আজ নবমীপূজা, সোমবার, ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। এইমাত্র রাত্রি প্রভাত হইল। মা-কালীর মঙ্গল আরতি হইয়া গেল। নহবত হইতে রোশনচৌকি প্রভাতী রাগরাগিণী আলাপ করিতেছে। চাঙ্গারি হস্তে মালীরা ও সাজি হস্তে ব্রাহ্মণেরা পুষ্পচয়ন করিতে আসিতেছেন। মার পূজা হইবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ অতি প্রত্যূষে অন্ধকার থাকিতে থাকিতে উঠিয়াছেন। ভবনাথ, বাবুরাম, নিরঞ্জন ও মাস্টার গত রাত্রি হইতে রহিয়াছেন। তাঁহারা ঠাকুরের ঘরের বারান্দায় শুইয়াছিলেন। চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখেন ঠাকুর মাতোয়ারা হইয়া নৃত্য করিতেছেন। বলিতেছেন—জয় জয় দুর্গে! জয় জয় দুর্গে!—
ঠিক একটি বালক! কোমরে কাপড় নাই। মার নাম করিতে করিতে ঘরের মধ্যে নাচিয়া বেড়াইতেছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে আবার বলিতেছেন—সহজানন্দ, সহজানন্দ! শেষে গোবিন্দের নাম বারবার বলিতেছেন—
প্রাণ হে গোবিন্দ মম জীবন!
ভক্তেরা উঠিয়া বসিয়াছেন! একদৃষ্টে ঠাকুরের ভাব দেখিতেছেন। হাজরাও কালীবাড়িতে আছেন। ঠাকুরের ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় তাঁহার আসন। লাটুও আছেন ও তাঁহার সেবা করেন! রাখাল এ সময় বৃন্দাবনে। নরেন্দ্র মাঝে মাঝে আসিয়া দর্শন করেন। আজ নরেন্দ্র আসিবেন।
ঠাকুরের ঘরের উত্তরদিকের ছোট বারান্দাটিতে ভক্তেরা শুইয়াছিলেন। শীতকাল, তাই ঝাঁপ দেওয়া ছিল। সকলের মুখ ধোয়ার পরে এই উত্তর বারান্দাটিতে ঠাকুর আসিয়া একটি মাদুরে বসিলেন। ভবনাথ ও মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। অন্যান্য ভক্তেরাও মাঝে মাঝে আসিয়া বসিতেছেন।
[জীবকোটি সংশয়াত্মা (Sceptic)—ঈশ্বরকোটির স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাস]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভবনাথের প্রতি)—কি জানিস, যারা জীবকোটি, তাদের বিশ্বাস সহজে হয় না। ঈশ্বরকোটির বিশ্বাস স্বতঃসিদ্ধ। প্রহ্লাদ ‘ক’ লিখতে একেবারে কান্না—কৃষ্ণকে মনে পড়েছে! জীবের স্বভাব—সংশয়াত্মক বুদ্ধি! তারা বলে, হাঁ, বটে, কিন্তু—।
“হাজরা কোনরকমে বিশ্বাস করবে না যে, ব্রহ্ম ও শক্তি, শক্তি আর শক্তিমান অভেদ। যখন নিষ্ক্রিয় তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই; যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করেন, তখন শক্তি বলি। কিন্তু একই বস্তু; অভেদ। অগ্নি বললে, দাহিকাশক্তি অমনি বুঝায়; দাহিকাশক্তি বললে, অগ্নিকে মনে পড়ে। একটাকে ছেড়ে আর একটাকে চিন্তা করবার জো নাই।
“তখন প্রার্থনা করলুম, মা, হাজরা এখানকার মত উলটে দেবার চেষ্টা কচ্চে। হয় ওকে বুঝিয়ে দে, নয় এখান থেকে সরিয়ে দে। তার পরদিন, সে আবার এসে বললে, হাঁ মানি। তখন বলে যে, বিভু সব জায়গায় আছেন।”
