৩৬.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – হাজরা মহাশয়—অহেতুকী ভক্তি
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে, ভক্তসঙ্গে মধ্যাহ্নসেবার পর নিজের ঘরে বসিয়া আছেন (৫ই অক্টোবর, ১৮৮৪)। কাছে মেঝেতে মাস্টার, হাজরা, বড় কালী, বাবুরাম, রামলাল, মুখুজ্জেদের হরি প্রভৃতি—কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া আছেন। শ্রীযুক্ত কেশবের মাতাঠাকুরানীর নিমন্ত্রণে গতকল্য তাঁহাদের কলুটোলার বাড়িতে গিয়া ঠাকুর কীর্তনানন্দ করিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি)—আমি কাল কেশব সেনের এ বাটীতে (নবীন সেনের বাটীতে) বেশ খেলুম—বেশ ভক্তি করে দিলে।
[হাজরা মহাশয় ও তত্ত্বজ্ঞান—হাজরা ও তর্কবুদ্ধি]
হাজরা মহাশয় অনেকদিন ঠাকুরের কাছে রহিয়াছেন। “আমি জ্ঞানী” এই বলিয়া তাঁহার একটু অভিমান আছে। লোকজনের কাছে ঠাকুরের একটু নিন্দা করাও হয়। এদিকে বারান্দাতে নিজের আসনে বসিয়া একমন হইয়া মালা জপও করেন। চৈতন্যদেবকে “হালের অবতার” বলিয়া সামান্য জ্ঞান করেন। বলেন, “ঈশ্বর যে শুদ্ধ ভক্তি দেন, তা নয়; তাঁহার ঐশ্বর্যের অভাব নাই,—তিনি ঐশ্বর্যও দেন। তাঁকে লাভ করলে অষ্টসিদ্ধি প্রভৃতি শক্তিও হয়।”বাড়ির দরুন কিছু দেনা আছে—প্রায় হাজার টাকা। সেগুলির জন্য তিনি ভাবিত আছেন।
বড় কালী অফিসে কর্ম করেন। সামান্য বেতন। ঘরে পরিবার ছেলেপুলে আছে। পরমহংসদেবের উপর খুব ভক্তি; মাঝে মাঝে আফিস কামাই করিয়াও তাঁহাকে দর্শন করিতে আসেন।
বড় কালী (হাজরার প্রতি)—তুমি যে কষ্টিপাথর হয়ে, কে ভাল সোনা, কে মন্দ সোনা, পরখ করে করে বেড়াও—পরের নিন্দা অত করো কেন?
হাজরা—যা বলতে হয়, ওঁর কাছেই বলছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা বটে।
হাজরা তত্ত্বজ্ঞান মানে ব্যাখ্যা করিতেছেন।
হাজরা—তত্ত্বজ্ঞান মানে কি—না চব্বিশ তত্ত্ব আছে, এইটি জানা।
একজন ভক্ত—চব্বিশ তত্ত্ব কি কি?
হাজরা—পঞ্চভূত, ছয় রিপু, পাঁচটা জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটা কর্মেন্দ্রিয়, এই সব।
মাস্টার (ঠাকুরকে, সহাস্যে)—ইনি বলছেন, ছয় রিপু চব্বিশ তত্ত্বের ভিতরে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ওই দেখ না। তত্ত্বজ্ঞানের মানে কি করছে আবার দেখ। তত্ত্বজ্ঞান মানে আত্মজ্ঞান! তৎ মানে পরমাত্মা, ত্বং মানে জীবাত্মা। জীবাত্মা আর পরমাত্মা এক জ্ঞান হলে তত্ত্বজ্ঞান হয়।
হাজরা কিয়ত্ক্ষণ পরে ঘর হইতে বারান্দায় গিয়া বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতিকে)—ও কেবল তর্ক করে। এই একবার বেশ বুঝে গেল—আবার খানিক পরে যেমন তেমনি।
“বড় মাছ জোর করছে দেখে আমি সুতো ছেড়ে দিই। তা না হলে সুতো ছিঁড়ে ফেলবে, আর যে ধরেছে, সে শুদ্ধ জলে পড়বে। আমি তাই আর কিছু বলি না।”
[হাজরা ও মুক্তি ও ষড়ৈশ্বর্য—মলিন ও অহেতুকী ভক্তি]
(মাস্টারকে)—“হাজরা বলে, ‘ব্রাহ্মণ শরীর না হলে মুক্তি হয় না।’ আমি বললাম, সে কি! ভক্তি দ্বারাই মুক্তি হবে। শবরী ব্যাধের মেয়ে, রুহিদাস যার খাবার সময় ঘণ্টা বাজত—এরা সব শূদ্র। এদের ভক্তি দ্বারাই মুক্তি হয়েছে! হাজরা বলে, তবু!
“ধ্রুবকে ল্যায়। প্রহ্লাদকে যত ল্যায়, ধ্রুবকে তত না। নটো বললে ‘ধ্রুবের ছেলেবেলা থেকে অত অনুরাগ’—তখন আবার চুপ করে।
“আমি বলি, কামনাশূন্য ভক্তি, অহেতুকী ভক্তি—এর বাড়া আর কিছুই নাই। ও-কথা সে কাটিয়ে দেয়। যারা কিছু চাইবে, তারা এলে, বড়মানুষ ব্যাজার হয়—বিরক্ত হয়ে বলে, ওই আসছেন। এলে পরে একরকম স্বর করে বলে ‘বসুন’!—যেন কত বিরক্ত। যারা কিছু চায়, তাদের এক গাড়িতে নিয়ে যায় না।
“হাজরা বলে, তিনি এ-সব ধনীদের মতো নয়। তাঁর কি ঐশ্বর্যের অভাব যে দিতে কষ্ট হবে?
“হাজরা আরও বলে—‘আকাশের জল যখন পড়ে তখন গঙ্গা আর সব বড় বড় নদী, বড় বড় পুকুর—এসব বেড়ে যায়; আবার ডোবা টোবাগুলোও পরিপূর্ণ হয়। তাঁর কৃপা হলে জ্ঞান-ভক্তিও দেন,—আবার টাকা-কড়িও দেন।’
“কিন্তু একে মলিন ভক্তি বলে। শুদ্ধাভক্তিতে কোন কামনা থাকবে না। তুমি এখানে কিছু চাও না, কিন্তু (আমাকে) দেখতে আর (আমার) কথা শুনতে ভালবাস;—তোমার দিকেও আমার মন পড়ে থাকে—কেমন আছে—কেন আসে না—এই সব ভাবি।
“কিছু চাও না অথচ ভালবাস—এর নাম অহেতুকী ভক্তি, শুদ্ধাভক্তি। প্রহ্লাদের এটি ছিল; রাজ্য চায় না, ঐশ্বর্য চায় না, কেবল হরিকে চায়।”
মাস্টার—হাজরা মহাশয় কেবল ফড়র ফড়র করে বকে। চুপ না করলে কিছু হচ্ছে না।
[হাজরার অহংকার ও লোকনিন্দা]
শ্রীরামকৃষ্ণ—এক-একবার বেশ কাছে এসে নরম হয়!—কি গ্রহ, আবার তর্ক করে। অহংকার যাওয়া বড় শক্ত। অশ্বত্থগাছ, এই কেটে দিলে আবার তার পর দিন ফেঁকড়ি বেরিয়েছে। যতক্ষণ তার শিকড় আছে ততক্ষণ আবার হবে।
“আমি হাজরাকে বলি, কারুকে নিন্দা করো না।
“নারায়ণই এই সব রূপ ধরে রয়েছেন। দুষ্ট খারাপ লোককেও পূজা করা যায়।
“দেখ না কুমারীপূজা। একটা হাগে মোতে, নাক দিয়ে কফ পড়ছে এমন মেয়েকে পূজা করা কেন? ভগবতীর একটি রূপ বলে।
“ভক্তের ভিতর তিনি বিশেষরূপে আছেন। ভক্ত ঈশ্বরের বৈঠকখানা।
“নাউ-এর খুব ডোল হলে তানপুরা ভাল হয়,—বেশ বাজে।
(সহাস্যে, রামলালের প্রতি)—“হ্যাঁরে রামলাল, হাজরা ওটা কি করে বলেছিল—অন্তস্ বহিস্ যদি হরিস্ (স-কার দিয়ে)? যেমন একজন বলেছিল মাতারং ভাতারং খাতারং অর্থাৎ মা ভাত খাচ্ছে।” (সকলের হাস্য)
রামলাল (সহাস্যে)—অন্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এইটে তুমি অভ্যাস করো, আমায় মাঝে মাঝে বলবে।
ঠাকুরের ঘরের রেকাবি হারাইয়াছে। রামলাল ও বৃন্দে ঝি রেকাবির কথা বলিতেছেন—‘সে রেকাবি কি আপনি জানেন?’
শ্রীরামকৃষ্ণ—কই, এখন আর দেখতে পাই না! আগে ছিল বটে—দেখেছিলাম।
৩৬.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সাধুদ্বয় সঙ্গে—ঠাকুরের পরমহংস অবস্থা
আজ পঞ্চবটীতে দুইটি সাধু অতিথি আসিয়াছেন। তাঁহারা গীতা, বেদান্ত এ সব অধ্যয়ন করেন। মধ্যাহ্নে সেবার পর ঠাকুরকে আসিয়া দর্শন করিতেছেন। তিনি ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। সাধুরা প্রণাম করিয়া মেঝেতে মাদুরের উপর আসিয়া বসিলেন। মাস্টার প্রভৃতিও বসিয়া আছেন। ঠাকুর হিন্দিতে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আপনাদের সেবা হয়েছে?
সাধুরা—জী, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি খেলেন?
সাধুরা—ডাল-রুটি; আপনি খাবেন?
[সাধু ও নিষ্কামকর্ম—ভক্তি কামনা—বেদান্ত—সংসারী ও ‘সোঽহম্’]
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, আমি দুটি ভাত খাই। আচ্ছা জী, আপনারা যা জপ ধ্যান করেন তা নিষ্কাম করেন; না?
সাধু—জী, মহারাজ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওই আচ্ছা হ্যায়, আর ঈশ্বরে ফল সমর্পণ করতে হয়;—না? গীতাতে ওইরূপ আছে।
সাধু (অন্য সাধুর প্রতি)—
যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ ।
যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্ ॥ (BG 9.27)
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁকে একগুণ যা দেবে, সহস্রগুণ তাই পাবে। তাই সব কাজ করে জলের গণ্ডুষ অর্পণ—কৃষ্ণে ফল সমর্পণ।
“যুধিষ্ঠির যখন সব পাপ কৃষ্ণকে অর্পণ করতে যাচ্ছিল, তখন একজন (ভীম) সাবধান করলে, ‘অমন কর্ম করো না—কৃষ্ণকে যা অর্পণ করবে, সহস্রগুণ তাই হবে!’ আচ্ছা জী, নিষ্কাম হতে হয়—সব কামনা ত্যাগ করতে হয়?”
সাধু—জী, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার কিন্তু ভক্তিকামনা আছে। ও মন্দ নয়, বরং ভালই হয়। মিষ্ট খারাপ জিনিস—অম্ল হয়, কিন্তু মিছরিতে বরং উপকার হয়। কেমন?
সাধু—জী, মহারাজ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা জী, বেদান্ত কেমন?
সাধু—বেদান্তমে খট্ শাস্ত্র (ষড়দর্শন) হ্যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু বেদান্তের সার—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। আমি আলাদা কিছু নই; আমি সেই ব্রহ্ম। কেমন?
সাধু—জী, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু যারা সংসারে আছে, আর যাদের দেহবুদ্ধি আছে, তাদের সোঽহম্ এ-ভাবটি ভাল নয়। সংসারীর পক্ষে যোগবাশিষ্ঠ, বেদান্ত—ভাল নয়। বড় খারাপ।
সংসারীরা সেব্য-সেবক ভাবে থাকবে। ‘হে ঈশ্বর, তুমি সেব্য—প্রভু, আমি সেবক—আমি তোমার দাস।’ “যাদের দেহবুদ্ধি আছে তাদের সোঽহম্ এ-ভাব ভাল না।”
সকলেই চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর আপনা-আপনি একটু একটু হাসিতেছেন। আত্মারাম। আপনার আনন্দে আনন্দিত।
একজন সাধু অপরকে ফিসফিস করিয়া বলিতেছেন—“আরে, দেখো দেখো! এস্কো পরমহংস অবস্থা বোল্তা হ্যায়।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে, তাহার দিকে তাকাইয়া)—হাসি পাচ্ছে।
ঠাকুর বালকের ন্যায় আপনা-আপনি ঈষৎ হাসিতেছেন।
৩৬.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ‘কামিনী’—সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম
[পূর্বকথা—শ্বশুরঘর যাবার সাধ—উলোর বামনদাসের সঙ্গে দেখা]
সাধুরা দর্শন করিয়া চলিয়া গেলেন।
ঠাকুর ও বাবুরাম, মাস্টার, মুখুজ্জেদের হরি প্রভৃতি ভক্তেরা ঘরে ও বারান্দায় বেড়াইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে)—নবীন সেনের ওখানে তুমি গিছলে?
মাস্টার—আজ্ঞা, গিছলাম। নিচে বসে সব গান শুনেছিলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা বেশ করেছ। তোমার ওরা গিছল। কেশব সেন ওদের খুড়তাতো ভাই?
মাস্টার—একটু তফাত আছে।
শ্রীযুক্ত নবীন সেনেরা একজন ভক্তের শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কীয় লোক।
মণির সহিত বেড়াইতে বেড়াইতে ঠাকুর নিভৃতে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—লোকে শ্বশুরবাড়ি যায়। এত ভেবেছিলুম, বিয়ে করব, শ্বশুরঘর যাব—সাধ আহ্লাদ করব! কি হয়ে গেল!
মণি—আজ্ঞা, ‘ছেলে যদি বাপকে ধরে, সে পড়তে পারে; বাপ যে ছেলেকে ধরেছেন সে আর পড়ে না।’—এই কথা আপনি বলেন। আপনারও ঠিক সেই অবস্থা। মা আপনাকে ধরে রয়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—উলোর বামনদাসের সঙ্গে—বিশ্বাসদের বাড়িতে—দেখা হল। আমি বললাম, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। যখন চলে এলাম, শুনতে পেলাম, সে বলছে, ‘বাবা, বাঘ যেমন মানুষকে ধরে, তেমনই ঈশ্বরী এঁকে ধরে রয়েছেন!’ তখন সমর্থ বয়স—খুব মোটা। সর্বদাই ভাবে!
“আমি মেয়ে বড় ভয় করি। দেখি যেন বাঘিনী খেতে আসছে! আর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, ছিদ্র সব খুব বড় বড় দেখি। সব রাক্ষসীর মতো দেখি।
“আগে ভারী ভয় ছিল! কারুকে কাছে আসতে দিতাম না। এখন তবু অনেক করে মনকে বুঝিয়ে, মা আনন্দময়ীর এক-একটি রূপ বলে দেখি।
“ভগবতীর অংশ। কিন্তু পুরুষের পক্ষে—সাধুর পক্ষে—ভক্তের পক্ষে—ত্যাজ্য।
“হাজার ভক্ত হলেও মেয়েমানুষকে বেশিক্ষণ কাছে বসতে দিই না। একটু পরে, হয় বলি, ঠাকুর দেখো গে যাও; তাতেও যদি না উঠে, তামাক খাবার নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।
“দেখতে পাই, কারু কারু মেয়েমানুষের দিকে আদপে মন নাই। নিরঞ্জন বলে, ‘কই আমার মেয়েমানুষের দিকে মন নাই’।”
[হরিবাবু, নিরঞ্জন, পাঁড়ে খোট্টা, জয়নারাণ]
“হরি (উপেন ডাক্তারের ভাই)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, সেও বলে, ‘না, মেয়েমানুষের দিকে মন নাই।’
“যে মন ভগবানকে দিতে হবে, সে মনের বারো আনা মেয়েমানুষ নিয়ে ফেলে। তারপর তার ছেলে হলে প্রায় সব মনটাই খরচ হয়ে যায়। তাহলে ভগবানকে আর কি দেবে?
