১৯.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে ভক্তসঙ্গে
রবিবার, ৯ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ; (২৪শে)অগ্রহায়ণ, শুক্লা দশমী তিথি, বেলা প্রায় একটা-দুইটা হইবে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ঘরে সেই ছোট খাটটিতে বসিয়া ভক্তদের সঙ্গে হরিকথা কহিতেছেন। অধর, মনোমোহন, ঠনঠনের শিবচন্দ্র, রাখাল, মাস্টার, হরিশ ইত্যাদি অনেকে বসিয়া আছেন, হাজরাও তখন ওইখানে থাকেন। ঠাকুর মহাপ্রভুর অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন।
[ভক্তিযোগ—সমাধিতত্ত্ব ও মহাপ্রভুর অবস্থা—হঠযোগ ও রাজযোগ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—চৈতন্যদেবের তিনটি অবস্থা হত—
১. বাহ্যদশা—তখন স্থূল আর সূক্ষ্মে তাঁর মন থাকত।
২. অর্ধবাহ্যদশা—তখন কারণ শরীরে, কারণানন্দে মন গিয়েছে।
৩. অর্ন্তদশা—তখন মহাকারণে মন লয় হত।
“বেদান্তের পঞ্চকোষের সঙ্গে, এর বেশ মিল আছে। স্থূলশরীর, অর্থাৎ অন্নময় ও প্রাণময় কোষ। সূক্ষ্মশরীর, অর্থাৎ মনোময় ও বিজ্ঞানময় কোষ। কারণ শরীর, অর্থাৎ আনন্দময় কোষ। মহাকারণ পঞ্চকোষের অতীত। মহাকারণে যখন মন লীন হত তখন সমাধিস্থ।—এরই নাম নির্বিকল্প বা জড়সমাধি।
“চৈতন্যদেবের যখন বাহ্যদশা হত তখন নামসংকীর্তন করতেন। অর্ধ-বাহ্যদশায় ভক্তসঙ্গে নৃত্য করতেন। অর্ন্তদশায় সমাধিস্থ হতেন।”
মাস্টার (স্বগত)—ঠাকুর কি নিজের সমস্ত অবস্থা এইরূপে ইঙ্গিত করছেন? চৈতন্যদেবেরও এইরূপ হত!
শ্রীরামকৃষ্ণ—চৈতন্য ভক্তির অবতার, জীবকে ভক্তি শিখাতে এসেছিলেন। তাঁর উপর ভক্তি হল তো সবই হল। হঠযোগের কিছু দরকার নাই।
একজন ভক্ত—আজ্ঞা, হঠযোগ কিরূপ?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হঠযোগে শরীরের উপর বেশি মনোযোগ দিতে হয়। ভিতর প্রক্ষালন করবে বলে বাঁশের নলে গুহ্যদ্বার রক্ষা করে। লিঙ্গ দিয়ে দুধ ঘি টানে। জিহ্বাসিদ্ধি অভ্যাস করে। আসন করে শূন্যে কখন কখন উঠে! ও-সব বায়ুর কার্য। একজন বাজি দেখাতে দেখাতে তালুর ভিতর জিহ্বা প্রবেশ করে দিয়েছিল। অমনি তার শরীর স্থির হয়ে গেল। লোকে মনে করলে, মরে গেছে। অনেক বত্সর সে গোর দেওয়া রহিল। বহুকালের পরে সেই গোর কোন সূত্রে ভেঙে গিয়েছিল! সেই লোকটার তখন হঠাৎ চৈতন্য হল। চৈতন্য হবার পরই, সে চেঁচাতে লাগল, লাগ্ ভেলকি, লাগ্ ভেলকি! (সকলের হাস্য) এ-সব বায়ুর কার্য।
“হঠযোগ বেদান্তবাদীরা মানে না।
“হঠযোগ আর রাজযোগ। রাজযোগে মনের দ্বারা যোগ হয়—ভক্তির দ্বারা, বিচারের দ্বারা যোগ হয়। ওই যোগই ভাল। হঠযোগ ভাল নয়, কলিতে অন্নগত প্রাণ!”
১৯.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ঠাকুরের তপস্যা—ঠাকুরের আত্মীয়গণ ও ভবিষ্যৎ মহাতীর্থ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নহবতের পার্শ্বে রাস্তায় দাঁড়াইয়া আছেন। দেখিতেছেন নহবতের বারান্দার একপার্শ্বে বসিয়া, বেড়ার আড়ালে মণি গভীর চিন্তানিমগ্ন। তিনি কি ঈশ্বরচিন্তা করিতেছেন? ঠাকুর ঝাউতলায় গিয়াছিলেন, মুখ ধুইয়া ওইখানে আসিয়া দাঁড়াইলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিগো, এইখানে বসে! তোমার শীঘ্র হবে। একটু করলেই কেউ বলবে, এই এই!
চকিত হইয়া তিনি ঠাকুরের দিকে তাকাইয়া আছেন। এখনও আসন ত্যাগ করেন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার সময় হয়েছে। পাখি ডিম ফুটোবার সময় না হলে ডিম ফুটোয় না। যে ঘর বলেছি, তোমার সেই ঘরই বটে।
এই বলিয়া ঠাকুর মণির ‘ঘর’ আবার বলিয়া দিলেন।
“সকলেরই যে বেশি তপস্যা করতে হয়, তা নয়। আমার কিন্তু বড় কষ্ট করতে হয়েছিল। মাটির ঢিপি মাথায় দিয়ে পড়ে থাকতাম। কোথা দিয়ে দিন চলে যেত। কেবল মা মা বলে ডাকতাম, কাঁদতাম।”
মণি ঠাকুরের কাছে প্রায় দুই বত্সর আসিতেছেন। তিনি ইংরেজী পড়েছেন। ঠাকুর তাঁহাকে কখন কখন ইংলিশম্যান বলতেন। কলেজে পড়াশুনা করেছেন। বিবাহ করেছেন।
তিনি কেশব ও অন্যান্য পণ্ডিতদের লেকচার শুনিতে, ইংরেজী দর্শন ও বিজ্ঞান পড়িতে ভালবাসেন। কিন্তু ঠাকুরের কাছে আসা অবধি, ইওরোপীয় পণ্ডিতদের গ্রন্থ ও ইংরেজী বা অন্য ভাষার লেকচার তাঁহার আলুনী বোধ হইয়াছে। এখন কেবল ঠাকুরকে রাতদিন দেখিতে ও তাঁহার শ্রীমুখের কথা শুনিতে ভালবাসেন।
আজকাল তিনি ঠাকুরের একটি কথা সর্বদা ভাবেন। ঠাকুর বলেছেন, “সাধন করলেই ঈশ্বরকে দেখা যায়,” আরও বলেছেন, “ঈশ্বরদর্শনই মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—একটু কল্লেই কেউ বলবে, এই এই। তুমি একাদশী করো। তোমরা আপনার লোক, আত্মীয়। তা না হলে এত আসবে কেন? কীর্তন শুনতে শুনতে রাখালকে দেখেছিলাম ব্রজমণ্ডলের ভিতর রয়েছে। নরেন্দ্রের খুব উঁচুঘর। আর হীরানন্দ। তার কেমন বালকের ভাব। তার ভাবটি কেমন মধুর। তাকেও দেখবার ইচ্ছা করে।
[পূর্বকথা—গৌরাঙ্গের সাঙ্গোপাঙ্গ—তুলসী কানন—সেজোবাবুর সেবা]
“গৌরাঙ্গের সাঙ্গোপাঙ্গ দেখেছিলাম। ভাবে নয়, এই চোখে! আগে এমন অবস্থা ছিল যে, সাদাচোখে সব দর্শন হত! এখন তো ভাবে হয়।
“সাদাচোখে গৌরাঙ্গের সাঙ্গোপাঙ্গ সব দেখেছিলাম। তারমধ্যে তোমায়ও যেন দেখেছিলাম। বলরামকেও যেন দেখেছিলাম।
“কারুকে দেখলে তড়াক করে উঠে দাঁড়াই কেন জান; আত্মীয়দের অনেক কাল পরে দেখলে ওইরূপ হয়।
“মাকে কেঁদে কেঁদে বলতাম, মা! ভক্তদের জন্যে আমার প্রাণ যায়, তাদের শীঘ্র আমায় এনে দে। যা যা মনে করতাম, তাই হত।
“পঞ্চবটীতে তুলসী কানন করেছিলাম, জপ-ধ্যান করব বলে। ব্যাঁকারির বেড়া দেবার জন্য বড় ইচ্ছা হল। তারপরেই দেখি জোয়ারে কতকগুলি ব্যাঁকারির আঁটি, খানিকটা দড়ি, ঠিক পঞ্চবটীর সামনে এসে পড়েছে! ঠাকুরবাড়ির একজন ভারী ছিল, সে নাচতে নাচতে এসে খবর দিলে।
“যখন এই অবস্থা হল, পূজা আর করতে পারলাম না। বললাম, মা, আমায় কে দেখবে? মা! আমার এমন শক্তি নাই যে, নিজের ভার নিজে লই। আর তোমার কথা শুনতে ইচ্ছা করে; ভক্তদের খাওয়াতে ইচ্ছা করে; কারুকে সামনে পড়লে কিছু দিতে ইচ্ছা করে। এ-সব মা, কেমন করে হয়। মা, তুমি একজন বড়মানুষ পেছনে দাও! তাইতো সেজোবাবু এত সেবা করলে।
“আবার বলেছিলাম, মা! আমার তো আর সন্তান হবে না, কিন্তু ইচ্ছা করে, একটি শুদ্ধ-ভক্ত ছেলে, আমার সঙ্গে সর্বদা থাকে। সেইরূপ একটি ছেলে আমায় দাও। তাই তো রাখাল হল। যারা যারা আত্মীয়, তারা কেউ অংশ, কেউ কলা।”
ঠাকুর আবার পঞ্চবটীর দিকে যাইতেছেন। মাস্টার সঙ্গে আছেন, আর কেহ নাই। ঠাকুর সহাস্যে তাঁহার সহিত নানা কথা কহিতেছেন।
[পূর্বকথা—অদ্ভুত মূর্তি দর্শন—বটগাছের ডাল]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—দেখ, একদিন দেখি—কালীঘর থেকে পঞ্চবটী পর্যন্ত এক অদ্ভুত মূর্তি। এ তোমার বিশ্বাস হয়?
মাস্টার অবাক্ হইয়া রহিলেন।
তিনি পঞ্চবটীর শাখা হইতে ২/১টি পাতা পকেটে রাখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এই ডাল পড়ে গেছে, দেখছ; এর নিচে বসতাম।
মাস্টার—আমি এর একটি কচি ডাল ভেঙে নিয়ে গেছি—বাড়িতে রেখে দিয়েছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কেন?
মাস্টার—দেখলে আহ্লাদ হয়। সব চুকে গেলে এই স্থান মহাতীর্থ হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—কিরকম তীর্থ? কি, পেনেটীর মতো?