ভবনাথ (সহাস্যে)—হাজরার এই কথাতে আপনার এত কষ্ট বোধ হয়েছিল?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার অবস্থা বদলে গেছে। এখন লোকের সঙ্গে হাঁকডাক করতে পারি না। হাজরার সঙ্গে যে তর্ক-ঝগড়া করব, এরকম অবস্থা আমার এখন নয়। যদু মল্লিকের বাগানে হৃদে১ বললে, মামা, আমাকে রাখবার কি তোমার ইচ্ছা নাই? আমি বললুম, না, সে অবস্থা এখন আমার নাই, এখন তোর সঙ্গে হাঁকডাক করবার জো নাই।১ হৃদয়ের তখন বাগানে আসিবার হুকুম ছিল না। কর্তৃপক্ষীয়েরা তাঁহার উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। হৃদয়ের ইচ্ছা যে, ঠাকুর বলিয়া কহিয়া আবার তাঁহাকে কর্মে নিযুক্ত করাইয়া দেন। হৃদয় ঠাকুরের খুব সেবা করিতেন; কিন্তু কটুবাক্যও বলিতেন। ঠাকুর অনেক সহ্য করিতেন, মাঝে মাঝে খুব তিরস্কার করিতেন।
[পূর্বকথা—কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণ—জগৎ চৈতন্যময়—বালকের বিশ্বাস]
“জ্ঞান আর অজ্ঞান কাকে বলে?—যতক্ষণ ঈশ্বর দূরে এই বোধ ততক্ষণ অজ্ঞান; যতক্ষণ হেথা হেথা বোধ, ততক্ষণ জ্ঞান।
“যখন ঠিক জ্ঞান হয়, তখন সব জিনিস চৈতন্যময় বোধ হয়। আমি শিবুর সঙ্গে আলাপ করতুম। শিবু তখন খুব ছেলেমানুষ—চার-পাঁচ বছরের হবে। ও-দেশে তখন আছি। মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ হচ্ছে। শিবু বলছে, খুড়ো ওই চকমকি ঝাড়ছে! (সকলের হাস্য) একদিন দেখি, সে একলা ফড়িং ধরতে যাচ্ছে। কাছে গাছে পাতা নড়ছিল। তখন পাতাকে বলছে, চুপ, চুপ, আমি ফড়িং ধরব। বালক সব চৈতন্যময় দেখছে! সরল বিশ্বাস, বালকের বিশ্বাস না হলে ভগবানকে পাওয়া যায় না। উঃ আমার কি অবস্থা ছিল! একদিন ঘাস বনেতে কি কামড়েছে। তা ভয় হল, যদি সাপে কামড়ে থাকে! তখন কি করি! শুনেছিলাম, আবার যদি কামড়ায়, তাহলে বিষ তুলে লয়। অমনি সেইখানে বসে গর্ত খুঁজতে লাগলুম, যাতে আবার কামড়ায়। ওইরকম কচ্চি, একজন বললে, কি কচ্ছেন? সব শুনে সে বললে, ঠিক ওইখানে কামড়ানো চাই, যেখানটিতে আগে কামড়েছে। তখন উঠে আসি। বোধ হয় বিছে-টিছে কামড়েছিল।
“আর-একদিন রামলালের কাছে শুনেছিলুম, শরতের হিম ভাল। কি একটা শ্লোক আছে, রামলাল বলেছিল। আমি কলকাতা থেকে গাড়ি করে আসবার সময় গলা বাড়িয়ে এলুম, যাতে সব হিমটুকু লাগে। তারপর অসুখ!” (সকলের হাস্য)
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ঔষধ]
এইবার ঠাকুর ঘরের ভিতর আসিয়া বসিলেন। তাঁর পা দুটি একটু ফুলো ফুলো হয়েছিল। ভক্তদের হাত দিয়ে দেখতে বললেন, আঙুল দিলে ডোব হয় কি না। একটু একটু ডোব হতে লাগল; কিন্তু সকলেই বলতে লাগলেন, ও কিছুই নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভবনাথকে)—তুই সিঁথির মহিন্দরকে ডেকে দিস। সে বললে তবে আমার মনটা ভাল হবে।
ভবনাথ (সহাস্যে)—আপনার ঔষধে খুব বিশ্বাস। আমাদের অত নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঔষধ তাঁরই। তিনিই একরূপে চিকিত্সক। গঙ্গাপ্রসাদ বললে, আপনি রাত্রে জল খাবেন না। আমি ওই কথা বেদবাক্য ধরে রেখেছি। আমি জানি, সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি।
৩৩.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্র, ভবনাথ প্রভৃতি মধ্যে সমাধিস্থ
হাজরা আসিয়া বসিলেন। এ-কথা ও-কথার পর ঠাকুর হাজরাকে বললেন, “দেখ, কাল রামের বাড়ি অতগুলি লোক বসেছিল, বিজয়, কেদার এরা, তবু নরেন্দ্রকে দেখে এত হল কেন? কেদার, আমি দেখেছি, কারণানন্দের ঘর।”
