লয়, বারণ করতে পার না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সব্বাই কি অখণ্ড সচ্চিদানন্দকে ধরতে পারে?
ডাক্তার—তা বলে যা ঠিক মত, তা বলবে না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—রুচিভেদ আর অধিকারীভেদ আছে।
ডাক্তার—সে আবার কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—রুচিভেদ, কিরকম জানো? কেউ মাছটা ঝোলে খায়, কেউ ভাজা খায়, কেউ মাছের অম্বল খায়, কেউ মাছের পোলাও খায়। আর অধিকারীভেদ। আমি বলি আগে কলাগাছ বিঁধতে শেখ, তারপর শলতে, তারপর পাখি উড়ে যাচ্ছে, তাকে বেঁধ।
[অখণ্ডদর্শন—ডাক্তার সরকার ও হরিবল্লভকে দর্শন]
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন হইলেন। এত অসুখ; কিন্তু অসুখ যেন একধারে পড়িয়া রহিল। দুই-চারজন অন্তরঙ্গ ভক্ত কাছে বসিয়া একদৃষ্টে দেখিতেছেন। ঠাকুর অনেকক্ষণ এই অবস্থায় আছেন।
ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। মণি কাছে বসিয়া আছেন, তাঁহাকে একান্তে বলিতেছেন—“দেখ, অখণ্ডে মন লীন হয়ে গিছিল! তারপর দেখলাম—সে অনেক কথা। ডাক্তারকে দেখলাম, ওর হবে—কিছুদিন পরে;—আর বেশি ওকে বলতে টলতে হবে না। আর-একজনকে দেখলাম। মন থেকে উঠল ‘তাকেও নাও’। তার কথা পরে তোমায় বলব।
[সংসারী জীবকে নানা উপদেশ]
শ্রীযুক্ত শ্যাম বসু ও দোকড়ি ডাক্তার ও আরও দু-একটি লোক আসিয়াছেন। এইবার তাঁহাদের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্যাম বসু—আহা, সেদিন সেই কথাটি যা বলেছিলেন, কি চমত্কার।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কি কথাটি গা?
শ্যাম বসু—সেই যে বললেন, জ্ঞান-অজ্ঞানের পারে গেলে কি থাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—বিজ্ঞান। নানা জ্ঞানের নাম অজ্ঞান। সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন, এর নাম জ্ঞান। বিশেষরূপে জানার নাম বিজ্ঞান। ঈশ্বরের সহিত আলাপ, তাতে আত্মীয়বোধ, এর নাম বিজ্ঞান।
“কাঠে আগুন আছে, অগ্নিতত্ত্ব আছে; এর নাম জ্ঞান। সেই কাঠ জ্বালিয়ে ভাত রেঁধে খাওয়া ও খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হওয়ার নাম বিজ্ঞান।”
শ্যাম বসু (সহাস্যে)—আর সেই কাঁটার কথা!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ, যেমন পায়ে কাঁটা ফুটলে আর-একটি কাঁটা আহরণ করতে হয়; তারপর পায়ের কাঁটাটি তুলে দুটি কাঁটা ফেলে দেয়। তেমনি অজ্ঞানকাঁটা তুলবার জন্য জ্ঞানকাঁটা জোগাড় করতে হয়। অজ্ঞান নাশের পর জ্ঞান-অজ্ঞান দুই-ই ফেলে দিতে হয়। তখন বিজ্ঞান।
ঠাকুর শ্যাম বসুর উপর প্রসন্ন হইয়াছেন। শ্যাম বসুর বয়স হইয়াছে, এখন ইচ্ছা—কিছুদিন ঈশ্বরচিন্তা করেন। পরমহংসদেবের নাম শুনিয়া এখানে আসিয়াছেন। ইতিপূর্বে আর একদিন আসিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্যাম বসুর প্রতি)—বিষয়ের কথা একবারে ছেড়ে দেবে। ঈশ্বরীয় কথা বই অন্য কোনও কথা বলো না। বিষয়ী লোক দেখলে আসতে আসতে সরে যাবে। এতদিন সংসার করে তো দেখলে সব ফক্কাবাজি! ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। ঈশ্বরই সত্য, আর সব দুদিনের জন্য। সংসারে আছে কি? আমড়ার অম্বল; খেতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু আমড়াতে আছে কি? আঁটি আর চামড়া খেলে অম্লশূল হয়।
শ্যাম বসু—আজ্ঞা হাঁ; যা বলছেন সবই সত্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ—অনেকদিন ধরে অনেক বিষয়কর্ম করেছ, এখন গোলমালে ধ্যান ঈশ্বরচিন্তা হবে না। একটু নির্জন দরকার। নির্জন না হলে মন স্থির হবে না। তাই বাড়ি থেকে আধপো অন্তরে ধ্যানের জায়গা করতে হয়।
শ্যামবাবু একটু চুপ করিয়া রহিলেন, যেন কি চিন্তা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আর দেখ, দাঁতও সব পড়ে গেছে, আর দুর্গাপূজা কেন? (সকলের হাস্য) একজন বলেছিল, আর দুর্গাপূজা কর না কেন? সে ব্যক্তি উত্তর দিলে, আর দাঁত নাই ভাই। পাঁঠা খাবার শক্তি গেছে।
শ্যাম বসু—আহা, চিনিমাখা কথা!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—এই সংসারে বালি আর চিনি মিশেল আছে। পিঁপড়ের মতো বালি ত্যাগ করে করে চিনিটুকু নিতে হয়। যে চিনিটুকু নিতে পারে সেই চতুর। তাঁর চিন্তা করবার জন্য একটু নির্জন স্থান কর। ধ্যানের স্থান। তুমি একবার কর না। আমিও একবার যাব।
সকলে কিয়ত্কাল চুপ করিয়া আছেন।
শ্যাম বসু—মহাশয়, জন্মান্তর কি আছে? আবার কি জন্মাতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঈশ্বরকে বল, আন্তরিক ডাক; তিনি জানিয়ে দেন, দেবেন। যদু মল্লিকের সঙ্গে আলাপ কর, যদু মল্লিকই বলে দেবে, তার কখানা বাড়ি, কত টাকার কোম্পানির কাগজ। আগে সে-সব জানবার চেষ্টা করা ঠিক নয়। আগে ঈশ্বরকে লাভ কর, তারপর যা ইচ্ছা, তিনিই জানিয়ে দেবেন।
শ্যাম বসু—মহাশয়, মানুষ সংসারে থেকে কত অন্যায় করে, পাপকর্ম করে। সে মানুষ কি ঈশ্বরকে লাভ করতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেহত্যাগের আগে যদি কেউ ঈশ্বরের সাধন করে, আর সাধন করতে করতে ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে, যদি দেহত্যাগ হয়, তাকে আর পাপ কখন স্পর্শ করবে? হাতির স্বভাব বটে, নাইয়ে দেওয়ার পরেও আবার ধুলো-কাদা মাখে; কিন্তু মাহুত নাইয়ে দিয়ে যদি আস্তাবলে তাকে ঢুকিয়ে দিতে পারে, তাহলে আর ধুলো-কাদা মাখতে পায় না।
ঠাকুরের কঠিন পীড়া! ভক্তেরা অবাক্, অহেতুক-কৃপাসিন্ধু দয়াল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জীবের দুঃখে কাতর; অহর্নিশ জীবের মঙ্গলচিন্তা করিতেছেন। শ্যাম বসুকে সাহস দিতেছেন—অভয় দিতেছেন; “ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে যদি দেহত্যাগ হয়, আর পাপ স্পর্শ করবে না।”
৫৩.৩৪ চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় শ্যামপুকুর বাটীতে ভক্তসঙ্গে
শুক্রবার আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী; ১৫ই কার্তিক; ৩০শে অক্টোবর, ১৮৮৫। শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরে চিকিত্সার্থ আসিয়াছেন। দোতলার ঘরে আছেন; বেলা ৯টা; মাস্টারের সহিত একাকী কথা কহিতেছেন; মাস্টার ডাক্তার সরকারের কাছে গিয়া পীড়ার খবর দিবেন ও তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিবেন। ঠাকুরের শরীর এত অসুস্থ;—কিন্তু কেবল ভক্তদের জন্য চিন্তা!