পেনেটীতে মহাসমারোহ করিয়া রাঘব পণ্ডিতের মহোত্সব হয়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রায় প্রতি বত্সর এই মহোত্সব দেখিতে গিয়া থাকেন ও সংকীর্তন মধ্যে প্রেমানন্দে নৃত্য করেন, যেন শ্রীগৌরাঙ্গ ভক্তের ডাক শুনিয়া স্থির থাকিতে না পারিয়া, নিজে আসিয়া সংকীর্তন মধ্যে প্রেমমূর্তি দেখাইতেছেন।
১৯.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – হরিকথাপ্রসঙ্গে
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরের ছোট খাটটিতে বসিয়া মার চিন্তা করিতেছেন। ক্রমে ঠাকুরবাড়িতে ঠাকুরদের আরতি আরম্ভ হইল। শাঁকঘণ্টা বাজিতে লাগিল। মাস্টার আজ রাত্রে থাকিবেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে ঠাকুর মাস্টারকে “ভক্তমাল” পাঠ করিয়া শুনাইতে বলিলেন। মাস্টার পড়িতেছেন—
চরিত্র শ্রীমহারাজ শ্রীজয়মল
জয়মল নামে এক রাজা শুদ্ধমতি । অনির্বচনীয় তাঁর শ্রীকৃষ্ণ পিরীতি ॥
ভক্তি-অঙ্গ-যাজনে যে সুদৃঢ় নিয়ম । পাষাণের রেখা যেন নাহি বেশি কম ॥
শ্যামল সুন্দর নাম শ্রীবিগ্রহসেবা । তাহাতে প্রপন্ন, নাহি জানে দেবী দেবা ॥
দশদণ্ড-বেলা-বধি তাঁহার সেবায় । নিযুক্ত থাকয়ে সদা দৃঢ় নিয়ম হয় ॥
রাজ্যধন যায় কিবা বজ্রাঘাত হয় । তথাপিহ সেবা সমে ফিরি না তাকায় ॥
প্রতিযোগী রাজা ইহা সন্ধান জানিয়া । সেই অবকাশকালে আইল হানা দিয়া ॥
রাজার হুকুম বিনে সৈন্য-আদি-গণ । যুদ্ধ না করিতে পারে করে নিরীক্ষণ ॥
ক্রমে ক্রমে আসি গড় ঘেরে রিপুগণ । তথাপিহ তাহাতে কিঞ্চিৎ নাহি মন ॥
মাতা তাঁর আসি করে কত উচ্চধ্বনি । উদ্বিগ্ন হইয়া যে মাথায় কর হানি ॥
সর্বস্ব লইল আর সর্বনাশ হৈল । তথাপি তোমার কিছু ভুরুক্ষেপ নৈল ॥
জয়মল কহে মাতা কেন দুঃখভাব । যেই দিল সেই লবে তাহে কি করিব ॥
সেই যদি রাখে তবে কে লইতে পারে । অতএব আমা সবার উদ্যমে কি করে ॥
শ্যামলসুন্দর হেথা ঘোড়ায় চড়িয়া । যুদ্ধ করিবারে গেলা অস্তর ধরিয়া ॥
একাই ভক্তের রিপু সৈন্যগণ মারি । আসিয়া বান্ধিল ঘোড়া আপন তেওয়ারি ॥
সেবা সমাপনে রাজা নিকশিয়া দেখে । ঘোড়ার সর্বাঙ্গে ঘর্ম শ্বাস বহে নাকে ॥
জিজ্ঞাসয়ে মোর অশ্বে সওয়ার কে হৈল । ঠাকুর মন্দিরে বা কে আনি বান্ধিল ॥
সবে কহে কে চড়িল কে আনি বান্ধিল । আমরা যে নাহি জানি কখন আনিল ॥
সংশয় হইয়া রাজা ভাবিতে ভাবিতে । সৈন্যসামন্ত সহ চলিল যুদ্ধেতে ॥
যুদ্ধস্থানে গিয়া দেখে শত্তুরের সৈন্য। রণশয্যায় শুইয়াছে মাত্র এক ভিন্ন ॥
প্রধান যে রাজা এবে সেই মাত্র আছে । বিস্ময় হইয়া ঞিহ কারণ কি পুছে ॥
হেনকালে অই প্রতিযোগী যে রাজা । গলবস্ত্র হইয়া করিল বহু পূজা ॥
আসিয়া জয়মল মহারাজার অগ্রেতে । নিবেদন করে কিছু করি জোড়হাতে ॥
কি করিব যুদ্ধ তব এক যে সেপাই । পরম আশ্চর্য সে ত্রৈলোক্য-বিজয়ী ॥
অর্থ নাহি মাগোঁ মুঞি রাজ্য নাহি চাহোঁ । বরঞ্চ আমার রাজ্য চল দিব লহো ॥
শ্যামল সেপাই সেই লড়িতে আইল। তোমাসনে প্রীতি কি তার বিবরিয়া বল ॥
সৈন্য যে মারিল মোর তারে মুই পারি । দরশনমাত্রে মোর চিত্ত নিল হরি ॥
জয়মল বুঝিল এই শ্যামলজীর কর্ম । প্রতিযোগী রাজা যে বুঝিল ইহা মর্ম ॥
জয়মলের চরণ ধরিয়া স্তব করে। যাহার প্রসাদে কৃষ্ণকৃপা হৈল তারে ॥
তাঁহা-সবার শ্রীচরণে শরণ আমার । শ্যামল সেপাই যেন করে অঙ্গীকার ॥
পাঠান্তে ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।
[ভক্তমাল একঘেয়ে—অন্তরঙ্গ কে? জনক ও শুকদেব]
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার এ-সব বিশ্বাস হয়? তিনি সওয়ার হয়ে সেনা বিনাশ করেছিলেন—এ-সব বিশ্বাস হয়?
মাস্টার—ভক্ত, ব্যাকুল হয়ে ডেকেছিল—এ-অবস্থা বিশ্বাস হয়। ঠাকুরকে সওয়ার ঠিক দেখেছিল কিনা—এ-সব বুঝতে পারি না। তিনি সওয়ার হয়ে আসতে পারেন, তবে ওরা তাঁকে ঠিক দেখেছিল কিনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—বইখানিতে বেশ ভক্তদের কথা আছে। তবে একঘেয়ে যাদের অন্য মত, তাদের নিন্দা আছে।
পরদিন সকালে উদ্যানপথে দাঁড়াইয়া ঠাকুর কথা কহিতেছেন। মণি বলিতেছেন, আমি তাহলে এখানে এসে থাকব।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, এত যে তোমরা আস, এর মানে কি! সাধুকে লোকে একবার হদ্দ দেখে যায়। এত আস—এর মানে কি?
মণি অবাক্। ঠাকুর নিজেই প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—অন্তরঙ্গ না হলে কি আস। অন্তরঙ্গ মানে আত্মীয়, আপনার লোক—যেমন, বাপ, ছেলে, ভাই, ভগ্নী।
“সব কথা বলি না। তাহলে আর আসবে কেন?
“শুকদেব ব্রহ্মজ্ঞানের জন্য জনকের কাছে গিয়েছিল। জনক বললে, আগে দক্ষিণা দাও। শুকদেব বললে, আগে উপদেশ না পেলে কেমন করে দক্ষিণা হয়! জনক হাসতে হাসতে বললে, তোমার ব্রহ্মজ্ঞান হলে আর কি গুরু-শিষ্য বোধ থাকবে? তাই আগে দক্ষিণার কথা বললাম।”
১৯.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সেবক-হৃদয়ে
শুক্লপক্ষ। চাঁদ উঠিয়াছে। মণি কালীবাড়ির উদ্যানপথে পাদচারণ করিতেছেন। পথের একধারে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর, নহবতখানা, বকুলতলা ও পঞ্চবটী; অপরধারে ভাগীরথী জ্যোত্স্নাময়ী।
আপনা-আপনি কি বলিতেছেন।—“সত্য সত্যই কি ঈশ্বরদর্শন করা যায়? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তো বলিতেছেন। বললেন, একটু কিছু করলে কেউ এসে বলে দেবে, ‘এই এই’। অর্থাৎ একটু সাধনের কথা বললেন। আচ্ছা; বিবাহ, ছেলেপুলে হয়েছে, এতেও কি তাঁকে লাভ করা যায়? (একটু চিন্তার পর) অবশ্য করা যায়, তা না হলে ঠাকুর বলছেন কেন? তাঁর কৃপা হলে কেন না হবে?
“এই জগৎ সামনে—সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, জীব, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব। এ-সব কিরূপে হল, এর কর্তাই বা কে, আর আমিই বা তাঁর কে—এ না জানলে বৃথাই জীবন!
“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পুরুষের শ্রেষ্ঠ। এরূপ মহাপুরুষ এ-পর্যন্ত এ-জীবনে দেখি নাই। ইনি অবশ্যই সেই ঈশ্বরকে দেখেছেন। তা না হলে, মা মা করে কার সঙ্গে রাতদিন কথা কন! আর তা না হলে, ঈশ্বরের ওপর ওঁর এত ভালবাসা কেমন করে হল। এত ভালবাসা যে বাহ্যশূন্য হয়ে যান! সমাধিস্থ, জড়ের ন্যায় হয়ে যান। আবার কখন বা প্রেমে উন্মত্ত হয়ে হাসেন, কাঁদেন, নাচেন, গান!”
১৯.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – মণি, রামলাল, শ্যাম ডাক্তার, কাঁসারিপাড়ার ভক্তেরা
অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা ও সংক্রান্তি—শুক্রবার ১৪ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। বেলা প্রায় নয়টা হইবে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার ঘরের দ্বারের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় দাঁড়াইয়া আছেন। রামলাল কাছে দাঁড়াইয়া আছেন। রাখাল, লাটু নিকটে এদিক-ওদিকে ছিলেন। মণি আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন।
ঠাকুর বলিলেন, “এসেছো? তা আজ বেশ দিন।” তিনি ঠাকুরের কাছে কিছুদিন থাকিবেন, ‘সাধন’ করিবেন। ঠাকুর বলিয়াছেন, কিছু করিলেই কেউ বলে দেবে, “এই এই”।
ঠাকুর বলিয়া দিয়াছেন, এখানে অতিথিশালার অন্ন তোমার রোজ খাওয়া উচিত নয়। সাধু কাঙালের জন্য ও হয়েছে। তুমি তোমার রাঁধবার জন্য একটি লোক আনবে। তাই সঙ্গে একটি লোক এসেছে।
তাঁহার কোথায় রান্না হইবে? তিনি দুধ খাইবেন, ঠাকুর রামলালকে গোয়ালার কাছে বন্দোবস্ত করিয়া দিতে বলিলেন।
শ্রীযুক্ত রামলাল অধ্যাত্ম রামায়ণ পড়িতেছেন ও ঠাকুর শুনিতেছেন। মণিও বসিয়া শুনিতেছেন।
রামচন্দ্র সীতাকে বিবাহ করিয়া অযোধ্যায় আসিতেছেন। পথে পরশুরামের সহিত দেখা হইল। রাম হরধনু ভঙ্গ করিয়াছেন শুনিয়া পরশুরাম রাস্তায় বড় গোলমাল করিতে লাগিলেন। দশরথ ভয়ে আকুল। পরশুরাম আর একটা ধনু রামকে ছুঁড়িয়া মারিলেন। আর ওই ধনুতে জ্যা রোপণ করিতে বলিলেন। রাম ঈষৎ হাস্য করিয়া বামহস্তে ধনু গ্রহণ করিলেন ও জ্যা রোপণ করিয়া টঙ্কার করিলেন! ধনুকে বাণ যোজনা করিয়া পরশুরামকে বলিলেন, এখন এ-বাণ কোথায় ত্যাগ করব বল। পরশুরামের দর্প চূর্ণ হইল। তিনি শ্রীরামকে পরমব্রহ্ম বলে স্তব করিতে লাগিলেন।
পরশুরামের স্তব শুনিতে শুনিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট! মাঝে মাঝে “রাম রাম” এই নাম মধুরকণ্ঠে উচ্চারণ করিতেছেন। ★★★
শ্রীরামকৃষ্ণ (রামলালকে)—একটু গুহক চণ্ডালের কথা বল দেখি!
রামচন্দ্র যখন “পিতৃসত্যের কারণ” বনে গিয়াছিলেন, গুহকরাজ চমকিত হইয়াছিলেন। রামলাল ভক্তমাল পড়িতেছেন—
নয়নে গলয়ে ধারা মনে উতরোল । চমকি চাহিয়া রহে নাহি আইসে বোল ॥
নিমিখ নাহিক পড়ে চাহিয়া রহিল । কাষ্ঠের পুতুলি প্রায় অস্পন্দ হইল ॥
তারপর ধীরে ধীরে রামের কাছে গিয়া বলিলেন, আমার ঘরে এস। রামচন্দ্র তাঁকে মিতা বলে আলিঙ্গন করিলেন। গুহ তখন তাঁহাকে আত্মসমর্পণ করিতেছেন—
গুহ বলে ভাল ভাল তুমি মোর মিতে । তোমাতে সঁপিনু দেহ পরাণ সহিতে ॥
তুমি মোর সরবস প্রাণ ধন রাজ্য । তুমি মোর ভক্তি, মুক্তি, তুমি শুভকার্য ॥
আমি মর্যা যাই তব বালায়ের সনে । দেহ সমর্পিণু মিতা তোমার চরণে ॥
রামচন্দ্র চৌদ্দবত্সর বনে থাকিবেন ও জটাবল্কল ধারণ করিবেন শুনিয়া গুহও জটা বল্কল ধারণ করিয়া রহিলেন ও ফলমূল ছাড়া অন্য কিছু আহার করিলেন না। চৌদ্দবত্সরান্তে রাম আসিতেছেন না দেখিয়া, গুহ অগ্নি প্রবেশ করিতে যাইতেছেন, এমন সময় হনুমান আসিয়া সংবাদ দিলেন। সংবাদ পাইয়া গুহ মহানন্দে ভাসিতেছেন। রামচন্দ্র ও সীতা পুষ্পক রথে করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
দয়াল পরমানন্দ,প্রেমাধীন রামচন্দ্র, ভক্তবত্সল গুণধাম ।
প্রিয় ভক্তরাজ গুহ, হেরিয়া পুলক দেহ, হৃদয়ে লইয়া প্রিয়তম ॥
গাঢ় আলিঙ্গনে দোঁহে, প্রভু ভৃত্যে লাগি রহে,
অশ্রুজলে দোঁহা অঙ্গ ভিজে ॥
ধন্য গুহ মহাশয়, চারিদিকে জয় জয়,
কোলাহল হল ক্ষিতি মাঝে ॥
[কেশব সেনের যদৃচ্ছালাভ—উপায়—তীব্র বৈরাগ্য ও সংসারত্যাগ]
আহারান্তে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একটু বিশ্রাম করিতেছেন। মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। এমন সময় শ্যাম ডাক্তার ও আরও কয়েকটি লোক আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উঠিয়া বসিলেন ও কথা কহিতে লাগিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কর্ম যে বরাবরই করতে হয়, তা নয়। ঈশ্বরলাভ হলে আর কর্ম থাকে না। ফল হলে ফুল আপনিই ঝরে যায়।
“যার লাভ হয়, তার সন্ধ্যাদি কর্ম থাকে না। সন্ধ্যা গায়ত্রীতে লীন হয়। তখন গায়ত্রী জপলেই হয়। আর গায়ত্রী ওঁকারে লয় হয়। তখন গায়ত্রীও বলতে হয় না। তখন শুধু ‘ওঁ’ বললেই হয়। সন্ধ্যাদি কর্ম কতদিন? যতদিন হরিনামে কি রামনামে পুলক না হয়, আর ধারা না পড়ে। টাকা-কড়ির জন্য, কি মোকদ্দমা জিত হবে বলে, পূজাদি কর্ম—ও-সব ভাল না।”
একজন ভক্ত—টাকা-কড়ির চেষ্টা তো সকলেই করছে দেখছি। কেশব সেন কেমন রাজার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেশবের আলাদা কথা। যে ঠিক ভক্ত সে চেষ্টা না করলেও ঈশ্বর তার সব জুটিয়ে দেন। যে ঠিক রাজার বেটা, সে মুসোহারা পায়। উকিল-ফুকিলের কথা বলছি না,—যারা কষ্ট করে, লোকের দাসত্ব করে টাকা আনে। আমি বলছি, ঠিক রাজার বেটা। যার কোন কামনা নাই সে টাকা-কড়ি চায় না, টাকা আপনি আসে। গীতায় আছে—যদৃচ্ছালাভ।
“সদ্ব্রাক্ষণ, যার কোন কামনা নাই, সে হাড়ির বাড়ির সিধে নিতে পারে। ‘যদৃচ্ছালাভ’। সে চায় না, কিন্তু আপনি আসে।”
একজন ভক্ত—আজ্ঞা, সংসারে কিরকম করে থাকতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—পাঁকাল মাছের মতো থাকবে। সংসার থেকে তফাতে গিয়ে নির্জনে ঈশ্বরচিন্তা মাঝে মাঝে করলে, তাঁতে ভক্তি জন্মে। তখন নির্লিপ্ত হয়ে থাকতে পারবে। পাঁক আছে, পাঁকের ভিতর থাকতে হয়, তবু গায়ে পাঁক লাগে না। সে লোক অনাসক্ত হয়ে সংসারে থাকে।
ঠাকুর দেখিতেছেন, মণি বসিয়া একমনে সমস্ত শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণিদৃষ্টে)—তীব্র বৈরাগ্য হলে তবে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। যার তীব্র বৈরাগ্য হয়, তার বোধ হয়, সংসার দাবানল! জ্বলছে! মাগছেলেকে দেখে যেন পাতকুয়া! সেরকম বৈরাগ্য যদি ঠিক ঠিক হয়, তাহলে বাড়ি ত্যাগ হয়ে পড়ে। শুধু অনাসক্ত হয়ে থাকা নয়। কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। মায়াকে যদি চিনতে পার, আপনি লজ্জায় পালাবে। একজন বাঘের ছাল পরে ভয় দেখাচ্ছে। যাকে ভয় দেখাচ্ছে সে বললে, আমি তোকে চিনেছি—তুই আমাদের ‘হরে’। তখন সে হেসে চলে গেল—আর-একজনকে ভয় দেখাতে গেল।
“যত স্ত্রীলোক, সকলে শক্তিরূপা। সেই আদ্যাশক্তিই স্ত্রী হয়ে, স্ত্রীরূপ ধরে রয়েছেন। অধ্যাত্মে আছে রামকে নারদাদি স্তব করছেন, হে রাম, যত পুরুষ সব তুমি; আর প্রকৃতির যত রূপ সীতা ধারণ করেছেন। তুমি ইন্দ্র, সীতা ইন্দ্রাণী; তুমি শিব, সীতা শিবানী; তুমি নর, সীতা নারী! বেশি আর কি বলব—যেখানে পুরুষ, সেখানে তুমি; যেখানে স্ত্রী, সেখানে সীতা।”
[ত্যাগ ও প্রারব্ধ—বামাচার সাধন ঠাকুরের নিষেধ]
(ভক্তদের প্রতি)—“মনে করলেই ত্যাগ করা যায় না। প্রারব্ধ, সংস্কার—এ-সব আবার আছে। একজন রাজাকে একজন যোগী বললে, তুমি আমার কাছে বসে থেকে ভগবানের চিন্তা কর। রাজা বললে, সে বড় হবে না; আমি থাকতে পারি; কিন্তু আমার এখনও ভোগ আছে। এ-বনে যদি থাকি, হয়তো বনেতে একটা রাজ্য হয়ে যাবে! আমার এখনও ভোগ আছে।
“নটবর পাঁজা যখন ছেলেমানুষ, এই বাগানে গরু চরাত। তার কিন্তু অনেক ভোগ ছিল। তাই এখন রেড়ির কল করে অনেক টাকা করেছে। আলমবাজারে রেড়ির কলের ব্যবসা খুব ফেঁদেছে।
“এক মতে আছে, মেয়েমানুষ নিয়ে সাধন করা। কর্তাভজা মাগীদের ভিতর আমায় একবার নিয়ে গিছিল। সব আমার কাছে এসে বসল। আমি তাদের মা, মা বলাতে পরস্পর বলাবলি করতে লাগল, ইনি প্রবর্তক, এখনও ঘাট চিনেন নাই! ওদের মতে কাঁচা অবস্থাকে বলে প্রবর্তক, তারপরে সাধক, তারপর সিদ্ধের সিদ্ধ।
“একজন মেয়ে বৈষ্ণবচরণের কাছে গিয়ে বসল। বৈষ্ণবচরণকে জিজ্ঞাসা করাতে বললে, এর বালিকাভাব!
“স্ত্রীভাবে শীঘ্র পতন হয়। মাতৃভাব শুদ্ধভাব।”
কাঁসারিপাড়ার ভক্তেরা গাত্রোত্থান করিলেন; ও বলিলেন, তবে আমরা আসি; মা-কালীকে, আর আর ঠাকুরকে দর্শন করব।
১৯.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও প্রতিমাপূজা—ব্যাকুলতা ও ঈশ্বরলাভ
মণি পঞ্চবটী ও কালীবাড়ির অন্যান্য স্থানে একাকী বিচরণ করিতেছেন। ঠাকুর বলিয়াছেন, একটু সাধন করিলে ঈশ্বরদর্শন করা যায়। মণি কি তাই ভাবিতেছেন?
আর তীব্র বৈরাগ্যের কথা। আর “মায়াকে চিনলে আপনি পালিয়ে যায়?” বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে মণি আবার বসিয়া আছেন। ব্রাউটন্ ইন্স্টিটিউশন হইতে একটি শিক্ষক কয়েকটি ছাত্র লইয়া ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন। ঠাকুর তাঁহাদের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। শিক্ষকটি মাঝে মাঝে এক-একটি প্রশ্ন করিতেছেন। প্রতিমাপূজা সম্বন্ধে কথা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শিক্ষকের প্রতি)—প্রতিমাপূজাতে দোষ কি? বেদান্তে বলে, যেখানে “অস্তি, ভাতি আর প্রিয়”, সেইখানেই তাঁর প্রকাশ। তাই তিনি ছাড়া কোন জিনিসই নাই।
“আবার দেখ, ছোট মেয়েরা পুতুল খেলা কতদিন করে? যতদিন না বিবাহ হয়, আর যতদিন না স্বামী সহবাস করে। বিবাহ হলে পুতুলগুলি পেটরায় তুলে ফেলে। ঈশ্বরলাভ হলে আর প্রতিমাপূজার কি দরকার?”
মণির দিকে চাহিয়া বলিতেছেন—
“অনুরাগ হলে ঈশ্বরলাভ হয়। খুব ব্যাকুলতা চাই। খুব ব্যাকুলতা হলে সমস্ত মন তাঁতে গত হয়।”
[বালকের বিশ্বাস ও ঈশ্বরলাভ—গোবিন্দস্বামী—জটিলবালক]
“একজনের একটি মেয়ে ছিল। খুব অল্পবয়সে মেয়েটি বিধবা হয়ে গিছিল। স্বামীর মুখ কখনও দেখে নাই। অন্য মেয়ের স্বামী আসে দেখে। সে একদিন বললে, বাবা, আমার স্বামী কই? তার বাবা বললে, গোবিন্দ তোমার স্বামী, তাঁকে ডাকলে তিনি দেখা দেন। মেয়েটি ওই কথা শুনে ঘরে দ্বার দিয়ে গোবিন্দকে ডাকে আর কাঁদে;—বলে, গোবিন্দ! তুমি এস, আমাকে দেখা দাও, তুমি কেন আসছো না। ছোট মেয়েটির সেই কান্না শুনে ঠাকুর থাকতে পারলেন না, তাকে দেখা দিলেন।
“বালকের মতো বিশ্বাস! বালক মাকে দেখবার জন্য যেমন ব্যাকুল হয়, সেই ব্যাকুলতা। এই ব্যাকুলতা হল তো অরুণ উদয় হল। তারপর সূর্য উঠবেই। এই ব্যাকুলতার পরেই ঈশ্বরদর্শন।
“জটিল বালকের কথা আছে। সে পাঠশালে যেত। একটু বনের পথ দিয়ে পাঠশালে যেতে হত, তাই সে ভয় পেত। মাকে বলাতে মা বললে, তোর ভয় কি? তুই মধুসূদনকে ডাকবি। ছেলেটি জিজ্ঞাসা করলে, মধুসূদন কে? মা বললে, মধুসূদন তোর দাদা হয়। তখন একলা যেতে যেতে যাই ভয় পেয়েছে, অমনি ডেকেছে, ‘দাদা মধুসূদন’। কেউ কোথাও নাই। তখন উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লাগল, ‘কোথায় দাদা মধুসূদন,তুমি এসো, আমার বড় ভয় পেয়েছে।’ ঠাকুর তখন থাকতে পারলেন না। এসে বললেন, ‘এই যে আমি, তোর ভয় কি?’ এই বলে সঙ্গে করে পাঠশালার রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছিয়া দিলেন, আর বললেন, ‘তুই যখন ডাকবি, আমি আসব। ভয় কি?’ এই বালকের বিশ্বাস! এই ব্যাকুলতা!
“একটি ব্রাহ্মণের বাড়িতে ঠাকুরের সেবা ছিল। একদিন কোন কাজ উপলক্ষে তার অন্যস্থানে যেতে হয়েছিল। ছোট ছেলেটিকে বলে গেল তুই আজ ঠাকুরের ভোগ দিস, ঠাকুরকে খাওয়াবি। ছেলেটি ঠাকুরকে ভোগ দিল। ঠাকুর কিন্তু চুপ করে বসে আছেন। কথাও কন না, খানও না। ছেলেটি অনেকক্ষণ বসে বসে দেখলে যে, ঠাকুর উঠছেন না! সে ঠিক জানে যে, ঠাকুর এসে আসনে বসে খাবেন। তখন সে বারবার বলতে লাগল, ঠাকুর, এসে খাও, অনেক দেরি হল; আর আমি বসতে পারি না। ঠাকুর কথা কন না। ছেলেটি কান্না আরম্ভ করলে। বলতে লাগল, ঠাকুর, বাবা তোমাকে খাওয়াতে বলে গেছেন; তুমি কেন আসবে না, কেন আমার কাছে খাবে না? ব্যাকুল হয়ে যাই খানিকক্ষণ কেঁদেছে, ঠাকুর হাসতে হাসতে এসে আসনে বসে খেতে লাগলেন! ঠাকুরকে খাইয়ে যখন ঠাকুরঘর থেকে সে গেল, বাড়ির লোকেরা বললে, ভোগ হয়ে গেছে; সে-সব নামিয়ে আন। ছেলেটি বললে, হাঁ হয়ে গেছে; ঠাকুর সব খেয়ে গেছেন। তারা বললে, সে কি রে! ছেলেটি সরল বুদ্ধিতে বললে, কেন, ঠাকুর তো খেয়ে গেছেন। তখন ঠাকুরঘরে গিয়ে দেখে সকলে অবাক্!”
সন্ধ্যা হইতে দেরি আছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নহবতখানার দক্ষিণ পার্শ্বে দাঁড়াইয়া মণির সহিত কথা কহিতেছেন। সম্মুখে গঙ্গা। শীতকাল, ঠাকুরের গায়ে গরম কাপড়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—পঞ্চবটীর ঘরে শোবে?
মণি—নহবতখানার উপরের ঘরটি কি দেবে না?