ঠাকুর পূর্বদিনে, মহাষ্টমীর দিনে কলিকাতায় প্রতিমাদর্শনে গিয়াছিলেন। অধরের বাড়ি প্রতিমাদর্শন করিতে যাওয়ার পূর্বে রামের বাড়ি হইয়া যান। সেখানে অনেকগুলি ভক্তের সমাবেশ হইয়াছিল। নরেন্দ্রকে দেখিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়াছিলেন। নরেন্দ্রের হাঁটুর উপর পা বাড়াইয়া দিয়াছিলেন, ও দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সমাধি হইয়াছিল।
দেখিতে দেখিতে নরেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত—ঠাকুরের আনন্দের আর সীমা রহিল না। নরেন্দ্র ঠাকুরকে প্রণামের পর ভবনাথাদির সঙ্গে ওই ঘরে একটু গল্প করিতেছেন। কাছে মাস্টার। ঘরের মধ্যে লম্বা মাদুর পাতা। নরেন্দ্র কথা কহিতে কহিতে উপুড় হইয়া মাদুরের উপর শুইয়া আছেন। হঠাৎ তাঁহাকে দেখিতে দেখিতে ঠাকুরের সমাধি হইল—তাঁহার পিঠের উপর গিয়া বসিলেন; সমাধিস্থ!
ভবনাথ গান গাইতেছেন :
গো আনন্দময়ী হয়ে মা আমায় নিরানন্দ করো না ।
ও দুটি চরণ, বিনা আমার মন, অন্য কিছু আর জানে না ॥
ঠাকুরের সমাধি ভঙ্গ হইল। ঠাকুর গাইতেছেন :
কখন কি রঙ্গে থাক মা।
ঠাকুর আবার গাইতেছেন :
বল রে শ্রীদুর্গা নাম।
(ওরে আমার আমার আমার মন রে) ।
নমো নমো নমো গৌরী, নমো নারায়ণী!
দুঃখী দাসে কর দয়া তবে গুণ জানি ॥
তুমি সন্ধ্যা, তুমি দিবা তুমি গো যামিনী ।
কখন পুরুষ হও মা, কখন কামিনী ॥
রামরূপে ধর ধনু মা, কৃষ্ণরূপে বাঁশী ।
ভুলালি শিবের মন মা হয়ে এলোকেশী ।
দশ মহাবিদ্যা তুমি মা, দশ অবতার ।
কোনরূপে এইবার আমারে কর মা পার ॥
যশোদা পূজিয়েছিল মা জবা বিল্বদলে ।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কৈলি কৃষ্ণ দিয়ে কোলে ॥
যেখানে সেখানে থাকি মা, থাকি গো কাননে ।
নিশিদিন মন থাকে যেন ও রাঙ্গাচরণে ॥
যেখানে সেখানে মরি মা, মরি গো বিপাকে ।
অন্তকালে জিহ্বা যেন মা, শ্রীদুর্গা বলে ডাকে ॥
যদি বল যাও যাও মা, যাব কার কাছে ।
সুধামাখা তারা নাম, মা আর কার আছে ॥
যদি বল ছাড় ছাড় মা, আমি না ছাড়িব ।
বাজন নূপুর হয়ে মা, তোর চরণে বাজিব ।
যখন বসিবে মাগো শিব সন্নিধানে ।—
জয় শিব জয় শিব বলে বাজিব চরণে ॥
চরণে লিখিতে নাম আঁচড় যদি যায় ।
ভূমিতে লিখিয়ে থুই নাম, পদ দে গো তায় ॥
শঙ্করী হইয়ে মাগো গগনে উড়িবে ।
মীন হয়ে রব জলে মা, নখে তুলে লবে ॥
নখাঘাতে ব্রহ্মময়ী যখন যাবে গো পরাণী ।
কৃপা করে দিও মা গো রাঙ্গা চরণ দুখানি ॥
পার কর ও মা কালী, কালের কামিনী ।
তরাবারে দুটি পদ করেছ তরণী ॥
তুমি স্বর্গ, তুমি মর্ত্য, তুমি গো পাতাল ।
তোমা হতে হরি ব্রহ্মা দ্বাদশ গোপাল ॥
গোলকে সর্বমঙ্গলা, ব্রজে কাত্যায়নী ।
কাশীতে মা অন্নপূর্ণা অনন্তরূপিণী ॥
দুর্গা দুর্গা দুর্গা বলে যেবা পথে চলে যায় ।
শূলহস্তে শূলপাণি রক্ষা করেন তায় ॥
৩৩.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ভবনাথ নরেন্দ্র প্রভৃতি মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি ও নৃত্য
হাজরা উত্তর-পূর্ব বারান্দায় বসিয়া হরিনামের মালা হাতে করিয়া জপ করিতেছেন। ঠাকুর সম্মুখে আসিয়া বসিলেন ও হাজরার জপের মালা হাতে লইলেন। মাস্টার ও ভবনাথ সঙ্গে। বেলা প্রায় দশটা হইবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি)—দেখ, আমার জপ হয় না;—না, না, হয়েছে!—বাঁ হাতে পারি, কিন্তু উদিক (নামজপ) হয় না!