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি, সহাস্যে)—আজ সকালে পূর্ণ এসেছিল। বেশ স্বভাব। মণীন্দ্রের প্রকৃতিভাব। কি আশ্চর্য! চৈতন্যচরিত পড়ে ওইটি মনে ধারণা হয়েছে—গোপীভাব, সখীভাব; ঈশ্বর পুরুষ আর আমি যেন প্রকৃতি।
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ।
পূর্ণচন্দ্র স্কুলের ছেলে, বয়স ১৫।১৬। পূর্ণকে দেখিবার জন্য ঠাকুর বড় ব্যাকুল হন, কিন্তু বাড়িতে তাহাকে আসিতে দেয় না। দেখিবার জন্য প্রথম প্রথম এত ব্যাকুল হইয়াছিলেন যে, একদিন রাত্রে তিনি দক্ষিণেশ্বর হইতে হঠাৎ মাস্টারের বাড়িতে উপস্থিত। মাস্টার পূর্ণকে বাড়ি হইতে সঙ্গে করিয়া আনিয়া দেখা করাইয়া দিয়াছিলেন। ঈশ্বরকে কিরূপে ডাকিতে হয়,—তাহার সহিত এইরূপ অনেক কথাবার্তার পর—ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া যান।
মণীন্দ্রের বয়সও ১৫।১৬ হইবে। ভক্তেরা তাঁহাকে খোকা বলিয়া ডাকিতেন, এখনও ডাকেন। ছেলেটি ভগবানের নামগুণগান শুনিলে ভাবে বিভোর হইয়া নৃত্য করিত।
৫৩.৩৫ পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ – ডাক্তার ও মাস্টার
বেলা ১০টা-১০॥টা। ডাক্তার সরকারের বাড়ি মাস্টার গিয়াছেন। রাস্তার উপর দোতলার বৈঠকখানার ঘরের বারান্দা, সেইখানে ডাক্তারের সঙ্গে কাষ্ঠাসনে বসিয়া কথা কহিতেছেন। ডাক্তারের সম্মুখে কাঁচের আধারে জল, তাহাতে লাল মাছ খেলা করিতেছে। ডাক্তার মাঝে মাঝে এলাচের খোসা জলে ফেলিয়া দিতেছেন। এক-একবার ময়দার গুলি পাকাইয়া খোলা ছাদের দিকে চড়ুই পাখিদের আহারের জন্য ফেলিয়া দিতেছেন। মাস্টার দেখিতেছেন।
ডাক্তার (মাস্টারের প্রতি সহাস্যে)—এই দেখ, এরা (লাল মাছ) আমার দিকে চেয়ে আছে, কিন্তু উদিকে যে এলাচের খোসা ফেলে দিইছি তা দেখে নাই। তাই বলি, শুধু ভক্তিতে কি হবে, জ্ঞান চাই। (মাস্টারের হাস্য)। ওই দেখ, চড়ুই পাখি উড়ে গেল; ময়দার গুলি ফেললুম, ওর দেখে ভয় হল। ওর ভক্তি হল না, জ্ঞান নাই বলে। জানে না যে খাবার জিনিস।
ডাক্তার বৈঠকখানার মধ্যে আসিয়া বসিলেন। চতুর্দিকে আলমারিতে স্তূপাকার বই। ডাক্তার একটু বিশ্রাম করিতেছেন। মাস্টার বই দেখিতেছেন ও একখানি লইয়া পড়িতেছেন। শেষে কিয়ত্ক্ষণ পড়িতেছেন—Canon Farrar’s Life of Jesus.
ডাক্তার মাঝে মাঝে গল্প করিতেছেন। কত কষ্টে হোমিওপ্যাথিক হস্পিট্যাল্ হইয়াছিল, সেই সকল ব্যাপার সম্বন্ধীয় চিঠিপত্র পড়িতে বলিলেন, আর বলিলেন যে, “ওই সকল চিঠিপত্র ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ‘ক্যালকাটা জার্ণাল্ অব মেডিসিন’-এ পাওয়া যাইবে।” ডাক্তারের হোমিওপ্যাথির উপর খুব অনুরাগ।
মাস্টার আর একখানি বই বাহির করিয়াছেন, Munger’s New Theology। ডাক্তার দেখিলেন।
ডাক্তার—Munger বেশ যুক্তি বিচারের উপর সিদ্ধান্ত করেছে। এ তোমার চৈতন্য অমুক কথা বলেছে, কি বুদ্ধ বলেছে, কি যীশুখ্রীষ্ট বলেছে,—তাই বিশ্বাস করতে হবে,—তা নয়।
মাস্টার (সহাস্যে)—চৈতন্য, বুদ্ধ, নয়; তবে ইনি (Munger)।
ডাক্তার—তা তুমি যা বল।
মাস্টার—একজন তো কেউ বলছে। তাহলে দাঁড়ালো ইনি। (ডাক্তারের হাস্য)
ডাক্তার গাড়িতে উঠিয়াছেন, মাস্টার সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়াছেন। গাড়ি শ্যামপুকুর অভিমুখে যাইতেছে, বেলা দুই প্রহর হইয়াছে। দুইজনে গল্প করিতে করিতে যাইতেছেন। ডাক্তার ভাদুড়ীও মাঝে মাঝে ঠাকুরকে দেখিতে আসেন; তাঁহারই কথা পড়িল।
মাস্টার (সহাস্যে)—আপনাকে ভাদুড়ী বলেছেন, ইটপাটকেল থেকে আরম্ভ করতে হবে।
ডাক্তার—সে কিরকম?
মাস্টার—মহাত্মা, সূক্ষ্ম শরীর, এসব আপনি মানেন না। ভাদুড়ী মহাশয় বোধ হয় থিয়সফিস্ট্। তা ছাড়া, আপনি অবতারলীলা মানেন না। তাই তিনি বুঝি ঠাট্টা করে বলেছেন, এবার মলে মানুষ জন্ম তো হবেই না; কোনও জীবজন্তু, গাছপালা কিছুই হতে পারবেন না! ইটপাটকেল থেকে আরম্ভ করতে হবে, তারপর অনেক জন্মের পর যদি কখনও মানুষ হন!
ডাক্তার—ও বাবা!
মাস্টার—আর বলেছেন, আপনাদের যে Science নিয়ে জ্ঞান সে মিথ্যা জ্ঞান। এই আছে, এই নাই। তিনি উপমাও দিয়েছেন। যেমন দুটি পাতকুয়া আছে। একটি পাতকুয়ার জল নিচের Spring থেকে আসছে; দ্বিতীয় পাতকুয়ার Spring নাই, তবে বর্ষার জলে পরিপূর্ণ হয়েছে। সে জল কিন্তু বেশিদিন থাকবার নয়। আপনার Science-এর জ্ঞানও বর্ষার পাতকুয়ার জলের মতো শুকিয়ে যাবে।
ডাক্তার (ঈষৎ হাসিয়া)—বটে।
গাড়ি কর্ণওয়ালিস্ স্ট্রীটে আসিয়া উপস্থিত হইল। ডাক্তার সরকার শ্রীযুক্ত প্রতাপ ডাক্তারকে তুলিয়া লইলেন। তিনি গতকল্য ঠাকুরকে দেখিতে গিয়াছিলেন।
৫৩.৩৬ ষট্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – ডাক্তার সরকারের প্রতি উপদেশ—জ্ঞানীর ধ্যান
ঠাকুর সেই দোতলার ঘরে বসিয়া আছেন,—কয়েকটি ভক্তসঙ্গে। ডাক্তার এবং প্রতাপের সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
ডাক্তার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আবার কাশি হয়েছে? (সহাস্যে) তা কাশীতে যাওয়া তো ভাল। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তাতে তো মুক্তি গো! আমি মুক্তি চাই না, ভক্তি চাই। (ডাক্তার ও ভক্তেরা হাসিতেছেন)
শ্রীযুক্ত প্রতাপ, ডাক্তার ভাদুড়ীর জামাতা। ঠাকুর প্রতাপকে দেখিয়া ভাদুড়ীর গুণগান করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রতাপকে)—আহা, তিনি কি লোক হয়েছেন! ঈশ্বরচিন্তা, শুদ্ধাচার, আর নিরাকার-সাকার সব ভাব নিয়েছেন।
মাস্টারের বড় ইচ্ছা যে ইটপাটকেলের কথাটি আর একবার হয়। তিনি ছোট নরেনকে আস্তে আস্তে—অথচ ঠাকুর যাহাতে শুনিতে পান—এমন ভাবে বলিতেছেন, “ইটপাটকেলের কথাটি ভাদুড়ী কি বলেছেন মনে আছে?”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, ডাক্তারের প্রতি)—আর তোমায় কি বলেছেন জানো? তুমি এ-সব বিশ্বাস কর না, মন্বন্তরের পর তোমার ইটপাটকেল থেকে আরম্ভ করতে হবে। (সকলের হাস্য)
ডাক্তার (সহাস্যে)—ইটপাটকেল থেকে আরম্ভ করে অনেক জন্মের পর যদি মানুষ হই, আবার এখানে এলেই তো ইটপাটকেল থেকে আবার আরম্ভ। (ডাক্তারের ও সকলের হাস্য)
ঠাকুর এত অসুস্থ, তবুও তাঁহার ঈশ্বরীয় ভাব হয় ও তিনি ঈশ্বরের কথা সর্বদা কন, এই কথা হইতেছে।
প্রতাপ—কাল দেখে গেলাম ভাবাবস্থা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে আপনি আপনি হয়ে গিয়েছিল; বেশি নয়।
ডাক্তার—কথা আর ভাব এখন ভাল নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—কাল যে ভাবাবস্থা হয়েছিল, তাতে তোমাকে দেখলাম। দেখলাম, জ্ঞানের আকার—কিন্তু মজক একেবারে শুষ্ক, আনন্দরস পায় নাই। (প্রতাপের প্রতি) ইনি (ডাক্তার) যদি একবার আনন্দ পান, অধঃ ঊর্ধ্ব পরিপূর্ণ দেখেন। আর ‘আমি যা বলছি তাই ঠিক, আর অন্যেরা যা বলে তা ঠিক নয়,’—এ-সব কথা তাহলে আর বলেন না—আর হ্যাঁক-ম্যাঁক লাঠিমারা কথাগুলো আর ওঁর মুখ দিয়ে বেরোয় না!