ঠাকুর খাজাঞ্চীকে মণির কথা বলিবেন। থাকবার ঘর একটি নির্দিষ্ট করে দিবেন। তার নহবতের উপরের ঘর পছন্দ হয়েছে। তিনি কবিত্বপ্রিয়। নহবত থেকে আকাশ, গঙ্গা, চাঁদের আলো, ফুলগাছ—এ-সব দেখা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেবে না কেন? তবে পঞ্চবটীর ঘর বলছি এই জন্য ওখানে অনেক হরিনাম, ঈশ্বরচিন্তা হয়েছে।
১৯.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – ‘প্রয়োজন’ (END OF LIFE) ঈশ্বরকে ভালবাসা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে ধুনা দেওয়া হইল। ছোট খাটটিতে বসিয়া ঠাকুর ঈশ্বরচিন্তা করিতেছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন। রাখাল, লাটু, রামলাল ইহারাও ঘরে আছেন।
ঠাকুর মণিকে বলিতেছেন, কথাটা এই—তাঁকে ভক্তি করা, তাঁকে ভালবাসা। রামলালকে গাইতে বলিলেন। তিনি মধুর কণ্ঠে গাইতেছেন। ঠাকুর এক-একটি গান ধরাইয়া দিতেছেন।
ঠাকুর বলাতে রামলাল প্রথমে শ্রীগৌরাঙ্গের সন্ন্যাস গাইতেছেন :
কি দেখিলাম রে,কেশব ভারতীর কুটিরে,
অপরূপ জ্যোতিঃ, শ্রীগৌরাঙ্গ মূরতি, দুনয়নে প্রেম বহে শতধারে ।
গৌর মত্তমাতঙ্গের প্রায়, প্রেমাবেশে নাচে গায়,
কভু ধরাতে লুটায়, নয়নজলে ভাসে রে,
কাঁদে আর বলে হরি, স্বর্গমর্ত্য ভেদ করি, সিংহরবে রে,
আবার দন্তে তৃণ লয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে,
দাস্য মুক্তি যাচেন বারে বারে ॥
মুড়ায়ে চাঁচর কেশ, ধরেছেন যোগীর বেশ,
দেখে ভক্তি প্রেমাবেশ, প্রাণ কেঁদে উঠে রে ।
জীবের দুঃখে কাতর হয়ে,
এলেন সর্বস্ব ত্যজিয়ে, প্রেম বিলাতে রে;
প্রেমদাসের বাঞ্ছা মনে, শ্রীচৈতন্যচরণে,
দাস হয়ে বেড়াই দ্বারে দ্বারে ॥
রামলাল পরে গাইলেন, শচী কেঁদে বলছেন, ‘নিমাই! কেমন করে তোকে ছেড়ে থাকব?’ ঠাকুর বলিলেন, সেই গানটি গা তো।
(১)—আমি মুক্তি দিতে কাতর নই
(২)—রাধার দেখা কি পায় সকলে,
রাধার প্রেম কি পায় সকলে ।
অতি সুদুর্লভ ধন, না করলে আরাধন,
সাধন বিনে সে-ধন, এ-ধনে কি মেলে
তুলারাশিমাসে তিথি অমাবস্যা,
স্বাতী নক্ষত্রে যে বারি বরিষে,
অন্য অন্য মাসে যে বারি বরিষে,
সে বারি কি বরিষে বরিষার জলে ।
যুবতী সকলে শিশু লয়ে কোলে,
আয় চাঁদ বলে ডাকে বাহু তুলে ।
শিশু তাহে ভুলে, চন্দ্র কি তায় ভুলে,
গগন ছেড়ে চাঁদ কি উদয় হয় ভূতলে ।
(৩)—নবনীরদবরণ কিসে গণ্য শ্যামচাঁদ রূপ হেরে ।
ঠাকুর রামলালকে আবার বলিতেছেন, সেই গানটি গা—গৌর নিতাই তোমরা দুভাই। রামলালের সঙ্গে ঠাকুরও যোগ দিতেছেন—
গৌর নিতাই তোমরা দুভাই, পরম দয়াল হে প্রভু
(আমি তাই শুনে এসেছি হে নাথ)
আমি গিয়েছিলাম কাশীপুরে, আমায় কয়ে দিলেন কাশী বিশ্বেশ্বরে, ও সে পরব্রহ্ম শচীর ঘরে, (আমি চিনেছি হে, পরব্রহ্ম) ।
আমি গিয়েছিলাম অনেক ঠাঁই, কিন্তু এমন দয়াল দেখি নাই । (তোমাদের মতো) ।
তোমরা ব্রজে ছিলে কানাই, বলাই, এখন নদে এসে হলে গৌর নিতাই । (সেরূপ লুকায়ে) ।
ব্রজের খেলা ছিল দৌড়াদৌড়ি, এখন নদের খেলা ধূলায় গড়াগড়ি ।
(হরিবোল বলে হে) (প্রেমে মত্ত হয়ে) ।
ছিল ব্রজের খেলা উচ্চরোল, আজ নদের খেলা কেবল হরিবোল
(ওহে প্রাণ গৌর)
তোমার সকল অঙ্গ গেছে ঢাকা, কেবল আছে দুটি নয়ন বাঁকা ।
(ওহে দয়াল গৌর) ।
তোমার পতিতপাবন নাম শুনে, বড় ভরসা পেয়েছি মনে ।
(ওহে পতিতপাবন) ।
বড় আশা করে এলাম ধেয়ে, আমায় রাখ চরণ ছায়া দিয়ে ।
(ওহে দয়াল গৌর) ।
জগাই মাধাই তরে গেছে, প্রভু সেই ভরসা আমার আছে ।
(ওহে অধমতারণ) ।
তোমরা নাকি আচণ্ডালে দাও কোল, কোল দিয়ে বল হরিবোল!
(ওহে পরম করুণ) (ও কাঙালের ঠাকুর) ।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তদের গোপনে সাধন]
নহবতখানার উপরের ঘরে মণি একাকী বসিয়া আছেন। অনেক রাত্রি হইয়াছে। আজ অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা। আকাশ, গঙ্গা, কালীবাড়ি, মন্দিরশীর্ষ, উদ্যানপথ, পঞ্চবটী চাঁদের আলোতে ভাসিয়াছে! মণি একাকী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে চিন্তা করিতেছেন।
রাত প্রায় তিনটা হইল,তিনি উঠিলেন। উত্তরাস্য হইয়া পঞ্চবটীর অভিমুখে যাইতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীর কথা বলিয়াছেন। আর নহবতখানা ভাল লাগিতেছে না। তিনি পঞ্চবটীর ঘরে থাকিবেন, স্থির করিলেন।
চতুর্দিক নীরব। রাত এগারটার সময় জোয়ার আসিয়াছে। এক-একবার জলের শব্দ শুনা যাইতেছে। তিনি পঞ্চবটীর দিকে অগ্রসর হইতেছেন!—দূর হইতে একটি শব্দ শুনিতে পাইলেন। কে যেন পঞ্চবটীর বৃক্ষমণ্ডপের ভিতর হইতে আর্তনাদ করিয়া ডাকিতেছেন, কোথায় দাদা মধুসূদন!
আজ পূর্ণিমা। চতুর্দিকে বটবৃক্ষের শাখাপ্রশাখার মধ্য দিয়া চাঁদের আলো ফাটিয়া পড়িতেছে।
আরও অগ্রসর হইলেন। একটু দূর হইতে দেখিলেন পঞ্চবটীমধ্যে ঠাকুরের একটি ভক্ত বসিয়া আছেন! তিনিই নির্জনে একাকী ডাকিতেছেন, কোথায় দাদা মধুসূদন! মণি নিঃশব্দে দেখিতেছেন।
১৯.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে গুরুরূপী শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তরঙ্গসঙ্গে
[প্রহ্লাদচরিত্র শ্রবণ ও ভাবাবেশ—যোষিত্সঙ্গ নিন্দা]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে মেঝেতে বসিয়া প্রহ্লাদ চরিত্র শুনিতেছেন। বেলা ৮টা হইবে। শ্রীযুক্ত রামলাল ভক্তমাল গ্রন্থ হইতে প্রহ্লাদচরিত্র পড়িতেছেন।
আজ শনিবার, (১লা পৌষ) অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা প্রতিপদ; ১৫ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। মণি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার পদছায়ায় বাস করিতেছেন;—তিনি ঠাকুরের কাছে বসিয়া প্রহ্লাদচরিত্র শুনিতেছেন। ঘরে শ্রীযুক্ত রাখাল, লাটু, হরিশ; কেহ বসিয়া শুনিতেছেন,—কেহ যাতায়াত করিতেছেন। হাজরা বারান্দায় আছেন।
ঠাকুর প্রহ্লাদচরিত্র কথা শুনিতে শুনিতে ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। যখন হিরণ্যকশিপু বধ হইল, নৃসিংহের রুদ্রমূর্তি দেখিয়া ও সিংহনাদ শুনিয়া ব্রহ্মাদি দেবতারা প্রলয়াশঙ্কায় প্রহ্লাদকেই নৃসিংহের কাছে পাঠাইয়া দিলেন। প্রহ্লাদ বালকের ন্যায় স্তব করিতেছেন। ভক্তবত্সল স্নেহে প্রহ্লাদের গা চাটিতেছেন। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন, “আহা! আহা! ভক্তের উপর কি ভালবাসা!” বলিতে বলিতে ঠাকুরের ভাবসমাধি হইল! স্পন্দহীন,—চক্ষের কোণে প্রেমাশ্রু!
ভাব উপশমের পর ঠাকুর ছোট খাটখানিতে গিয়া বসিয়াছেন। মণি মেঝের উপর তাঁহার পাদমূলে বসিলেন। ঠাকুর তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতেছেন। ঈশ্বরের পথে থাকিয়া যাহারা স্ত্রীসঙ্গ করে তাহাদের প্রতি ঠাকুর ক্রোধ ও ঘৃণা প্রকাশ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—লজ্জা হয় না। ছেলে হয়ে গেছে আবার স্ত্রীসঙ্গ! ঘৃণা করে না!—পশুদের মতো ব্যবহার! নাল, রক্ত, মল, মূত্র—এ-সব ঘৃণা করে না! যে ভগবানের পাদপদ্ম চিন্তা করে, তার পরমাসুন্দরী রমণী চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়। যে শরীর থাকবে না—যার ভিতর কৃমি, ক্লেদ, শ্লেষ্মা, যতপ্রকার অপবিত্র জিনিস—সেই শরীর নিয়ে আনন্দ। লজ্জা হয় না!
[ঠাকুরের প্রেমানন্দ ও মা-কালীর পূজা]
মণি চুপ করিয়া হেঁটমুখ হইয়া আছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বলিতেছেন—তাঁর প্রেমের একবিন্দু যদি কেউ পায় কামিনী-কাঞ্চন অতি তুচ্ছ বলে বোধ হয়। মিছরির পানা পেলে চিটেগুড়ের পানা তুচ্ছ হয়ে যায়। তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করলে, তাঁর নামগুণ সর্বদা কীর্তন করলে—তাঁর উপর ভালবাসা ক্রমে হয়।
এই বলিয়া ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া ঘরের মধ্যে নাচিয়া বেড়াইতে লাগিলেন ও গান গাইতে লাগিলেন :
সুরধুনীর তীরে হরি বলে কে, বুঝি প্রেমদাতা নিতাই এসেছে ।
(নিতাই নইলে প্রাণ জুড়াবে কিসে) ।
প্রায় ১০টা বাজে। শ্রীযুক্ত রামলাল কালীঘরে মা-কালীর নিত্যপূজা সাঙ্গ করিয়াছেন। ঠাকুর মাকে দর্শন করিবার জন্য কালীঘরে যাইতেছেন। মণি সঙ্গে আছেন। মন্দিরে প্রবিষ্ট হইয়া ঠাকুর আসনে উপবিষ্ট হইলেন। দুই-একটি ফুল মার চরণে দিলেন। নিজের মাথায় ফুল দিয়া ধ্যান করিতেছেন। এইবার গীতচ্ছলে মার স্তব করিতেছেন :
ভবদারা ভয়হরা নাম শুনেছি তোমার ।
তাইতে এবার দিয়েছি ভার, তারো তারো না তারো মা ।
ঠাকুর কালীঘর হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাঁর ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় বসিয়াছেন। বেলা ১০টা হইবে। এখনও ঠাকুরদের ভোগ ও ভোগারতি হয় নাই। মা-কালী ও রাধাকান্তের প্রসাদি মাখন ও ফলমূল হইতে কিছু লইয়া ঠাকুর জলযোগ করিয়াছেন। রাখাল প্রভৃতি ভক্তেরাও কিছু কিছু পাইয়াছেন।
ঠাকুরের কাছে বসিয়া রাখাল Smiles’ Self-Help পড়িতেছেন,—Lord Erskine-এর বিষয়।
[নিষ্কামকর্ম—পূর্ণজ্ঞানী গ্রন্থ পড়ে না]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—ওতে কি বলছে?
মাস্টার—সাহেব ফলাকাঙ্ক্ষা না করে কর্তব্য কর্ম করতেন,—এই কথা বলছে। নিষ্কামকর্ম।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তবে তো বেশ! কিন্তু পূর্ণজ্ঞানের লক্ষণ—একখানাও পুস্তক সঙ্গে থাকবে না। যেমন শুকদেব—তাঁর সব মুখে।
“বইয়ে—শাস্ত্রে—বালিতে চিনিতে মিশেল আছে। সাধু চিনিটুকু লয়ে বালি ত্যাগ করে। সাধু সার গ্রহণ করে।”
শুকদেবাদির নাম করিয়া ঠাকুর কি নিজের অবস্থা ইঙ্গিত করিয়া বুঝাইতেছেন?
বৈষ্ণবচরণ কীর্তনিয়া আসিয়াছেন। তিনি সুবোলমিলন কীর্তন শুনাইলেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরে শ্রীযুত রামলাল থালায় করিয়া ঠাকুরের জন্য প্রসাদ আনিয়া দিলেন। সেবার পর—ঠাকুর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিলেন।
রাত্রে মণি নবতে শয়ন করিলেন। শ্রীশ্রীমা যখন দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ঠাকুরের সেবার জন্য আসিতেন তখন এই নবতেই বাস করিতেন। কয়েক মাস হইল তিনি কামারপুকুরে শুভাগমন করিয়াছেন।
১৯.৯ নবম পরিচ্ছেদ – শ্রীরাখাল, লাটু, জনাইয়ের মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মণির সঙ্গে পশ্চিমের গোল বারান্দায় বসিয়া আছেন। সম্মুখে দক্ষিণবাহিনী ভাগীরথী। কাছেই করবী, বেল, জুঁই, গোলাপ, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি নানা কুসুমবিভূষিত পুষ্পবৃক্ষ। বেলা ১০টা হইবে।
আজ রবিবার, অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা দ্বিতীয়া, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর মণিকে দেখিতেছেন ও গান গাইতেছেন :
তারিতে হবে মা তারা হয়েছি শরণাগত ।
হইয়া রয়েছি যেন পিঞ্জরের পাখির মতো ॥
অসংখ্য অপরাধী আমি, জ্ঞানশূন্য মিছে ভ্রমি ।
মায়াতে মোহিত হয়ে বত্সহারা গাভীর মতো ॥
[রামচিন্তা—সীতার ন্যায় ব্যাকুলতা]
“কেন? পিঞ্জরের পাখির মতো হতে যাব কেন? হ্যাক্! থু!”
কথা কহিতে কহিতে ভাবাবিষ্ট—শরীর, মন সব স্থির ও চক্ষে ধারা। কিয়ত্ক্ষণ পরে বলিতেছেন, মা সীতার মতো করে দাও—একেবারে সব ভুল—দেহ ভুল, যোনি, হাত, পা, স্তন—কোনোদিকে হুঁশ নাই। কেবল এক চিন্তা—‘কোথায় রাম!’
কিরূপ ব্যাকুল হলে ঈশ্বরলাভ হয়—মণিকে এইটি শিখাইবার জন্যই কি ঠাকুরের সীতার উদ্দীপন হইল? সীতা রামময়জীবিতা,—রামচিন্তা করে উন্মাদিনী—দেহ যে এমন প্রিয় তাহাও ভুলে গেছেন!