এই বলিয়া ঠাকুর একটু জপ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু জপ আরম্ভ করিতে গিয়া একেবারে সমাধি!
ঠাকুর এই সমাধি অবস্থায় অনেকক্ষণ বসিয়া আছেন। হাতে মালা-গাছটি এখনও রহিয়াছে। ভক্তেরা অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন। হাজরা নিজের আসনে বসিয়া—তিনিও অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন। অনেকক্ষণ পরে হুঁশ হইল। ঠাকুর বলিয়া উঠিলেন, খিদে পেয়েছে। প্রকৃতিস্থ হইবার জন্য এই কথাগুলি সমাধির পর প্রায় বলেন।
মাস্টার খাবার আনিতে যাইতেছেন। ঠাকুর বলিয়া উঠিলেন, “না বাপু, আগে কালীঘরে যাব।”
[নবমীপূজা-দিবসে শ্রীরামকৃষ্ণের ৺কালীপূজা]
ঠাকুর পাকা উঠান দিয়া দক্ষিণাস্য হইয়া কালীঘরের দিকে যাইতেছেন। যাইতে যাইতে দ্বাদশ মন্দিরের শিবকে উদ্দেশ করিয়া প্রণাম করিলেন। বামপার্শ্বে রাধাকান্তের মন্দির। তাঁহাকে দর্শন করিয়া প্রণাম করিলেন। কালীঘরে গিয়া মাকে প্রণাম করিয়া আসনে বসিয়া মার পাদপদ্মে ফুল দিলেন, নিজের মাথায়ও ফুল দিলেন। চলিয়া আসিবার সময় ভবনাথকে বলিলেন, এইগুলি নিয়ে চল্—মার প্রসাদী ডাব আর শ্রীচরণামৃত। ঠাকুর ঘরে ফিরিয়া আসিলেন, সঙ্গে ভবনাথ ও মাস্টার। আসিয়াই, হাজরার সম্মুখে আসিয়া প্রণাম। হাজরা চিত্কার করিয়া উঠিলেন, বলিলেন, কি করেন, কি করেন!
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, তুমি বল, যে এ অন্যায়?