[জীবনের উদ্দেশ্য—পূর্বকথা—ন্যাংটার উপদেশ]
ভক্তেরা সকলে চুপ করিয়া আছেন, হঠাৎ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হইয়া ডাক্তার সরকারকে বলিতেছেন—
“মহীন্দ্রবাবু—কি টাকা টাকা করছো! মাগ, মাগ!—মান, মান! করছো! ও-সব এখন ছেড়ে দিয়ে, একচিত্ত হয়ে ঈশ্বরেতে মন দাও!—ওই আনন্দ ভোগ করো।”
ডাক্তার সরকার চুপ করিয়া আছেন। সকলেই চুপ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—জ্ঞানীর ধ্যানের কথা ন্যাংটা বলত। জলে জল, অধঃ ঊর্ধ্ব পরিপূর্ণ! জীব যেন মীন, জলে আনন্দে সে সাঁতার দিচ্ছে। ঠিক ধ্যান হলে এইটি সত্য সত্য দেখবে।
“অনন্ত সমুদ্র, জলেরও অবধি নাই। তার ভিতরে যেন একটি ঘট রয়েছে। বাহিরে ভিতরে জল। জ্ঞানী দেখে—অন্তরে বাহিরে সেই পরমাত্মা। তবে ঘটটি কি? ঘট আছে বলে জল দুই ভাগ দেখাচ্ছে, অন্তরে বাহিরে বোধ হচ্ছে। ‘আমি’ ঘট থাকলে এই বোধ হয়। ওই ‘আমিটি’ যদি যায়, তাহলে যা আছে তাই, মুখে বলবার কিছু নাই।
“জ্ঞানীর ধ্যান আর কিরকম জানো? অনন্ত আকাশ, তাতে পাখি আনন্দে উড়ছে, পাখা বিস্তার করে। চিদাকাশ, আত্মা পাখি। পাখি খাঁচায় নাই, চিদাকাশে উড়ছে! আনন্দ ধরে না।”১
ভক্তেরা অবাক্ হইয়া এই ধ্যানযোগ কথা শুনিতেছেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে প্রতাপ আবার কথা আরম্ভ করিলেন।
প্রতাপ (সরকারের প্রতি)—ভাবতে গেলে সব ছায়া।
ডাক্তার—ছায়া যদি বললে, তবে তিনটি চাই। সূর্য, বস্তু আর ছায়া। বস্তু না হলে ছায়া কি! এদিকে বলছো God real আবার Creation unreal! Creation-ও real।
প্রতাপ—আচ্ছা, আরশিতে যেমন প্রতিবিম্ব, তেমনি মনরূপ আরশিতে এই জগৎ দেখা যাচ্ছে।
ডাক্তার—একটা বস্তু না থাকলে কি প্রতিবিম্ব?
নরেন—কেন, ঈশ্বর বস্তু! [ডাক্তার চুপ করিয়া রহিলেন।]১ CF. Shelley’s Skylark.
[জগৎ-চৈতন্য ও Science—ঈশ্বরই কর্তা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ডাক্তারের প্রতি)—একটা কথা তুমি বেশ বলেছো। ভাবাবস্থা যে মনের যোগে হয় এটি আর কেউ বলেনি। তুমিই বলেছো।
“শিবনাথ বলেছিল, বেশি ঈশ্বরচিন্তা করলে বেহেড হয়ে যায়। বলে জগৎ-চৈতন্যকে চিন্তা করে অচৈতন্য হয়। বোধস্বরূপ, যাঁর বোধে জগৎ বোধ করছে, তাঁকে চিন্তা করে অবোধ!
“আর তোমার Science—এটা মিশলে ওটা হয়; ওটা মিশলে এটা হয়; ওগুলো চিন্তা করলে বরং বোধশূন্য হতে পারে, কেবল জড়গুলো ঘেঁটে!”
ডাক্তার—ওতে ঈশ্বরকে দেখা যায়।
মণি—তবে মানুষে আরও স্পষ্ট দেখা যায়। আর মহাপুরুষে আরও বেশি দেখা যায়। মহাপুরুষে বেশি প্রকাশ।
ডাক্তার—হাঁ, মানুষেতে বটে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁকে চিন্তা করলে অচৈতন্য! যে চৈতন্যে জড় পর্যন্ত চেতন হয়েছে, হাত-পা-শরীর নড়ছে! বলে শরীর নড়ছে, কিন্তু তিনি নড়ছেন, জানে না। বলে, জলে হাত পুড়ে গেল! জলে কিছু পোড়ে না। জলের ভিতর যে উত্তাপ, জলের ভিতর যে অগ্নি তাতেই হাত পুড়ে গেল!
“হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। আলু-বেগুন লাফাচ্ছে। ছোট ছেলে বলে আলু-বেগুনগুলো আপনি নাচছে। জানে না যে, নিচে আগুন আছে! মানুষ বলে, ইন্দ্রিয়েরা আপনা-আপনি কাজ করছে! ভিতরে যে সেই চৈতন্যস্বরূপ আছে তা ভাবে না!”
ডাক্তার সরকার গাত্রোত্থান করিলেন। এইবার বিদায় গ্রহণ করিবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও দাঁড়াইলেন।
ডাক্তার—বিপদে মধুসূদন। সাধে ‘তুঁহু তুঁহু’ বলায়। গলায় ওইটি হয়েছে তাই। তুমি নিজে যেমন বলো, এখন ধুনুরীর হাতে পড়েছো, ধুনুরীকে বলো। তোমারই কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি আর বলব।
ডাক্তার—কেন বলবে না? তাঁর কোলে রয়েছি, কোলে হাগছি আর ব্যায়রাম হলে তাঁকে বলব না তবে কাকে বলব?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঠিক ঠিক। এক-একবার বলি। তা—হয় না।
ডাক্তার—আর বলতেই বা হবে কেন, তিনি কি জানছেন না?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—একজন মুসলমান নমাজ করতে করতে ‘হো আল্লা’ ‘হো আল্লা’ বলে চিত্কার করে ডাকছিল। তাকে একজন লোক বললে, তুই আল্লাকে ডাকছিস তা অতো চেঁচাচ্ছিস কেন? তিনি যে পিঁপড়ের পায়ের নূপুর শুনতে পান!
[যোগীর লক্ষণ—যোগী অন্তর্মুখ—বিল্বমঙ্গল ঠাকুর]
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁতে যখন মনের যোগ হয়, তখন ঈশ্বরকে খুব কাছে দেখে। হৃদয়ের মধ্যে দেখে।
“কিন্তু একটি কথা আছে, যত এই যোগ হবে ততই বাহিরের জিনিস থেকে মন সরে আসবে। ভক্তমালে এক ভক্তের (বিল্বমঙ্গলের) কথা আছে। সে বেশ্যালয়ে যেত। একদিন অনেক রাত্রে যাচ্ছে। বাড়িতে বাপ-মায়ের শ্রাদ্ধ হয়েছিল তাই দেরি হয়েছে। শ্রাদ্ধের খাবার বেশ্যাকে দেবে বলে হাতে করে লয়ে যাচ্ছে। তার বেশ্যার দিকে এত একাগ্র মন যে কিসের উপর দিয়ে যাচ্ছে, কোন্খান দিয়ে যাচ্ছে, এ-সব কিছু হুঁশ নাই। পথে এক যোগী চক্ষু বুজে ঈশ্বরচিন্তা কচ্ছিল, তাঁর গায়ে পা দিয়ে চলে যাচ্ছে। যোগী রাগ করে বলে উঠল, ‘কি তুই দেখতে পাচ্ছিস না? আমি ঈশ্বরকে চিন্তা করছি, তুই গায়ের উপর পা দিয়ে চলে যাচ্ছিস?’ তখন সে লোকটি বললে, আমায় মাপ করবেন, কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, বেশ্যাকে চিন্তা করে আমার হুঁশ নাই, আর আপনি ঈশ্বরচিন্তা কচ্ছেন, আপনার সব বাহিরের হুঁশ আছে! এ কিরকম ঈশ্বরচিন্তা! সে ভক্ত শেষে সংসারত্যাগ করে ঈশ্বরের আরাধনায় চলে গিয়েছিল। বেশ্যাকে বলেছিল, তুমি আমার গুরু, তুমিই শিখিয়েছ কিরকম ঈশ্বরে অনুরাগ করতে হয়। বেশ্যাকে মা বলে ত্যাগ করেছিল।”
ডাক্তার—এ তান্ত্রিক উপাসনা। জননী রমণী।
[লোকশিক্ষা দিবার সংসারীর অনধিকার]
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখ, একটা গল্প শোন। একজন রাজা ছিল। একটি পণ্ডিতের কাছে রাজা রোজ ভাগবত শুনত। প্রত্যহ ভাগবত পড়ার পর পণ্ডিত রাজাকে বলত, রাজা বুঝেছ? রাজাও রোজ বলত, তুমি আগে বোঝ! ভাগবতের পণ্ডিত বাড়ি গিয়ে রোজ ভাবে যে, রাজা রোজ এমন কথা বলে কেন! আমি রোজ এত করে বোঝাই আর রাজা উলটে বলে, তুমি আগে বোঝ! একি হল! পণ্ডিতটি সাধন-ভজন করত। কিছুদিন পরে তাঁর হুঁশ হল যে ঈশ্বরই বস্তু, আর সব—গৃহ পরিবার, ধন, জন, মানসম্ভ্রম সব অবস্তু। সংসারে সব মিথ্যা বোধ হওয়াতে সে সংসারত্যাগ করলে। যাবার সময় কেবল একজনকে বলে গেল যে, রাজাকে বলো যে এখন আমি বুঝেছি।
“আর একটি গল্প শোন। একজনের একটি ভাগবতের পণ্ডিত দরকার হয়েছিল,—পণ্ডিত এসে রোজ শ্রীমদ্ভাগবতের কথা বলবে। এখন ভাগবতের পণ্ডিত পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খোঁজার পর একটি লোক এসে বললে, মহাশয়, একটি উত্কৃষ্ট ভাগবতের পণ্ডিত পেয়েছি। সে বললে, তবে বেশ হয়েছে,—তাঁকে আন। লোকটি বললে, একটু কিন্তু গোল আছে। তার কয়খানা লাঙ্গল আর কয়টা হেলে গরু আছে—তাদের নিয়ে সমস্ত দিন থাকতে হয়, চাষ দেখতে হয়, একটুও অবসর নাই। তখন যার ভাগবতের পণ্ডিত দরকার সে বললে, ওহে, যার লাঙ্গল আর হেলে গরু আছে, এমন ভাগবতের পণ্ডিত আমি চাচ্ছি না,—আমি চাচ্ছি এমন লোক যার অবসর আছে, আর আমাকে হরিকথা শুনাতে পারেন। (ডাক্তারের প্রতি) বুঝলে?”
ডাক্তার চুপ করিয়া রহিলেন।
[শুধু পাণ্ডিত্য ও ডাক্তার]
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি জানো, শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে? পণ্ডিতেরা অনেক জানে-শোনে—বেদ, পুরাণ, তন্ত্র। কিন্তু শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে? বিবেক-বৈরাগ্য চাই। বিবেক-বৈরাগ্য যদি থাকে, তবে তার কথা শুনতে পারা যায়। যারা সংসারকে সার করেছে, তাদের কথা নিয়ে কি হবে!
“গীতা পড়লে কি হয়? দশবার ‘গীতা গীতা’ বললে যা হয়। ‘গীতা গীতা’ বলতে বলতে ‘ত্যাগী’ হয়ে যায়। সংসারে কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি যার ত্যাগ হয়ে গেছে, যে ঈশ্বরেতে ষোল আনা ভক্তি দিতে পেরেছে, সেই গীতার মর্ম বুঝেছে। গীতা সব বইটা পড়বার দরকার নাই। ‘ত্যাগী’ ‘ত্যাগী’ বলতে পারলেই হল।”
ডাক্তার—‘ত্যাগী’ বলতে গেলেই একটা য-ফলা আনতে হয়।
মণি—তা য-ফলা না আনলেও হয়, নবদ্বীপ গোস্বামী ঠাকুরকে বলেছিলেন। ঠাকুর পেনেটিতে মহোত্সব দেখতে গিয়েছিলেন, সেখানে নবদ্বীপ গোস্বামীকে এই গীতার কথা বলেছিলেন। তখন গোস্বামী বললেন, তগ্ ধাতু ঘঙ্ ‘তাগ’ হয়, তার উত্তর ইন্ প্রত্যয় করলে ত্যাগী হয়, ত্যাগী ও তাগী এক মানে।
ডাক্তার—আমায় একজন রাধা মানে বলেছিল। বললে, রাধা মানে কি জানো? কথাটা উল্টে নাও অর্থাৎ ‘ধারা, ধারা’। (সকলের হাস্য)
(সহাস্যে)—“আজ ‘ধারা’ পর্যন্তই রহিল।”
৫৩.৩৭ সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ – ঐহিক জ্ঞান বা Science
ডাক্তার চলিয়া গেলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন ও একান্তে কথা হইতেছে। মাস্টার ডাক্তারের বাড়িতে গিয়াছিলেন, সেই সব কথা হইতেছিল।
মাস্টার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—লাল মাছকে এলাচের খোসা দেওয়া হচ্ছিল, আর চড়ুই পাখিদের ময়দার গুলি। তা বলেন, ‘দেখলে, ওরা এলাচের খোসা দেখেনি, তাই চলে গেল! আগে জ্ঞান চাই তবে ভক্তি। দুই-একটা চড়ুইও ময়দার ডেলা ছোড়া দেখে পালিয়ে গেল। ওদের জ্ঞান নাই, তাই ভক্তি হল না।’
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ও জ্ঞানের মানে ঐহিক জ্ঞান—ওদের Science-এর জ্ঞান।
মাস্টার—আবার বললেন, ‘চৈতন্য বলে গেছে, কি বুদ্ধ বলে গেছে, কি যীশুখ্রীষ্ট বলে গেছে, তবে বিশ্বাস করব! তা নয়!’
“এক নাতি হয়েছে,—তা বউমার সুখ্যাতি করলেন। বললেন, একদিনও বাড়িতে দেখতে পাই না, এমনি শান্ত আর লজ্জাশীলা—”
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখানকার কথা ভাবছে। ক্রমে শ্রদ্ধা হচ্ছে। একবারে অহংকার কি যায় গা! অত বিদ্যা, মান! টাকা হয়েছে! কিন্তু এখানকার কথাতে অশ্রদ্ধা নেই।
৫৩.৩৮ ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – অবতীর্ণ শক্তি বা সদানন্দ
বেলা ৫টা। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই দোতলার ঘরে বসিয়া আছেন। চতুর্দিকে ভক্তেরা চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। তন্মধ্যে অনেকগুলি বাহিরের লোক তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছেন। কোন কথা নাই।
মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। তাঁহার সঙ্গে নিভৃতে এক-একটি কথা হইতেছে। ঠাকুর জামা পরিবেন—মাস্টার জামা পরাইয়া দিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—দেখো, এখন আর বড় ধ্যান-ট্যান করতে হয় না। অখণ্ড একবারে বোধ হয়ে যায়। এখন কেবল দর্শন।
মাস্টার চুপ করিয়া আছেন। ঘরও নিস্তব্ধ।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর তাহাকে আবার একটি কথা বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, এরা যে সব একাসনে চুপ করে বসে আছে, আর আমায় দেখে—কথা নাই, গান নাই; এতে কি দেখে?
ঠাকুর কি ইঙ্গিত করিতেছেন যে, সাক্ষাৎ ঈশ্বরের শক্তি অবতীর্ণ—তাই এত লোকের আকর্ষণ, তাই ভক্তেরা অবাক্ হইয়া তাঁহার দিকে তাকাইয়া থাকে!
মাস্টার উত্তর করিলেন—আজ্ঞে, এরা সব আপনার কথা অনেক আগে শুনেছে, আর দেখে—যা কখনও ওরা দেখতে পায় না—সদানন্দ বালকস্বভাব, নিরহংকার, ঈশ্বরের প্রেমে মাতোয়ারা! সেদিন ঈশান মুখুজ্জের বাড়ি আপনি গিছিলেন; সেই বাহিরের ঘরে পায়চারি কচ্ছিলেন; আমরাও ছিলাম, একজন আপনাকে এসে বললে, এমন ‘সদানন্দ পুরুষ’ কোথাও দেখি নাই।
মাস্টার আবার চুপ করিয়া রহিলেন। ঘর আবার নিস্তব্ধ! কিয়ত্কাল পরে ঠাকুর আবার মৃদুস্বরে মাস্টারকে কি বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, ডাক্তারের কিরকম হচ্ছে? এখানকার কথা সব কি বেশ নিচ্ছে?
মাস্টার—এ অমোঘ বীজ কোথায় যাবে, একবার না একবার একদিক দিয়ে বেরোবে। সেদিনকার একটা কথায় হাসি পাচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি কথা?
মাস্টার—সেদিন বলেছিলেন, যদু মল্লিকের খাবার সময় কোন্ ব্যঞ্জনে নুন হয়েছে, কোন্ ব্যঞ্জনে হয়নি এ বুঝতে পারে না; এত অন্যমনস্ক! কেউ যদি বলে দেয় এ ব্যঞ্জনে নুন হয় নাই, তখন এ্যাঁ এ্যাঁ করে বলে, ‘নুন হয় নাই?’ ডাক্তারকে এই কথাটি শোনাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন কিনা যে, আমি এত অন্যমনস্ক হয়ে যাই। আপনি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন যে, সে বিষয়চিন্তা করে অন্যমনস্ক, ঈশ্বরচিন্তা করে নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওগুলো কি ভাববে না?
মাস্টার—ভাববেন বইকি। তবে নানা কাজ, অনেককথা ভুলে যায়। আজকেও বেশ বললেন, তিনি যখন বললেন, ‘ও তান্ত্রিকের উপাসনা।—জননী রমণী।’
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি কি বললুম?
মাস্টার—আপনি বললেন, হেলে গরুওয়ালা ভাগবত পণ্ডিতের কথা। (শ্রীরামকৃষ্ণের হাস্য) আর বললেন, সেই রাজার কথা যে বলেছিল, ‘তুমি আগে বোঝ!’ (শ্রীরামকৃষ্ণের হাস্য)
“আর বললেন, গীতার কথা। গীতার সার কথা কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ,—কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি ত্যাগ। ডাক্তারকে আপনি বললেন যে সংসারী হয়ে (ত্যাগী না হয়ে) ও আবার কি শিক্ষা দেবে? তা তিনি বুঝতে বোধ হয় পারেন নাই। শেষে ‘ধারা’ ‘ধারা’ বলে চাপা দিয়ে গেলেন।”
ঠাকুর ভক্তের জন্য চিন্তা করিতেছেন;—পূর্ণ বালক ভক্ত, তাঁহার জন্য। মণীন্দ্রও বালক ভক্ত; ঠাকুর তাঁহাকে পূর্ণের সঙ্গে আলাপ করিতে পাঠাইলেন।
৫৩.৩৯ ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরাধাকৃষ্ণতত্ত্বপ্রসঙ্গে—‘সব সম্ভবে’ নিত্যলীলা
সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে আলো জ্বলিতেছে। কয়েকটি ভক্ত ও যাঁহারা ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছেন, তাঁহারা সেই ঘরে একটু দূরে বসিয়া আছেন। ঠাকুর অন্তর্মুখ—কথা কহিতেছেন না। ঘরের মধ্যে যাঁহারা আছেন, তাঁহারাও ঈশ্বরকে চিন্তা করিতে করিতে মৌনাবলম্বন করিয়া আছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে নরেন্দ্র একটি বন্ধুকে সঙ্গে করিয়া আনিলেন। নরেন্দ্র বলিলেন, ইনি আমার বন্ধু, ইনি কয়েকখানি গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন, ইনি ‘কিরন্ময়ী’ লিখেন। ‘কিরন্ময়ী’ লেখক প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। ঠাকুরের সঙ্গে কথা কহিবেন।
নরেন্দ্র—ইনি রাধাকৃষ্ণের বিষয় লিখেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (লেখকের প্রতি)—কি লিখেছো গো, বল দেখি।
লেখক—রাধাকৃষ্ণই পরব্রহ্ম, ওঁকারের বিন্দুস্বরূপ। সেই রাধাকৃষ্ণ পরব্রহ্ম থেকে মহাবিষ্ণু; মহাবিষ্ণু থেকে পুরুষ-প্রকৃতি,—শিব-দুর্গা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বেশ! নিত্যরাধা নন্দ ঘোষ দেখেছিলেন। প্রেমরাধা বৃন্দাবনে লীলা করেছিলেন, কামরাধা চন্দ্রাবলী।
“কামরাধা, প্রেমরাধা। আরও এগিয়ে গেলে নিত্যরাধা। প্যাঁজ ছাড়িয়ে গেলে প্রথমে লাল খোসা, তারপরে ঈষৎ লাল, তারপরে সাদা, তারপরে আর খোসা পাওয়া যায় না। ওইটি নিত্যরাধার স্বরূপ—যেখানে নেতি নেতি বিচার বন্ধ হয়ে যায়!
“নিত্য রাধাকৃষ্ণ, আর লীলা রাধাকৃষ্ণ। যেমন সূর্য আর রশ্মি। নিত্য সূর্যের স্বরূপ, লীলা রশ্মির স্বরূপ।
“শুদ্ধভক্ত কখনও নিত্যে থাকে, কখন লীলায়।
“যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা। দুই কিংবা বহু নয়।”
লেখক—আজ্ঞে, ‘বৃন্দাবনের কৃষ্ণ’ আর ‘মথুরার কৃষ্ণ’ বলে কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও গোস্বামীদের মত। পশ্চিমে পণ্ডিতেরা তা বলে না। তাদের কৃষ্ণ এক, রাধা নাই। দ্বারিকার কৃষ্ণ ওইরকম।
লেখক—আজ্ঞে, রাধাকৃষ্ণই পরব্রহ্ম।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বেশ! কিন্তু তাঁতে সব সম্ভবে! সেই তিনিই নিরাকার সাকার। তিনিই স্বরাট বিরাট! তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি!
“তাঁর ইতি নাই,—শেষ নাই; তাঁতে সব সম্ভবে। চিল-শকুনি যত উপরে উঠুক না কেন, আকাশ গায়ে ঠেকে না। যদি জিজ্ঞাসা কর ব্রহ্ম কেমন—তা বলা যায় না। সাক্ষাত্কার হলেও মুখে বলা যায় না। যদি জিজ্ঞাসা কেউ করে, কেমন ঘি? তার উত্তর,—কেমন ঘি, না যেমন ঘি। ব্রহ্মের উপমা ব্রহ্ম। আর কিছুই নাই।”
৫৩.৪০ চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ – শ্যামপুকুর বাটীতে হরিবল্লভ, নরেন্দ্র, মিশ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে শ্রীযুক্ত বলরামের জন্য চিন্তা—শ্রীযুক্ত হরিবল্লভ বসু
শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরের বাটীতে ভক্তসঙ্গে চিকিত্সার্থ বাস করিতেছেন। আজ শনিবার। আশ্বিন, কৃষ্ণা অষ্টমী তিথি, ১৬ই কার্তিক। ৩১শে অক্টোবর, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ। বেলা নয়টা।
এখানে ভক্তেরা দিবারাত্রি থাকেন—ঠাকুরের সেবার্থ! এখনও কেহ সংসার ত্যাগ করেন নাই।
বলরাম সপরিবারে ঠাকুরের সেবক। তিনি যে বংশে জন্মিয়াছেন, সে অতি ভক্তবংশ। পিতা বৃদ্ধ হইয়াছেন, বৃন্দাবনে একাকী বাস করেন—তাঁহাদের প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রীশ্যামসুন্দরের কুঞ্জে। তাঁহার পিতৃব্যপুত্র শ্রীযুক্ত হরিবল্লভ বসু ও বাটীর অন্যান্য সকলেই বৈষ্ণব।
হরিবল্লভ কটকের প্রধান উকিল। পরমহংসদেবের কাছে বলরাম যাতায়াত করেন—বিশেষতঃ মেয়েদের লইয়া যান—শুনিয়া বিরক্ত হইয়াছেন। দেখা হইলে, বলরাম বলিয়াছিলেন, তুমি তাঁহাকে একবার দর্শন কর—তারপর যা হয় বলো!
আজ হরিবল্লভ আসিয়াছেন, তিনি ঠাকুরকে দর্শন করিয়া অতি ভক্তিভাবে প্রণাম করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি করে ভাল হবে!—আপনি কি দেখছো, শক্ত ব্যামো?
হরিবল্লভ—আজ্ঞা, ডাক্তারেরা বলতে পারেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—মেয়েরা পায়ের ধুলা লয়। তা ভাবি একরূপে তিনিই (ঈশ্বর) ভিতরে আছেন—হিসাব আনি।
হরিবল্লভ—আপনি সাধু! আপনাকে সকলে প্রণাম করবে, তাতে দোষ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে ধ্রুব, প্রহ্লাদ, নারদ, কপিল, এরা কেউ হলে হত। আমি কি! আপনি আবার আসবেন।
হরি—আজ্ঞা, আমাদের টানেই আসব—আপনি বলছেন কেন।
হরিবল্লভ বিদায় লইবেন—প্রণাম করিতেছেন। পায়ের ধুলা লইতে যাইতেছেন—ঠাকুর পা সরাইয়া লইতেছেন। কিন্তু হরিবল্লভ ছাড়িলেন না—জোর করিয়া পায়ে ধুলা লইলেন।
হরিবল্লভ গাত্রোত্থান করিলেন। ঠাকুর যেন তাঁহাকে খাতির করিবার জন্য দাঁড়াইলেন। বলিতেছেন, “বলরাম অনেক দুঃখ করে। আমি মনে কল্লাম, একদিন যাই—গিয়ে তোমাদের সঙ্গে দেখা করি। তা আবার ভয় হয়! পাছে তোমরা বল, একে কে আনলে!”
হরি—ও-সব কথা কে বলেছে। আপনি কিছু ভাববেন না।
হরিবল্লভ চলিয়া গেলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—ভক্তি আছে—তা না হলে জোর করে পায়ের ধুলা নিলে কেন?
“সেই যে তোমায় বলেছিলাম, ভাবে দেখলাম ডাক্তার ও আর-একজনকে,—এই সেই আর-একজন। তাই দেখ, এসেছে।”
মাস্টার—আজ্ঞে, ভক্তিরই ঘর।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি সরল!
ডাক্তার সরকারের কাছে ঠাকুরের অসুখের সংবাদ দিবার জন্য মাস্টার শাঁখারিটোলায় আসিয়াছেন। ডাক্তার আজ আবার ঠাকুরকে দেখিতে যাইবেন।
ডাক্তার ঠাকুরের ও মহিমাচরণ প্রভৃতি ভক্তদের কথা বলিতেছেন।
ডাক্তার—কই, তিনি (মহিমাচরণ) সে বইতো আনেন নাই—যে বই আমাকে দেখাবেন বলেছিলেন! বললে, ভুল হয়েছে। তা হতে পারে—আমারও হয়।
মাস্টার—তাঁর বেশ পড়াশুনা আছে।
ডাক্তার—তাহলে এই দশা!
ঠাকুরের সম্বন্ধে ডাক্তার বলিতেছেন, “শুধু ভক্তি নিয়ে কি হবে—জ্ঞান যদি না থাকে।”
মাস্টার—কেন, ঠাকুর তো বলেন—জ্ঞানের পর ভক্তি। তবে তাঁর ‘জ্ঞান, ভক্তি’ আর আপনাদের ‘জ্ঞান, ভক্তি’র মানে অনেক তফাত।
“তিনি যখন বলেন—‘জ্ঞানের পর ভক্তি’ তার মানে—তত্ত্বজ্ঞানের পর ভক্তি, ব্রহ্মজ্ঞানের পর ভক্তি—ভগবানকে জানার পর ভক্তি। আপনাদের জ্ঞান মানে সেন্স্ নলেজ্ (ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে পাওয়া জ্ঞান।) প্রথমটি not verifiable by our standard; তত্ত্বজ্ঞান ইন্দ্রিয়লভ্য জ্ঞানের দ্বারা ঠিক করা যায় না। দ্বিতীয়টি—verifiable (জড়জ্ঞান)।”
ডাক্তার চুপ করিয়া, আবার অবতার সম্বন্ধে কথা কহিতেছেন।
ডাক্তার—অবতার আবার কি? আর পায়ের ধুলো লওয়া কি!
মাস্টার—কেন, আপনি তো বলেন একস্পেরিমেন্ট্ সময় তাঁর সৃষ্টি দেখে ভাব হয়, মানুষ দেখলে ভাব হয়। তা যদি হয়, ঈশ্বরকে কেন না মাথা নোয়াব? মানুষের হৃদয় মধ্যে ঈশ্বর আছেন।
“হিন্দুধর্মে দেখে সর্বভূতে নারায়ণ! এটা তত আপনার জানা নাই। সর্বভূতে যদি থাকেন তাঁকে প্রণাম করতে কি?
“পরমহংসদেব বলেন, কোনও কোনও জিনিসে তিনি বেশি প্রকাশ। সূর্যের প্রকাশ জলে, আরশিতে। জল সব জায়গায় আছে—কিন্তু নদীতে, পুষ্করিণীতে, বেশি প্রকাশ। ঈশ্বরকেই নমস্কার করা হয়—মানুষকে নয়। God is God—not man is God.
“তাঁকে তো রীজ্নিং (সামান্য বিচার) করে জানা যায় না—সমস্ত বিশ্বাসের উপর নির্ভর। এই সব কথা ঠাকুর বলেন।”
আজ মাস্টারকে ডাক্তার তাঁহার রচিত একখানি বই উপহার দিলেন—
Physiological Basis of Psychology—‘as a token of brotherly regards’.
৫৩.৪১ একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ ও Jesus Christ—তাঁহাতে খ্রীষ্টের আবির্ভাব
ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বেলা এগারটা। মিশ্র নামক একটি খ্রীষ্টান ভক্তের সহিত কথা কহিতেছেন। মিশ্রের বয়ঃক্রম ৩৫ বত্সর হইবে। মিশ্র খ্রীষ্টানবংশে জন্মিয়াছেন। যদিও সাহেবের পোশাক, ভিতরে গেরুয়া আছে। এখন সংসারত্যাগ করিয়াছেন। ইঁহার জন্মস্থান পশ্চিমাঞ্চলে। একটি ভ্রাতার বিবাহের দিনে তাঁহার এবং আর একটি ভ্রাতার একদিনে মৃত্যু হয়। সেই দিন হইতে মিশ্র সংসারত্যাগ করিয়াছেন। তিনি কোয়েকার্ সম্প্রদায়ভুক্ত।
মিশ্র—‘ওহি রাম ঘট্ ঘটমে লেটা।’
শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট নরেনকে আস্তে আস্তে বলিতেছেন—যাহাতে মিশ্রও শুনিতে পান—‘এক রাম তাঁর হাজার নাম।’
“খ্রীষ্টানরা যাঁকে God বলে, হিন্দুরা তাঁকেই রাম, কৃষ্ণ, ঈশ্বর—এই সব বলে। পুকুরে অনেকগুলি ঘাট। একঘাটে হিন্দুরা জল খাচ্ছে, বলছে জল; ঈশ্বর। খ্রীষ্টানেরা আর-একঘাটে খাচ্ছে,—বলছে, ওয়াটার; গড্ যীশু। মুসলমানেরা আর-একঘাটে খাচ্ছে—বলছে, পানি; আল্লা।”
মিশ্র—মেরির ছেলে Jesus নয়। Jesus স্বয়ং ঈশ্বর।
(ভক্তদের প্রতি)—“ইনি (শ্রীরামকৃষ্ণ) এখন এই আছেন—আবার এক সময় সাক্ষাৎ ঈশ্বর।
“আপনারা (ভক্তেরা) এঁকে চিনতে পাচ্ছেন না। আমি আগে থেকে এঁকে দেখেছি—এখন সাক্ষাৎ দেখছি। দেখেছিলাম—একটি বাগান, উনি উপরে আসনে বসে আছেন; মেঝের উপর আর-একজন বসে আছেন,—তিনি advanced (উন্নত) নন।
“এই দেশে চারজন দ্বারবান্ আছেন। বোম্বাই অঞ্চলে তুকারাম ও কাশ্মীরে রবার্ট মাইকেল;—এখানে ইনি;—আর পূর্বদেশে আর-একজন আছেন।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি কিছু দেখতে-টেকতে পাও?
মিশ্র—আজ্ঞা, বাটীতে যখন ছিলাম তখন থেকে জ্যোতিঃদর্শন হত। তারপর যীশুকে দর্শন করেছি। সে-রূপ আর কি বলব!—সে সৌন্দর্যের কাছে কি স্ত্রীর সৌন্দর্য!
কিয়ত্ক্ষণ পরে ভক্তদের সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে মিশ্র জামা পেন্টলুন খুলিয়া ভিতরের গেরুয়ার কৌপীন দেখাইলেন।
ঠাকুর বারান্দা হইতে আসিয়া বলিতেছেন—“বাহ্যে হল না—এঁকে (মিশ্রকে) দেখলাম, বীরের ভঙ্গী করে দাঁড়িয়ে আছে।”
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইতেছেন। পশ্চিমাস্য হইয়া দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ।
কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া মিশ্রকে দেখিতে দেখিতে হাসিতেছেন।
এখনও দাঁড়াইয়া। ভাবাবেশে মিশ্রকে শেক্ হ্যাণ্ড (হস্তধারণ) করিতেছেন ও হাসিতেছেন। হাত ধরিয়া বলিতেছেন, “তুমি যা চাইছ তা হয়ে যাবে।”
ঠাকুরের বুঝি যীশুর ভাব হইল! তিনি আর যীশু কি এক?
মিশ্র (করজোড়ে)—আমি সেদিন থেকে মন, প্রাণ, শরীর,—সব আপনাকে দিয়েছি!
[ঠাকুর ভাবা বেশে হাসিতেছেন।]
ঠাকুর উপবেশন করিলেন। মিশ্র ভক্তদের কাছে তাঁহার পূর্বকথা সব বর্ণনা করিতেছেন। তাঁহার দুই ভাই বরের সভায় সামিয়ানা চাপা পড়িয়া, মানবলীলা সম্বরণ করিলেন,—তাহাও বলিলেন।
ঠাকুর মিশ্রকে যত্ন করিবার কথা ভক্তদের বলিয়া দিলেন।
[নরেন্দ্র, ডাঃ সরকার প্রভৃতি সঙ্গে কীর্তনানন্দে]
ডাক্তার সরকার আসিয়াছেন। ডাক্তারকে দেখিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ। কিঞ্চিৎ ভাব উপশমের পর ঠাকুর ভাবাবেশে বলিতেছেন—“কারণানন্দের পর সচ্চিদানন্দ।—কারণের কারণ!”
ডাক্তার বলিতেছেন, হাঁ!
শ্রীরামকৃষ্ণ—বেহুঁশ হই নাই।
ডাক্তার বুঝিয়াছেন যে, ঠাকুরের ঈশ্বরের আবেশ হইয়াছে। তাই বলিতেছেন—“না, তুমি খুব হুঁশে আছ!”
ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন—
গান—সুরাপান করি না আমি, সুধা খাই জয়কালী বলে,
মন মাতালে মাতাল করে, মদ মাতালে মাতাল বলে ।
গুরুদত্ত গুড় লয়ে, প্রবৃত্তি তায় মশলা দিয়ে (মা)
জ্ঞান শুঁড়িতে চুয়ায় ভাঁটি, পান করে মোর মন মাতালে ।
মূলমন্ত্র যন্ত্র ভরা, শোধন করি বলে তারা,
প্রসাদ বলে এমন সুরা, খেলে চতুর্বর্গ মেলে ।
গান শুনিয়া ডাক্তার ভাবাবিষ্টপ্রায় হইলেন। ঠাকুরেরও আবার ভাবাবেশ হইল। ভাবে ডাক্তারের কোলে চরণ বাড়াইয়া দিলেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ভাব সম্বরণ হইল,—তখন চরণ গুটাইয়া লইয়া ডাক্তারকে বলিতেছেন—“উহ্! তুমি কি কথাই বলেছ! তাঁরই কোলে বসে আছি, তাঁকে ব্যারামের কথা বলব না তো কাকে বলব।—ডাকতে হয় তাঁকেই ডাকব!”
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুরের চক্ষু জলে ভরিয়া গেল।
আবার ভাবাবিষ্ট।—ভাবে ডাক্তারকে বলিতেছেন—“তুমি খুব শুদ্ধ! তা না হলে পা রাখতে পারি না!” আবার বলিতেছেন, “শান্ত ওহি হ্যায় যো রাম-রস চাখে!
“বিষয় কি?—ওতে আছে কি?—টাকা-কড়ি, মান, শরীরের সুখ—ওতে আছে কি? রামকো যো চিনা নাই দিল্ চিনা হ্যায় সো কেয়া রে।”
এত অসুখের উপর ঠাকুরের ভাবাবেশ হইতেছে দেখিয়া ভক্তেরা চিন্তিত হইয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “ওই গানটি হলে আমি থামব;—হরিরস মদিরা।”
নরেন্দ্র কক্ষান্তরে ছিলেন, তাঁকে ডাকানো হইল। তিনি তাঁহার দেবদুর্লভ কণ্ঠে গান শুনাইতেছেন :
হরিরসমদিরা পিয়ে মম মানস মাতো রে ।
(একবার) লুটায়ে অবনীতল হরি হরি বলি কাঁদো রে ।
গভীর নিনাদে হরিনামে গগন ছাও রে
নাচো হরি বলে, দুবাহু তুলে, হরিনাম বিলাও রে ।
হরিপ্রেমানন্দরসে অনুদিন ভাসো রে,
গাও হরিনাম হও পূর্ণকাম, নীচ বাসনা নাশো রে!
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর সেইটি? ‘চিদানন্দসিন্ধুনীরে?’
নরেন্দ্র গাইতেছেন :
(১)—চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী,
মহাভাব রসলীলা কি মাধুরী মরি মরি ।
মহাযোগে সব একাকার হইল, দেশকাল ব্যবধান সব ঘুচিল রে,
এখন আনন্দে মাতিয়া, দু বাহু তুলিয়া বল রে মন হরি হরি ।
(২)—চিন্তয় মম মানস হরি চিদ্ঘন নিরঞ্জন ।
ডাক্তার একাগ্রমনে শুনিতেছেন। গান সমাপ্ত হইলে বলিতেছেন, ‘চিদানন্দসিন্ধুনীরে, ওইটি বেশ!’ ডাক্তারের আনন্দ দেখিয়া ঠাকুর বলিতেছেন—“ছেলে বলেছিল, ‘বাবা, একটু (মদ) চেখে দেখ তারপর আমায় ছাড়তে বল তো ছাড়া যাবে।’ বাবা খেয়ে বললে, ‘তুমি বাছা ছাড় আপত্তি নাই কিন্তু আমি ছাড়ছি না।’ (ডাক্তার ও সকলের হাস্য)
“সেদিন মা দেখালে দুটি লোককে। ইনি তার ভিতর একজন। খুব জ্ঞান হবে দেখলাম,—কিন্তু শুষ্ক। (ডাক্তারকে, সহাস্যে) কিন্তু তুমি রোসবে।”
ডাক্তার চুপ করিয়া আছেন।
৫৩.৪২ দ্বিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ – ৺কালীপূজার দিবসে শ্যামপুকুর বাটীতে ভক্তসঙ্গে
শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরের বাটীর উপরের দক্ষিণের ঘরে দাঁড়াইয়া আছেন। বেলা ৯টা। ঠাকুরের পরিধানে শুদ্ধবস্ত্র এবং কপালে চন্দনের ফোঁটা।
মাস্টার ঠাকুরের আদেশে ৺সিদ্ধেশ্বরী কালীর প্রসাদ আনিয়াছেন; প্রসাদ হস্তে ঠাকুর অতি ভক্তিভাবে দাঁড়াইয়া কিঞ্চিৎ গ্রহণ এবং কিঞ্চিৎ মস্তকে ধারণ করিতেছেন। গ্রহণ করিবার সময় পাদুকা খুলিয়াছেন। মাস্টারকে বলিতেছেন, “বেশ প্রসাদ।”
আজ শুক্রবার (২২শে কার্তিক, ১২৯২); আশ্বিন অমাবস্যা, ৬ই নভেম্বর, ১৮৮৫। আজ ৺কালীপূজা।
ঠাকুর মাস্টারকে আদেশ করিয়াছিলেন ঠনঠনের ৺সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতাকে পুষ্প, ডাব, চিনি, সন্দেশ দিয়ে আজ সকালে পূজা দিবে। মাস্টার স্নান করিয়া নগ্নপদে সকালে পূজা দিয়া আবার নগ্নপদে ঠাকুরের কাছে প্রসাদ আনিয়াছেন।
ঠাকুরের আর একটি আদেশ—‘রামপ্রসাদের ও কমলাকান্তের গানের বই কিনিয়া আনিবে।’ ডাক্তার সরকারকে দিতে হইবে।
মাস্টার বলিতেছেন, “এই বই আনিয়াছি। রামপ্রসাদ আর কমলাকান্তের গানের বই।” শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, “এই গান সব (ডাক্তারের ভিতর) ঢুকিয়ে দেবে।”
গান—মন কি তত্ত্ব কর তাঁরে, যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে ।
সে যে ভাবের বিষয়, ভাব ব্যতীত অভাবে কি ধরতে পারে ॥
গান—কে জানে কালী কেমন। ষড়্দর্শনে না পায় দরশন ।
গান—মন রে কৃষি কাজ জান না ।
এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা ॥
গান—আয় মন বেড়াতে যাবি ।
কালী কল্পতরু মূলে রে মন চারি ফল কুড়ায়ে পাবি ॥
মাস্টার বলিলেন, আজ্ঞা হাঁ। ঠাকুর মাস্টারের সহিত ঘরে পায়চারি করিতেছেন—চটিজুতা পায়ে। অত অসুখ—সহাস্যবদন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আর ও গানটাও বেশ!—‘এ সংসার ধোঁকার টাটি’। আর ‘এ সংসার মজার কুটি! ও ভাই আনন্দ বাজারে লুটি।’
মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ।
ঠাকুর হঠাৎ চমকিত হইতেছেন। অমনি পাদুকা ত্যাগ করিয়া স্থিরভাবে দাঁড়াইলেন। একেবারে সমাধিস্থ। আজ জগন্মাতার পূজা, তাই কি মুহুর্মুহুঃ চমকিত এবং সমাধিস্থ! অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া যেন অতি কষ্টে ভাব সম্বরণ করিলেন।
৫৩.৪৩ ত্রয়শ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ – কালীপূজার দিবসে ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর সেই উপরের ঘরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন; বেলা ১০টা। বিছানার উপর বালিশে ঠেসান দিয়া আছেন, ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া। রাম, রাখাল, নিরঞ্জন, কালীপদ, মাস্টার প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্ত আছেন। ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয় মুখুজ্জের কথা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাম প্রভৃতিকে)—হৃদে এখনও জমি জমি করছে। যখন দক্ষিণেশ্বরে তখন বলেছিল, শাল দাও, না হলে নালিশ করব।
“মা তাকে সরিয়ে দিলেন। লোকজন গেলে কেবল টাকা টাকা করত। সে যদি থাকত এ-সব লোক যেত না। মা সরিয়ে দিলেন।
“গো—অমনি আরম্ভ করেছিল। খুঁতখুঁত করত। গাড়িতে আমার সঙ্গে যাবে তা দেরি করত। অন্য ছোকরারা আমার কাছে এলে বিরক্ত হত। তাদের যদি আমি কলকাতায় দেখতে যেতাম—আমায় বলত, ওরা কি সংসার ছেড়ে আসবে তাই দেখতে যাবেন! জল-খাবার ছোকরাদের দেওয়ার আগে ভয়ে বলতুম, তুই খা আর ওদের দে। জানতে পারলুম ও থাকবে না।
“তখন মাকে বললাম—মা ওকে হৃদের মতো একেবারে সরাস নে। তারপর শুনলাম বৃন্দাবনে যাবে।
“গো—যদি থাকত এই-সব ছোকরাদের হত না। ও বৃন্দাবনে চলে গেল তাই এই-সব ছোকরারা আসতে যেতে লাগল।”
গো (বিনীতভাবে)—আজ্ঞে, আমার তা মনে ছিল না।
রাম (দত্ত)—তোমার মন উনি যা বুঝবেন তা তুমি বুঝবে?
গো—চুপ করিয়া রহিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গো প্রতি) তুই কেন অমন করছিস—আমি তোকে সন্তান অপেক্ষা ভালবাসি!
“তুই চুপ কর না……এখন তোর সে ভাব নাই।”
ভক্তদের সহিত কথাবার্তার পর তাঁহারা কক্ষান্তরে চলিয়া গেলে ঠাকুর গো—কে ডাকাইলেন ও বলিলেন, তুই কি কিছু মনে করেছিস।
গো—আজ্ঞে না।
ঠাকুর মাস্টারকে বলিলেন, আজ কালীপূজা, কিছু পূজার আয়োজন করা ভাল। ওদের একবার বলে এস। পাঁকাটি এনেছে কিনা জিজ্ঞাসা করো দেখি।
মাস্টার বৈঠকখানায় গিয়া ভক্তদের সমস্ত জানাইলেন। কালীপদ ও অন্যান্য ভক্তেরা পূজার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
বেলা আন্দাজ ২টার সময় ডাক্তার ঠাকুরকে দেখিতে আসিলেন। সঙ্গে অধ্যাপক নীলমণি। ঠাকুরের কাছে অনেকগুলি ভক্ত বসিয়া আছেন। গিরিশ, কালীপদ, নিরঞ্জন, রাখাল, খোকা (মণীন্দ্র), লাটু, মাস্টার অনেকে। ঠাকুর সহাস্যবদন, ডাক্তারের সঙ্গে অসুখের কথা ও ঔষধাদির কথা একটু হইলে পর বলিতেছেন, “তোমার জন্য এই বই এসেছে।” ডাক্তারের হাতে মাস্টার সেই দুখানি বই দিলেন।
ডাক্তার গান শুনিতে চাইলেন। ঠাকুরের আদেশক্রমে মাস্টার ও একটি ভক্ত রামপ্রসাদের গান গাইতেছেন :
গান—মন কর কি তত্ত্ব তাঁরে, যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে ।
গান—কে জানে কালী কেমন ষড়দর্শনে না পায় দরশন ।
গান—মন রে কৃষি কাজ জান না ।
গান—আয় মন বেড়াতে যাবি ।
ডাক্তার গিরিশকে বলিতেছেন, “তোমার ওই গানটি বেশ—বীণের গান—বুদ্ধ চরিতের।” ঠাকুরের ইঙ্গিতে গিরিশ ও কালীপদ দুইজনে মিলিয়া গান শুনাইতেছেন :
আমার এই সাধের বীণে, যত্নে গাঁথা তারের হার ।
যে যত্ন জানে বাজায় বীণে উঠে সুধা অনিবার ॥
তানে মানে বাঁধলে ডুরি, শত ধারে বয় মাধুরী ।
বাজে না আলগা তারে, টানে ছিঁড়ে কোমল তার ॥
গান—জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই ।
ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি,
কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই ॥
কে খেলায়, আমি খেলি বা কেন,
জাগিয়ে ঘুমাই কুহকে যেন ।
এ কেমন ঘোর, হবে নাকি ভোর,
অধীর-অধীর যেমতি সমীর, অবিরাম গতি নিয়ত ধাই ॥
জানি না কেবা, এসেছি কোথায়,
কেন বা এসেছি, কোথা নিয়ে যায়,
যাই ভেসে ভেসে কত কত দেশে,
চারিদিকে গোল উঠে নানা রোল ।
কত আসে যায়, হাসে কাঁদে গায়,
এই আছে আর তখনি নাই ॥
কি কাজে এসেছি কি কাজে গেল,
কে জানে কেমন কি খেলা হল ।
প্রবাহের বারি, রহিতে কি পারি,
যাই যাই কোথা কূল কি নাই?
কর হে চেতন, কে আছ চেতন,
কতদিনে আর ভাঙিবে স্বপন?
কে আছ চেতন ঘুমাইও না আর,
দারুণ এ-ঘোর নিবিড় আঁধার ।
কর তমঃ নাশ, হও হে প্রকাশ,
তোমা বিনা আর নাহিক উপায়,
তব পদে তাই শরণ চাই ॥
গান—আমায় ধর নিতাই ।
আমার প্রাণ যেন আজ করে রে কেমন ॥
নিতাই, জীবকে হরি নাম বিলাতে,
উঠল গো ঢেউ প্রেম-নদীতে,
(এখন) সেই তরঙ্গে এখন আমি ভাসিয়ে যাই ।
নিতাই যে দুঃখ আমার অন্তরে, দুঃখের কথা কইব কারে,
জীবের দুঃখে এখন আমি ভাসিয়ে যাই ।
গান—প্রাণভরে আয় হরি বলি, নেচে আয় জগাই মাধাই ।
গান—কিশোরীর প্রেম নিবি আয়, প্রেমের জুয়ার বয়ে যায় ।
বহিছে রে প্রেম শতধারে, যে যত চায় তত পায় ॥
প্রেমের কিশোরী প্রেম বিলায় সাধ করি,
রাধার প্রেমে বল রে হরি ।
প্রেমে প্রাণ মত্ত করে, প্রেম তরঙ্গে প্রাণ নাচায়,
রাধার প্রেমে হরি বলে, আয় আয় আয় আয় ॥
গান শুনিতে শুনিতে দুই-তিনটি ভক্তের ভাব হইয়া গেল,—খোকার (মণীন্দ্রের), লাটুর! লাটু নিরঞ্জনের পার্শ্বে বসিয়াছিলেন। গান হইয়া গেলে ঠাকুরের সহিত ডাক্তার আবার কথা কহিতেছেন। গতকল্য প্রতাপ (মজুমদার) ঠাকুরকে ‘নাক্স্ ভমিকা’ ঔষধ দিয়াছিলেন। ডাক্তার সরকার শুনিয়া বিরক্ত হইয়াছেন।
ডাক্তার—আমি তো মরি নাই, নাক্স্ ভমিকা দেওয়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তোমার অবিদ্যা মরুক!
ডাক্তার—আমার কোনকালে অবিদ্যা নাই।
ডাক্তার অবিদ্যা মানে নষ্টা স্ত্রীলোক বুঝিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—না গো! সন্ন্যাসীর অবিদ্যা মা মরে যায় আর বিবেক সন্তান হয়। অবিদ্যা মা মরে গেলে অশৌচ হয়,—তাই বলে সন্ন্যাসীকে ছুঁতে নাই।
হরিবল্লভ আসিয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “তোমায় দেখলে আনন্দ হয়।” হরিবল্লভ অতি বিনীত। মাদুরের নিচে মাটির উপর বসিয়া ঠাকুরকে পাখা করিতেছেন। হরিবল্লভ কটকের বড় উকিল।
কাছে অধ্যাপক নীলমণি বসিয়া আছেন। ঠাকুর তাঁহার মান রাখিতেছেন ও বলিতেছেন, আজ আমার খুব দিন। কিয়ত্ক্ষণ পরে ডাক্তার ও তাঁহার বন্ধু নীলমণি বিদায় গ্রহণ করিলেন। হরিবল্লভও আসিলেন। আসিবার সময় বলিলেন, আমি আবার আসব।
৫৩.৪৪ চতুঃচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ – জগন্মাতা ৺কালীপূজা
শরত্কাল, অমাবস্যা, রাত্রি ৭টা। সেই উপরের ঘরেই পূজার সমস্ত আয়োজন হইয়াছে। নানাবিধ পুষ্প, চন্দন, বিল্বপত্র, জবা; পায়স ও নানাবিধ মিষ্টান্ন ঠাকুরের সম্মুখে ভক্তেরা আনিয়াছেন। ঠাকুর বসিয়া আছেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে ঘেরিয়া বসিয়া আছেন। শরৎ, শশী, রাম, গিরিশ, চুনিলাল, মাস্টার, রাখাল, নিরঞ্জন, ছোট নরেন, বিহারী প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্ত।
ঠাকুর বলিতেছেন, “ধুনা আন”। কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর জগন্মাতাকে সমস্ত নিবেদন করিলেন। মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। মাস্টারের দিকে তাকাইয়া ঠাকুর বলিতেছেন, “একটু সবাই ধ্যান করো”। ভক্তেরা সকলে একটু ধ্যান করিতেছেন।
দেখিতে দেখিতে গিরিশ ঠাকুরের পাদপদ্মে মালা দিলেন। মাস্টারও গন্ধপুষ্প দিলেন। তারপরেই রাখাল। তারপর রাম প্রভৃতি সকল ভক্তেরা চরণে ফুল দিতে লাগিলেন।
নিরঞ্জন পায়ে ফুল দিয়া ব্রহ্মময়ী ব্রহ্মময়ী বলিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া, পায়ে মাথা দিয়া প্রণাম করিতেছেন। ভক্তেরা সকলে ‘জয় মা! জয় মা!’ধ্বনি করিতেছেন।
দেখিতে দেখিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হইয়াছেন। কি আশ্চর্য! ভক্তেরা অদ্ভুত রূপান্তর দেখিতেছেন। ঠাকুরের জ্যোতির্ময় বদনমণ্ডল! দুই হস্তে বরাভয়! ঠাকুর নিস্পন্দ বাহ্যশূন্য! উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। সাক্ষাৎ জগন্মাতা কি ঠাকুরের ভিতর আবির্ভূতা হইলেন!
সকলে অবাক্ হইয়া এই অদ্ভুত বরাভয়দায়িনী জগন্মাতার মূর্তি দর্শন করিতেছেন।
এইবারে ভক্তেরা স্তব করিতেছেন। আর একজন গান গাহিয়া স্তব করিতেছেন ও সকলে যোগদান করিয়া সমস্বরে গাইতেছেন।
গিরিশ স্তব করিতেছেন :
কে রে নিবিড় নীল কাদম্বিনী সুরসমাজে ।
কে রে রক্তোত্পল চরণ যুগল হর উরসে বিরাজে ॥
কে রে রজনীকর নখরে বাস, দিনকর কত পদে প্রকাশ ।
মৃদু মৃদু হাস ভাস, ঘন ঘন ঘন গরজে ॥
আবার গাইতেছেন :
দীনতারিণী, দূরিতহারিণী, সত্ত্বরজস্তম ত্রিগুণধারিণী,
সৃজন-পালন-নিধনকারিণী, সগুণা নির্গুণা সর্বস্বরূপিণী ।
ত্বংহি কালী তারা পরমাপ্রকৃতি, ত্বংহি মীন কূর্ম বরাহ প্রভৃতি,
ত্বংহি স্থল জল অনিল অনল, ত্বংহি ব্যোম ব্যোমকেশ প্রসবিনী ।
সাংখ্য পাতঞ্জল মীমাংসক ন্যায়, তন্ন তন্ন জ্ঞানে ধ্যানে সদা ধ্যায়,
বৈশেষিক বেদান্ত ভ্রমে হয়ে ভ্রান্ত, তথাপি অদ্যাপি জানিতে পারেনি ॥
নিরুপাধি আদি অন্তরহিত, করিতে সাধক জনার হিত,
গণেশাদি পঞ্চরূপে কালবঞ্চ ভবভয়হরা ত্রিকালবর্তিনী ।
সাকার সাধকে তুমি সে সাকার, নিরাকার উপাসকে নিরাকার,
কেহ কেহ কয় ব্রহ্ম জ্যোতির্ময়, সেও তুমি নগতনয়া জননী ।
যে অবধি যার অভিসন্ধি হয়, সে অবধি সে পরমব্রহ্ম কয়,
তত্পরে তুরীয় অনির্বচনীয়, সকলি মা তারা ত্রিলোকব্যাপিনী ।
বিহারী স্তব করিতেছেন :
মনেরি বাসনা শ্যামা শবাসনা শোন মা বলি,
হৃদয় মাঝে উদয় হইও মা, যখন হবে অন্তর্জলি ।
তখন আমি মনে মনে, তুলব জবা বনে বনে,
মিশাইয়ে ভক্তি চন্দন মা, পদে দিব পুষ্পাঞ্জলি ।
মণি গাহিতেছেন ভক্তসঙ্গে :
সকলি তোমারি ইচ্ছা মা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি,
তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি ।
পঙ্কে বদ্ধ কর করী পঙ্গুরে লঙ্ঘাও গিরি,
কারে দাও মা ইন্দ্রত্বপদ কারে কর অধোগামী ।
আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী,
আমি রথ তুমি রথী যেমন চালাও তেমনি চলি ।
গান—তোমারি করুণায় মা সকলি হইতে পারে ।
অলঙ্ঘ্য পর্বত সম বিঘ্ন বাধা যায় দূরে ॥
তুমি মঙ্গল নিধান, করিছ মঙ্গল বিধান ।
তবে কেন বৃথা মরি ফলাফল চিন্তা করে ॥
গান—গো আনন্দময়ী হয়ে মা আমায় নিরানন্দ করো না ।
গান—নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি ।
ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। আদেশ করিতেছেন, এই গানটি গাইতে—
গান—কখন কি রঙ্গে থাক মা শ্যামা সুধাতরঙ্গিণী ।
গান সমাপ্ত হইলে ঠাকুর আবার আদেশ করিতেছেন—
গান—শিব সঙ্গে সদা রঙ্গে আনন্দে মগনা ।
ঠাকুর ভক্তবৃন্দের আনন্দের জন্য একটু পায়স মুখে দিতেছেন। কিন্তু একেবারে ভাবে বিভোর, বাহ্যশূন্য হইলেন!
কিয়ত্ক্ষণ পরে ভক্তেরা সকলে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া প্রসাদ লইয়া বৈঠকখানা ঘরে গেলেন ও সকলে মিলিয়া আনন্দ করিতে করিতে সেই প্রসাদ পাইলেন। রাত ৯টা। ঠাকুর বলিয়া পাঠাইলেন—রাত হইয়াছে, সুরেন্দ্রের বাড়িতে আজ ৺কালীপূজা হবে, তোমরা সকলে নিমন্ত্রণে যাও।
ভক্তেরা আনন্দ করিতে করিতে সিমলা স্ট্রীটে সুরেন্দ্রের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। সুরেন্দ্র অতি যত্নসহকারে তাঁহাদিগকে উপরের বৈঠকখানা ঘরে লইয়া গিয়া বসাইলেন। বাটীতে উত্সব। সকলেই গীতবাদ্য ইত্যাদি লইয়া আনন্দ করিতেছেন।
সুরেন্দ্রের বাটীতে প্রসাদ পাইয়া বাড়িতে ফিরিতে ভক্তদের প্রায় দুই প্রহরের অধিক রাত্রি হইয়াছিল।
*****