বেলা ৪টা বাজিয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে সেই ঘরে বসিয়া আছেন। জনাইয়ের মুখুজ্জেবাবু একজন আসিয়াছেন—তিনি শ্রীযুক্ত প্রাণকৃষ্ণের জ্ঞাতি। তাঁহার সঙ্গে একটি শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ বন্ধু। মণি, রাখাল, লাটু, হরিশ, যোগীন প্রভৃতি ভক্তেরাও আছেন।
যোগীন দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ চৌধুরীদের ছেলে।তিনি আজকাল প্রায় প্রত্যহ বৈকালে ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসেন ও রাত্রে চলিয়া যান। যোগীন এখনও বিবাহ করেন নাই।
মুখুজ্জে (প্রণামানন্তর)—আপনাকে দর্শন করে বড় আনন্দ হল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি সকলের ভিতরই আছেন। সকলের ভিতর সেই সোনা, কোনখানে বেশি প্রকাশ। সংসারে অনেক মাটি চাপা।
মুখুজ্জে (সহাস্যে)—মহাশয়, ঐহিক পারত্রিক কি তফাত?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সাধনের সময় ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে ত্যাগ করতে হয়। তাঁকে লাভের পর বুঝা যায় তিনিই সব হয়েছেন।
“যখন রামচন্দ্রের বৈরাগ্য হল দশরথ বড় ভাবিত হয়ে বশিষ্ঠদেবের শরণাগত হলেন—যাতে রাম সংসারত্যাগ না করেন। বশিষ্ঠ রামচন্দ্রের কাছে গিয়ে দেখেন, তিনি বিমনা হয়ে বসে আছেন—অন্তরে তীব্র বৈরাগ্য। বশিষ্ঠ বললেন, রাম, তুমি সংসারত্যাগ করবে কেন? সংসার কি তিনি ছাড়া? আমার সঙ্গে বিচার কর। রাম দেখিলেন, সংসার সেই পরব্রহ্ম থেকেই হয়েছে,—তাই চুপ করে রহিলেন।
“যেমন যে জিনিস থেকে ঘোল, সেই জিনিস থেকে মাখম। তখন ঘোলেরই মাখম, মাখমেরই ঘোল। অনেক কষ্টে মাখম তুললে (অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান হল);—তখন দেখছ যে মাখম থাকলেই ঘোলও আছে,—যেখানে মাখম সেইখানেই ঘোল। ব্রহ্ম আছেন বোধ থাকলেই—জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব-ও আছে।”
[ব্রহ্মজ্ঞানের একমাত্র উপায়]
“ব্রহ্ম যে কি বস্তু মুখে বলা যায় না। সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়েছে (অর্থাৎ মুখে বলা হয়েছে), কিন্তু ব্রহ্ম কি,—কেউ মুখে বলতে পারে নাই। তাই উচ্ছিষ্ট হয় নাই। এ-কথাটি বিদ্যাসাগরকে বলেছিলাম—বিদ্যাসাগর শুনে ভারী খুশি।
“বিষয়বুদ্ধির লেশ থাকলে এই ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। কামিনী-কাঞ্চন মনে আদৌ থাকবে না, তবে হবে। গিরিরাজকে পার্বতী বললেন, ‘বাবা, ব্রহ্মজ্ঞান যদি চাও তাহলে সাধুসঙ্গ কর’।”
ঠাকুর কি বলছেন, সংসারী লোক বা সন্ন্যাসী যদি কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকে তাহলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় না?
[যোগভ্রষ্ট—ব্রহ্মজ্ঞানের পর সংসার]
শ্রীরামকৃষ্ণ আবার মুখুজ্জেকে সম্বোধন করে বলছেন, “তোমাদের ধন ঐশ্বর্য আছে অথচ ঈশ্বরকে ডাকছ—এ খুব ভাল। গীতায় আছে যারা যোগভ্রষ্ট তারাই ভক্ত হয়ে ধনীর ঘরে জন্মায়।”
মুখুজ্জে (বন্ধুর প্রতি, সহাস্যে)—শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোঽভিজায়তে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি মনে করলে জ্ঞানীকে সংসারেও রাখতে পারেন। তাঁর ইচ্ছাতে জীবজগৎ হয়েছে। তিনি ইচ্ছাময়—
মুখুজ্জে (সহাস্যে)—তাঁর আবার ইচ্ছা কি? তাঁর কি কিছু অভাব আছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তাতেই বা দোষ কি? জল স্থির থাকলেও জল,—তরঙ্গ হলেও জল।
[জীবজগৎ কি মিথ্যা?]
“সাপ চুপ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকলেও সাপ,—আবার তির্যগ্গতি হয়ে এঁকেবেঁকে চললেও সাপ।
“বাবু যখন চুপ করে আছে তখনও যে ব্যক্তি,—যখন কাজ করছে তখনও সেই ব্যক্তি।
“জীবজগৎকে বাদ দেবে কেমন করে—তাহলে যে ওজনে কম পড়ে। বেলের বিচি, খোলা বাদ দিলে সমস্ত বেলের ওজন পাওয়া যায় না।
“ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। বায়ুতে সুগন্ধ দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। সেই আদ্যাশক্তিতেই জীবজগৎ হয়েছে।”
[সমাধিযোগের উপায়—ক্রন্দন। ভক্তিযোগ ও ধ্যানযোগ]
মুখুজ্জে—কেন যোগভ্রষ্ট হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—‘গর্ভে ছিলাম যোগে ছিলাম, ভূমে পড়ে খেলাম মাটি। ওরে ধাত্রীতে কেটেছে নাড়ী, মায়ার বেড়ি কিসে কাটি।’
“কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। মন থেকে ওই দুটি গেলেই যোগ। আত্মা—পরমাত্মা চুম্বক পাথর, জীবাত্মা যেন একটি ছুঁচ—তিনি টেনে নিলেই যোগ। কিন্তু ছুঁচে যদি মাটি মাখা থাকে চুম্বকে টানে না,—মাটি সাফ করে দিলে আবার টানে। কামিনী-কাঞ্চন মাটি পরিষ্কার করতে হয়।”
মুখুজ্জে—কিরূপে পরিষ্কার হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁর জন্য ব্যাকুল হয়ে কাঁদ—সেই জল মাটিতে লাগলে ধুয়ে ধুয়ে যাবে। যখন খুব পরিষ্কার হবে তখন চুম্বকে টেনে লবে।—যোগ তবেই হবে।
মুখুজ্জে—আহা কি কথা!
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁর জন্য কাঁদতে পারলে দর্শন হয়—সমাধি হয়। যোগে সিদ্ধ হলেই সমাধি। কাঁদলে কুম্ভক আপনি হয়, তারপর সমাধি।
“আর-এক আছে ধ্যান। সহস্রারে শিব বিশেষরূপে আছেন। তাঁর ধ্যান। শরীর সরা, মন-বুদ্ধি জল। এই জলে সেই সচ্চিদানন্দ সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়ে। সেই প্রতিবিম্ব সূর্যের ধ্যান করতে করতে সত্য সূর্য তাঁর কৃপায় দর্শন হয়।”
[সাধুসঙ্গ কর ও আমমোক্তারি (বকলমা) দাও]
“কিন্তু সংসারী লোকের সর্বদাই সাধুসঙ্গ দরকার। সকলেরই দরকার। সন্ন্যাসীরও দরকার। তবে সংসারীদের বিশেষতঃ, রোগ লেগেই আছে—কামিনী-কাঞ্চনের মধ্যে সর্বদা থাকতে হয়।”
মুখুজ্জে—আজ্ঞা, রোগ লেগেই আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁকে আমমোক্তারি (বকলমা) দাও—যা হয় তিনি করুন। তুমি বিড়ালছানার মতো কেবল তাঁকে ডাকো—ব্যাকুল হয়ে। তার মা যেখানে তাকে রাখে—সে কিছু জানে না;—কখনও বিছানার উপর রাখছে, কখনও হেঁশালে।
[প্রবর্তক শাস্ত্র পড়ে—সাধনার পর তবে দর্শন]
মুখুজ্জে—গীতা প্রভৃতি শাস্ত্র পড়া ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—শুধু পড়লে শুনলে কি হবে? কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দুধ দেখেছে, কেউ খেয়েছে। ঈশ্বরকে দর্শন করা যায়—আবার তাঁর সঙ্গে আলাপ করা যায়।
“প্রথমে প্রবর্তক। সে পড়ে, শুনে। তারপর সাধক,—তাঁকে ডাকছে, ধ্যান চিন্তা করছে, নামগুণকীর্তন করছে। তারপর সিদ্ধ—তাঁকে বোধে বোধ করেছে, দর্শন করেছে। তারপর সিদ্ধের সিদ্ধ; যেমন চৈতন্যদেবের অবস্থা—কখনও বাত্সল্য, কখনও মধুরভাব।”
মণি, রাখাল, যোগীন, লাটু প্রভৃতি ভক্তেরা এই সকল দেবদুর্লভ তত্ত্বকথা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
এইবার মুখুজ্জেরা বিদায় লইবেন। তাঁহারা প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলেন। ঠাকুরও যেন তাঁদের সম্মানার্থ উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
মুখুজ্জে (সহাস্যে)—আপনার আবার উঠা বসা।—
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আবার উঠা বসাতেই বা ক্ষতি কি? জল স্থির হলেও জল,—আর হেললে দুললেও জল। ঝড়ের এঁটো পাতা—হাওয়াতে যেদিকে লয়ে যায়। আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী।
১৯.১০ দশম পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন ও বেদান্ত সম্বন্ধে গুহ্য ব্যাখ্যা—অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ—জগৎ কি মিথ্যা? Identity of the Undifferentiated and Differentiated
জনাইয়ের মুখুজ্জেরা চলিয়া গেলেন। মণি ভাবিতেছেন, বেদান্তদর্শন মতে “সব স্বপ্নবৎ”। তবে জীবজগৎ, আমি—এ-সব কি মিথ্যা?
মণি একটু একটু বেদান্ত দেখিয়াছেন। আবার বেদান্তের অস্ফুট প্রতিধ্বনি কান্ট্, হেগেল প্রভৃতি জার্মান পণ্ডিতদের বিচার একটু পড়েছেন। কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দুর্বল মানুষের ন্যায় বিচার করেন নাই,—জগন্মাতা তাঁহাকে সমস্ত দর্শন১ করাইয়াছেন। মণি তাই ভাবছেন।
কিয়ত্ক্ষণ পরেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মণির সহিত একাকী পশ্চিমের গোল বারান্দায় কথা কহিতেছেন। সম্মুখে গঙ্গা—কুলকুল রবে দক্ষিণে প্রবাহিত হইতেছেন। শীতকাল—সূর্যদেব এখনও দেখা যাইতেছেন দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। যাঁহার জীবন বেদময়—যাঁহার শ্রীমুখনিঃসৃত বাক্য বেদান্তবাক্য—যাঁহার শ্রীমুখ দিয়া শ্রীভগবান কথা কন—যাঁহার কথামৃত লইয়া বেদ, বেদান্ত, শ্রীভাগবত গ্রন্থাকার ধারণ করে, সেই অহেতুককৃপাসিন্ধু পুরুষ গুরুরূপ ধারণ করিয়া কথা কহিতেছেন।
মণি—জগৎ কি মিথ্যা?
শ্রীরামকৃষ্ণ—মিথ্যা কেন? ও-সব বিচারের কথা।১ Revelation: Transcendental Perception: God-vision.
“প্রথমটা, ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার করবার সময়, তিনি জীব নন, জগৎ নন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নন, হয়ে যায়;—‘এ-সব স্বপ্নবৎ’ হয়ে যায়। তারপর অনুলোম বিলোম। তখন তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন বোধ হয়।
“তুমি সিঁড়ি ধরে ধরে ছাদে উঠলে। কিন্তু যতক্ষণ ছাদবোধ ততক্ষণ সিঁড়িও আছে। যার উঁচুবোধ আছে, তার নিচুবোধও আছে।
“আবার ছাদে উঠে দেখলে—যে জিনিসে ছাদ তৈয়ের হয়েছে—ইট, চুন, সুরকি—সেই জিনিসেই সিঁড়ি তৈয়ের হয়েছে।
“আর যেমন বেলের কথা বলেছি ।
“যার অটল আছে তার টলও আছে ।
“আমি যাবার নয়। ‘আমি ঘট’ যতক্ষণ রয়েছে ততক্ষণ জীবজগৎও রয়েছে। তাঁকে লাভ করলে দেখা যায় তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন।—শুধু বিচারে হয় না।
“শিবের দুই অবস্থা। যখন সমাধিস্থ—মহাযোগে বসে আছেন—তখন আত্মারাম। আবার যখন সে অবস্থা থেকে নেবে আসেন—একটু ‘আমি’ থাকে তখন ‘রাম’ ‘রাম’ করে নৃত্য করেন!”
ঠাকুর শিবের অবস্থা বর্ণনা করিয়া কি নিজের অবস্থা ইঙ্গিত করিয়া বলিতেছেন?
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর জগন্মাতার নাম ও তাঁহার চিন্তা করিতেছেন। ভক্তেরাও নির্জনে গিয়া যে যার ধ্যানাদি করিতে লাগিলেন। এদিকে ঠাকুরবাড়িতে মা-কালীর মন্দিরে, শ্রীশ্রীরাধাকান্তের মন্দিরে ও দ্বাদশ শিবমন্দিরে আরতি হইতে লাগিল।
আজ কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। সন্ধ্যার কিয়ত্কাল পরে চন্দ্রোদয় হইল। সে আলো মন্দিরশীর্ষ, চতুর্দিকের তরুলতা ও মন্দিরের পশ্চিমে ভাগীরথীবক্ষে পড়িয়া অপূর্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। এই সময় সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়া আছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন। মণি বৈকালে বেদান্ত সম্বন্ধে যে-কথার অবতারণা করিয়াছিলেন ঠাকুর আবার সেই কথাই কহিতেছেন।
[সব চিন্ময়দর্শন—মথুরকে খাজাঞ্চীর পত্র লেখা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—জগৎ মিথ্যা কেন হবে?ও-সব বিচারের কথা। তাঁকে দর্শন হলে তখন বোঝা যায় যে তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন।
“আমায় মা কালীঘরে দেখিয়ে দিলেন যে মা-ই সব হয়েছেন। দেখিয়ে দিলেন সব চিন্ময়!—প্রতিমা চিন্ময়!—বেদী চিন্ময়!—কোশাকুশি চিন্ময়!—চৌকাট চিন্ময়!—মার্বেলের পাথর—সব চিন্ময়!
“ঘরের ভিতর দেখি—সব যেন রসে রয়েছে! সচ্চিদানন্দ রসে।
“কালীঘরের সম্মুখে একজন দুষ্ট লোককে দেখলাম,—কিন্তু তারও ভিতরে তাঁর শক্তি জ্বলজ্বল করছে দেখলাম!
“তাইতো বিড়ালকে ভোগের লুচি খাইয়েছিলাম। দেখলাম মা-ই সব হয়েছেন—বিড়াল পর্যন্ত। তখন খাজাঞ্চী সেজোবাবুকে চিঠি লিখলে যে ভটচার্জি মহাশয় ভোগের লুচি বিড়ালদের খাওয়াচ্ছেন। সেজোবাবু আমার অবস্থা বুঝতো। পত্রের উত্তরে লিখলে, ‘উনি যা করেন তাতে কোন কথা বলো না।’
“তাঁকে লাভ করলে এইগুলি ঠিক দেখা যায়। তিনিই জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন।
“তবে যদি তিনি ‘আমি’ একেবারে পুঁছে দেন তখন যে কি হয় মুখে বলা যায় না। রামপ্রসাদ যেমন বলেছেন—
‘তখন তুমি ভাল কি আমি ভাল সে তুমিই বুঝবে।’
“সে অবস্থাও আমার এক-একবার হয়।
“বিচার করে একরকম দেখা যায়,—আর তিনি যখন দেখিয়ে দেন তখন আর একরকম দেখা যায়।”
১৯.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরদর্শন—উপায় প্রেম
পরদিন (১৭ই ডিসেম্বর) সোমবার, বেলা আটটা হইল। ঠাকুর সেই ঘরে বসিয়া আছেন। রাখাল, লাটু প্রভৃতি ভক্তেরাও আছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন। শ্রীযুক্ত মধু ডাক্তারও আসিয়াছেন। তিনি ঠাকুরের কাছে সেই ছোট খাটটির উপরেই বসিয়া আছেন। মধু ডাক্তার প্রবীণ—ঠাকুরের অসুখ হইলে প্রায় তিনি আসিয়া দেখেন। বড় রসিক লোক।
মণি ঘরে প্রবেশ করিয়া প্রণামানন্তর উপবেশন করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—কথাটা এই—সচ্চিদানন্দে প্রেম।
[ঠাকুরের সীতামূর্তি-দর্শন—গৌরী পণ্ডিতের কথা]
“কিরূপ প্রেম? ঈশ্বরকে কিরূপ ভালবাসতে হবে? গৌরী বলত রামকে জানতে গেলে সীতার মতো হতে হয়; ভগবানকে জানতে ভগবতীর মতো হতে হয়,—ভগবতী যেমন শিবের জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন সেইরূপ তপস্যা করতে হয়; পুরুষকে জানতে গেলে প্রকৃতিভাব আশ্রয় করতে হয়—সখীভাব, দাসীভাব, মাতৃভাব।
“আমি সীতামূর্তি দর্শন করেছিলাম। দেখলাম সব মনটা রামেতেই রয়েছে। যোনি, হাত, পা, বসন-ভূষণ কিছুতেই দৃষ্টি নাই। যেন জীবনটা রামময়—রাম না থাকলে, রামকে না পেলে, প্রাণে বাঁচবে না!”
মণি—আজ্ঞা হাঁ,—যেন পাগলিনী।
শ্রীরামকৃষ্ণ—উন্মাদিনী!—ইয়া। ঈশ্বরকে লাভ করতে গেলে পাগল হতে হয়।
“কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকলে হয় না। কামিনীর সঙ্গে রমণ,—তাতে কি সুখ! ঈশ্বরদর্শন হলে রমণসুখের কোটিগুণ আনন্দ হয়। গৌরী বলত, মহাভাব হলে শরীরের সব ছিদ্র—লোমকূপ পর্যন্ত—মহাযোনি হয়ে যায়। এক-একটি ছিদ্রে আত্মার সহিত রমণসুখ বোধ হয়।”
[গুরু পূর্ণজ্ঞানী হবেন]
শ্রীরামকৃষ্ণ—ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে হয়। গুরুর মুখে শুনে নিতে হয়—কি করলে তাঁকে পাওয়া যায়।
“গুরু নিজে পূর্ণজ্ঞানী হলে তবে পথ দেখিয়ে দিতে পারে।
“পূর্ণজ্ঞান হলে বাসনা যায়,—পাঁচ বছরের বালকের স্বভাব হয়। দত্তাত্রেয় আর জড়ভরত—এদের বালকের স্বভাব হয়েছিল।”
মণি—আজ্ঞে, এদের খপর আছে;—আরও এদের মতো কত জ্ঞানী লোক হয়ে গেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ! জ্ঞানীর সব বাসনা যায়,—যা থাকে তাতে কোন হানি হয় না। পরশমণিকে ছুঁলে তরবার সোনা হয়ে যায়,—তখন আর সে তরবারে হিংসার কাজ হয় না। সেইরূপ জ্ঞানীর কাম-ক্রোধের কেবল ভঙ্গীটুকু থাকে। নামমাত্র। তাতে কোন অনিষ্ট হয় না।
মণি—আপনি যেমন বলেন, জ্ঞানী তিনগুণের অতীত হয়। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—কোন গুণেরই বশ নন। এরা তিনজনেই ডাকাত।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওইগুলি ধারণা করা চাই।
মণি—পূর্ণজ্ঞানী পৃথিবীতে বোধ হয় তিন-চারজনের বেশি নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন, পশ্চিমের মঠে অনেক সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায়।
মণি—আজ্ঞা, সে সন্ন্যাসী আমিও হতে পারি!
শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথায় কিয়ত্ক্ষণ মণিকে এক দৃষ্টে দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—কি, সব ছেড়ে?
মণি—মায়া না গেলে কি হবে? মায়াকে যদি জয় না করতে পারে শুধু সন্ন্যাসী হয়ে কি হবে?
সকলেই কিয়ত্ক্ষণ চুপ করিয়া আছেন।
[ত্রিগুণাতীত ভক্ত যেমন বালক]
মণি—আজ্ঞা, ত্রিগুণাতীত ভক্তি কাকে বলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে ভক্তি হলে সব চিন্ময় দেখে। চিন্ময় শ্যাম। চিন্ময় ধাম। ভক্তও চিন্ময়। সব চিন্ময়। এ-ভক্তি কম লোকের হয়।
ডাক্তার মধু (সহাস্যে)—ত্রিগুণাতীত ভক্তি—অর্থাৎ ভক্ত কোন গুণের বশীভূত নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—ইয়া! যেমন পাঁচ বছরের বালক—কোন গুণের বশ নয়।
মধ্যাহ্নে সেবার পর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একটু বিশ্রাম করিতেছেন। শ্রীযুক্ত মণিলাল মল্লিক আসিয়া প্রণাম করিলেন ও মেঝেতে আসন গ্রহণ করিলেন।
মণিও মেঝেতে বসিয়া আছেন। ঠাকুর শুইয়া শুইয়া মণি মল্লিকের সঙ্গে মাঝে মাঝে একটি একটি কথা কহিতেছেন।
মণি মল্লিক—আপনি কেশব সেনকে দেখতে গিছলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ—এখন কেমন আছেন?
মণি মল্লিক—কিছু সারেন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—দেখলাম বড় রাজসিক,—অনেকক্ষণ বসিয়েছিল,—তারপর দেখা হল।
ঠাকুর উঠিয়া বসিলেন ও ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন।
[শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত—ঠাকুর “রাম রাম” করিয়া পাগল]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—আমি ‘রাম’ ‘রাম’ করে পাগল হয়েছিলাম। সন্ন্যাসীর ঠাকুর রামলালাকে লয়ে লয়ে বেড়াতাম। তাকে নাওয়াতাম, খাওয়াতাম, শোয়াতাম। যেখানে যাব,—সঙ্গে করে লয়ে যেতাম। “রামলালা রামলালা” করে পাগল হয়ে গেলাম।
১৯.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে
শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বদাই সমাধিস্থ;কেবল রাখালাদি ভক্তদের শিক্ষার জন্য তাঁহাদের লইয়া ব্যস্ত—কিসে চৈতন্য হয়।
তাঁহার ঘরের পশ্চিমের বারান্দায় সকাল বেলা বসিয়া আছেন। আজ মঙ্গলবার, অগ্রহায়ণ চতুর্থী; ১৮ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। ৺দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্তি ও বৈরাগ্যের কথায় তিনি তাঁহার প্রশংসা করিতেছেন। রাখালাদি ছোকরা ভক্তদের দেখিয়া বলিতেছেন, তিনি ভাল লোক; কিন্তু যারা সংসারে না ঢুকিয়া ছেলেবেলা থেকে শুকদেবাদির মতো অহর্নিশ ঈশ্বরের চিন্তা করে, কৌমারবৈরাগ্যবান, তারা ধন্য!
“সংসারী লোকদের একটা না একটা কামনা বাসনা থাকে। এদিকে ভক্তিও বেশ দেখা যায়। সেজোবাবু কি একটা মোকদ্দমায় পড়েছিল—মা-কালীর কাছে, আমায় বলছে, বাবা, এই অর্ঘ্যটি মাকে দাও তো—আমি উদার মনে দিলাম।
“কিন্তু কেমন বিশ্বাস যে আমি দিলেই হবে।
“রতির মার এদিকে কত ভক্তি! প্রায় এসে কত সেবা। রতির মা বৈষ্ণবী। কিছুদিন পরে যাই দেখলে আমি মা-কালীর প্রসাদ খাই—অমনি আর এলো না! একঘেয়ে! লোককে দেখলে প্রথম প্রথম চেনা যায় না।”
শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরের ভিতর পূর্বদিকের দরজার নিকট বসিয়া আছেন। শীতকাল, গায়ে মোলস্কিনের র্যাপার। হঠাৎ সূর্যদর্শন ও সমাধিস্থ। নিমেষশূন্য! বাহ্যশূন্য!
এই কি গায়ত্রী মন্ত্রের সার্থকতা—“তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি”?
অনেকক্ষণ পরে সমাধি ভঙ্গ হইল। রাখাল, হাজরা, মাস্টার প্রভৃতি কাছে বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি)—সমাধি, ভাব, প্রেমের বটে। ও-দেশে (শ্যামবাজারে) নটবর গোস্বামীর বাড়িতে কীর্তন হচ্ছিল—শ্রীকৃষ্ণ ও গোপীগণ দর্শন করে সমাধিস্থ হলাম! বোধ হল আমার লিঙ্গ শরীর (সূক্ষ্ম শরীর) শ্রীকৃষ্ণের পায় পায় বেড়াচ্ছে!
“জোড়াসাঁকো হরিসভায় ওইরূপ কীর্তনের সময় সমাধি হয়ে বাহ্যশূন্য! সেদিন দেহত্যাগের সম্ভাবনা ছিল।”
শ্রীরামকৃষ্ণ স্নান করিতে গেলেন। স্নানানন্তর ওই গোপী প্রেমেরই কথা বলিতেছেন।
(মণি প্রভৃতির প্রতি)—“গোপীদের ওই টানটুকু নিতে হয়!
“এই সব গান গাইবে :
সখি, সে বন কতদূর!
(যেখানে আমার শ্যামসুন্দর)
(আর চলিতে যে নারি!)
গান—ঘরে যাবই যে না গো!
যে ঘরে কৃষ্ণ নামটি করা দায়। (সঙ্গিনীয়া)”
১৯.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ রাখালের জন্য ৺সিদ্ধেশ্বরীকে ডাব-চিনি মানিয়াছেন। মণিকে বলিতেছেন, “তুমি ডাব, চিনির দাম দিবে।”
বৈকালে শ্রীরামকৃষ্ণ রাখাল, মণি প্রভৃতির সঙ্গে ঠনঠনের ৺সিদ্ধেশ্বরী-মন্দির অভিমুখে গাড়ি করিয়া আসিতেছেন। পথে সিমুলিয়া বাজার, সেখানে ডাব, চিনি কেনা হইল।
মন্দিরে আসিয়া ভক্তদের বলিতেছেন, একটা ডাব কেটে চিনি দিয়ে মার কাছে দাও।
যখন মন্দিরে আসিয়া পৌঁছিলেন, তখন পূজারীরা বন্ধু লইয়া মা-কালীর সম্মুখে তাস খেলিতেছিলেন। ঠাকুর দেখিয়া ভক্তদের বলিতেছেন, দেখেছ, এ-সব স্থানে তাস খেলা! এখানে ঈশ্বরচিন্তা করতে হয়।
এইবার শ্রীরামকৃষ্ণ যদু মল্লিকের বাটীতে আসিয়াছেন। তাঁহার সঙ্গে অনেকগুলি বাবু বসিয়া আছেন।
যদু বলিতেছেন, ‘এস’ ‘এস’। পরস্পর কুশল প্রশ্নের পর, শ্রীরামকৃষ্ণ কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তুমি অত ভাঁড়, মোসাহেব রাখ কেন?
যদু (সহাস্যে)—তুমি উদ্ধার করবে বলে। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ—মোসাহেবরা মনে করে বাবু তাদের টাকা ঢেলে দেবে। কিন্তু বাবুর কাছে আদায় করা বড় কঠিন। একটা শৃগাল একটা বলদকে দেখে তার সঙ্গ আর ছাড়ে না। সে চরে বেড়ায়, ওটাও সঙ্গে সঙ্গে। শৃগালটা মনে করেছে ওর অণ্ডের কোষ ঝুলছে সেইটে কখন না কখন পড়ে যাবে আর আমি খাব। বলদটা কখন ঘুমোয়, সেও কাছে শুয়ে ঘুমোয়; আর যখন উঠে চরে বেড়ায়, সেও সঙ্গে সঙ্গে থাকে। কতদিন এইরূপে যায়, কিন্তু কোষটা পড়ল না; তখন সে নিরাশ হয়ে চলে গেল। (সকলের হাস্য) মোসাহেবদের এইরূপই অবস্থা।
যদু ও তাঁহার মাতাঠাকুরানী শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তদের জলসেবা করাইলেন।
১৯.১৪ চতুর্দশ পরিচ্ছেদ – বিল্বমূলে ও পঞ্চবটীতলায় শ্রীরামকৃষ্ণ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিল্ববৃক্ষের নিকট মণির সহিত কথা কহিতেছেন। বেলা প্রায় নয়টা হইবে।
আজ বুধবার, ১৯শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ (৫ই পৌষ, ১২৯০), কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথি।
বিল্বতল ঠাকুরের সাধনভূমি। অতি নির্জন স্থান। উত্তরে বারুদখানা ও প্রাচীর। পশ্চিমে ঝাউগাছগুলি সর্বদাই প্রাণ-উদাসকারী সোঁ-সোঁ শব্দ করিতেছে, পরেই ভাগীরথী। দক্ষিণে পঞ্চবটী দেখা যাইতেছে। চতুর্দিকে এত গাছপালা, দেবালয়গুলি দেখা যাইতেছে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করলে কিন্তু হবে না।
মণি—কেন? বশিষ্ঠদেব তো রামচন্দ্রকে বলেছিলেন, রাম, সংসার যদি ঈশ্বরছাড়া হয়, তাহলে সংসারত্যাগ করো।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈষৎ হাসিয়া)—সে রাবণবধের জন্য! তাই রাম সংসারে রইলেন—বিবাহ করলেন।
মণি নির্বাক্ হইয়া কাষ্ঠের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথা বলিয়া নিজের ঘরে ফিরিয়া যাইবার জন্য পঞ্চবটী অভিমুখে গমন করিলেন। বেলা ৯টা হইয়া গিয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত মণির কথা চলিতেছে পঞ্চবটীমূলে।
মণি (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—জ্ঞান ভক্তি দুই-ই কি হয় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—খুব উঁচু ঘরের হয়। ঈশ্বরকোটির হয়—যেমন চৈতন্যদেবের। জীবকোটিদের আলাদা কথা।
“আলো (জ্যোতিঃ) পাঁচপ্রকার। দীপ আলোক, অন্যান্য অগ্নির আলো, চান্দ্র আলো, সৌর আলো ও চান্দ্র সৌর একাধারে। ভক্তি চন্দ্র; জ্ঞান সূর্য।
“কখনও কখনও আকাশে সূর্য অস্ত না যেতে যেতে চন্দ্রোদয় দেখা যায়। অবতারাদির ভক্তিচন্দ্র জ্ঞানসূর্য একাধারে দেখা যায়।
“মনে করলেই কি সকলের জ্ঞান ভক্তি একাধারে দুই হয়? আধার বিশেষ। কোন বাঁশের ফুটো বেশি, কোন বাঁশের খুব সরু ফুটো। ঈশ্বর বস্তু ধারণা কি সকল আধারে হয়। একসের ঘটিতে কি দুসের দুধ ধরে!”
মণি—কেন, তাঁর কৃপায়? তিনি কৃপা করলে তো ছুঁচের ভিতর উট যেতে পারে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু কৃপা কি অমনি হয়? ভিখারি যদি পয়সা চায়, দেওয়া যায়। কিন্তু একেবারে যদি রেলভাড়া চেয়ে বসে?
মণি নিঃশব্দে দণ্ডায়মান। শ্রীরামকৃষ্ণও চুপ করিয়া আছেন। হঠাৎ বলিতেছেন, হাঁ বটে, কারু কারু আধারে তাঁর কৃপা হলে হতে পারে; দুই-ই হতে পারে।
[‘নিরাকার সাধনা বড় কঠিন’]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতলায় মণির সহিত কথা কহিতেছেন। বেলা প্রায় ১০টা হইল।
মণি—আজ্ঞা, নিরাকার সাধন কি হয় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হবে না কেন? ও-পথ বড় কঠিন১। আগেকার ঋষিরা অনেক তপস্যার দ্বারা বোধে বোধ করত,—ব্রহ্ম কি বস্তু অনুভব করত। ঋষিদের খাটুনি কত ছিল।—নিজেদের কুটির থেকে সকালবেলা বেরিয়ে যেত,—সমস্ত দিন তপস্যা করে সন্ধ্যার পর আবার ফিরত। তারপর এসে একটু ফলমূল খেত।
“এ-সাধনে একেবারে বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে হবে না। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ—এসব বিষয় মনে আদপে থাকবে না। তবে শুদ্ধমন হবে। সেই শুদ্ধমনও যা শুদ্ধ আত্মাও তা। মনেতে কামিনী-কাঞ্চন একেবারে থাকবে না—
“তখন আর-একটি অবস্থা হয়। ‘ঈশ্বরই কর্তা আমি অকর্তা’। আমি না হলে চলবে না এরূপ জ্ঞান থাকবে না—সুখে দুঃখে।
“একটি মঠের সাধুকে দুষ্টলোকে মেরেছিল,—সে অজ্ঞান হয়ে গিছল। চৈতন্য হলে যখন জিজ্ঞাসা করলে কে তোমায় দুধ খাওয়াচ্ছে। সে বলেছিল, যিনি আমায় মেরেছেন তিনিই দুধ খাওয়াচ্ছেন।”
মণি—আজ্ঞা হাঁ, জানি।১ ক্লেশোঽধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্ । অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে ॥ [গীতা, ১২/৫]
[স্থিতসমাধি ও উন্মনাসমাধি]
শ্রীরামকৃষ্ণ—না, শুধু জানলে হবে না;—ধারণা করা চাই।
“বিষয়চিন্তা মনকে সমাধিস্থ হতে দেয় না।
“একেবারে বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ হলে স্থিতসমাধি হয়। আমার স্থিতসমাধিতে দেহত্যাগ হতে পারে, কিন্তু ভক্তি-ভক্ত নিয়ে একটু থাকবার বাসনা আছে। তাই একটু দেহের উপরেও মন আছে।
“আর এক আছে উন্মনাসমাধি। ছড়ানো মন হঠাৎ কুড়িয়ে আনা। ওটা তুমি বুঝেছ?”
মণি—আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ছড়ানো মন হঠাৎ কুড়িয়ে আনা। বেশিক্ষণ এ-সমাধি থাকে না, বিষয়চিন্তা এসে ভঙ্গ হয়—যোগীর যোগ ভঙ্গ হয়।
“ও-দেশে দেয়ালের ভিতর গর্তে নেউল থাকে। গর্তে যখন থাকে বেশ আরামে থাকে। কেউ কেউ ন্যাজে ইট বেঁধে দেয়—তখন ইটের জোরে গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ে। যতবার গর্তের ভিতর গিয়ে আরামে বসবার চেষ্টা করে—ততবারই ইটের জোরে বাইরে এসে পড়ে। বিষয়চিন্তা এমনি—যোগীকে যোগভ্রষ্ট করে।
“বিষয়ী লোকদের এক-একবার সমাধির অবস্থা হতে পারে। সূর্যোদয়ে পদ্ম ফোটে, কিন্তু সূর্য মেঘেতে ঢাকা পড়লে আবার পদ্ম মুদিত হয়ে যায়। বিষয় মেঘ।”
মণি—সাধন করলে জ্ঞান আর ভক্তি দুই কি হয় না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভক্তি নিয়ে থাকলে দুই-ই হয়। দরকার হয়, তিনিই ব্রহ্মজ্ঞান দেন। খুব উঁচু ঘর হলে একাধারে দুই-ই হতে পারে।
প্রণামপূর্বক মণি বেলতলার দিকে যাইতেছেন।
বেলতলা হইতে ফিরিতে দুপ্রহর হইয়া গিয়াছে। দেরি দেখিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ বেলতলার দিকে আসিতেছেন। মণি সতরঞ্চি, আসন, জলের ঘটি লইয়া ফিরিতেছেন, পঞ্চবটীর কাছে ঠাকুরের সহিত দেখা হইল। তিনি অমনি ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—আমি যাচ্ছিলাম তোমায় খুঁজতে। ভাবলাম এত বেলা, বুঝি পাঁচিল ডিঙিয়ে পালালো! তোমার চোখ তখন যা দেখেছিলাম—ভাবলাম বুঝি নারাণ শাস্ত্রীর মতো পালালো। তারপর আবার ভাবলাম, না সে পালাবে না; সে অনেক ভেবে-চিন্তে কাজ করে।
১৯.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ মণি প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
আবার রাত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ মণির সহিত কথা কহিতেছেন। রাখাল, লাটু, হরিশ প্রভৃতি আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—আচ্ছা, কেহ কেহ কৃষ্ণলীলার অধ্যাত্ম ব্যাখ্যা করে; তুমি কি বল?
মণি—নানা মত, তা হলেই বা। ভীষ্মদেবের কথা আপনি বলেছেন—শরশয্যায় দেহত্যাগের সময় বলেছিলেন, ‘কেন কাঁদছি? যন্ত্রণার জন্য নয়। যখন ভাবছি যে, সাক্ষাৎ নারায়ণ অর্জুনের সারথি হয়েছিলেন অথচ পাণ্ডবদের এত বিপদ, তখন তাঁর লীলা কিছুই বুঝতে পারলাম না—তাই কাঁদছি।’
“আবার হনুমানের কথা আপনি বলেছিলেন—হনুমান বলতেন, ‘আমি বার, তিথি, নক্ষত্র—ও-সব জানি না, আমি কেবল এক রামচিন্তা করি।’
“আপনি তো বলেছেন, দুটি জিনিস বই তো আর কিছু নাই—ব্রহ্ম আর শক্তি। আর বলেছেন, জ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান) হলে ওই দুইটি এক বোধ হয়; যে একের দুই নাই।”
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ বটে; চীজ নেবে তা কাঁটাবন দিয়েই হউক আর ভাল রাস্তা দিয়ে চলে গিয়েই হউক।
“নানা মত বটে। ন্যাংটা বলত, মতের জন্য সাধুসেবা হল না। এক জায়গায় ভাণ্ডারা হচ্ছিল। অনেক সাধু সম্প্রদায়; সবাই বলে আমাদের সেবা আগে, তারপর অন্য সম্প্রদায়। কিছুই মীমাংসা হল না; শেষে সকলে চলে গেল! আর বেশ্যাদের খাওয়ানো হল!”
মণি—তোতাপুরী খুব লোক।
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাজরা বলে অমনি (সামান্য)। না বাবু, কথায় কাজ নাই—সবাই বলে আমার ঘড়ি ঠিক চলছে।
“দেখ, নারাণ শাস্ত্রীর খুব কিন্তু বৈরাগ্য হয়েছিল। অত বড় পণ্ডিত—স্ত্রী ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মন থেকে একেবারে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করলে তবে যোগ হয়। কারু কারু যোগীর লক্ষণ দেখা যায়।
“তোমায় ষট্চক্রের বিষয় কিছু বলে দিতে হবে। যোগীরা ষট্চক্র ভেদ করে তাঁর কৃপায় তাঁকে দর্শন করে। ষট্চক্র শুনেছ?”
মণি—বেদান্তমতে সপ্তভূমি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বেদান্ত নয়, বেদ মত। ষট্চক্র কিরকম জান? সূক্ষ্মদেহের ভিতর সব পদ্ম আছে—যোগীরা দেখতে পায়। যেমন মোমের গাছের ফলপাতা।
মণি—আজ্ঞা হাঁ, যোগীরা দেখতে পায়। একটা বইয়ে আছে, একরকম কাচ (Magnifier) আছে, তার ভিতর দিয়ে দেখলে খুব ছোট জিনিস বড় দেখায়। সেইরূপ যোগের দ্বারা ওই সব সূক্ষ্মপদ্ম দেখা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীর ঘরে থাকিতে বলিয়াছেন। মণি ওই ঘরে রাত্রিবাস করিতেছেন।
প্রত্যূষে ওই ঘরে একাকী গান গাহিতেছেন :
গৌর হে আমি সাধন-ভজনহীন
পরশে পবিত্র করো আমি দীনহীন ॥
চরণ পাবো পাবো বলে হে,
(চরণ তো আর পেলাম না, গৌর!)
আমার আশায় আশায় গেল দিন!