হাজরা তর্ক করিয়া প্রায় এই কথা বলিতেন, ঈশ্বর সকলের ভিতরেই আছেন, সাধনের দ্বারা সকলেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিতে পারে।
বেলা হইয়াছে। ভোগ আরতির ঘণ্টা বাজিয়া গেল। অতিথিশালায় ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, কাঙাল সকলে যাইতেছে। মার প্রসাদ, রাধাকান্তের প্রসাদ, সকলে পাইবে। ভক্তেরাও মার প্রসাদ পাইবেন। অতিথিশালায় ব্রাহ্মণ কর্মচারীরা যেখানে বসেন, সেইখানে ভক্তেরা বসিয়া প্রসাদ পাইবেন। ঠাকুর বলিলেন, সবাই গিয়ে ওখানে খা—কেমন? (নরেন্দ্রের প্রতি) না, তুই এখানে খাবি?—
“আচ্ছা, নরেন্দ্র আর আমি এইখানে খাব।”
ভবনাথ, বাবুরাম, মাস্টার ইত্যাদি সকলে প্রসাদ পাইতে গেলেন।
প্রসাদ পাওয়ার পর ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিলেন, কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। ভক্তেরা বারান্দায় বসিয়া গল্প করিতেছেন, সেইখানে আসিয়া বসিলেন ও তাঁহাদের সঙ্গে আনন্দ করিতে লাগিলেন। বেলা দুইটা। সকলে উত্তর-পূর্ব বারান্দায় আছেন। হঠাৎ ভবনাথ দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দা হইতে ব্রহ্মচারী বেশে আসিয়া উপস্থিত। গায়ে গৈরিকবস্ত্র, হাতে কমণ্ডলু, মুখে হাসি। ঠাকুর ও ভক্তেরা সকলে হাসিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ওর মনের ভাব ওই কিনা, তাই ওই সেজেছে।
নরেন্দ্র—ও ব্রহ্মচারী সেজেছে, আমি বামাচারী সাজি। (হাস্য)
হাজরা—তাতে পঞ্চ মকার, চক্র—এ-সব করতে হয়।
ঠাকুর বামাচারের কথায় চুপ করিয়া রহিলেন। ও কথায় সায় দিলেন না। কেবল রহস্য করিয়া উড়াইয়া দিলেন। হঠাৎ মাতোয়ারা হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন। গাহিতেছেন :
আর ভুলালে ভুলব না মা, দেখেছি তোমার রাঙা চরণ।
[পূর্বকথা—রাজনারায়ণের চণ্ডী—নকুড় আচার্যের গান]
ঠাকুর বলিতেছেন, আহা, রাজনারায়ণের চণ্ডীর গান কি চমত্কার! ওই রকম করে নেচে নেচে তারা গায়। আর ও-দেশে নকুড় আচার্যের গান। আহা, কি নৃত্য, কি গান!
পঞ্চবটীতে একটি সাধু আসিয়াছেন। বড় রাগী সাধু। যাকে তাকে গালাগাল দেন, শাপ দেন! তিনি খড়ম পায়ে দিয়ে এসে উপস্থিত।
সাধু বলিলেন, হিঁয়া আগ মিলে গা? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হাতজোড় করিয়া সাধুকে নমস্কার করিতেছেন এবং যতক্ষণ সে সাধুটি রহিলেন, ততক্ষণ হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন।
সাধুটি চলিয়া গেলে ভবনাথ হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, আপনার সাধুর উপর কি ভক্তি!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ওরে তমোমুখ নারায়ণ! যাদের তমোগুণ, তাদের এইরকম করে প্রসন্ন করতে হয়। এ যে সাধু!
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও গোলোকধাম খেলা—“ঠিক লোকের সর্বত্র জয়”]
গোলোকধাম খেলা হইতেছে। ভক্তেরা খেলিতেছেন, হাজরাও খেলিতেছেন। ঠাকুর আসিয়া দাঁড়াইলেন। মাস্টার ও কিশোরীর ঘুঁটি উঠিয়া গেল। ঠাকুর দুইজনকে নমস্কার করিলেন! বলিলেন, ধন্য তোমরা দু-ভাই। (মাস্টারকে একান্তে) আর খেলো না। ঠাকুর খেলা দেখিতেছেন, হাজরার ঘুঁটি একবার নরকে পড়িয়াছিল। ঠাকুর বলিতেছেন, হাজরার কি হল!—আবার!