“আবার কারু কারু তাকে আগলাতে আগলাতেই প্রাণ বেরিয়ে যায়। পাঁড়ে জমাদার খোট্টা বুড়ো—তার চৌদ্দ বছরের বউ! বুড়োর সঙ্গে তার থাকতে হয়! গোলপাতার ঘর। গোলপাতা খুলে খুলে লোক দেখে। এখন মেয়েটা বেরিয়ে এসেছে।
“একজনের বউ—কোথায় রাখে এখন ঠিক পাচ্ছে না। বাড়িতে বড় গোল হয়েছিল। মহা ভাবিত। সে কথা আর কাজ নাই।
“আর মেয়েমানুষের সঙ্গে থাকলেই তাদের বশ হয়ে যেতে হয়। সংসারীরা মেয়েদের কথায় উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বসে। সকলেই আপনার পরিবারদের সুখ্যাত করে।
“আমি একজায়গায় যেতে চেয়েছিলাম। রামলালের খুড়ীকে জিজ্ঞাসা করাতে বারণ করলে, আর যাওয়া হল না। খানিক পরে ভাবলুম—উঃ, আমি সংসার করি নাই, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী, তাতেই এই!—সংসারীরা না জানি পরিবারদের কাছে কিরকম বশ!”
মণি—কামিনী-কাঞ্চনের মাঝখানে থাকলেই একটু না একটু গায়ে আঁচ লাগবেই। আপনি বলেছিলেন, জয়নারাণ অতো পণ্ডিত—বুড়ো হয়েছিল—আপনি যখন গেলেন, বালিস-টালিস শুকুতে দিচ্ছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু পণ্ডিত বলে অহংকার ছিল না। আর যা বলেছিল, শেষে আইন মাফিক্ কাশীতে গিয়ে বাস হল।
“ছেলেগুনো দেখলাম, বুট পায়ে দেওয়া ইংরাজী পড়া।”
[ঠাকুরের প্রেমোন্মাদ প্রভৃতি নানা অবস্থা]
ঠাকুর মণিকে প্রশ্নচ্ছলে নিজের অবস্থা বুঝাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আগে খুব উন্মাদ ছিল, এখন কমলো কেন?—কিন্তু মাঝে মাঝে হয়।
মণি—আপনার একরকম অবস্থা তো নয়। যেমন বলেছিলেন, কখনও বালকবৎ—কখনও উন্মাদবৎ—কখনও জড়বৎ—কখনও পিশাচবৎ—এই সব অবস্থা মাঝে মাঝে হয়। আবার মাঝে মাঝে সহজ অবস্থাও হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, বালকবৎ। আবার ওই সঙ্গে বাল্য, পৌগণ্ড, যুবা—এ-সব অবস্থা হয়। যখন জ্ঞান উপদেশ দেবে, তখন যুবার অবস্থা।
“আবার পৌগণ্ড অবস্থা! বারো-তেরো বছরের ছোকরার মতো ফচকিমি করতে ইচ্ছা হয়। তাই ছোকরাদের নিয়ে ফষ্টিনাষ্টি হয়।”
[নারাণের গুণ—কামিনী-কাঞ্চনত্যাগই সন্ন্যাসীর কঠিন সাধনা]
“আচ্ছা, নারাণ কেমন?”
মণি—আজ্ঞা, লক্ষণ সব ভাল আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নাউ-এর ডোলটা ভাল—তানপুরো বেশ বাজবে।
“সে আমায় বলে, আপনি সবই (অর্থাৎ অবতার)। যার যা ধারণা, সে তাই বলে। কেউ বলে, এমনি শুধু সাধুভক্ত।
“যেটি বারণ করে দিয়েছি, সেটি বেশ ধারণা করে। পরদা গুটোতে বললাম। তা গুটোলে না।
“গেরো দেওয়া, সেলাই করা, পরদা গুটোনো, দোর বাস্ক চাবি দিয়ে বন্ধ করা—এসব বারণ করেছিলাম—তাই ঠিক ধারণা। যে ত্যাগ করবে, তার এই সব সাধন করতে হয়। সন্ন্যাসীর পক্ষে এই সব সাধন।
“সাধনের অবস্থায় ‘কামিনী’ দাবানল স্বরূপ—কালসাপের স্বরূপ। সিদ্ধ অবস্থায় ভগবানদর্শনের পর—তবে মা আনন্দময়ী! তবে মার এক-একটি রূপ বলে, দেখবে।”
কয়েকদিন হইল, ঠাকুর নারাণকে কামিনী সম্বন্ধে অনেক সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন—‘মেয়েমানুষের গায়ের হাওয়া লাগাবে না; মোটা কাপড় গায়ে দিয়ে থাকবে, পাছে তাদের হাওয়া গায় লাগে;—আর মা ছাড়া সকলের সঙ্গে আটহাত, নয় দুহাত, নয় অন্ততঃ একহাত সর্বদা তফাত থাকবে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—তার মা নারাণকে বলেছে, তাঁকে দেখে আমরাই মুগ্ধ হই, তুই তো ছেলেমানুষ! আর সরল না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। নিরঞ্জন কেমন সরল!
মণি—আজ্ঞা, হাঁ।
[নিরঞ্জন, নরেন্দ্র কি সরল?]
শ্রীরামকৃষ্ণ—সেদিন কলকাতা যাবার সময় গাড়িতে দেখলে না? সব সময়েই এক ভাব—সরল। লোক ঘরের ভিতর একরকম আবার বাড়ির বাহিরে গেলে আর-একরকম হয়! নরেন্দ্র এখন (বাপের মৃত্যুর পর) সংসারের ভাবনায় পড়েছে। ওর একটু হিসাব বুদ্ধি আছে। সব ছোকরা এদের মতো কি হয়?
[শ্রীরামকৃষ্ণ নবীন নিয়োগীর বাড়ি—নীলকণ্ঠের যাত্রা]
“নীলকণ্ঠের যাত্রা আজ শুনতে গিছলাম—দক্ষিণেশ্বরে। নবীন নিয়োগীর বাড়ি। সেখানকার ছোঁড়াগুনো বড় খারাপ। কেবল এর নিন্দা, ওর নিন্দা! ওরকম স্থলে ভাব সম্বরণ হয়ে যায়।
“সেবার যাত্রার সময় মধু ডাক্তারের চক্ষে ধারা দেখে, তার দিকে চেয়েছিলাম। আর কারু দিকে তাকাতে পারলাম না।”
৩৬.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ, কেশব ও ব্রাহ্মসমাজ—সমন্বয় উপদেশ
The Universal Catholic church of Sree Ramkrishna
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—আচ্ছা, লোক যে এত আকর্ষণ হয়ে আসে এখানে, তার মানে কি?
মণি—আমার ব্রজের লীলা মনে পড়ে। কৃষ্ণ যখন রাখাল আর বত্স হলেন, তখন রাখালদের উপর গোপীদের, আর বত্সদের উপর গাভীদের, বেশি আকর্ষণ হতে লাগল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে ঈশ্বরের আকর্ষণ। কি জানো, মা এইরূপ ভেলকি লাগিয়ে দেন আর আকর্ষণ হয়।
“আচ্ছা, কেশব সেনের কাছে যত লোক যেত, এখানে তো তত আসে না। আর কেশব সেনকে কত লোক গণে মানে, বিলাতে পর্যন্ত জানে—কুইন (রানী ভিক্টোরিয়া) কেশবের সঙ্গে কথা কয়েছে! গীতায় তো বলেছে, যাকে অনেকে গণে মানে, সেখানে ঈশ্বরের শক্তি। এখানে তো অত হয় না?”
মণি—কেশব সেনের কাছে সংসারী লোক গিয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, তা বটে। ঐহিক লোক।
মণি—কেশব সেন যা করে গেলেন, তা কি থাকবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন, সংহিতা করে গেছে,—তাতে কত নিয়ম!
মণি—অবতার যখন নিজে কাজ করেন, তখন আলাদা কথা। যেমন চৈতন্যদেবের কাজ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, হাঁ, ঠিক।
মণি—আপনি তো বলেন,—চৈতন্যদেব বলেছিলেন, আমি যা বীজ ছড়িয়ে দিয়ে গেলাম, কখন না কখন এর কাজ হবে। কার্ণিশের উপর বীজ রেখেছিল, বাড়ি পড়ে গেলে সেই বীজ আবার গাছ হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, শিবনাথরা যে সমাজ করেছে, তাতেও অনেক লোক যায়।
মণি—আজ্ঞা, তেমনি লোক যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ, হাঁ, সংসারী লোক সব যায়। যারা ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল—কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে চেষ্টা করছে—এমন সব লোক কম যায় বটে।
মণি—এখান থেকে একটা স্রোত যদি বয়, তাহলে বেশ হয়। সে স্রোতের টানেতে সব ভেসে যাবে। এখান থেকে যা হবে সে তো আর একঘেয়ে হবে না।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান—বৈষ্ণব ও ব্রহ্মজ্ঞানী]
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আমি যার যা ভাব তার সেই ভাব রক্ষা করি। বৈষ্ণবকে বৈষ্ণবের ভাবটিই রাখতে বলি, শাক্তকে শাক্তের ভাব। তবে বলি, ‘এ কথা বলো না—আমারই পথ সত্য আর সব মিথ্যা, ভুল।’ হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান—নানা পথ দিয়ে এক জায়গায়ই যাচ্ছে। নিজের নিজের ভাব রক্ষা করে, আন্তরিক তাঁকে ডাকলে, ভগবান লাভ হবে!
“বিজয়ের শাশুড়ি বলে, তুমি বলরামদের বলে দাও না, সাকার পুজোর কি দরকার? নিরাকার সচ্চিদানন্দকে ডাকলেই হল।
“আমি বললাম, ‘অমন কথা আমিই বা বলতে যাব কেন—আর তারাই বা শুনবে কেন?’ মা মাছ রেঁধেছে—কোনও ছেলেকে পোলোয়া রেঁধে দেয়, যার পেট ভাল নয় তাকে মাছের ঝোল করে দেয়। রুচিভেদে, অধিকারীভেদে, একই জিনিস নানারূপ করে দিতে হয়।”
মণি—আজ্ঞা, হাঁ। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সব আলাদা রাস্তা। তবে যে রাস্তা দিয়েই যাওয়া হোক না কেন, শুদ্ধমন হয়ে আন্তরিক ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তবে তাঁকে পাওয়া যায়। এই কথা আপনি বলেন।
[মুখুজ্জেদের হরি—শ্রীরামকৃষ্ণ ও দান-ধ্যান]
ঘরের ভিতর ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া আছেন। মেঝেতে মুখুজ্জেদের হরি, মাস্টার প্রভৃতি বসিয়া আছেন। একটি অপরিচিত ব্যক্তি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বসিলেন। ঠাকুর পরে বলিয়াছিলেন, তাঁহার চক্ষুর লক্ষণ ভাল না—বিড়ালের ন্যায় কটাচক্ষু।
ঠাকুরকে হরি তামাক সাজিয়া আনিয়া দিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হুঁকা হাতে করিয়া, হরির প্রতি)—দেখি তোর—হাত দেখি। এই যে যব রয়েছে—এ বেশ ভাল লক্ষণ।
“হাত আলগা কর দেখি। (নিজের হাতে হরির হাত লইয়া যেন ওজন করিতেছেন)—ছেলেমানষি বুদ্ধি এখনও আছে;—দোষ এখনও কিছু হয় নাই। (ভক্তদের প্রতি)—আমি হাত দেখলে খল কি সরল বলতে পারি। (হরির প্রতি)—কেন, শ্বশুরবাড়ি যাবি—বউর সঙ্গে কথাবার্তা কইবি—আর ইচ্ছে হয় একটু আমোদ-আহ্লাদ করবি।
(মাস্টারের প্রতি)—“কেমন গো?” (মাস্টার প্রভৃতির হাস্য)
মাস্টার—আজ্ঞা, নতুন হাঁড়ি যদি খারাপ হয়ে যায়, তাহলে আর দুধ রাখা যাবে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—এখন যে হয় নাই তা কি করে জানলে?
মুখুজ্জেরা দুই ভাই—মহেন্দ্র ও প্রিয়নাথ। তাঁহারা চাকরি করেন না। তাঁহাদের ময়দার কল আছে। প্রিয়নাথ পূর্বে ইঞ্জিনিয়ারের কর্ম করিতেন। ঠাকুর হরির নিকট মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়ের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হরির প্রতি)—বড় ভাইটি বেশ, না? বেশ সরল।
হরি—আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—ছোট নাকি বড় সন (কৃপণ)?—এখানে এসে নাকি অনেক ভাল হয়েছে। আমায় বললে আমি কিছু জানতুম না। (হরিকে) এরা কিছু দান-টান করে কি?
হরি—তেমন দেখতে পাই না। এদের বড়ভাই যিনি ছিলেন—তাঁর কাল হয়েছে—তিনি বড় ভাল ছিলেন—খুব দান-ধ্যান ছিল।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও দেহের লক্ষণ—৺মহেশ ন্যায়রত্নের ছাত্র]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতিকে)—শরীরের লক্ষণ দেখে অনেকটা বুঝা যায়, তার হবে কি না। খল হলে হাত ভারী হয়।
“নাক টেপা হওয়া ভাল না। শম্ভুর নাকটি টেপা ছিল। তাই অত জ্ঞান থেকেও তত সরল ছিল না।
“উনপাঁজুরে লক্ষণ ভাল না। আর হাড় পেকে—কনুয়ের গাঁট মোটা, হাত ছিনে। আর বিড়াল চক্ষু—বিড়ালের মত কটাচোখ।
“ঠোঁট—ডোমের মতো হলে—নীচবুদ্ধি হয়। বিষ্ণুঘরের পুরুত কয়মাস একটিং কর্মে এসেছিল। তার হাতে খেতুম না—হঠাৎ মুখ দিয়ে বলে ফেলেছিলুম, ‘ও ডোম’। তারপর সে একদিন বললে ‘হাঁ, আমাদের ঘর ডোম পাড়ায়। আমি ডোমের বাসন চাঙ্গারী বুনতে জানি’।
“আরও খারাপ লক্ষণ—এক চক্ষু আর ট্যারা। বরং এক চক্ষু কানা ভাল, তো ট্যারা ভাল নয়।ভারী দুষ্ট ও খল হয়।
“মহেশের (৺মহেশ ন্যায়রত্নের) একজন ছাত্র এসেছিল। সে বলে, ‘আমি নাস্তিক’। সে হৃদেকে বললে, ‘আমি নাস্তিক, তুমি আস্তিক হয়ে আমার সঙ্গে বিচার কর’। তখন তাকে ভাল করে দেখলাম। দেখি, বিড়াল চক্ষু!
“আবার চলনেতে লক্ষণ ভাল মন্দ টের পাওয়া যায়।
“পুরুষাঙ্গের উপর চামড়াটি মুসলমানদের মতো যদি কাটা হয়, সে একটি খারাপ লক্ষণ। (মাস্টার প্রভৃতির হাস্য) (মাস্টারকে সহাস্যে) তুমি ওটা দেখো—ও খারাপ লক্ষণ।” (সকলের হাস্য)
ঘর হইতে ঠাকুর বারান্দায় বেড়াইতেছেন। সঙ্গে মাস্টার ও বাবুরাম। শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি)—একজন এসেছিল,—দেখলাম বিড়ালের মতো চক্ষু। সে বলে, ‘আপনি জ্যোতিষ জানেন?—আমার কিছু কষ্ট আছে।’ আমি বললাম, ‘না, বরাহনগরে যাও, সেখানে জ্যোতিষের পণ্ডিত আছে।’
বাবুরাম ও মাস্টার নীলকণ্ঠের যাত্রার কথা কহিতেছেন। বাবুরাম নবীন সেনের বাটী হইতে দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া আসিয়া কাল রাত্রে এখানে ছিলেন। সকালে ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে নবীন নিয়োগীর বাড়িতে নীলকণ্ঠের যাত্রা শুনিয়াছিলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ, মণি ও নিভৃত চিন্তা—“ঈশ্বরের ইচ্ছা”—নারাণের জন্য ভাবনা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও বাবুরামের প্রতি)—তোমাদের কি কথা হচ্ছে?
মাস্টার ও বাবুরাম—আজ্ঞা, নীলকণ্ঠের যাত্রার কথা হচ্ছে,—আর সেই গানটির কথা—‘শ্যামাপদে আশ, নদীর তীরে বাস।’
ঠাকুর বারান্দায় বেড়াইতে বেড়াইতে হঠাৎ মণিকে নিভৃতে লইয়া বলিতেছেন—ঈশ্বরচিন্তা যত লোকে টের না পায় ততই ভাল। হঠাৎ এই কথা বলিয়াই ঠাকুর চলিয়া গেলেন।
ঠাকুর হাজরার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
হাজরা—নীলকণ্ঠ তো আপনাকে বলেছে, সে আসবে। তা ডাকতে গেলে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, রাত্রি জেগেছে,—ঈশ্বরের ইচ্ছায় আপনি আসে, সে এক। বাবুরামকে নারাণের বাড়ি গিয়া দেখা করিতে বলিতেছেন। নারাণকে সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখেন। তাই তাকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন। বাবুরামকে বলিতেছেন—“তুই বরং একখান ইংরাজী বই নিয়ে তার কাছে যাস।”
৩৬.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – নীলকণ্ঠ প্রভৃতি ভক্তগণসঙ্গে সংকীর্তনানন্দে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে নিজের আসনে বসিয়া আছেন। বেলা প্রায় তিনটা হইবে। নীলকণ্ঠ পাঁচ-সাতজন সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া ঠাকুরের ঘরে আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর পূর্বাস্য হইয়া তাহাকে যেন অভ্যর্থনা করিতে অগ্রসর হইলেন। নীলকণ্ঠ ঘরের পূর্ব দ্বার দিয়া আসিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন।
ঠাকুর সমাধিস্থ!—তাঁহার পশ্চাতে বাবুরাম, সম্মুখে মাস্টার, নীলকণ্ঠ ও চমত্কৃত অন্যান্য যাত্রাওয়ালারা। খাটের উত্তর ধারে দীননাথ খাজাঞ্চী আসিয়া দর্শন করিতেছেন। দেখিতে দেখিতে ঘর ঠাকুরবাড়ির লোকে পরিপূর্ণ হইল। কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুরের কিঞ্চিৎ ভাব উপশম হইতেছে। ঠাকুর মেঝেতে মাদুরে বসিয়াছেন—সম্মুখে নীলকণ্ঠ ও চতুর্দিকে ভক্তগণ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (আবিষ্ট হইয়া)—আমি ভাল আছি।
নীলকণ্ঠ (কৃতাঞ্জলি হইয়া)—আমায়ও ভাল করুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তুমি তো ভাল আছ। ‘ক’য়ে আকার ‘কা’, আবার আকার দিয়ে কি হবে? ‘কা’-এর উপর আবার আকার দিলে সেই ‘কা’-ই থাকে। (সকলের হাস্য)
নীলকণ্ঠ—আজ্ঞা, এই সংসারে পড়ে রয়েছি!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তোমায় সংসারে রেখেছেন পাঁচজনের জন্য।
“অষ্টপাশ। তা সব যায় না। দু-একটা পাশ তিনি রেখে দেন—লোকশিক্ষার জন্য! তুমি যাত্রাটি করেছো, তোমার ভক্তি দেখে কত লোকের উপকার হচ্ছে। আর তুমি সব ছেড়ে দিলে এঁরা (যাত্রাওয়ালারা) কোথায় যাবেন।
“তিনি তোমার দ্বারা কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। কাজ শেষ হলে তুমি আর ফিরবে না। গৃহিণী সমস্ত সংসারের কাজ সেরে,—সকলকে খাইয়ে-দাইয়ে, দাস-দাসীদের পর্যন্ত খাইয়ে-দাইয়ে—নাইতে যায়;—তখন আর ডাকাডাকি করলেও ফিরে আসে না।”
নীলকণ্ঠ—আমায় আশীর্বাদ করুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কৃষ্ণের বিরহে যশোদা উন্মাদিনী,—শ্রীমতীর কাছে গিয়েছেন। শ্রীমতী তখন ধ্যান কচ্ছিলেন। তিনি আবিষ্ট হয়ে যশোদাকে বললেন—“আমি সেই মূল প্রকৃতি আদ্যাশক্তি! তুমি আমার কাছে বর নাও!” যশোদা বললেন, ‘আর কি বর দেবে! এই বলো যেন কায়মনোবাক্যে তাঁর চিন্তা, তাঁর সেবা করতে পারি। কর্ণেতে যেন তাঁর নামগুণগান শুনতে পাই, হাতে যেন তাঁর ও তাঁর ভক্তের সেবা করতে পারি,—চক্ষে যেন তাঁর রূপ, তাঁর ভক্ত, দর্শন করতে পারি।
“তোমার যেকালে তাঁর নাম করতে চক্ষু জলে ভেসে যায়, সেকালে আর তোমার ভাবনা কি?—তাঁর উপর তোমার ভালবাসা এসেছে।
“অনেক জানার নাম অজ্ঞান,—এক জানার নাম জ্ঞান—অর্থাৎ এক ঈশ্বর সত্য সর্বভূতে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপের নাম বিজ্ঞান—তাঁকে লাভ করে নানাভাবে ভালবাসার নাম বিজ্ঞান।
“আবার আছে—তিনি এক-দুয়ের পার—বাক্য মনের অতীত। লীলা থেকে নিত্য, আবার নিত্য থেকে লীলায় আসা,—এর নাম পাকা ভক্তি।
“তোমার ও গানটি বেশ—‘শ্যামাপদে আশ, নদীর তীরে বাস।’
“তাহলেই হল,—তাঁর কৃপার উপর সব নির্ভর করছে।
“কিন্তু তা বলে তাঁকে ডাকতে হবে—চুপ করে থাকলে হবে না। উকিল হাকিমকে সব বলে শেষে বলে—‘আমি যা বলবার বললাম এখন হাকিমের হাত’।”
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর বলিতেছেন—তুমি সকালে অত গাইলে, আবার এখানে এসেছ কষ্ট করে। এখানে কিন্তু অনারারী (Honorary)।
নীলকণ্ঠ—কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—বুঝেছি, আপনি যা বলবেন।
নীলকণ্ঠ—অমূল্য রতন নিয়ে যাব!!!
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে অমূল্য রতন আপনার কাছে। আবার ‘ক’য়ে আকার দিলে কি হবে? না হলে তোমার গান অত ভাল লাগে কেন? রামপ্রসাদ সিদ্ধ, তাই তার গান ভাল লাগে।
“সাধারণ জীবকে বলে মানুষ। যার চৈতন্য হয়েছে, সেই মানহুঁস। তুমি তাই মানহুঁস।
“তোমার গান হবে শুনে আমি আপনি যাচ্ছিলাম—তা নিয়োগীও বলতে এসেছিল।”
ঠাকুর ছোট তক্তপোশের উপর নিজের আসনে গিয়া বসিয়াছেন। নীলকণ্ঠকে বলিতেছেন, একটু মায়ের নাম শুনব।
নীলকণ্ঠ সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া গান গাইতেছেন :
গান—শ্যামাপদে আশ, নদীর তীরে বাস।
গান—মহিষমর্দিনী।
এই গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ!
নীলকণ্ঠ গানে বলিতেছেন, ‘যার জটায় গঙ্গা, তিনি রাজরাজেশ্বরীকে হৃদয়ে ধারণ করিয়া আছেন।’
ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছেন। নীলকণ্ঠ ও ভক্তগণ তাঁহাকে বেড়িয়া বেড়িয়া গান গাহিতেছেন ও নৃত্য করিতেছেন।
গান—শিব শিব।
এই গানের সঙ্গেও ঠাকুর ভক্তসঙ্গে নৃত্য করিতে লাগিলেন।
গান সমাপ্ত হইল। ঠাকুর নীলকণ্ঠকে বলিতেছেন,—আমি আপনার সেই-গানটি শুনব, কলকাতায় যা শুনেছিলাম।
মাস্টার—শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর নব নটবর, তপত কাঞ্চন কায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, হাঁ।
নীলকণ্ঠ গাইতেছেন :
শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর, নব নটবর, তপত কাঞ্চন কায়।
‘প্রেমের বন্যে ভেসে যায়’—এই ধুয়া ধরিয়া ঠাকুর নীলকণ্ঠাদি ভক্তসঙ্গে আবার নাচিতেছেন। সে অপূর্ব নৃত্য যাঁহারা দেখিয়াছিলেন তাঁহারা কখনই ভুলিবেন না। ঘর লোকে পরিপূর্ণ সকলেই উন্মত্তপ্রায়। ঘরটি যেন শ্রীবাসের আঙ্গিনা হইয়াছে।
শ্রীযুক্ত মনোমোহন ভাবাবিষ্ট হইলেন। তাঁহার বাটীর কয়েকটি মেয়ে আসিয়াছেন; তাঁহারা উত্তরের বারান্দা হইতে এই অপূর্ব নৃত্য ও সংকীর্তন দর্শন করিতেছেন। তাঁহাদের মধ্যেও একজনের ভাব হইয়াছিল। মনোমোহন ঠাকুরের ভক্ত ও শ্রীযুক্ত রাখালের সম্বন্ধী।
ঠাকুর আবার গান ধরিলেন :
যাদের হরি বলতে নয়ন ঝুরে, তারা তারা দুভাই এসেছে রে!
সংকীর্তন করিতে করিতে ঠাকুর নীলকণ্ঠাদি ভক্তসঙ্গে নৃত্য করিতেছেন। ও আখর দিতেছেন—
‘রাধার প্রেমে মাতোয়ারা, তারা তারা দুভাই এসেছে রে।’
উচ্চ সংকীর্তন শুনিয়া চতুর্দিকের লোক আসিয়া জমিয়াছে। দক্ষিণের, উত্তরের ও পশ্চিমের গোল বারান্দায়, সব লোক দাঁড়াইয়া। যাঁহারা নৌকা করিয়া যাইতেছেন, তাঁহারাও এই মধুর সংকীর্তনের শব্দ শুনিয়া আকৃষ্ট হইয়াছেন।
কীর্তন সমাপ্ত হইল। ঠাকুর জগন্মাতাকে প্রণাম করিতেছেন ও বলিতেছেন—ভাগবত-ভক্ত-ভগবান—জ্ঞানীদের নমস্কার, যোগীদের নমস্কার, ভক্তদের নমস্কার।
এইবার ঠাকুর নীলকণ্ঠাদি ভক্তসঙ্গে পশ্চিমের গোল বারান্দায় আসিয়া বসিয়াছেন। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। আজ কোজাগর পূর্ণিমার পরদিন। চতুর্দিকে চাঁদের আলো। ঠাকুর নীলকণ্ঠের সহিত আনন্দে কথা কহিতেছেন।
[ঠাকুর কে? ‘আমি’ খুঁজে পাই নাই—“ঘরে আনবো চণ্ডী”]
নীলকণ্ঠ—আপনিই সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও গুনো কি!—আমি সকলের দাসের দাস।
“গঙ্গারই ঢেউ। ঢেউ-এর কখন গঙ্গা হয়?”
নীলকণ্ঠ—আপনি যা বলুন, আমরা আপনাকে তাই দেখছি!
শ্রীরামকৃষ্ণ (কিঞ্চিৎ ভাবাবিষ্ট হইয়া, করুণস্বরে)—বাপু, আমার ‘আমি’ খুঁজতে যাই, কিন্তু খুঁজে পাই না।
“হনুমান বলেছিলেন—হে রাম, কখন ভাবি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ—তুমি প্রভু আমি দাস,—আবার যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়—তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি!”
নীলকণ্ঠ—আর কি বলব, আমাদের কৃপা করবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তুমি কত লোককে পার করছ—তোমার গান শুনে কত লোকের উদ্দীপন হচ্ছে।
নীলকণ্ঠ—পার করছি বলছেন। কিন্তু আশীর্বাদ করুন, যেন নিজে ডুবি না!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—যদি ডোবো তো ওই সুধাহ্রদে!
ঠাকুর নীলকণ্ঠকে পাইয়া আনন্দিত হইয়াছেন। তাঁহাকে আবার বলিতেছেন “তোমার এখানে আসা!—যাকে অনেক সাধ্য-সাধনা করে তবে পাওয়া যায়! তবে একটা গান শোন :
গিরি! গণেশ আমার শুভকারী ।—
পূজে গণপতি, পেলাম হৈমবতী
যাও হে গিরিরাজ, আন গিয়ে গৌরী ॥
বিল্ববৃক্ষমূলে পাতিয়ে বোধন,
গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন ।
ঘরে আনবো চণ্ডী, শুনবো কত চণ্ডী,
কত আসবেন দণ্ডী, যোগী জটাধারী ॥
“চণ্ডী যেকালে এসেছেন—সেকালে কত যোগী জটাধারীও আসবে।”
ঠাকুর হাসিতেছেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে মাস্টার, বাবুরাম প্রভৃতি ভক্তদের বলিতেছেন—“আমার বড় হাসি পাচ্ছে। ভাবছি—এঁদের (যাত্রাওয়ালাদের) আবার আমি গান শোনাচ্ছি।”
নীলকণ্ঠ—আমরা যে গান গেয়ে বেড়াই, তার পুরস্কার আজ হল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কোন জিনিস বেচলে এক খাঁমচা ফাউ দেয়—তোমরা ওখানে গাইলে, এখানে ফাউ দিলে। (সকলের হাস্য)
৩৬.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে বেদান্তবাগীশ—ঈশান প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
আজ শনিবার, ১১ই অক্টোবর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ (২৬শে আশ্বিন, কৃষ্ণা সপ্তমী)। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে ছোট তক্তপোশে শুইয়া আছেন। বেলা আন্দাজ ২টা বাজিয়াছে। মেঝের উপর মাস্টার ও প্রিয় মুখুজ্জে বসিয়া আছেন।
মাস্টার স্কুল হইতে ১টার সময় ছাড়িয়া দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে প্রায় ২টার সময় পৌঁছিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যদু মল্লিকের বাড়ি গিয়াছিলাম। একেবারে জিজ্ঞাসা করে গাড়িভাড়া কত! যখন এরা বললে তিন টাকা দুইআনা, তখন একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করে আবার শুক্কুল ঠাকুর আড়ালে গাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করছে। সে বললে তিন টাকা চারিআনা (সকলের হাস্য) তখন আবার আমাদের কাছে দৌড়ে আসে; বলে, ভাড়া কত?
“কাছে দালাল এসেছে। সে যদুকে বললে, বড়বাজারে ৪ কাঠা জায়গা বিক্রী আছে নেবেন? যদু বলে, কত দাম? দামটা কিছু কমায় না? আমি বললুম, ‘তুমি নেবে না কেবল ঢঙ করছ। না?’ তখন আবার আমার দিকে ফিরে হাসে। বিষয়ী লোকদের দস্তুরই; ৫টা লোক আনাগোনা করবে বাজারে খুব নাম হবে।
“অধরের বাড়ি গিছল তা আমি আবার বললাম, তুমি অধরের বাড়ি গিছিলে, তা অধর বড় সন্তুষ্ট হয়েছে। তখন বলে, ‘এ্যাঁ, এ্যাঁ, সন্তুষ্ট হয়েছে?’
“যদুর বাড়িতে—মল্লিক এসেছিল! বড় চতুর আর শঠ, চক্ষু দেখে বুঝতে পাল্লাম। চক্ষুর দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘চতুর হওয়া ভাল নয়, কাক বড় সেয়ানা, চতুর, কিন্তু পরের গু খেয়ে মরে!’ আর দেখলাম লক্ষ্মীছাড়া। যদুর মা অবাক্ হয়ে বললে, বাবা, তুমি কেমন করে জানলে ওর কিছু নাই। চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম।”
নারাণ আসিয়াছেন, তিনিও মেঝেয় বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রিয়নাথের প্রতি)—হ্যাঁগা, তোমাদের হরিটি বেশ।
প্রিয়নাথ—আজ্ঞা, এমন বিশেষ ভাল কি? তবে ছেলেমানুষ—
নারাণ—পরিবারকে মা বলেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে কি! আমিই বলতে পারি না, আর সে মা বলেছে! (প্রিয়নাথের প্রতি)—কি জানো, ছেলেটি বেশ শান্ত, ঈশ্বরের দিকে মন আছে।
ঠাকুর অন্য কথা পাড়িলেন।
“হেম কি বলেছিল জানো? বাবুরামকে বললে, ঈশ্বরই এক সত্য আর সব মিথ্যা। (সকলের হাস্য) না গো, আন্তরিক বলেছে। আবার আমাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কীর্তন শুনাবে বলেছিল। তা হয় নাই। তারপর নাকি বলেছিল, ‘আমি খোল-করতাল নিলে লোকে কি বলবে’। ভয় পেয়ে গেল, পাছে লোকে বলে পাগল হয়েছে।”
[ঘোষপাড়ার স্ত্রীলোকের হরিপদকে গোপালভাব—কৌমারবৈরাগ্য ও স্ত্রীলোক]
“হরিপদ ঘোষপাড়ার এক মাগীর পাল্লায় পড়েছে। ছাড়ে না। বলে কোলে করে খাওয়ায়। বলে নাকি গোপালভাব! আমি অনেক সাবধান করে দিইছি। বলে বাত্সল্যভাব। ওই বাত্সল্য থেকে আবার তাচ্ছল্য হয়।
“কি জানো? মেয়ে-মানুষ থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়, তবে যদি ভগবান-লাভ হয়। যাদের মতলব খারাপ, সে-সব মেয়ে-মানুষের কাছে আনাগোনা করা, কি তাদের হাতে কিছু খাওয়া বড় খারাপ। এরা সত্তা হরণ করে।
“অনেক সাবধানে থাকলে তবে ভক্তি বজায় থাকে। ভবনাথ, রাখাল এরা সব একদিন আপনারা রান্না কল্লে। ওরা খেতে বসেছে, এমন সময় একজন বাউল এসে ওদের পঙ্ক্তিতে বসে বলে, খাব। আমি বললাম, আঁটবে না; আচ্ছা যদি থাকে, তোমার জন্য রাখবে। তা সে রেগে উঠে গেল। বিজয়ার দিনে যে সে মুখে খাইয়ে দেয়, সে ভাল নয়। শুদ্ধসত্ত্ব ভক্ত—এদের হাতে খাওয়া যায়।
“মেয়ে-মানুষের কাছে খুব সাবধান হতে হয়। গোপালভাব! এ-সব কথা শুনো না। মেয়ে ত্রিভুবন দিলে খেয়ে। অনেক মেয়ে-মানুষ জোয়ান ছোকরা, দেখতে ভালো, দেখে নূতন মায়া ফাঁদে। তাই গোপালভাব!
“যাদের কৌমারবৈরাগ্য; যারা ছেলেবেলা থেকে ভগবানের জন্য ব্যাকুল হয়ে বেড়ায়, সংসারে ঢোকে না, তারা একটি থাক আলাদা। তারা নৈকষ্য কুলীন। ঠিক ঠিক বৈরাগ্য হলে তারা মেয়ে-মানুষ থেকে ৫০ হাত তফাতে থাকে, পাছে তাদের ভাব ভঙ্গ হয়। তারা যদি মেয়ে-মানুষের পাল্লায় পড়ে, তাহলে আর নৈকষ্য কুলীন থাকে না, ভঙ্গ ভাব হয়ে যায়; তাদের ঘর নিচু হয়ে যায়। যাদের ঠিক কৌমারবৈরাগ্য তাদের উঁচু ঘর; অতি শুদ্ধভাব। গায়ে দাগটি পর্যন্ত লাগে না।”
[জিতেন্দ্রিয় হবার উপায়—প্রকৃতিভাব সাধন]
“জিতেন্দ্রিয় হওয়া যায় কিরকম করে? আপনাতে মেয়ের ভাব আরোপ করতে হয়। আমি অনেকদিন সখীভাবে ছিলাম। মেয়েমানুষের কাপড়, গয়না পরতুম, ওড়না গায়ে দিতুম। ওড়না গায়ে দিয়ে আরতি করতুম! তা না হলে পরিবারকে আট মাস কাছে এনে রেখেছিলাম কেমন করে? দুজনেই মার সখী!
“আমি আপনাকে পু (পুরুষ) বলতে পারি না। একদিন ভাবে রয়েছি (পরিবার) জিজ্ঞাসা কললে—আমি তোমার কে? আমি বললুম, ‘আনন্দময়ী’।
“এক মতে আছে, যার মাইয়ে বোঁটা আছে সেই মেয়ে। অর্জুন আর কৃষ্ণের মাইয়ে বোঁটা ছিল না। শিবপূজার ভাব কি জান? শিবলিঙ্গের পূজা, মাতৃস্থানের ও পিতৃস্থানের পূজা। ভক্ত এই বলে পূজা করে, ঠাকুর দেখো যেন আর জন্ম না হয়। শোণিত-শুক্রের মধ্য দিয়া মাতৃস্থান দিয়া আর যেন আসতে না হয়।”
৩৬.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – স্ত্রীলোক লইয়া সাধন—শ্রীরামকৃষ্ণের পুনঃ পুনঃ নিষেধ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতিভাবের কথা বলিতেছিলেন। শ্রীযুক্ত প্রিয় মুখুজ্জে, মাস্টার, আরও কয়েকটি ভক্ত বসিয়া আছেন। এমন সময় ঠাকুরদের বাড়ির একটি শিক্ষক ঠাকুরদের কয়েকটি ছেলে সঙ্গে করিয়া উপস্থিত হইলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—শ্রীকৃষ্ণের শিরে ময়ূর পাখা, ময়ূর পাখাতে যোনি চিহ্ন আছে—অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতিকে মাথায় রেখেছেন।
“কৃষ্ণ রাসমণ্ডলে গেলেন। কিন্তু সেখানে নিজে প্রকৃতি হলেন। তাই দেখ রাসমণ্ডলে তাঁর মেয়ের বেশ। নিজে প্রকৃতিভাব না হলে প্রকৃতির সঙ্গের অধিকারী হয় না। প্রকৃতিভাব হলে তবে রাস, তবে সম্ভোগ। কিন্তু সাধকের অবস্থায় খুব সাবধান হতে হয়! তখন মেয়েমানুষ থেকে অনেক অন্তরে থাকতে হয়। এমন কি ভক্তিমতী হলেও বেশি কাছে যেতে নাই। ছাদে উঠবার সময় হেলতে দুলতে নাই। হেললে দুললে পড়বার খুব সম্ভাবনা। যারা দুর্বল, তাদের ধরে ধরে উঠতে হয়।
“সিদ্ধ অবস্থায় আলাদা কথা। ভগবানকে দর্শনের পর বেশি ভয় নাই;অনেকটা নির্ভয়। ছাদে একবার উঠতে পাল্লে হয়। উঠবার পর ছাদে নাচাও যায়। সিঁড়িতে কিন্তু নাচা যায় না। আবার দেখ—যা ত্যাগ করে গিছি, ছাদে উঠবার পর তা আর ত্যাগ করতে হয় না। ছাদও ইট, চুন, সুরকির তৈয়ারী, আবার সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈয়ারী। যে মেয়েমানুষের কাছে এত সাবধান হতে হয়, ভগবানদর্শনের পর বোধ হবে, সেই মেয়েমানুষ সাক্ষাৎ ভগবতী। তখন তাঁকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করবে। আর তত ভয় নাই।
“কথাটা এই, বুড়ী ছুঁয়ে যা ইচ্ছা কর।”
[ধ্যানযোগ ও শ্রীরামকৃষ্ণ—অন্তর্মুখ ও বহির্মুখ]
“বহির্মুখ অবস্থায় স্থূল দেখে। অন্নময় কোষে মন থাকে। তারপর সূক্ষ্ম শরীর। লিঙ্গ শরীর। মনোময় ও বিজ্ঞানময় কোষে মন থাকে। তারপর কারণ শরীর; যখন মন কারণ শরীরে আসে, তখন আনন্দ,—আনন্দময় কোষে মন থাকে। এইটি চৈতন্যদেবের অর্ধবাহ্যদশা।
“তারপর মন লীন হয়ে যায়। মনের নাশ হয়। মহাকারণে নাশ হয়। মনের নাশ হলে আর খবর নাই। এইটি চৈতন্যদেবের অন্তর্দশা।
“অন্তর্মুখ অবস্থা কিরকম জানো? দয়ানন্দ বলেছিল, ‘অন্দরে এসো, কপাট বন্ধ করে! অন্দর বাড়িতে যে সে যেতে পারে না।’
“আমি দীপশিখাকে নিয়ে আরোপ করতুম। লালচে রঙটাকে বলতুম স্থূল, তার ভিতর সাদা সাদা ভাগটাকে বলতুম সূক্ষ্ম, সব ভিতরে কালো খড়কের মতো ভাগটাকে বলতুম কারণশরীর।
“ধ্যান যে ঠিক হচ্ছে, তার লক্ষণ আছে। একটি লক্ষণ—মাথায় পাখি বসবে জড় মনে করে।”
[পূর্বকথা—কেশবকে প্রথম দর্শন ১৮৬৪, ধ্যানস্থ—চক্ষু চেয়েও ধ্যান হয়]
“কেশব সেনকে প্রথম দেখি আদি সমাজে। তাকের (বেদীর) উপর কজন বসেছে, কেশব মাঝখানে বসেছে। দেখলাম যেন কাষ্ঠবৎ! সেজোবাবুকে বললুম, দেখ ওর ফাতনায় মাছ খেয়েছে! ওই ধ্যানটুকু ছিল বলে ঈশ্বরের ইচ্ছায় যেগুনো মনে করেছিল (মান-টানগুনো) হয়ে গেল।
“চক্ষু চেয়েও ধ্যান হয়। কথা হচ্ছে, তবুও ধ্যান হয়। যেমন মনে কর, একজনের দাঁতের ব্যামো আছে, কনকন করে!—”
ঠাকুরদের শিক্ষক—আজ্ঞে, ওটি বেশ জানি। (হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হ্যাঁগো, দাঁতের ব্যামো যদি থাকে, সব কর্ম করছে, কিন্তু দরদের দিকে মনটা আছে। তাহলে ধ্যান চোক চেয়েও হয়, কথা কইতে কইতেও হয়।
শিক্ষক—পতিতপাবন নাম তাঁর আছে, তাই ভরসা। তিনি দয়াময়।
[পূর্বকথা—শিখরা ও শ্রীযুক্ত কৃষ্ণদাসের সহিত কথা]
শ্রীরামকৃষ্ণ—শিখরাও বলেছিল, তিনি দয়াময়। আমি বললুম, তিনি কেমন করে দয়াময়? তা তারা বললে, কেন মহারাজ! তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আমাদের জন্য এত জিনিস তৈয়ারী করেছেন, আমাদের মানুষ করেছেন, আমাদের পদে পদে বিপদ থেকে রক্ষা করছেন। তা আমি বললুম, তিনি আমাদের জন্ম দিয়ে দেখছেন, খাওয়াচ্ছেন, তা কি এত বাহাদুরি? তোমার যদি ছেলে হয়, তাকে কি আবার বামুনপাড়ার লোক এসে মানুষ করবে?
শিক্ষক—আজ্ঞা, কারু ফস্ করে হয়, কারু হয় না, এর মানে কি?
[লালাবাবু ও রানী ভবানীর বৈরাগ্য—সংস্কার থাকলে সত্ত্বগুণ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—কি জান? অনেকটা পূর্বজন্মের সংস্কারেতে হয়। লোকে মনে করে হঠাৎ হচ্ছে।
“একজন সকালে একপাত্র মদ খেয়েছিল, তাতেই বেজায় মাতাল, ঢলাঢলি আরম্ভ করলে—লোকে অবাক্। একপাত্রে এত মাতাল কি করে হল? একজন বললে, ওরে, সমস্ত রাত্রি মদ খেয়েছে।
“হনুমান সোনার লঙ্কা দগ্ধ করলে। লোকে অবাক্। একটা বানর এসে সব পুড়িয়ে দিলে। কিন্তু আবার বলেছে, আদত কথা এই—সীতার নিঃশ্বাসে আর রামের কোপে পুড়েছিল।
“আর দেখ লালাবাবু১—এত ঐশ্বর্য; পূর্বজন্মের সংস্কার না থাকলে ফস্ করে কি বৈরাগ্য হয়? আর রানী ভবানী—মেয়েমানুষ হয়ে এত জ্ঞান ভক্তি!”১ লালাবাবু, বাঙালী জাতির গৌরব, পাইকপাড়ার কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ। যৌবনে বৈরাগ্য—সাত লক্ষ বার্ষিক আয়ের সম্পত্তি ত্যাগ। মথুরাবাস—ত্রিশ বৎসর বয়সে। চল্লিশে মাধুকরী, ভিক্ষাজীবী। বিয়াল্লিশ ৺প্রাপ্তি। পত্নী “রানী কাত্যায়নী” নিঃসন্তান। গুরু কৃষ্ণদাস বাবাজী, ভক্তমালের (বাঙলা পদ্যে) অনুবাদক।
[কৃষ্ণদাসের রজোগুণ—তাই জগতের উপকার]
“শেষ জন্মে সত্ত্বগুণ থাকে,ভগবানে মন হয়; তাঁর জন্য মন ব্যাকুল হয়, নানা বিষয়কর্ম থেকে মন সরে আসে।
“কৃষ্ণদাস পাল এসেছিল। দেখলাম রজোগুণ! তবে হিন্দু, জুতো বাইরে রাখলে। একটু কথা কয়ে দেখলুম, ভিতরে কিছুই নাই। জিজ্ঞাসা করলুম, মানুষের কি কর্তব্য? তা বলে, ‘জগতের উপকার করব।’ আমি বললুম, হ্যাঁগা তুমি কে? আর কি উপকার করবে? আর জগৎ কতটুকু গা, যে তুমি উপকার করবে?”
নারাণ আসিয়াছেন। ঠাকুরের ভারী আনন্দ। নারায়ণকে ছোট খাটটির উপর পাশে বসাইলেন। গায়ে হাত দিয়া আদর করিতে লাগিলেন। মিষ্টান্ন খাইতে দিলেন। আর সস্নেহে বললেন, জল খাবি? নারাণ মাস্টারের স্কুলে পড়েন। ঠাকুরের কাছে আসেন বলিয়া বাড়িতে মার খান। ঠাকুর সস্নেহে একটু হাসিতে হাসিতে নারায়ণকে বলছেন, তুই একটা চামড়ার জামা কর, তাহলে মারলে লাগবে না।
ঠাকুর হরিশকে বললেন, তামাক খাব।
[স্ত্রীলোক লয়ে সাধন ঠাকুরের বারবার নিষেধ—ঘোষপাড়ার মত]
আবার নারায়ণকে সম্বোধন করে বলছেন, “হরিপদর সেই পাতানো মা এসেছিল। আমি হরিপদকে খুব সাবধান করে দিয়েছি। ওদের ঘোষপাড়ার মত। আমি তাকে জিজ্ঞাসা কল্লুম, তোমার কেউ আশ্রয় আছে? তা বলে, হাঁ—অমুক চক্রবর্তী।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—আহা, নীলকণ্ঠ সেদিন এসেছিল। এমন ভাব! আর-একদিন আসবে বলে গেছে। গান শুনাবে। আজ ওদিকে নাচ হচ্ছে, দেখো গে যাও না। (রামলালকে) তেল নাই যে, (ভাঁড় দৃষ্টে) কই তেল ভাঁড়ে তো নাই।
৩৬.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – পুরুষপ্রকৃতিবিবেক যোগ—রাধাকৃষ্ণ, তাঁরা কে? আদ্যাশক্তি
[বেদান্তবাগীশ, দয়ানন্দ সরস্বতী, কর্ণেল অল্কট্, সুরেন্দ্র, নারাণ]
এইবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পাদচারণ করিতেছেন; কখনও ঘরের ভিতর, কখনও ঘরের দক্ষিণদিকের বারান্দায়, কখনও বা ঘরের পশ্চিমদিকে গোল বারান্দাটিতে দাঁড়াইয়া, গঙ্গা দর্শন করিতেছেন।
[সঙ্গ (Environment) দোষ, গুণ, ছবি, গাছ, বালক]
কিয়ত্ক্ষণ পরে আবার ছোট খাটটিতে বসিলেন। বেলা ৩টা বাজিয়া গিয়াছে। ভক্তেরা আবার মেঝেতে আসিয়া বসিলেন। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া চুপ করিয়া আছেন। এক-একবার ঘরের দেওয়ালের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছেন। দেওয়ালে অনেকগুলি পট আছে। ঠাকুরের বামদিকে শ্রীশ্রীবীণাপাণির পট, তাহার কিছু দূরে নিতাই গৌর ভক্তসঙ্গে কীর্তন করিতেছেন। ঠাকুরের সম্মুখে ধ্রুব ও প্রহ্লাদের ছবি ও মা-কালীর মূর্তি। ঠাকুরের ডানদিকে দেওয়ালের উপর রাজরাজেশ্বরী মূর্তি, পিছনের দেওয়ালে যীশুর ছবি রহিয়াছে—পীটর ডুবিয়া যাইতেছেন, যীশু তুলিতেছেন। ঠাকুর হঠাৎ মাস্টারকে বলিতেছেন, দেখ, সাধু-সন্ন্যাসীর পট ঘরে রাখা ভাল। সকাল বেলা উঠে অন্য মুখ না দেখে সাধু-সন্ন্যাসীদের মুখ দেখে উঠা ভাল। ইংরাজী ছবি দেওয়ালে—ধনী, রাজা, কুইন-এর ছবি—কুইন-এর ছেলের ছবি, সাহেব-মেম বেড়াচ্ছে তার ছবি রাখা—এ-সব রজোগুণে হয়।
“যেরূপ সঙ্গের মধ্যে থাকবে, সেরূপ স্বভাব হয়ে যায়। তাই ছবিতেও দোষ। আবার নিজের যেরূপ স্বভাব, সেইরূপ সঙ্গ লোকে খোঁজে। পরমহংসেরা দু-পাঁচজন ছেলে কাছে রেখে দেয়—কাছে আসতে দেয়—পাঁচ-ছয় বছরের। ও অবস্থায় ছেলেদের ভিতর থাকতে ভাল লাগে। ছেলেরা সত্ত্ব রজঃ তমঃ কোন গুণের বশ নয়।
“গাছ দেখলে তপোবন, ঋষি তপস্যা করছে, উদ্দীপন হয়।”
সিঁথির একটি ব্রাহ্মণ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। ইনি কাশীতে বেদান্ত পড়িয়াছিলেন। স্থূলকায়, সদা হাস্যমুখ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিগো, কেমন সব আছ? অনেকদিন আস নাই।
পণ্ডিত (সহাস্যে)—আজ্ঞা, সংসারের কাজ। আর জানেন তো সময় আর হয় না।
পণ্ডিত আসন গ্রহণ করিলেন। তাঁহার সহিত কথা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কাশীতে অনেকদিন ছিলে, কি সব দেখলে, কিছু বল। দয়ানন্দের১ কথা একটু বল।
পণ্ডিত—দয়ানন্দের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আপনি তো দেখেছিলেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখতে গিছলুম, তখন ওধারে একটি বাগানে সে ছিল। কেশব সেনের আসবার কথা ছিল সেদিন। তা যেন চাতকের মতন কেশবের জন্য ব্যস্ত হতে লাগল। খুব পণ্ডিত। বাঙ্গালা ভাষাকে বলত, গৌরাণ্ড ভাষা। দেবতা মানত—কেশব মানত না! তা বলত, ঈশ্বর এত জিনিস করেছেন আর দেবতা করতে পারেন না! নিরাকারবাদী। কাপ্তেন “রাম রাম” কচ্ছিল, তা বললে, তার চেয়ে “সন্দেশ সন্দেশ” বল।
পণ্ডিত—কাশীতে দয়ানন্দের সঙ্গে পণ্ডিতদের খুব বিচার হল। শেষে সকলে একদিকে, আর ও একদিকে। তারপর এমন করে তুললে যে পালাতে পাল্লে বাঁচে। সকলে একসঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে বলতে লাগল—‘দয়ানন্দেন যদুক্তং তদ্ধেয়ম্’।১ দয়ানন্দ সরস্বতী, ১৮২৪-১৮৮৩। কাশীর আনন্দবাগে বিচার ১৮৬৯। কলিকাতায় স্থিতি, ঠাকুরদের নৈনালের প্রমোদ কাননে, ডিসেম্বর ১৮৭২-মার্চ ১৮৭৩। ওই সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের ও কেশবের ও কাপ্তেনের দর্শন। কাপ্তেন ঠাকুরকে ওই সময়ে সম্ভবতঃ দর্শন করেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও থিয়োসফি—ওরা কি ঈশ্বরকে ব্যাকুল হয়ে খোঁজে]
“আবার কর্ণেল অল্কট্কেও দেখেছিলাম। ওরা বলে সব ‘মহাত্মা’ আছে। আর চন্দ্রলোক, সূর্যলোক, নক্ষত্রলোক—এই সব আছে। সূক্ষ্মশরীর সেই সব জায়গায় যায়—এই সব অনেক কথা। আচ্ছা মহাশয়, আপনার থিয়োসফি কি-রকম বোধ হয়?”
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভক্তিই একমাত্র সার—ঈশ্বরে ভক্তি! তারা কি ভক্তি খোঁজে? তাহলে ভাল। ভগবানলাভ যদি উদ্দেশ্য হয় তা হলেই ভাল। চন্দ্রলোক, সূর্যলোক, নক্ষত্রলোক, মহাত্মা এই নিয়ে কেবল থাকলে ঈশ্বরকে খোঁজা হয় না। তাঁর পাদপদ্মে ভক্তি হবার জন্য সাধন করা চাই, ব্যাকুল হয়ে ডাকা চাই। নানা জিনিস থেকে মন কুড়িয়ে এনে তাঁতে লাগাতে হয়।
এই বলিয়া ঠাকুর রামপ্রসাদের গান ধরিলেন :
মন কর কি তত্ত্ব তাঁরে যেন উন্মত্ত আঁধার ঘরে ।
সে যে ভাবের বিষয়, ভাব ব্যতীত অভাবে কি ধরতে পারে ॥
সে ভাব লাগি পরম যোগী যোগ করে যুগ যুগান্তরে ।
হলে ভাবের উদয় লয় সে যেমন লোহাকে চুম্বকে ধরে ॥
“আর শাস্ত্র বল, দর্শন বল, বেদান্ত বল—কিছুতেই তিনি নাই। তাঁর জন্য প্রাণ ব্যাকুল না হলে কিছু হবে না।
“ষড় দর্শনে না পায় দরশন, আগম নিগম তন্ত্রসারে ।
সে যে ভক্তিরসের রসিক সদানন্দে বিরাজ করে পুরে ॥
“খুব ব্যাকুল হতে হয়। একটা গান শোন :
রাধার দেখা কি পায় সকলে”,
[অবতাররাও সাধন করেন—লোকশিক্ষার্থ—সাধন, তবে ঈশ্বরদর্শন]
“সাধনের খুব দরকার, ফস্ করে কি আর ঈশ্বরদর্শন হয়?
“একজন জিজ্ঞাসা করলে, কই ঈশ্বরকে দেখতে পাই না কেন? তা মনে উঠল, বললুম বড়মাছ ধরবে, তার আয়োজন কর। চারা (চার) কর। হাতসুতো, ছিপ যোগাড় কর। গন্ধ পেয়ে ‘গম্ভীর’ জল থেকে মাছ আসবে। জল নড়লে টের পাবে, বড় মাছ এসেছে।
“মাখন খেতে ইচ্ছা। তা দুধে আছে মাখন, দুধে আছে মাখন,—করলে কি হবে? খাটতে হয় তবে মাখন উঠে। ঈশ্বর আছেন, ঈশ্বর আছেন, বললে কি ঈশ্বরকে দেখা যায়? সাধন চাই!
“ভগবতী নিজে—পঞ্চমুণ্ডীর উপর বসে কঠোর তপস্যা করেছিলেন—লোকশিক্ষার জন্য। শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ পূর্ণব্রহ্ম, তিনিও রাধাযন্ত্র কুড়িয়ে পেয়ে লোকশিক্ষার জন্য তপস্যা করেছিলেন।”
[রাধাই আদ্যাশক্তি বা প্রকৃতি—পুরুষ ও প্রকৃতি, ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ]
“শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ, রাধা প্রকৃতি, চিচ্ছক্তি—আদ্যাশক্তি। রাধা প্রকৃতি ত্রিগুণময়ী! এঁর ভিতরে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিনগুণ। যেমন পেঁয়াজ ছাড়িয়ে যাও, প্রথমে লাল-কালোর আমেজ, তারপর লাল, তারপর সাদা বেরুতে থাকে। বৈষ্ণবশাস্ত্রে আছে, কামরাধা, প্রেমরাধা, নিত্যরাধা। কামরাধা চন্দ্রাবলী; প্রেমরাধা শ্রীমতী; নিত্যরাধা নন্দ দেখেছিলেন—গোপাল কোলে!
“এই চিচ্ছক্তি আর বেদান্তের ব্রহ্ম (পুরুষ) অভেদ। যেমন জল আর তার হিমশক্তি। জলের হিমশক্তি ভাবলেই জলকে ভাবতে হয়; আবার জলকে ভাবলেই জলের হিমশক্তি ভাবনা এসে পড়ে। সাপ আর সাপের তির্যগ্গতি। তির্যগ্গতি ভাবলেই সাপকে ভাবতে হবে। ব্রহ্ম বলি কখন? যখন নিষ্ক্রিয় বা কার্যে নির্লিপ্ত। পুরুষ যখন কাপড় পরে, তখন সেই পুরুষই থাকে। ছিলে দিগম্বর হলে সাম্বর—আবার হবে দিগম্বর। সাপের ভিতর বিষ আছে, সাপের কিছু হয় না। যাকে কামড়াবে, তার পক্ষে বিষ। ব্রহ্ম নিজে নির্লিপ্ত।
“নামরূপ যেখানে, সেইখানেই প্রকৃতির ঐশ্বর্য। সীতা হনুমানকে বলেছিলেন, ‘বৎসে! আমিই একরূপে রাম, একরূপে সীতা হয়ে আছি; একরূপে ইন্দ্র, একরূপে ইন্দ্রাণী—একরূপে ব্রহ্মা, একরূপে ব্রহ্মাণী—একরূপে রুদ্র, একরূপে রুদ্রাণী,—হয়ে আছি’!—নামরূপ যা আছে সব চিচ্ছক্তির ঐশ্বর্য। চিচ্ছক্তির ঐশ্বর্য সমস্তই; এমন কি ধ্যান ধ্যাতা পর্যন্ত। আমি ধ্যান কচ্চি, যতক্ষণ বোধ ততক্ষণ তাঁরই এলাকায় আছি। (মাস্টারের প্রতি)—এইগুলি ধারণা কর। বেদ পুরাণ শুনতে হয়, তিনি যা বলেছেন করতে হয়।
(পণ্ডিতের প্রতি)—“মাঝে মাঝে সাধুসঙ্গ ভাল। রোগ মানুষের লেগেই আছে। সাধুসঙ্গে অনেক উপশম হয়।”
[বেদান্তবাগীশকে শিক্ষা—সাধুসঙ্গ কর; আমার কেউ নয়; দাসভাব]
“আমি ও আমার। এর নামই ঠিক জ্ঞান—‘হে ঈশ্বর! তুমিই সব করছ, আর তুমিই আমার আপনার লোক। আর তোমার এই সমস্ত ঘরবাড়ি, পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু, সমস্ত জগৎ; সব তোমার!’ আর ‘আমি সব করছি, আমি কর্তা, আমার ঘরবাড়ি, পরিবার, ছেলেপুলে, বন্ধু, বিষয়’—এ-সব অজ্ঞান।
“গুরু শিষ্যকে এ কথা বুঝাচ্ছিলেন। ঈশ্বর তোমার আপনার, আর কেউ আপনার নয়। শিষ্য বললে, ‘আজ্ঞা, মা, পরিবার এরা তো খুব যত্ন করেন; না দেখলে অন্ধকার দেখেন, কত ভালবাসেন। গুরু বললেন, ও তোমার মনের ভুল। আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি, কেউ তোমার নয়। এই ঔষধবড়ি কয়টি তোমার কাছে রেখে দাও। তুমি বাড়িতে গিয়ে খেয়ে শুয়ে থেকো। লোকে মনে করবে যে তোমার দেহত্যাগ হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার সব বাহ্যজ্ঞান থাকবে, তুমি দেখতে শুনতে সব পাবে;—আমি সেই সময় গিয়ে পড়ব।’
“শিষ্যটি তাই করলে। বাটীতে গিয়ে বড়ি ক’টি খেলে; খেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে রহিল। মা, পরিবার, বাড়ির সকলে, কান্নাকাটি আরম্ভ করলে। এমন সময় গুরু কবিরাজের বেশে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সমস্ত শুনে বললেন, আচ্ছা, এর ঔষধ আছে—আবার বেঁচে উঠবে। তবে একটি কথা আছে। এই ঔষধটি আগে একজন আপনার লোকের খেতে হবে, তারপর ওকে দেওয়া যাবে! যে আপনার লোক ওই বড়িটি খাবে, তার কিন্তু মৃত্যু হবে। তা এখানে ওঁর মা কি পরিবার এঁরা তো সব আছেন, একজন না একজন কেউ খাবেন, সন্দেহ নাই। তাহলেই ছেলেটি বেঁচে উঠবে।
“শিষ্য সমস্ত শুনছে! কবিরাজ আগে মাকে ডাকলেন। মা কাতর হয়ে ধুলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছেন। কবিরাজ বললেন, মা! আর কাঁদতে হবে না। তুমি এই ঔষধটি খাও, তাহলেই ছেলেটি বেঁচে উঠবে। তবে তোমার এতে মৃত্যু হবে। মা ঔষধ হাতে ভাবতে লাগলেন। অনেক ভেবে-চিন্তে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বাবা, আমার আর কটি ছেলেমেয়ে আছে, আমি গেলে কি হবে, এও ভাবছি। কে তাদের দেখবে, খাওয়াবে, তাদের জন্য ভাবছি। পরিবারকে ডেকে তখন ঔষধ দেওয়া হল,—পরিবারও খুব কাঁদছিলেন। ঔষধ হাতে করে তিনিও ভাবতে লাগলেন। শুনলেন যে ঔষধ খেলে মরতে হবে। তখন কেঁদে বলতে লাগলেন, ওগো, ওঁর যা হবার, তা তো হয়েছে গো; আমার অপগণ্ডগুলির এখন কি হবে বল? কে ওদের বাঁচাবে? আমি কেমন করে ও ঔষধ খাই? শিষ্যের তখন ঔষধের নেশা চলে গেছে। সে বুঝলে যে, কেউ কারু নয়। ধড়মড় করে উঠে গুরুর সঙ্গে চলে গেল। গুরু বললেন, তোমার আপনার কেবল একজন,—ঈশ্বর।
“তাই তাঁর পাদপদ্মে যাতে ভক্তি হয়,—যাতে তিনিই ‘আমার’ বলে ভালবাসা হয়—তাই করাই ভাল। সংসার দেখছো, দুদিনের জন্য। আর এতে কিছুই নাই।”
[গৃহস্থ সর্বত্যাগ পারে না—জ্ঞান অন্তঃপুরে যায় না—ভক্তি যেতে পারে]
পণ্ডিত (সহাস্যে)—আজ্ঞে, এখানে এলে সেদিন পূর্ণ বৈরাগ্য হয়। ইচ্ছা করে—সংসার ত্যাগ করে চলে যাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, ত্যাগ করতে হবে কেন? আপনারা মনে ত্যাগ কর। সংসারে অনাসক্ত হয়ে থাক।
“সুরেন্দ্র এখানে মাঝে মাঝে রাত্রে এসে থাকবে বলে একটা বিছানা এনে রেখেছিল। দু-একদিন এসেও ছিল, তারপর তার পরিবার বলেছে, দিনের বেলা যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাও, রাত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া হবে না। তখন সুরেন্দ্র আর কি করে? আর রাত্রে থাকবার জো নাই!
“আর দেখ শুধু বিচার কললে কি হবে? তাঁর জন্য ব্যাকুল হও, তাঁকে ভালবাসতে শেখ! জ্ঞান-বিচার—পুরুষমানুষ, বাড়ির বারবাড়ি পর্যন্ত যায়।
“ভক্তি—মেয়েমানুষ অন্তঃপুর পর্যন্ত যায়।
“একটা কোনরকম ভাব আশ্রয় করতে হয়। তবে ঈশ্বরলাভ হয়। সনকাদি ঋষিরা শান্ত রস নিয়ে ছিলেন। হনুমান দাসভাব নিয়ে ছিলেন। শ্রীদাম, সুদাম, ব্রজের রাখালদের—সখ্যভাব। যশোদার বাত্সল্যভাব ঈশ্বরেতে সন্তানবুদ্ধি! শ্রীমতীর মধুরভাব।
“হে ঈশ্বর! তুমি প্রভু, আমি দাস,—এ-ভাবটির নাম দাসভাব। সাধকের পক্ষে এ-ভাবটি খুব ভাল।”
পণ্ডিত—আজ্ঞা, হাঁ।
৩৬.৯ নবম পরিচ্ছেদ – ঈশানকে উপদেশ—ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ—জ্ঞানের লক্ষণ
সিঁথির পণ্ডিত চলিয়া গিয়াছেন। ক্রমে সন্ধ্যা হইল। কালীবাড়িতে ঠাকুরদের আরতির বাজনা বাজিয়া উঠিল। শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরদের নমস্কার করিতেছেন। ছোট খাটটিতে বসিয়া উন্মনা। কয়েকটি ভক্ত মেঝেতে আসিয়া আবার বসিলেন। ঘর নিঃশব্দ।
রাত্রি একঘণ্টা হইয়াছে। ঈশান মুখোপাধ্যায় ও কিশোরী আসিয়া উপস্থিত। তাঁহারা ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। ঈশানের পুরশ্চরণাদি শাস্ত্রোল্লিখিত কর্মে খুব অনুরাগ। ঈশান কর্মযোগী। এইবার ঠাকুর কথা কহিতেছেন—
শ্রীরামকৃষ্ণ—জ্ঞান জ্ঞান বললেই কি হয়? জ্ঞান হবার লক্ষণ আছে। দুটি লক্ষণ—প্রথম অনুরাগ অর্থাৎ ঈশ্বরকে ভালবাসা। শুধু জ্ঞানবিচার করছি, কিন্তু ঈশ্বরেতে অনুরাগ নাই, ভালবাসা নাই, সে মিছে। আর-একটি লক্ষণ কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ। কুলকুণ্ডলিনী যতক্ষণ নিদ্রিত থাকেন, ততক্ষণ জ্ঞান হয় না। বসে বসে বই পড়ে যাচ্ছি, বিচার করছি, কিন্তু ভিতরে ব্যাকুলতা নাই, সেটি জ্ঞানের লক্ষণ নয়।
“কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ হলে ভাব, ভক্তি, প্রেম—এই সব হয়। এরই নাম ভক্তিযোগ।
“কর্মযোগ বড় কঠিন। কর্মযোগে কতকগুলি শক্তি হয়—সিদ্ধাই হয়।”
ঈশান—আমি হাজরা মহাশয়ের কাছে যাই।
ঠাকুর চুপ করিয়া রহিলেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে ঈশান আবার ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। সঙ্গে হাজরা। ঠাকুর নিঃশব্দে বসিয়া আছেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে হাজরা ঈশানকে বলিলেন, চলুন ইনি এখন ধ্যান করবেন। ঈশান ও হাজরা চলিয়া গেলেন।
ঠাকুর নিঃশব্দে বসিয়া আছেন। ক্রমে সত্য সত্যই ধ্যান করিতেছেন। করে জপ করিতেছেন। সেই হাত একবার মাথার উপরে রাখিলেন, তারপর কপালে, তারপর কণ্ঠে, তারপর হৃদয়ে, তারপর নাভিদেশে।
শ্রীরামকৃষ্ণ কি ষট্চক্রে আদ্যাশক্তির ধ্যান করিতেছেন? শিব সংহিতাদি শাস্ত্রে যে যোগের কথা আছে, এ কি তাই!
৩৬.১০ দশম পরিচ্ছেদ – নিবৃত্তিমার্গ—ঈশ্বরলাভের পর কর্মত্যাগ
[ঈশানকে শিক্ষা—উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত—কর্মযোগ বড় কঠিন]
ঈশান হাজরার সহিত কালীঘরে গিয়াছেন। ঠাকুর ধ্যান করিতেছিলেন। রাত্রি প্রায় ৭॥টা। ইতিমধ্যে অধর আসিয়া পড়িয়াছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর মা-কালী দর্শন করিতে গিয়াছেন। দর্শন করিয়া পাদপদ্ম হইতে নির্মাল্য লইয়া মস্তকে ধারণ করিলেন—মাকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিলেন এবং চামর লইয়া মাকে ব্যজন করিলেন। ঠাকুর ভাবে মাতোয়ারা! বাহিরে আসিবার সময় দেখিলেন, ঈশান কোশাকুশি লইয়া সন্ধ্যা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি)—কি, আপনি সেই এসেছ? আহ্নিক করছ। একটা গান শুন।
ভাবে উন্মত্ত হইয়া ঈশানের কাছে বসিয়া মধুর কণ্ঠে গাইতেছেন :
গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায়!
কালী কালী কালী বলে আমার অজপা যদি ফুরায় ॥
ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা সন্ধ্যা সে কি চায় ।
সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে কভু সন্ধি নাহি পায় ॥
দয়া ব্রত দান আদি আর কিছু না মনে লয়,
মদনেরই যাগযজ্ঞ ব্রহ্মময়ীর রাঙ্গা পায় ।
“সন্ধ্যাদি কতদিন? যতদিন না তাঁর পাদপদ্মে ভক্তি হয়—তাঁর নাম করতে করতে চক্ষের জল যতদিন না পড়ে,—আর শরীর রোমাঞ্চ যতদিন না হয়।
রামপ্রসাদ বলে ভক্তি মুক্তি উভয়ে মাথায় রেখেছি,
আমি কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি।
“যখন ফল হয়, তখন ফুল ঝরে যায়; যখন ভক্তি হয়, যখন ঈশ্বরলাভ হয়,—তখন সন্ধ্যাদি কর্ম চলে যায়।
“গৃহস্থের বউর পেটে যখন সন্তান হয়, শাশুড়ী কাজ কমিয়ে দেয়। দশমাস হলে আর সংসারের কাজ করতে দেয় না। তারপর সন্তান প্রসব হলে সে কেবল ছেলেটিকে কোলে করে তার সেবা করে। কোন কাজই থাকে না। ঈশ্বরলাভ হলে সন্ধ্যাদি কর্ম ত্যাগ হয়ে যায়।
“তুমি এরকম ঢিমে তেতালা বাজালে চলবে না। তীব্র বৈরাগ্য দরকার। ১৫ মাসে এক বত্সর করলে কি হয়? তোমার ভিতরে যেন জোর নাই। শক্তি নাই। চিড়ের ফলার। উঠে পড়ে লাগো। কোমর বাঁধো।
“তাই আমার ওই গানটা ভাল লাগে না! ‘হরিষে লাগি রহরে ভাই,তেরা বন্ত বন্ত বনি যাই।’ বন্ত বন্ত বনি যাই—আমার ভাল লাগে না। তীব্র বৈরাগ্য চাই। হাজরাকেও তাই আমি বলি।”
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও যোগতত্ত্ব—কামিনী-কাঞ্চন যোগের বিঘ্ন]
“কেন তীব্র বৈরাগ্য হয় না জিজ্ঞাসা করছ? তার মানে আছে। ভিতরে বাসনা প্রবৃত্তি সব আছে। হাজরাকে তাই বলি। ও-দেশে মাঠে জল আনে, মাঠের চারিদিকে আল দেওয়া আছে, পাছে জল বেরিয়ে যায়। কাদার আল, কিন্তু আলের মাঝে মাঝে ঘোগ। গর্ত। প্রাণপণে তো জল আনছে, কিন্তু ঘোগ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাসনা ঘোগ। জপতপ করে বটে, কিন্তু পেছনে বাসনা-ঘোগ দিয়ে সব বেরিয়ে যাচ্ছে।
“মাছ ধরে শট্কা কল দিয়ে। বাঁশ সোজা থাকবার কথা; তবে নোয়ানো রয়েছে কেন? মাছ ধরবে বলে। বাসনা মাছ তাই মন সংসারে নোয়ানো রয়েছে। বাসনা না থাকলে মনের সহজে ঊর্ধ্বদৃষ্টি হয়। ঈশ্বরের দিকে।
“কিরকম জানো? নিক্তির কাঁটা যেমন। কামিনী-কাঞ্চনের ভার আছে বলে উপরের কাঁটা নিচের কাঁটা এক হয় না। তাই যোগভ্রষ্ট হয়। দীপশিখা দেখ নাই? একটু হাওয়া লাগলেই চঞ্চল হয়। যোগাবস্থা দীপশিখার মতো—যেখানে হাওয়া নাই।
“মনটি পড়েছে ছড়িয়ে—কতক গেছে ঢাকা, কতক গেছে দিল্লী, কতক গেছে কুচবিহার। সেই মনকে কুড়ুতে হবে। কুড়িয়ে এক জায়গায় করতে হবে। তুমি যদি ষোল আনার কাপড় চাও, তাহলে কাপড়ওয়ালাকে ষোল আনা তো দিতে হবে। একটু বিঘ্ন থাকলে আর যোগ হবার জো নাই। টেলিগ্রাফের তারে যদি একটু ফুটো থাকে, তাহলে আর খবর যাবে না।”
[ত্রৈলোক্য বিশ্বাসের জোর—নিষ্কামকর্ম কর—জোর করে বল “আমার মা”]
“তা সংসারে আছ, থাকলেই বা। কিন্তু কর্মফল সমস্ত ঈশ্বরকে সমর্পণ করতে হবে। নিজে কোন ফলকামনা করতে নাই।
“তবে একটা কথা আছে। ভক্তিকামনা কামনার মধ্যে নয়। ভক্তিকামনা, ভক্তিপ্রার্থনা—করতে পার।
“ভক্তির তমঃ আনবে। মার কাছে জোর কর।—
“মায়ে পোয়ে মোকদ্দমা ধুম হবে রামপ্রসাদ বলে,
তখন শান্ত হবো ক্ষান্ত হয়ে আমায় যখন করবি কোলে।
“ত্রৈলোক্য বলেছিল, আমি যেকালে ওদের ঘরে জন্মেছি, তখন আমার হিস্যে আছে।
“তোমার যে আপনার মা, গো! এ কি পাতানো মা, এ কি ধর্ম মা! এতে জোর চলবে না তো কিসে জোর চলবে? বলো—
“মা আমি কি আটাশে ছেলে, আমি ভয় করিনি চোখ রাঙ্গালে।
এবার করবো নালিস্ শ্রীনাথের আগে, ডিক্রি লব এক সওয়ালে।
“আপনার মা! জোর কর! যার যাতে সত্তা থাকে, তার তাতে টানও থাকে। মার সত্তা আমার ভিতর আছে বলে তাই তো মার দিকে অত টান হয়। যে ঠিক শৈব, সে শিবের সত্তা পায়। কিছু কণা তার ভিতর এসে পড়ে। যে ঠিক বৈষ্ণব তার নারায়ণের সত্তা ভিতরে আসে। আর এ সময় তো আর তোমার বিষয়কর্ম করতে হয় না। এখন দিন কতক তাঁর চিন্তা কর। দেখলে তো সংসারে কিছু নাই।”
ঠাকুর আবার সেই মধুর কণ্ঠে গাইতেছেন :
ভেবে দেখ মন কেউ কারু নয়, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে ।
ভুলো না দক্ষিণাকালী বদ্ধ হয়ে মায়াজালে ॥
দিন দুই-তিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে,
সেই কর্তারে দেবে ফেলে, কালাকালের কর্তা এলে ॥
যার জন্য মর ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে,
সেই প্রেয়সী দিবে ছড়া, অমঙ্গল হবে বলে ॥
[সালিসী, মোড়লী, হাসপাতাল, ডিস্পেনসারি করবার বাসনা—লোকমান্য, পাণ্ডিত্য, বাসনা—এ-সব আদিকাণ্ড—লালচুষি ত্যাগের পর তবে ঈশ্বরলাভ]
“আর তুমি সালিসী মোড়লী ও-সব কি কচ্ছো? লোকের ঝগড়া বিবাদ মিটাও—তোমাকে সালিসী ধরে, শুনতে পাই। ও তো অনেকদিন করে আসছো। যারা করবে তারা এখন করুক। তুমি এখন তাঁর পাদপদ্মে বেশি করে মন দেও। বলে ‘লঙ্কায় রাবণ মলো, বেহুলা কেঁদে আকুল হলো!’
“তা শম্ভুও বলেছিল। বলে হাসপাতাল ডিস্পেনসারি করব। লোকটা ভক্ত ছিল। তাই আমি বললুম, ভগবানের সাক্ষাত্কার হলে কি হাসপাতাল ডিস্পেনসারি চাইবে!
“কেশব সেন বললে, ঈশ্বরদর্শন কেন হয় না। তা বললুম যে, লোকমান্য, বিদ্যা—এ-সব নিয়ে তুমি আছ কি না, তাই হয় না। ছেলে চুষি নিয়ে যতক্ষণ চোষে, ততক্ষণ মা আসে না। লালচুষি। খানিকক্ষণ পরে চুষি ফেলে যখন চিত্কার করে, তখন মা ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে আসে।
“তুমিও মোড়লী কোচ্চ। মা ভাবছে, ছেলে আমার মোড়ল হয়ে বেশ আছে। আছে তো থাক।”
ঈশান ইতিমধ্যে ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করিয়া বসিয়া আছেন। চরণ ধরিয়া বিনীতভাবে বলিতেছেন—আমি যে ইচ্ছা করে এ-সব করি তা নয়।
[বাসনার মূল মহামায়া—তাই কর্মকাণ্ড]
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা জানি। সে মায়েরই খেলা! এঁরই লীলা! সংসারে বদ্ধ করে রাখা সে মহামায়ার ইচ্ছা! কি জান? ‘ভবসাগরে উঠছে ডুবছে কতই তরী।’ আবার—‘ঘুড়ি লক্ষের দুটো একটা কাটে, হেসে দাও মা হাত চাপড়ি।’ লক্ষের মধ্যে দু-একজন মুক্ত হয়ে যায়। বাকী সবাই মার ইচ্ছায় বদ্ধ হয়ে আছে।
“চোর চোর খেলা দেখ নাই; বুড়ীর ইচ্ছা যে খেলাটা চলে। সবাই যদি বুড়ীকে ছুঁয়ে ফেলে, তাহলে আর খেলা চলে না। তাই বুড়ীর ইচ্ছা নয় যে, সকলে ছোঁয়।
“আর দেখ, বড় বড় দোকানে চালের বড় বড় ঠেক থাকে। ঘরের চাল পর্যন্ত উঁচু। চাল থাকে—দালও থাকে। কিন্তু পাছে ইঁদুরে খায়, তাই দোকানদার কুলোয় করে খই মুড়কি রেখে দেয়। মিষ্ট লাগে আর সোঁধা গন্ধ—তাই যত ইঁদুর সেই কুলোতে গিয়ে পড়ে, বড় বড় ঠেকের সন্ধান পায় না!—জীব কামিনী-কাঞ্চনে মুগ্ধ হয়। ঈশ্বরের খবর পায় না।”
৩৬.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণের সব কামনা ত্যাগ—কেবল ভক্তিকামনা
শ্রীরামকৃষ্ণ—নারদকে রাম বললেন, তুমি আমার কাছে কিছু বর নাও। নারদ বললেন, রাম! আমার আর কী বাকী আছে? কি বর লব? তবে যদি একান্ত বর দিবে, এই বর দাও যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি থাকে, আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। রাম বললেন, নারদ! আর কিছু বর লও। নারদ আবার বললেন, রাম! আর কিছু আমি চাই না, যেন তোমার পাদপদ্মে আমার শুদ্ধাভক্তি থাকে, এই করো!
“আমি মার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম; বলেছিলাম মা! আমি লোকমান্য চাই না মা, অষ্টসিদ্ধি চাই না মা, ও মা! শতসিদ্ধি চাই না মা, দেহসুখ চাই না মা, কেবল এই করো যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয় মা।
“অধ্যাত্মে আছে, লক্ষ্মণ রামকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাম! তুমি কত ভাবে কত রূপে থাক, কিরূপে তোমায় চিনতে পারব? রাম বললেন, ‘ভাই! একটা কথা জেনে রাখ, যেখানে উজ্ঝিতা (ঊর্জিতা) ভক্তি, সেখানে নিশ্চয়ই আমি আছি।’ উজ্ঝিতা (ঊর্জিতা) ভক্তিতে হাসে কাঁদে নাচে গায়! যদি কারু এরূপ ভক্তি হয়, নিশ্চয় জেনো, ঈশ্বর সেখানে স্বয়ং বর্তমান। চৈতন্যদেবের ওইরূপ হয়েছিল।”
ভক্তেরা অবাক্ হইয়া শুনিতে লাগিলেন। দৈববাণীর ন্যায় এই সকল কথা শুনিতেছিলেন। কেহ ভাবিতেছেন, ঠাকুর বলিতেছেন, ‘প্রেমে হাসে কাঁদে নাচে গায়’; এ তো শুধু চৈতন্যদেবের অবস্থা নয়, ঠাকুরের তো এই অবস্থা। তবে কি এইখানে স্বয়ং ঈশ্বর সাক্ষাৎ বর্তমান?
ঠাকুরের অমৃতময়ী কথা চলিতেছে নিবৃত্তিমার্গের কথা। ঈশানকে যাহা মেঘগম্ভীরস্বরে বলিতেছেন—সেই কথা চলিতেছে।
[ঈশান খোসামুদে হতে সাবধান—শ্রীরামকৃষ্ণ ও জগতের উপকার]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি)—তুমি খোসামুদের কথায় ভুলো না। বিষয়ী লোক দেখলেই খোসামুদে এসে জুটে!
“মরা গরু একটা পেলে যত শকুনি সেখানে এসে পড়ে।”
[সংসারীর শিক্ষা কর্মকাণ্ড—সর্বত্যাগীর শিক্ষা, কেবল ঈশ্বরের পাদপদ্ম চিন্তা]
“বিষয়ী লোকগুলোর পদার্থ নাই। যেন গোবরের ঝোড়া! খোসামুদেরা এসে
বলবে, আপনি দানী, জ্ঞানী, ধ্যানী। বলা তো নয় অমনি—বাঁশ! ও কি! কতকগুলো সংসারী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত নিয়ে রাতদিন বসে থাকা, আর খোসামোদ শোনা!
“সংসারী লোকগুলো তিনজনের দাস, তাদের কি পদার্থ থাকে? মেগের দাস, টাকার দাস, মনিবের দাস। একজনের নাম করব না। আটশো টাকা মাইনে কিন্তু মেগের দাস, উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বসে!
“আর সালিসী, মোড়লী—এ-সব কাজ কি? দয়া, পরোপকার?—এ-সব তো অনেক হল! ও-সব যারা করবে তাদের থাক্ আলাদা। তোমার ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন দিবার সময় হয়েছে। তাঁকে পেলে সব পাওয়া যায়। আগে তিনি, তারপর দয়া, পরোপকার, জগতের উপকার, জীব উদ্ধার। তোমার ও ভাবনায় কাজ কি?
“লঙ্কায় রাবণ মলো বেহুলা কেঁদে আকুল হলো।
“তাই হয়েছে তোমার। একজন সর্বত্যাগী তোমায় বলে দেয়, এই এই করো তবে বেশ হয়। সংসারী লোকের পরামর্শে ঠিক হবে না। তা, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতই হউন আর যিনিই হউন।”
[ঈশান পাগল হও—“এ সমস্ত উপদেশ মা দিলেন”]
“পাগল হও, ঈশ্বরের প্রেমে পাগল হও। লোকে না হয় জানুক যে ঈশান এখন পাগল হয়েছে আর পারে না। তাহলে তারা সালিসী মোড়লী করাতে আর তোমার কাছে আসবে না। কোশাকুশি ছুঁড়ে ফেলে দাও, ঈশান নাম সার্থক কর।”
ঈশান—দে মা, পাগল করে। আর কাজ নাই মা জ্ঞানবিচারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—পাগল না ঠিক? শিবনাথ বলেছিল, বেশি ঈশ্বরচিন্তা কল্লে বেহেড হয়ে যায়। আমি বললুম, কি?—চৈতন্যকে চিন্তা করে কি কেউ অচৈতন্য হয়ে যায়? তিনি নিত্যশুদ্ধবোধরূপ। যাঁর বোধে সব বোধ কচ্ছে যাঁর চৈতন্যে সব চৈতন্যময়! বলে নাকি কে সাহেবদের হয়েছিল—বেশি চিন্তা করে বেহেড হয়ে গিয়েছিল। তা হতে পারে। তারা ঐহিক পদার্থ চিন্তা করে। ‘ভাবেতে ভরল তনু, হরল গেয়ান!’ এতে যে জ্ঞানের (গেয়ানের) কথা আছে, সে জ্ঞান মানে বাহ্যজ্ঞান।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চরণ স্পর্শ করিয়া ঈশান বসিয়া আছেন ও সমস্ত কথা শুনিতেছেন। তিনি এক-একবার মন্দিরমধ্যবর্তী পাষাণময়ী কালীপ্রতিমার দিকে চাহিতেছিলেন। দীপালোকে মার মুখ হাসিতেছে, যেন দেবী আবির্ভূতা হইয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বেদমন্ত্রতুল্য বাক্যগুলি শুনিয়া আনন্দ করিতেছেন।
ঈশান (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—যে-সব কথা আপনি শ্রীমুখে বললেন, ও সব কথা ওইখান থেকে এসেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি যন্ত্র, উনি যন্ত্রী;—আমি ঘর, উনি ঘরণী;—আমি রথ, উনি রথী; উনি যেমন চালান, তেমনি চলি; যেমন বলান, তেমনি বলি।
“কলিযুগে অন্যপ্রকার দৈববাণী হয় না। তবে আছে, বালক কি পাগল, এদের মুখ দিয়ে তিনি কথা কন।
“মানুষ গুরু হতে পারে না। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে। মহাপাতক, অনেকদিনের পাতক, অনেকদিনের অজ্ঞান, তাঁর কৃপা হলে একক্ষণে পালিয়ে যায়।
“হাজার বছরের অন্ধকার ঘরের ভিতর যদি হঠাৎ আলো আসে, তাহলে সেই হাজার বছরের অন্ধকার কি একটু একটু করে যায়, না একক্ষণে যায়? অবশ্য আলো দেখালেই সমস্ত অন্ধকার পালিয়ে যায়।
“মানুষ কি করবে। মানুষ অনেক কথা বলে দিতে পারে, কিন্তু শেষে সব ঈশ্বরের হাত। উকিল বলে, আমি যা বলবার সব বলেছি, এখন হাকিমের হাত।
“ব্রহ্ম নিষ্ক্রিয়। তিনি যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়—এই সকল কাজ করেন, তখন তাঁকে আদ্যাশক্তি বলে। সেই আদ্যাশক্তিকে প্রসন্ন করতে হয়। চণ্ডীতে আছে জান না? দেবতারা আগে আদ্যাশক্তির স্তব কল্লেন। তিনি প্রসন্ন হলে তবে হরির যোগনিদ্রা ভাঙবে।”
ঈশান—আজ্ঞা, মধুকৈটভ বধের সময় ব্রহ্মাদি দেবতারা স্তব করছেন—
ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা ।
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা ॥
অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ ।
ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা ॥
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমত্স্যন্তে চ সর্বদা ॥
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে ।
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোঽস্য জগন্ময়ে ॥1
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ ওইটি ধারণা।
৩৬.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ ও কর্মকাণ্ড—কর্মকাণ্ড কঠিন তাই ভক্তিযোগ
কালীমন্দিরের সম্মুখে ভক্তেরা শ্রীরামকৃষ্ণকে ঘেরিয়া চতুর্দিকে বসিয়া আছেন। এতক্ষণ অবাক্ হইয়া শ্রীমুখের বাণী শুনিতেছিলেন।
এইবার ঠাকুর গাত্রোত্থান করিলেন। মন্দিরের সম্মুখে চাতালে আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া মাকে প্রণাম করিলেন। ভক্তেরা সকলে তাঁহার কাছে সত্বর আসিয়া তাঁহার পাদমূলে ভূমিষ্ঠ হইয়া পড়িলেন। সকলেই চরণধূলির ভিখারী। সকলে চরণবন্দনা করিলে পর, ঠাকুর চাতাল হইতে নামিতেছেন ও মাস্টারের সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে নিজের ঘরের দিকে আসিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গীত গাহিতে গাহিতে মাস্টারের প্রতি)—
“প্রসাদ বলে ভুক্তি মুক্তি উভয়ে মাথায় রেখেছি।
আমি কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম, ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি!
“ধর্মাধর্ম কি জানো? এখানে ‘ধর্ম’ মানে বৈধীধর্ম। যেমন দান করতে হবে, শ্রাদ্ধ, কাঙালীভোজন—এই সব।
“এই ধর্মকেই বলে কর্মকাণ্ড। এ-পথ বড় কঠিন। নিষ্কামকর্ম করা বড় কঠিন! তাই ভক্তিপথ আশ্রয় করতে বলেছে।
“একজন বাড়িতে শ্রাদ্ধ করেছিল। অনেক লোকজন খাচ্ছিল। একটা কসাই গরু নিয়ে যাচ্ছে, কাটবে বলে। গরু বাগ মানছিল না—কসাই হাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন সে ভাবলে শ্রাদ্ধবাড়ি গিয়ে খাই। খেয়ে গায়ে জোর করি, তারপর গরুটাকে নিয়ে যাব। শেষে তাই কল্লে, কিন্তু যখন সে গরু কাটলে তখন যে শ্রাদ্ধ করেছিল, তারও গো-হত্যার পাপ হল।
“তাই বলছি, কর্মকাণ্ডের চেয়ে ভক্তিপথ ভাল।”
ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করিতেছেন, সঙ্গে মাস্টার। ঠাকুর গুনগুন করিয়া গাহিতেছেন। নিবৃত্তিমার্গের বিষয় যা বললেন, তারই ফুট উঠছে। ঠাকুর গুনগুন করে বলছেন—“অবশেষে রাখ গো মা, হাড়ের মালা সিদ্ধি ঘোটা।”
ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিলেন। অধর, কিশোরী ও অন্যান্য ভক্তেরা আসিয়া বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—ঈশানকে দেখলুম—কই, কিছুই হয় নাই! বল কি? পুরশ্চরণ পাঁচমাস করেছে! অন্য লোকে এক কাণ্ড করত।
অধর—আমাদের সম্মুখে ওঁকে অত কথা বলা ভাল হয় নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে কি! ও জাপক লোক, ওর ওতে কি?
কিয়ত্ক্ষণ কথার পর ঠাকুর অধরকে বলিতেছেন, ঈশান খুব দানী। আর দেখ, জপতপ খুব করে।
ঠাকুর কিছুকাল চুপ করিয়া আছেন। ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া একদৃষ্টে চাহিয়া আছেন।
হঠাৎ ঠাকুর অধরকে উদ্দেশ করিয়া বলিতেছেন—আপনাদের যোগ ও ভোগদুই-ই আছে।
৩৬.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে কালীপূজা মহানিশায় ভক্তসঙ্গে
[মাস্টার, বাবুরাম, গোপাল, হরিপদ, নিরঞ্জনের আত্মীয়, রামলাল, হাজরা]
আজ ৺কালীপূজা, ১৮ই অক্টোবর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, শনিবার (৩রা কার্তিক, অমাবস্যা)। রাত দশটা-এগারটার সময় ৺কালীপূজা আরম্ভ হইবে। কয়েকজন ভক্ত এই গভীর অমাবস্যা নিশিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিবেন, তাই ত্বরা করিয়া আসিতেছেন।
মাস্টার রাত্রি আন্দাজ আটটার সময় একাকী আসিয়া পৌঁছিলেন। বাগানে আসিয়া দেখিলেন, কালীমন্দিরে মহোত্সব আরম্ভ হইয়াছে। উদ্যানমধ্যে মাঝে মাঝে দীপ—দেবমন্দির আলোকে সুশোভিত হইয়াছে। মাঝে মাঝে রোশনচৌকি বাজিতেছে, কর্মচারীরা দ্রুতপদে মন্দিরের এ-স্থান হইতে ও-স্থানে যাতায়াত করিতেছেন। আজ রাসমণির কালীবাড়িতে ঘটা হইবে, দক্ষিণেশ্বরের গ্রামবাসীরা শুনিয়াছেন, আবার শেষরাত্রে যাত্রা হইবে। গ্রাম হইতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বহুসংখ্যক লোক ঠাকুরদর্শন করিতে সর্বদা আসিতেছে।
বৈকালে চণ্ডীর গান হইতেছিল—রাজনারায়ণের চণ্ডীর গান। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে প্রেমানন্দে গান শুনিয়াছেন। আজ আবার জগতের মার পূজা হইবে। ঠাকুর আনন্দে বিভোর হইয়াছেন।
রাত্রি আটটার সময় পৌঁছিয়া মাস্টার দেখিতেছেন, ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন, তাঁহাকে সম্মুখে করিয়া মেঝের উপর কয়েকটি ভক্ত বসিয়া আছেন—বাবুরাম, ছোট গোপাল, হরিপদ, কিশোরী, নিরঞ্জনের একটি আত্মীয় ছোকরা ও এঁড়েদার আর একটি ছেলে। রামলাল ও হাজরা মাঝে মাঝে আসিতেছেন ও যাইতেছেন।
নিরঞ্জনের আত্মীয় ছোকরাটি ঠাকুরের সম্মুখে ধ্যান করিতেছেন,—ঠাকুর তাঁহাকে ধ্যান করিতে বলিয়াছেন—
মাস্টার প্রণাম করিয়া উপবিষ্ট হইলেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে নিরঞ্জনের আত্মীয় প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। এঁড়েদার দ্বিতীয় ছেলেটিও প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলেন—ওই সঙ্গে যাবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নিরঞ্জনের আত্মীয়ের প্রতি)—তুমি কবে আসবে?
ভক্ত—আজ্ঞা, সোমবার—বোধ হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (আগ্রহের সহিত)—লণ্ঠন চাই, সঙ্গে নিয়ে যাবে?
ভক্ত—আজ্ঞা না, এই বাগানের পাশে;—আর দরকার নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (এঁড়েদার ছোকরাটির প্রতি)—তুইও চললি?
ছোকরা—আজ্ঞা, সর্দি—
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, বরং মাথায় কাপড় দিয়ে যেও।
ছেলে দুটি আবার প্রণাম করিয়া চলিয়া গেলেন।
৩৬.১৪ চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে ৺কালীপূজা মহানিশায় শ্রীরামকৃষ্ণ ভজনানন্দে
গভীর অমাবস্যা নিশি। আবার জগতের মার পূজা। শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে বালিশে হেলান দিয়া আছেন। কিন্তু অন্তর্মুখ, মাঝে মাঝে ভক্তদের সঙ্গে একটি-দুইটি কথা কহিতেছেন।
হঠাৎ মাস্টার ও ভক্তদের প্রতি তাকাইয়া বলিতেছেন, আহা, ছেলেটির কি ধ্যান! (হরিপদের প্রতি)—কেমন রে? কি ধ্যান!
হরিপদ—আজ্ঞা হাঁ, ঠিক কাষ্ঠের মতো।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কিশোরীর প্রতি)—ও ছেলেটিকে জান? নিরঞ্জনের কিরকম ভাই হয়।
আবার সকলেই নিঃস্তব্ধ। হরিপদ ঠাকুরের পদসেবা করিতেছেন।
ঠাকুর বৈকালে চণ্ডীর গান শুনিয়াছেন। গানের ফুট উঠিতেছে। আস্তে আস্তে গাইতেছেন :
কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে না পায় দরশন ॥
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন ।
কালী পদ্মবনে হংসসনে হংসীরূপে করে রমণ ॥
আত্মারামের আত্মাকালী, প্রমাণ প্রণবের মতন ।
তিনি ঘটে ঘটে বিরাজ করেন ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন ॥
মায়ের উদরে ব্রহ্মাণ্ড-ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জান কেমন ।
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম অন্য কেবা জানে তেমন ॥
প্রসাদ ভাষে লোকে হাসে সন্তরণে সিন্ধু তরণ ।
আমার মন বুঝেছে প্রাণ বুঝে না, ধরবে শশী হয়ে বামন ॥
ঠাকুর উঠিয়া বসিলেন। আজ মায়ের পূজা—মায়ের নাম করিবেন! আবার উত্সাহের সহিত গাইতেছেন :
এ সব ক্ষেপা মায়ের খেলা
(যার মায়ায় ত্রিভুবন বিভোলা) (মাগীর আপ্তভাবে গুপ্তলীলা)
সে যে আপনি ক্ষেপা, কর্তা ক্ষেপা, ক্ষেপা দুটো চেলা ॥
কি রূপ কি গুণ ভঙ্গী, কি ভাব কিছুই যায় না বলা ।
যার নাম জপিয়ে কপাল পোড়ে কণ্ঠে বিষের জ্বালা ॥
সগুণে নির্গুণে বাঁধিয়ে বিবাদ, ঢ্যালা দিয়ে ভাঙছে ঢ্যালা ।
মাগী সকল বিষয়ে সমান রাজী নারাজ কেবল কাজের বেলা ॥
প্রসাদ বলে থাকো বসে ভবার্ণবে ভাসিয়ে ভেলা ।
যখন আসবে জোয়ার উজিয়ে যাবে, ভাঁটিয়ে যাবে ভাঁটার বেলা ॥
ঠাকুর গান করিতে করিতে মাতোয়ারা হইয়াছেন। বলিলেন, এ-সব মাতালের ভাবে গান। বলিয়া গাইতেছেন :
(১)—এবার কালী তোমায় খাব।
(২)—তাই তোমাকে সুধাই কালী।
(৩)—সদানন্দময়ী কালী, মহাকালের মনোমোহিনী।
তুমি আপনি নাচ, আপনি গাও, আপনি দাও মা করতালি ॥
আদিভূতা সনাতনী, শূন্যরূপা শশীভালী ।
ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি ॥
সবে মাত্র তুমি যন্ত্রী, আমরা তোমার তন্ত্রে চলি ।
যেমন রাখ তেমনি থাকি মা, যেমন বলাও তেমনি বলি ॥
অশান্ত কমলাকান্ত দিয়ে বলে গালাগালি ।
এবার সর্বনাশী ধরে অসি, ধর্মাধর্ম দুটো খেলি ॥
(৪)—জয় কালী জয় কালী বলে যদি আমার প্রাণ যায় ।
শিবত্ব হইব প্রাপ্ত, কাজ কি বারাণসী তায় ॥
অনন্তরূপিণী কালী, কালীর অন্ত কেবা পায়?
কিঞ্চিৎ মাহাত্ম্য জেনে শিব পড়েছেন রাঙা পায় ॥
গান সমাপ্ত হইল এমন সময়ে রাজনারায়ণের ছেলে দুটি আসিয়া প্রণাম করিল। নাটমন্দিরে বৈকালে রাজনারায়ণ চণ্ডীর গান গাইয়াছিলেন, ছেলে দুটিও সঙ্গে সঙ্গে গাইয়াছিল। ঠাকুর ছেলে দুটির সঙ্গে আবার গাইতেছেন : ‘এ সব ক্ষেপা মেয়ের খেলা’।
ছোট ছেলেটি ঠাকুরকে বলিতেছেন,—ওই গানটি একবার যদি—
‘পরম দয়াল হে প্রভু’—
ঠাকুর বলিলেন, “গৌর নিতাই তোমরা দুভাই?”—এই বলিয়া গানটি গাইতেছেন :
গৌর নিতাই তোমরা দুভাই পরম দয়াল হে প্রভু।
গান সমাপ্ত হইল। রামলাল ঘরে আসিয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, ‘একটু গা, আজ পূজা।’ রামলাল গাইতেছেন :
(১)—সমর আলো করে কার কামিনী!
সজল জলদ জিনিয়া কায়, দশনে প্রকাশে দামিনী ॥
এলায়ে চাঁচর চিকুর পাশ, সুরাসুর মাঝে না করে ত্রাস
অট্টহাসে দানব নাশে, রণ প্রকাশে রঙ্গিণী ॥
কিবা শোভা করে শ্রমজ বিন্দু, ঘনতনু ঘেরি কুমুদবন্ধু,
অমিয় সিন্ধু হেরিয়ে ইন্দু, মলিন এ কোন মোহিনী ॥
এ কি অসম্ভব ভব পরাভব, পদতলে শবসদৃশ নীরব,
কমলাকান্ত কর অনুভব, কে বটে ও গজগামিনী ॥
(২)—কে রণে নাচিছে বামা নীরদবরণী।
ঠাকুর প্রেমানন্দে নাচিতেছেন। নাচিতে নাচিতে গান ধরিলেন ঃ
মজলো আমার মন ভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে!
গান ও নৃত্য সমাপ্ত হইল। ভক্তেরা আবার সকলে মেঝেতে বসিয়াছেন। ঠাকুরও ছোট খাটটিতে বসিলেন।
মাস্টারকে বলিতেছেন, তুমি এলে না, চণ্ডীর গান কেমন হলো।
৩৬.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – কালীপূজা রাত্রে সমাধিস্থ—সাঙ্গোপাঙ্গ সম্বন্ধে দৈববাণী
ভক্তেরা কেহ কেহ কালীমন্দিরে ঠাকুর দর্শন করিতে গমন করিলেন। কেহ বা দর্শন করিয়া একাকী গঙ্গাতীরে বাঁধাঘাটের উপর বসিয়া নির্জনে নিঃশব্দে নামজপ করিতেছেন। রাত্রি প্রায় ১১টা। মহানিশা। জোয়ার সবে আসিয়াছে—ভাগীরথী উত্তরবাহিনী। তীরস্থ দীপালোকে এক-একবার কালো জল দেখা যাইতেছে।
রামলাল পূজাপদ্ধতি নামক পুঁথি হস্তে মায়ের মন্দিরে একবার আসিলেন। পুঁথিখানি মন্দিরমধ্যে রাখিয়া দিবেন। মণি মাকে সতৃষ্ণ নয়নে দর্শন করিতেছেন দেখিয়া রামলাল বলিলেন, ভিতরে আসবেন কি? মণি অনুগৃহীত হইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, মা বেশ সাজিয়াছেন। ঘর আলোকাকীর্ণ। মার সম্মুখে দুই সেজ; উপরে ঝাড় ঝুলিতেছে। মন্দিরতল নৈবেদ্যে পরিপূর্ণ। মার পাদপদ্মে জবাবিল্ব। নানাবিধ পুষ্প মালায় বেশকারী মাকে সাজাইয়াছেন। মণি দেখিলেন, সম্মুখে চামর ঝুলিতেছে। হঠাৎ মনে পড়িল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই চামর লইয়া ঠাকুরকে কত ব্যজন করেন। তখন তিনি সঙ্কুচিতভাবে রামলালকে বলিতেছেন, “এই চামরটি একবার নিতে পারি?”
রামলাল অনুমতি প্রদান করিলেন; তিনি মাকে ব্যজন করিতে লাগিলেন। তখনও পূজা আরম্ভ হয় নাই।
যে সকল ভক্তেরা বাহিরে গিয়াছিলেন, তাঁহারা আবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে আসিয়া মিলিত হইলেন।
শ্রীযুক্ত বেণী পাল নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। আগামীকল্য সিঁথি ব্রাহ্মসমাজে যাইতে হইবে। ঠাকুরের নিমন্ত্রণ। নিমন্ত্রণ পত্রে কিন্তু তারিখ ভুল হইয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—বেণী পাল নিমন্ত্রণ করেছে। তবে এরকম লিখলে কেন বল দেখি?
মাস্টার—আজ্ঞে, লেখাটি ঠিক হয় নাই। তবে অত ভেবে-চিন্তে লেখেন নাই।
ঘরের মধ্যে ঠাকুর দাঁড়াইয়া, বাবুরাম কাছে দাঁড়াইয়া। ঠাকুর বেণী পালের চিঠির কথা কহিতেছেন। বাবুরামকে স্পর্শ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। হঠাৎ সমাধিস্থ!
ভক্তেরা সকলে তাঁহাকে ঘেরিয়া দাঁড়াইয়াছেন। এই সমাধিস্থ মহাপুরুষকে অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন। ঠাকুর সমাধিস্থ; বাম পা বাড়াইয়া দাঁড়াইয়া আছেন—গ্রীবাদেশ ঈষৎ আকুঞ্চিত। বাবুরামের গ্রীবার পশ্চাদ্দেশে কানের কাছে হাতটি রহিয়াছে।
কিয়ত্ক্ষণ পরে সমাধিভঙ্গ হইল। তখনও দাঁড়াইয়া। এইবার গালে হাত দিয়া যেন কত চিন্তিত হইয়া দাঁড়াইলেন।
ঈষৎ হাস্য করিয়া এইবার ভক্তদের সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন—
শ্রীরামকৃষ্ণ—সব দেখলুম—কার কত দূর এগিয়েছে। রাখাল, ইনি (মণি), সুরেন্দ্র, বাবুরাম, অনেককে দেখলুম।
হাজরা—এখানকার?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ।
হাজরা—বেশি কি বন্ধন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—না।
হাজরা—নরেন্দ্রকে দেখলেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখি নাই, কিন্তু এখনও বলতে পারি—একটু জড়িয়ে পড়েছে; কিন্তু সব্বায়ের হয়ে যাবে দেখলুম।
(মণির দিকে তাকাইয়া)—সব দেখলুম ঘুপটি মেরে রয়েছে!
ভক্তেরা অবাক্, দৈববাণীর ন্যায় অদ্ভুত সংবাদ শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু একে (বাবুরামকে) ছুঁয়ে ওরূপ হল!
হাজরা—ফাস্ট (First) কে?
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ চুপ করিয়া রহিলেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে বলিতেছেন, “নিত্যগোপালের মতো গোটাকতক হয়!”
আবার চিন্তা করিতেছেন। এখনও সেইভাবে দাঁড়াইয়া আছেন।
আবার বলিতেছেন—“অধর সেন—যদি কর্মকাজ কমে,—কিন্তু ভয় হয়—সাহেব আবার বকবে। যদি বলে, এ ক্যা হ্যায়!” (সকলের ঈষৎ হাস্য)
ঠাকুর আবার নিজাসনে গিয়া বসিলেন। ভক্তেরা মেঝেতে বসিলেন। বাবুরাম ও কিশোরী তাড়াতাড়ি করিয়া ছোট খাটটিতে গিয়া ঠাকুরের পাদমূলে বসিয়া একে একে পদসেবা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কিশোরীর দিকে তাকাইয়া)—আজ যে খুব সেবা!
রামলাল আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন; ও অতিশয় ভক্তিভাবে পদধূলি গ্রহণ করিলেন। মায়ে পূজা করিতে যাইতেছেন।
রামলাল (ঠাকুরের প্রতি)—তবে আমি আসি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওঁ কালী, ওঁ কালী। সাবধানে পূজা করো। আবার মেড়া বলি দিতে হবে।
মহানিশা। পূজা আরম্ভ হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পূজা দেখিতে আসিয়াছেন। মার কাছে গিয়া দর্শন করিতেছেন। এইবার বলি হইবে—লোক কাতার দিয়া দাঁড়াইয়াছে। বধ্য পশুর উত্সর্গ হইল। পশুকে বলিদানের জন্য লইয়া যাইবার উদ্যোগ হইতেছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির ত্যাগ করিয়া নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলেন।
ঠাকুরের সে অবস্থা নয়; পশুবধ দেখিতে পারিবেন না।
রাত দুইটা পর্যন্ত কোন কোন ভক্ত মা-কালীর মন্দিরে বসিয়াছিলেন। হরিপদ কালীঘরে আসিয়া বলিলেন, চলুন, তিনি ডাকছেন, খাবার সব প্রস্তুত। ভক্তেরা ঠাকুরের প্রসাদ পাইলেন ও যে যেখানে পাইলেন, একটু শুইয়া পড়িলেন।
ভোর হইল; মার মঙ্গল আরতি হইয়া গিয়াছে। মার সম্মুখে নাটমন্দির। নাটমন্দিরে যাত্রা হইতেছে, মা যাত্রা শুনিতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কালীবাড়ির বৃহৎ পাকা উঠান দিয়া যাত্রা শুনিতে আসিতেছেন। মণি সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছেন—ঠাকুরের কাছে বিদায় লইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন তুমি এখন যাবে?
মণি—আজ আপনি সিঁথিতে বৈকালে যাবেন, আমারও যাবার ইচ্ছা আছে, তাই বাড়িতে একবার যাচ্ছি।
কথা কহিতে কহিতে মা-কালীর মন্দিরের কাছে আসিয়া উপস্থিত। অদূরে নাটমন্দির, যাত্রা হইতেছে। মণি সোপানমূলে ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরের চরণ বন্দনা করিতেছেন।
ঠাকুর বলিলেন, “আচ্ছা এসো। আর দুখানা আটপৌরে নাইবার কাপড় আমার জন্য এনো।”
*****
- ১ তুমি হোম, শ্রাদ্ধ ও যজ্ঞে প্রযুজ্য স্বাহা, স্বধা ও বষট্কাররূপে মন্ত্রস্বরস্বরূপা এবং দেবভক্ষ্য সুধাও তুমি। হে নিত্যে! তুমি অক্ষর সমুদায়ে হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুত এই তিন প্রকার মাত্রাস্বরূপ হইয়া অবস্থান করিতেছ এবং যাহা বিশেষরূপে অনুচার্য্য ও অর্দ্ধমাত্রারূপে অবস্থিত, তাহাও তুমি। তুমিই সেই (বেদ সারভূতা) সাবিত্রী; হে দেবি! তুমিই আদি জননী। তোমা কর্তৃকই সমস্ত জগৎ ধৃত এবং তোমা কর্তৃকই জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে। তোমা কর্তৃকই এই জগৎ পালিত হইতেছে এবং তুমিই অন্তে ইহা ভক্ষণ (ধ্বংস) করিয়া থাক। হে জগদ্রূপে! তুমিই এই জগতের নানাপ্রকার নির্মাণকার্যে সৃষ্টিরূপা ও পালনকার্যে স্থিতিরূপা এবং অন্তে ইহার সংহার কার্যে তদ্রূপ সংহাররূপা। [মার্কণ্ডেয় চণ্ডী, ১।৭২—৭৬] ↩︎