হঠাৎ জানালার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখেন, শ্রীরামকৃষ্ণ দণ্ডায়মান। “পরশে পবিত্র করো আমি দীনহীন!”—এই কথা শুনিয়া তাঁহার চক্ষু, কি আশ্চর্য, অশ্রুপূর্ণ হইয়াছে।
আবার একটি গান হইতেছে :
আমি গেরুয়া বসন অঙ্গেতে পরিব
শঙ্খের কুণ্ডল পরি ।
আমি যোগিনীর বেশে যাব সেই দেশে,
যেখানে নিঠুর হরি ॥
শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে রাখাল বেড়াইতেছেন।
পরদিন শুক্রবার, ২১শে ডিসেম্বর (৭ই পৌষ, কৃষ্ণা অষ্টমী)। সকালবেলা শ্রীরামকৃষ্ণ একাকী বেলতলায় মণির সঙ্গে অনেক কথা কহিতেছেন। সাধনের নানা গুহ্যকথা, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগের কথা। আর কখনও কখনও মনই গুরু হয়—এ-সব কথা বলিতেছেন।
আহারের পর পঞ্চবটীতে আসিয়াছেন—মনোহর পীতাম্বরধারী! পঞ্চবটীতে দু-তিনজন বাবাজী বৈষ্ণব আসিয়াছেন—একজন বাউল। তিনি বৈষ্ণবকে বলছেন, তোর ডোরকৌপীনের স্বরূপ বল দেখি!
অপরাহ্ণে নানকপন্থী সাধু আসিয়াছেন। হরিশ, রাখালও আছেন। সাধু নিরাকারবাদী। ঠাকুর তাঁহাকে সাকারও চিন্তা করিতে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ সাধুকে বলিতেছেন, ডুব দাও; উপর উপর ভাসলে রত্ন পাওয়া যায় না। আর ঈশ্বর নিরাকারও বটেন আবার সাকার। সাকার চিন্তা করলে শীঘ্র ভক্তি হয়। তখন আবার নিরাকার চিন্তা। যেমন পত্র পড়ে নিয়ে সে পত্র ফেলে দেয়। তারপর লেখা অনুসারে কাজ করে।
১৯.১৬ ষোড়শ পরিচ্ছেদ – দক্ষিণেশ্বরে ভক্তসঙ্গে—বলরামের পিতা প্রভৃতি
আজ শনিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। এখন বেলা নয়টা হইবে। বলরামের পিতা আসিয়াছেন। রাখাল, হরিশ, মাস্টার, লাটু এখানে বাস করিতেছেন। শ্যামপুকুরের দেবেন্দ্র ঘোষ আসিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন।
একজন ভক্ত জিজ্ঞাসা করিতেছেন—ভক্তি কিসে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ (বলরামের পিতা প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি)—এগিয়ে পড়। সাত দেউড়ির পর রাজা আছেন। সব দেউড়ি পার হয়ে গেলে তবে তো রাজাকে দেখবে।
“আমি চানকে অন্নপূর্ণা প্রতিষ্ঠার সময় দ্বারিকবাবুকে বলেছিলাম, (১৮৭৪-৭৫) বড় দীঘিতে বড় মাছ আছে গভীর জলে। চার ফেল, সেই চারের গন্ধে ওই বড় মাছ আসবে। এক-একবার ঘাই দেবে। প্রেম-ভক্তিরূপ চার।”
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও অবতারতত্ত্ব]
“ঈশ্বর নরলীলা করেন। মানুষে তিনি অবতীর্ণ হন, যেমন শ্রীকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, চৈতন্যদেব।
“আমি কেশব সেনকে বলেছিলাম যে, মানুষের ভিতর তিনি বেশি প্রকাশ। মাঠের আলের ভিতর ছোট ছোট গর্ত থাকে; তাহাদের বলে ঘুটী। ঘুটীর ভিতর মাছ, কাঁকড়া জমে থাকে। মাছ, কাঁকড়া খুঁজতে গেলে ওই ঘুটীর ভিতর খুঁজতে হয়; ঈশ্বরকে খুঁজতে হলে অবতারের ভিতর খুঁজতে হয়।
“ওই চৌদ্দপোয়া মানুষের ভিতরে জগন্মাতা প্রকাশ হন। গানে আছে—
শ্যামা মা কি কল করেছে!
চৌদ্দপোয়া কলের ভিতরি কত রঙ্গ দেখাতেছে!
আপনি থাকি কলের ভিতরি কল ঘুরায় ধরে কলডুরি,
কল বলে আপনি ঘুরি জানে না কে ঘোরাতেছে ।
“কিন্তু ঈশ্বরকে জানতে হলে, অবতারকে চিনতে গেলে, সাধনের প্রয়োজন। দীঘিতে বড় বড় মাছ আছে, চার ফেলতে হয়। দুধেতে মাখন আছে, মন্থন করতে হয়। সরিষার ভিতর তেল আছে, সরিষাকে পিষতে হয়। মেথিতে হাত রাঙা হয়, মেথি বাটতে হয়।”
[নিরাকার সাধনা ও শ্রীরামকৃষ্ণ]
ভক্ত (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আচ্ছা, তিনি সাকার না নিরাকার?
শ্রীরামকৃষ্ণ—দাঁড়াও, আগে কলকাতায় যাও তবে তো জানবে, কোথায় গড়ের মাঠ, কোথায় এসিয়াটিক সোসাইটি, কোথায় বাঙ্গাল ব্যাঙ্ক!
“খড়দা বামুনপাড়া যেতে হলে আগে তো খড়দায় পৌঁছুতে হবে।
“নিরাকার সাধনা হবে না কেন; তবে বড় কঠিন। কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না হলে হয় না! বাহিরে ত্যাগ আবার ভিতরে ত্যাগ। বিষয়বুদ্ধির লেশ থাকলে হবে না।
“সাকার সাধনা সোজা। তবে তেমন সোজা নয়।
“নিরাকার সাধনা, জ্ঞানযোগের সাধনা, ভক্তদের কাছে বলতে নাই। অনেক কষ্টে একটু ভক্তি হচ্ছে, সব স্বপ্নবৎ বললে ভক্তির হানি হয়।
“কবীর দাস নিরাকারবাদী। শিব, কালী, কৃষ্ণ এদের মানত না। কবীর বলত, কালী চাল কলা খান; কৃষ্ণ গোপীদের হাততালিতে বানর নাচ নাচতেন। (সকলের হাস্য)
“নিরাকার সাধক হয়তো আগে দশভুজা দর্শন করলে; তারপর চতুর্ভুজ; তারপর দ্বিভুজ গোপাল; শেষে অখণ্ড জ্যোতিঃ দর্শন করে তাইতে লীন।
“দত্তাত্রেয়, জড়ভরত ব্রহ্মদর্শনের পর আর ফেরে নাই—এইরূপ আছে।
“একমতে আছে শুকদেব সেই ব্রহ্ম-সমুদ্রের একটি বিন্দুমাত্র আস্বাদ করেছিলেন। সমুদ্রের হিল্লোল-কল্লোল দর্শন, শ্রবণ করেছিলেন; কিন্তু সমুদ্রে ডুব দেন নাই।
“একজন ব্রহ্মচারী বলেছিল, কেদারের ওদিকে গেলে শরীর থাকে না। সেইরূপ ব্রহ্মজ্ঞানের পর আর শরীর থাকে না। একুশ দিনে মৃত্যু।
“প্রাচীরের ওপারে অনন্ত মাঠ। চারজন বন্ধু প্রাচীরের ওপারে কি আছে দেখতে চেষ্টা করলে। এক-একজন প্রাচীরের উপর উঠে, ওই মাঠ দর্শন করে হা হা করে হেসে অপরপারে পড়ে যেতে লাগল। তিনজন কোন খপর দিলে না। একজন শুধু খপর দিলে। তার ব্রহ্মজ্ঞানের পরও শরীর রইল, লোকশিক্ষার জন্য। যেমন অবতার আদির।
“হিমালয়ের ঘরে পার্বতী জন্মগ্রহণ করলেন; আর পিতাকে তাঁর নানান রূপ দেখাতে লাগলেন। হিমালয় বললেন, মা, এ-সব রূপ তো দেখলাম। কিন্তু তোমার একটি ব্রহ্মস্বরূপ আছে—সেইটি একবার দেখাও। পার্বতী বললেন, বাবা, তুমি যদি ব্রহ্মজ্ঞান চাও, তাহলে সংসারত্যাগ করে সাধুসঙ্গ করতে হবে।
“হিমালয় কোনমতে ছাড়েন না। তখন পার্বতী একবার দেখালেন। দেখতেই গিরিরাজ একেবারে মূর্ছিত।”
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তিযোগ]
“এ যা বললুম সব বিচারের কথা। ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা—এই বিচার। সব স্বপ্নবৎ! বড় কঠিন পথ। এ-পথে তাঁর লীলা স্বপ্নবৎ, মিথ্যা হয়ে যায়। আবার ‘আমি’টাও উড়ে যায়। এ-পথে অবতারও মানে না। বড় কঠিন। এ-সব বিচারের কথা ভক্তদের বেশি শুনতে নাই।
“তাই ঈশ্বর অবতীর্ণ হয়ে ভক্তির উপদেশ দেন—শরণাগত হতে বলেন। ভক্তি থেকে তাঁর কৃপায় সব হয়—জ্ঞান, বিজ্ঞান সব হয়।
“তিনি লীলা করছেন—তিনি ভক্তের অধীন।
“কোন কলের ভক্তিডোরে আপনি শ্যামা বাঁধা আছে!
“কখনও ঈশ্বর চুম্বক হন, ভক্ত ছুঁচ হয়। আবার কখনও ভক্ত চুম্বক হয়, তিনি ছুঁচ হন। ভক্ত তাঁকে টেনে লয়—তিনি ভক্তবত্সল, ভক্তাধীন।
“এক মতে আছে যশোদাদি গোপীগণ পূর্বজন্মে নিরাকারবাদী ছিলেন। তাঁদের তাতে তৃপ্তি হয় নাই। বৃন্দাবনলীলায় তাই শ্রীকৃষ্ণকে লয়ে আনন্দ। শ্রীকৃষ্ণ একদিন বললেন, তোমাদের নিত্যধাম দর্শন করাবো, এসো যমুনায় স্নান করতে যাই। তাঁরা যাই ডুব দিয়েছেন—একেবারে গোলকদর্শন। আবার তারপর অখণ্ড জ্যোতিঃ দর্শন। যশোদা তখন বললেন, কৃষ্ণ রে ও-সব আর দেখতে চাই না—এখন তোর সেই মানুষরূপ দেখবো! তোকে কোলে করবো, খাওয়াবো।
“তাই অবতারে তিনি বেশি প্রকাশ। অবতারের শরীর থাকতে থাকতে তাঁর পূজা সেবা করতে হয়।
‘সে যে কোঠার ভিতর চোরকুঠরি
ভোর হলে সে লুকাবে রে ।’
“অবতারকে সকলে চিনতে পারে না। দেহধারণ করলে রোগ, শোক, ক্ষুধা, তৃষ্ণা সবই আছে, মনে হয়, আমাদেরই মতো। রাম সীতার শোকে কেঁদেছিলেন—
‘পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে ।’
“পুরাণে আছে, হিরণ্যাক্ষ বধের পর বরাহ অবতার নাকি ছানা-পোনা নিয়ে ছিলেন—তাদের মাই দিচ্ছিলেন। (সকলের হাস্য) স্বধামে যাবার নামটি নাই। শেষে শিব এসে ত্রিশূল দিয়ে শরীর নাশ করলে, তিনি হি-হি করে হেসে স্বধামে গেলেন।”
১৯.১৭ সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ, ভবনাথ, রাখাল, মণি, লাটু প্রভৃতি সঙ্গে
বৈকালে ভবনাথ আসিয়াছেন। ঘরে রাখাল, মাস্টার, হরিশ প্রভৃতি আছেন। শনিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভবনাথের প্রতি)—অবতারের উপর ভালবাসা এলেই হল। আহা গোপীদের কি ভালবাসা!
এই বলিয়া গান গাহিতেছেন গোপীদের ভাবে :
গান—শ্যাম তুমি পরাণের পরাণ ।
গান—ঘরে যাবই যে না গো (সঙ্গিনীয়া)
গান—সেদিন আমি দুয়ারে দাঁড়ায়ে ।
(বঁধু যখন বিপিন যাও, বিপিন যাও)
(বঁধু ইচ্ছা হয়, ইচ্ছা হয় রাখাল হয়ে তোমার বাধা মাথায় বই!)
“রাসমধ্যে যখন শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হলেন, গোপীরা একেবারে উন্মাদিনী। বৃক্ষ দেখে বলে, তুমি বুঝি তপস্বী, শ্রীকৃষ্ণকে নিশ্চয় দেখেছ! তা না হলে নিশ্চল, সমাধিস্থ হয়ে রয়েছ কেন? তৃণাচ্ছাদিত পৃথিবী দেখে বলে, হে পৃথিবী, তুমি নিশ্চিত তাঁকে দর্শন করেছ, না হলে তুমি রোমাঞ্চিত হয়ে রয়েছ কেন? অবশ্য তুমি তাঁর স্পর্শসুখ সম্ভোগ করেছ! আবার মাধবীকে দেখে বলে, ‘ও মাধবী, আমায় মাধব দে!’ গোপীদের প্রেমোন্মাদ!
“যখন অক্রূর এলেন, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম মথুরা যাবার জন্য তাঁর রথে উঠলেন, তখন গোপীরা রথের চাকা ধরে রইলেন, যেতে দেবেন না।”
এই বলিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ আবার গান গাহিতেছেন :
ধরো না ধরো না রথচক্র, রথ কি চক্রে চলে!
যে চক্রের চক্রী হরি, যাঁর চক্রে জগৎ চলে!
শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “রথ কি চক্রে চলে”—এ-কথাগুলি আমার বড় লাগে। “যে চক্রে ব্রহ্মাণ্ড ঘোরে!” “রথীর আজ্ঞা লয়ে সারথি চালায়!”