অর্থাৎ হাজরার ঘুঁটি আবার নরকে পড়িয়াছে! এই সকলে হো-হো করিয়া হাসিতেছেন।
লাটুর ঘুঁটি সংসারের ঘর থেকে একেবারে সাতচিৎ মুক্তি! লাটু ধেই ধেই করিয়া নাচিতেছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, নোটোর যে আহ্লাদ—দেখ। ওর উটি না হলে মনে বড় কষ্ট হত। (ভক্তদের প্রতি একান্তে)—এর একটা মানে আছে। হাজরার বড় অহংকার যে, এতেও আমার জিত হবে। ঈশ্বরের এমনও আছে যে, ঠিক লোকের কখনও কোথাও তিনি অপমান করেন না। সকলের কাছেই জয়।
৩৩.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্র প্রভৃতিকে স্ত্রীলোক লইয়া সাধন নিষেধ, বামাচার নিন্দা
[পূর্বকথা—তীর্থদর্শন; কাশীতে ভৈরবী চক্র—ঠাকুরের সন্তানভাব]
ঘরে ছোট তক্তপোশটিতে ঠাকুর বসিয়াছেন। নরেন্দ্র, ভবনাথ, বাবুরাম, মাস্টার মেঝেতে বসিয়া আছেন। ঘোষপাড়া ও পঞ্চনামী এই সব মতের কথা নরেন্দ্র তুলিলেন। ঠাকুর তাহাদের বর্ণনা করিয়া নিন্দা করিতেছেন। বলিতেছেন, “ঠিক ঠিক সাধন করিতে পারে না, ধর্মের নাম করিয়া ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করে।
(নরেন্দ্রের প্রতি)—“তোর আর এ-সব শুনে কাজ নাই।
“ভৈরব, ভৈরবী, এদেরও ওইরকম। কাশীতে যখন আমি গেলুম, তখন একদিন ভৈরবীচক্রে আমায় নিয়ে গেল। একজন করে ভৈরব, একজন করে ভৈরবী। আমায় কারণ পান করতে বললে। আমি বললাম, মা, আমি কারণ ছুঁতে পারি না। তখন তারা খেতে লাগল। আমি মনে কল্লাম, এইবার বুঝি জপ-ধ্যান করবে। তা নয়, নৃত্য করতে আরম্ভ করলে! আমার ভয় হতে লাগল, পাছে গঙ্গায় পড়ে যায়। চক্রটি গঙ্গার ধারে হয়েছিল।
“স্বামী-স্ত্রী যদি ভৈরব-ভৈরবী হয়, তবে তাদের বড় মান।
(নরেন্দ্রাদি ভক্তের প্রতি)—“কি জান? আমার ভাব মাতৃভাব, সন্তানভাব। মাতৃভাব অতি শুদ্ধভাব, এতে কোন বিপদ নাই। ভগ্নীভাব, এও মন্দ নয়। স্ত্রীভাব—বীরভাব বড় কঠিন। তারকের বাপ ওইভাবে সাধন করত। বড় কঠিন। ঠিক ভাব রাখা যায় না।
“নানা পথ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছিবার। মত পথ। যেমন কালীঘরে যেতে নানা পথ দিয়ে যাওয়া যায়। তবে কোনও পথ শুদ্ধ, কোনও পথ নোংরা, শুদ্ধ পথ দিয়ে যাওয়াই ভাল।
“অনেক মত—অনেক পথ—দেখলাম। এ-সব আর ভাল লাগে না। পরস্পর সব বিবাদ করে। এখানে আর কেউ নাই; তোমরা আপনার লোক, তোমাদের বলছি, শেষ এই বুঝেছি, তিনি পূর্ণ আমি তাঁর অংশ; তিনি প্রভু ‘আমি’ তাঁর দাস; আবার এক-একবার ভাবি, তিনিই আমি আমিই তিনি!”
ভক্তেরা নিস্তব্ধ হইয়া এই কথাগুলি শুনিতেছেন।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মানুষের উপর ভালবাসা—Love of Mankind]
ভবনাথ (বিনীতভাবে)—লোকের সঙ্গে মনান্তর থাকলে, মন কেমন করে। তাহলে সকলকে তো ভালবাসতে পারলুম না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—প্রথমে একবার কথাবার্তা কইতে—তাদের সঙ্গে ভাব করতে—চেষ্টা করবে। চেষ্টা করেও যদি না হয়, তারপর আর ও-সব ভাববে না। তাঁর শরণাগত হও—তাঁর চিন্তা কর—তাঁকে ছেড়ে অন্য লোকের জন্য মন খারাপ করবার দরকার নাই।
ভবনাথ—ক্রাইষ্ট, চৈতন্য, এঁরা সব বলে গেছেন যে, সকলকে ভালবাসবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভাল তো বাসবে, সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন বলে। কিন্তু যেখানে দুষ্টলোক, সেখানে দূর থেকে প্রণাম করবে। কি, চৈতন্যদেব? তিনিও “বিজাতীয় লোক দেখে প্রভু করেন ভাব সংবরণ।” শ্রীবাসের বাড়িতে তাঁর শাশুড়ীকে চুল ধরে বার করা হয়েছিল।
ভবনাথ—সে অন্য লোক বার করেছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁর সম্মতি না থাকলে পারে?
“কি করা যায়? যদি অন্যের মন পাওয়া না গেল, তো রাতদিন কি ওই ভাবতে হবে? যে মন তাঁকে দেব, সে মন এদিক-ওদিক বাজে খরচ করব? আমি বলি, মা, আমি নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল কিছুই চাই না, কেবল তোমায় চাই! মানুষ নিয়ে কি করব?
“ঘরে আসবেন চণ্ডী, শুনব কত চণ্ডী,
কত আসবেন দণ্ডী যোগী জটাধারী!
“তাঁকে পেলে সবাইকে পাব। টাকা মাটি, মাটিই টাকা—সোনা মাটি, মাটিই সোনা—এই বলে ত্যাগ কল্লুম; গঙ্গার জলে ফেলে দিলুম। তখন ভয় হল যে, মা লক্ষ্মী যদি রাগ করেন। লক্ষ্মীর ঐশ্বর্য অবজ্ঞা কল্লুম। যদি খ্যাঁট বন্ধ করেন। তখন বললুম, মা তোমায় চাই, আর কিছু চাই না; তাঁকে পেলে তবে সব পাব।”
ভবনাথ (হাসিতে হাসিতে)—এ পাটোয়ারী!
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ, ওইটুকু পাটোয়ারী!
“ঠাকুর সাক্ষাত্কার হয়ে একজনকে বললেন, তোমার তপস্যা দেখে বড় প্রসন্ন হয়েছি। এখন একটি বর নাও। সাধক বললেন, ঠাকুর যদি বর দেবেন তো এই বর দিন, যেন সোনার থালে নাতির সঙ্গে বসে খাই। এক বরেতে অনেকগুলি হল। ঐশ্বর্য হল, ছেলে হল, নাতি হল!” (সকলের হাস্য)
৩৩.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ঈশ্বর অভিভাবক—শ্রীরামকৃষ্ণের মাতৃভক্তি—সংকীর্তনানন্দে
ভক্তেরা ঘরে বসিয়াছেন। হাজরা বারান্দাতেই বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাজরা কি চাইছে জান? কিছু টাকা চায়, বাড়িতে কষ্ট। দেনা কর্জ। তা, জপ-ধ্যান করে বলে, তিনি টাকা দেবেন!
একজন ভক্ত—তিনি কি বাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারেন না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁর ইচ্ছা! তবে প্রেমোন্মাদ না হলে তিনি সমস্ত ভার লন না। ছোট ছেলেকেই হাত ধরে খেতে বসিয়ে দেয়। বুড়োদের কে দেয়? তাঁর চিন্তা ক’রে যখন নিজের ভার নিজে নিতে পারে না, তখনই ঈশ্বর ভার লন।১
“নিজে বাড়ির খবর লবে না! হাজরার ছেলে রামলালের কাছে বলেছে ‘বাবাকে আসতে বলো; আমরা কিছু চাইবো না!’ আমার কথাগুলি শুনে কান্না পেল।”১ অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে ।তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্ ॥ [গীতা, ৯|২২]
[শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত—শ্রীবৃন্দাবন-দর্শন]
“হাজরার মা বলেছে রামলালকে, ‘প্রতাপকে একবার আসতে বলো, আর তোমার খুড়োমশায়কে আমার নাম করে বলো, যেন তিনি প্রতাপকে আসতে বলেন।’ আমি বললুম—তা শুনলে না।
“মা কি কম জিনিস গা? চৈতন্যদেব কত বুঝিয়ে তবে মার কাছ থেকে চলে আসতে পাল্লেন। শচী বলেছিল, কেশব ভারতীকে কাটব। চৈতন্যদেব অনেক করে বোঝালেন। বললেন, ‘মা, তুমি না অনুমতি দিলে আমি যাব না। তবে সংসারে যদি আমায় রাখ, আমার শরীর থাকবে না। আর মা, যখন তুমি মনে করবে, আমাকে দেখতে পাবে। আমি কাছেই থাকব, মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যাব।’ তবে শচী অনুমতি দিলেন।
“মা যতদিন ছিল, নারদ ততদিন তপস্যায় যেতে পারেননি। মার সেবা করতে হয়েছিল কিনা! মার দেহত্যাগ হলে তবে হরিসাধন করতে বেরুলেন।
“বৃন্দাবনে গিয়ে আর আমার ফিরে আসতে ইচ্ছা হল না। গঙ্গামার কাছে থাকবার কথা হল। সব ঠিকঠাক! এদিকে আমার বিছানা হবে, ওদিকে গঙ্গামার বিছানা হবে, আর কলকাতায় যাব না, কৈবর্তর ভাত আর কতদিন খাব? তখন হৃদে বললে, না তুমি কলকাতায় চল। সে একদিকে টানে, গঙ্গামা আর-একদিকে টানে। আমার খুব থাকবার ইচ্ছা। এমন সময়ে মাকে মনে পড়ল। অমনি সব বদলে গেল। মা বুড়ো হয়েছেন। ভাবলুম মার চিন্তা থাকলে ঈশ্বর-ফীশ্বর সব ঘুরে যাবে। তার চেয়ে তাঁর কাছে যাই। গিয়ে সেইখানে ঈশ্বরচিন্তা করব, নিশ্চিন্ত হয়ে।
(নরেন্দ্রের প্রতি)—“তুমি একটু তাকে বলো না। আমায় সেদিন বললে, হাঁ দেশে যাব, তিনদিন গিয়ে থাকব। তারপর যে সেই।
(ভক্তদের প্রতি)—“আজ ঘোষপাড়া-ফোষপাড়া কি সব কথা হল। গোবিন্দ, গোবিন্দ, গোবিন্দ! এখন হরিনাম একটু বল। কড়ার ডাল টড়ার ডালের পর পায়েস মুণ্ডি হয়ে যাক্।”
নরেন্দ্র গাহিতেছেন :
এক পুরাতন পুরুষ নিরঞ্জনে, চিত্ত সমাধান কর রে,
আদি সত্য তিনি কারণ-কারণ, প্রাণরূপে ব্যাপ্ত চরাচরে,
জীবন্ত জ্যোতির্ময়, সকলের আশ্রয়, দেখে সেই যে জন বিশ্বাস করে।
অতীন্দ্রিয় নিত্য চৈতন্যস্বরূপ, বিরাজিত হৃদিকন্দরে;
জ্ঞানপ্রেম পুণ্যে, ভূষিত নানাগুণে, যাহার চিন্তনে সন্তাপ হরে ।
অনন্ত গুণাধার প্রশান্ত-মূরতি, ধারণা করিতে কেহ নাহি পারে,
পদাশ্রিত জনে, দেখা দেন নিজ গুণে, দীন হীন ব’লে দয়া করে ।
চির ক্ষমাশীল কল্যাণদাতা, নিকট সহায় দুঃখসাগরে;
পরম ন্যায়বান্ করেন ফলদান, পাপপুণ্য কর্ম অনুসারে ।
প্রেমময় দয়াসিন্ধু, কৃপানিধি, শ্রবণে যাঁর গুণ আঁখি ঝরে,
তাঁর মুখ দেখি, সবে হও রে সুখী, তৃষিত মন প্রাণ যাঁর তরে ।
বিচিত্র শোভাময় নির্মল প্রকৃতি, বর্ণিতে সে অপরূপ বচন হারে;
ভজন সাধন তাঁর, কর হে নিরন্তর, চির ভিখারী হয়ে তাঁর দ্বারে।
(২)—চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে।
ঠাকুর নাচিতেছেন। বেড়িয়া বেড়িয়া নাচিতেছেন, সকলে কীর্তন করিতেছেন আর নাচিতেছেন। খুব আনন্দ। গান হইয়া গেলে ঠাকুর নিজে আবার গান ধরিলেন :
শিব সঙ্গে সদা রঙ্গে আনন্দে মগনা,
মাস্টার সঙ্গে গাহিয়াছিলেন দেখিয়া ঠাকুর বড় খুশি! গান হইয়া গেলে ঠাকুর মাস্টারকে সহাস্যে বলিতেছেন, বেশ খুলি হত, তাহলে আরও জমাট হত। তাক তাক তা ধিনা, দাক দাক দা ধিনা; এই সব বোল বাজবে!
কীর্তন হইতে হইতে সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে।