১৮.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণের সিঁদুরিয়াপটী ব্রাহ্মসমাজে আগমন ও শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রভৃতির সহিত কথোপকথন
কার্তিক মাসের কৃষ্ণা একাদশী। ২৬শে নভেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ (সোমবার)। শ্রীযুক্ত মণিলাল মল্লিকের বাটীতে সিঁদুরিয়াপটী ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশন হয়। বাড়িটি চিত্পুর রোডের উপর; পূর্ব ধারে হ্যারিসন রোডের চৌমাথা—যেখানে বেদানা, পেস্তা, আপেল এবং অন্যান্য মেওয়ার দোকান—সেখান হইতে কয়েকখানি দোকানবাড়ির উত্তরে। সমাজের অধিবেশন রাজপথের পার্শ্ববর্তী দুতলার হলঘরে হয়। আজ সমাজের সাংবত্সরিক, তাই মণিলাল মহোত্সব করিয়াছেন।
উপাসনাগৃহ আজ আনন্দপূর্ণ, বাহিরে ও ভিতরে হরিৎ বৃক্ষপল্লবে নানা পুষ্প ও পুষ্পমালায় সুশোভিত। গৃহমধ্যে ভক্তগণ আসন গ্রহণ করিয়া প্রতীক্ষা করিতেছেন, কখন উপাসনা হইবে। গৃহমধ্যে সকলের স্থান হয় নাই, অনেকেই পশ্চিমদিকের ছাদে বিচরণ করিতেছেন, বা যথাস্থানে স্থাপিত সুন্দর বিচিত্র কাষ্ঠাসনে উপবিষ্ট হইয়াছেন। মাঝে মাঝে গৃহস্বামী ও তাঁহার আত্মীয়গণ আসিয়া মিষ্ট সম্ভাষণে অভ্যাগত ভক্তবৃন্দকে আপ্যায়িত করিতেছেন। সন্ধ্যার পূর্ব হইতেই ব্রাহ্মভক্তগণ আসিতে আরম্ভ করিয়াছেন। তাঁহারা আজ একটি বিশেষ উত্সাহে উত্সাহান্বিত—আজ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শুভাগমন হইবে। ব্রাহ্মসমাজের নেতৃগণ কেশব, বিজয়, শিবনাথ প্রভৃতি ভক্তগণকে পরমহংসদেব বড় ভালবাসেন, তাই তিনি ব্রাহ্মভক্তদের এত প্রিয়। তিনি হরিপ্রেমে মাতোয়ারা। তাঁহার প্রেম, তাঁহার জ্বলন্ত বিশ্বাস, তাঁহার বালকের ন্যায় ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন, ভগবানের জন্য ব্যাকুল হইয়া ক্রন্দন, তাঁহার মাতৃজ্ঞানে স্ত্রীজাতির পূজা, তাঁহার বিষয়কথা-বর্জন ও তৈলধারাতুল্য নিরবচ্ছিন্ন ঈশ্বরকথা প্রসঙ্গ, তাঁহার সর্বধর্ম-সমন্বয় ও অপর ধর্মে বিদ্বেষ-ভাবলেশশূন্যতা, তাঁহার ঈশ্বরভক্তের জন্য রোদন—এই সকল ব্যাপারে ব্রাহ্মভক্তদের চিত্তাকর্ষণ করিয়াছে। তাই আজ অনেকে বহুদূর হইতে তাঁহার দর্শনলাভার্থে আসিয়াছেন।
[শিবনাথ ও সত্যকথা—ঠাকুর ‘সমাধিমন্দিরে’]
উপাসনার পূর্বে শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও অন্যান্য ব্রাহ্মভক্তদের সহিত সহাস্যবদনে আলাপ করিতেছেন। সমাজগৃহে আলো জ্বালা হইল, অনতিবিলম্বে উপাসনা আরম্ভ হইবে।
পরমহংসদেব বলিতেছেন, “হ্যাঁগা, শিবনাথ আসবে না?” একজন ব্রাহ্মভক্ত বলিতেছেন, “না, আজ তাঁর অনেক কাজ আছে, আসতে পারবেন না।” পরমহংসদেব বলিলেন, “শিবনাথকে দেখলে আমার আনন্দ হয়, যেন ভক্তিরসে ডুবে আছে; আর যাকে অনেকে গণে-মানে, তাতে নিশ্চয়ই ঈশ্বরের কিছু শক্তি আছে। তবে শিবনাথের একটা ভারী দোষ আছে—কথার ঠিক নাই। আমাকে বলেছিল যে, একবার ওখানে (দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে) যাবে, কিন্তু যায় নাই, আর কোন খবরও পাঠায় নাই, ওটা ভাল নয়। এইরকম আছে যে, সত্য কথাই কলির তপস্যা। সত্যকে আঁট করে ধরে থাকলে ভগবানলাভ হয়। সত্যে আঁট না থাকলে ক্রমে ক্রমে সব নষ্ট হয়। আমি এই ভেবে যদিও কখন বলে ফেলি যে বাহ্যে যাব, যদি বাহ্যে নাও পায় তবুও একবার গাড়ুটা সঙ্গে করে ঝাউতলার দিকে যাই। ভয় এই—পাছে সত্যের আঁট যায়। আমার এই অবস্থার পর মাকে ফুল হাতে করে বলেছিলাম, ‘মা! এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার শুচি, এই নাও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার ভাল, এই নাও তোমার মন্দ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও মা; এই নাও তোমার পুণ্য, এই নাও তোমার পাপ, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’ যখন এই সব বলেছিলুম, তখন এ-কথা বলিতে পারি নাই, ‘মা! এই নাও তোমার সত্য, এই নাও তোমার অসত্য।’ সব মাকে দিতে পারলুম, ‘সত্য’ মাকে দিতে পারলুম না।”
ব্রাহ্মসমাজের পদ্ধতি অনুসারে উপাসনা আরম্ভ হইল। বেদীর উপর আচার্য, সম্মুখে সেজ। উদ্বোধনের পর আচার্য পরব্রহ্মের উদ্দেশে বেদোক্ত মহামন্ত্র উচ্চারণ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মভক্তগণ সমস্বরে সেই পুরাতন আর্য ঋষির শ্রীমুখ-নিঃসৃত, তাঁহাদের সেই পবিত্র রসনার দ্বারা উচ্চারিত নামগান করিতে লাগিলেন। বলিতে লাগিলেন, “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম, আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি, শান্তং শিবমদ্বৈতম্, শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।” প্রণবসংযুক্ত এই ধ্বনি ভক্তদের হৃদয়াকাশে প্রতিধ্বনিত হইল। অনেকের অন্তরে বাসনা নির্বাপিতপ্রায় হইল। চিত্ত অনেকটা স্থির ও ধ্যানপ্রবণ হইতে লাগিল। সকলেরই চক্ষু মুদ্রিত!—ক্ষণকালের জন্য বেদোক্ত সগুণ ব্রহ্মের চিন্তা করিতে লাগিলেন।
পরমহংসদেব ভাবে নিমগ্ন। স্পন্দহীন, স্থিরদৃষ্টি, অবাক্ চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় বসিয়া আছেন। আত্মাপক্ষী কোথায় আনন্দে বিচরণ করিতেছেন, আর দেহটি মাত্র শূন্যমন্দিরে পড়িয়া রহিয়াছে।
সমাধির অব্যবহিত পরেই চক্ষু মেলিয়া চারিদিকে চাহিতেছেন। দেখিলেন, সভাস্থ সকলেই নিমীলিত নেত্র। তখন ‘ব্রহ্ম’ ‘ব্রহ্ম’ বলিয়া হঠাৎ দণ্ডায়মান হইলেন। উপাসনান্তে ব্রাহ্মভক্তেরা খোল-করতাল লইয়া সংকীর্তন করিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমানন্দে মত্ত হইয়া তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন আর নৃত্য করিতে লাগিলেন। সকলে মুগ্ধ হইয়া সেই নৃত্য দেখিতেছেন। বিজয় ও অন্যান্য ভক্তেরাও তাঁহাকে বেড়িয়া বেড়িয়া নাচিতেছেন। অনেকে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখিয়া ও কীর্তনানন্দ সম্ভোগ করিয়া এককালে সংসার ভুলিয়া গেলেন—ক্ষণকালের জন্য হরি-রস-মদিরা পান করিয়া বিষয়ানন্দ ভুলিয়া গেলেন। বিষয়সুখের রস তিক্তবোধ হইতে লাগিল।
কীর্তনান্তে সকলে আসন গ্রহণ করিলেন। ঠাকুর কি বলেন, শুনিবার জন্য সকলে তাঁহাকে ঘেরিয়া বসিলেন।
১৮.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – গৃহস্থের প্রতি উপদেশ
সমবেত ব্রাহ্মভক্তগণকে সম্বোধন করিয়া তিনি বলিতেছেন, “নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করা কঠিন। প্রতাপ বলেছিল, মহাশয়, আমাদের জনক রাজার মত। জনক নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করেছিলেন, আমরাও তাই করব। আমি বললুম, মনে করলেই কি জনক রাজা হওয়া যায়! জনক রাজা কত তপস্যা করে জ্ঞানলাভ করেছিলেন, হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে অনেক বৎসর ঘোরতর তপস্যা করে তবে সংসারে ফিরে গিছলেন।
“তবে সংসারীর কি উপায় নাই? — হাঁ অবশ্য আছে। দিন কতক নির্জনে সাধন করতে হয়। তবে ভক্তিলাভ হয়, জ্ঞানলাভ হয়; তারপর গিয়ে সংসার কর, দোষ নাই। যখন নির্জনে সাধন করবে, সংসার থেকে একেবারে তফাতে যাবে। তখন যেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মাতা, পিতা, ভাই, ভগিনী, আত্মীয়-কুটুম্ব কেহ কাছে না থাকে। নির্জনে সাধনের সময় ভাববে, আমার কেউ নাই; ঈশ্বরই আমার সর্বস্ব। আর কেঁদে কেঁদে তাঁর কাছে জ্ঞান-ভক্তির জন্য প্রার্থনা করবে।
“যদি বল কতদিন সংসার ছেড়ে নির্জনে থাকবো? তা একদিন যদি এইরকম করে থাক, সেও ভাল; তিনদিন থাকলে আরও ভাল; বা বারোদিন, একমাস, তিনমাস, একবৎসর — যে যেমন পারে। জ্ঞান-ভক্তিলাভ করে সংসার করলে আর বেশি ভয় নাই।
“হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে হাতে আঠা লাগে না। চোর চোর যদি খেল বুড়ি ছুঁয়ে ফেললে আর ভয় নাই। একবার পরশমণিকে ছুঁয়ে সোনা হও, সোনা হবার পর হাজার বৎসর যদি মাটিতে পোঁতা থাক, মাটি থেকে তোলবার সময় সেই সোনাই থাকবে।
“মনটি দুধের মতো। সেই মনকে যদি সংসার-জলে রাখ, তাহলে দুধেজলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মনরূপ দুধ থেকে জ্ঞান-ভক্তিরূপ মাখন তোলা হল, তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার-জলে রাখা যায়। সে মাখন কখনও সংসার-জলের সঙ্গে মিশে যাবে না — সংসার-জলের উপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে।”
১৮.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – শ্রীযুক্ত বিজয় গোস্বামীর নির্জনে সাধন
শ্রীযুক্ত বিজয় গোস্বামী সবে গয়া হইতে ফিরিয়াছেন। সেখানে অনেকদিন নির্জনে বাস ও সাধুসঙ্গ হইয়াছিল। এক্ষণে তিনি গৈরিকবসন পরিধান করিয়াছেন। অবস্থা ভারী সুন্দর, যেন সর্বদা অন্তর্মুখ। পরমহংসদেবের নিকট হেঁটমুখ হইয়া রহিয়াছেন, যেন মগ্ন হইয়া কি ভাবিতেছেন।
বিজয়কে দেখিতে দেখিতে পরমহংসদেব তাঁহাকে বলিলেন, “বিজয়! তুমি কি বাসা পাকড়েছ?
“দেখ, দুজন সাধু ভ্রমণ করতে করতে একটি শহরে এসে পড়েছিল। একজন হাঁ করে শহরের বাজার, দোকান, বাড়ি দেখছিল; এমন সময় অপরটির সঙ্গে দেখা হল। তখন সে সাধুটি বললে, তুমি হাঁ করে শহর দেখছ—তল্পি-তল্পা কোথায়? প্রথম সাধুটি বললে, আমি আগে বাসা পাকড়ে, তল্পি-তল্পা রেখে, ঘরে চাবি দিয়ে, নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়েছি। এখন শহরে রঙ দেখে বেড়াচ্ছি। তাই তোমায় জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কি বাসা পাকড়েছ? (মাস্টার ইত্যাদির প্রতি) দেখ, বিজয়ের এতদিন ফোয়ারা চাপা ছিল, এইবার খুলে গেছে।”
[বিজয় ও শিবনাথ—নিষ্কামকর্ম—সন্ন্যাসীর বাসনাত্যাগ]
(বিজয়ের প্রতি)—দেখ, শিবনাথের ভারী ঝঞ্ঝাট। খবরের কাগজ লিখতে হয়, আর অনেক কর্ম করতে হয়। বিষয়কর্ম করলেই অশান্তি হয়, অনেক ভাবনা-চিন্তা জোটে।
“শ্রীমদ্ভাগবতে আছে যে, অবধূত চব্বিশ গুরুর মধ্যে চিলকে একটি গুরু করেছিলেন। এক জায়গায় জেলেরা মাছ ধরছিল, একটি চিল এসে একটা মাছ ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। কিন্তু মাছ দেখে পেছনে পেছনে প্রায় এক হাজার কাক চিলকে তাড়া করে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কা কা করে বড় গোলমাল করতে লাগল। মাছ নিয়ে চিল যেদিকে যায়, কাকগুলোও তাড়া করে সেইদিকে যেতে লাগল। দক্ষিণদিকে চিলটা গেল, কাকগুলোও সেইদিকে গেল; আবার উত্তরদিকে যখন সে গেল, ওরাও সেইদিকে গেল। এইরূপে পূর্বদিকে ও পশ্চিমদিকে চিল ঘুরতে লাগল। শেষে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাছটা তার কাছ থেকে পড়ে গেল। তখন কাকগুলো চিলকে ছেড়ে মাছের দিকে গেল। চিল তখন নিশ্চিন্ত হয়ে একটা গাছের ডালের উপর গিয়ে বসল। বসে ভাবতে লাগল—ওই মাছটা যত গোল করেছিল। এখন মাছ কাছে নাই, আমি নিশ্চিন্ত হলুম।
“অবধূত চিলের কাছে এই শিক্ষা করলেন যে, যতক্ষণ সঙ্গে মাছ থাকে অর্থাৎ বাসনা থাকে ততক্ষণ কর্ম থাকে আর কর্মের দরুন ভাবনা, চিন্তা, অশান্তি। বাসনাত্যাগ হলেই কর্মক্ষয় হয় আর শান্তি হয়।
“তবে নিষ্কামকর্ম ভাল। তাতে অশান্তি হয় না। কিন্তু নিষ্কামকর্ম করা বড় কঠিন। মনে করছি, নিষ্কামকর্ম করছি, কিন্তু কোথা থেকে কামনা এসে পড়ে, জানতে দেয় না। আগে যদি অনেক সাধন থাকে, সাধনের বলে কেউ কেউ নিষ্কামকর্ম করতে পারে। ঈশ্বরদর্শনের পর নিষ্কামকর্ম অনায়াসে করা যায়। ঈশ্বরদর্শনের পর প্রায় কর্মত্যাগ হয়; দুই-একজন (নারদাদি) লোকশিক্ষার জন্য কর্ম করে।”
[সন্ন্যাসী সঞ্চয় করিবে না—প্রেম হলে কর্মত্যাগ হয়]
“অবধূতের আর-একটি গুরু ছিল—মৌমাছি! মৌমাছি অনেক কষ্টে অনেকদিন ধরে মধু সঞ্চয় করে। কিন্তু সে মধু নিজের ভোগ হয় না। আর-একজন এসে চাক ভেঙে নিয়ে যায়। মৌমাছির কাছে অবধূত এই শিখলেন যে, সঞ্চয় করতে নাই। সাধুরা ঈশ্বরের উপর ষোল আনা নির্ভর করবে। তাদের সঞ্চয় করতে নাই।
“এটি সংসারীর পক্ষে নয়। সংসারীর সংসার প্রতিপালন করতে হয়। তাই সঞ্চয়ের দরকার হয়! পন্ছী (পাখি) আউর দরবেশ (সাধু) সঞ্চয় করে না। কিন্তু পাখির ছানা হলে সঞ্চয় করে—ছানার জন্য মুখে করে খাবার আনে।
“দেখ বিজয়, সাধুর সঙ্গে যদি পুঁটলি-পাটলা থাকে, পনেরটা গাঁটওয়ালা যদি কাপড়-বুচকি থাকে তাহলে তাদের বিশ্বাস করো না। আমি বটতলায় ওইরকম সাধু দেখেছিলাম। দু-তিনজন বসে আছে, কেউ ডাল বাছছে, কেউ কেউ কাপড় সেলাই করছে, আর বড় মানুষের বাড়ির ভাণ্ডারার গল্প করছে। বলছে, ‘আরে ও বাবুনে লাখো রূপেয়া খরচ কিয়া, সাধু লোককো বহুৎ খিলায়া—পুরি, জিলেবী, পেড়া, বরফী, মালপুয়া, বহুৎ চিজ তৈয়ার কিয়া।” (সকলের হাস্য)
বিজয়—আজ্ঞা হাঁ। গয়ায় ওইরকম সাধু দেখেছি। গয়ায় লোটাওয়ালা সাধু। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয়ের প্রতি)—ঈশ্বরের প্রতি প্রেম আসলে কর্মত্যাগ আপনি হয়ে যায়। যাদের ঈশ্বর কর্ম করাচ্ছেন, তারা করুক। তোমার এখন সময় হয়েছে।—সব ছেড়ে তুমি বলো, “মন, তুই দেখ আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে।”
এই বলিয়া ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ সেই অতুলনীয় কণ্ঠে মাধুর্য বর্ষণ করিতে করিতে গান গাহিলেন ঃ
যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে,
মন তুই দেখ আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে ।
কামাদিরে দিয়ে ফাঁকি, আয় মন বিরলে দেখি,
রসনারে সঙ্গে রাখি, সে যেন মা বলে ডাকে ।
(মাঝে মাঝে সে যেন মা বলে ডাকে) ॥
কুরুচি কুমন্ত্রী যত, নিকট হতে দিও নাকো
জ্ঞাননয়নকে প্রহরী রেখো, সে যেন সাবধানে থাকে ।
(খুব যেন সাবধানে থাকে) ॥
(বিজয়ের প্রতি)—“ভগবানের শরণাগত হয়ে এখন লজ্জা, ভয়—এ-সব ত্যাগ কর। ‘আমি হরিনামে যদি নাচি, লোকে আমায় কি বলবে’—এ-সব ভাব ত্যাগ কর।”
[লজ্জা—ঘৃণা—ভয়]
“লজ্জা, ঘৃণা, ভয় তিন থাকতে নয়। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, জাতি অভিমান, গোপন ইচ্ছা—এ-সব পাশ। এ-সব গেলে জীবের মুক্তি হয়।
“পাশবদ্ধ জীব, পাশমুক্ত শিব। ভগবানের প্রেম—দুর্লভ জিনিস। প্রথমে স্ত্রীর যেমন স্বামীতে নিষ্ঠা, সেইরূপ নিষ্ঠা যদি ঈশ্বরেতে হয় তবেই ভক্তি হয়। শুদ্ধাভক্তি হওয়া বড় কঠিন। ভক্তিতে প্রাণ মন ঈশ্বরেতে লীন হয়।
“তারপর ভাব। ভাবেতে মানুষ অবাক্ হয়। বায়ু স্থির হয়ে যায়। আপনি কুম্ভক হয়। যেমন বন্দুকে গুলি ছোড়বার সময়, যে ব্যক্তি গুলি ছোড়ে সে বাক্যশূন্য হয় ও তার বায়ু স্থির হয়ে যায়।
“প্রেম হওয়া অনেক দূরের কথা। চৈতন্যদেবের প্রেম হয়েছিল। ঈশ্বরে প্রেম হলে বাহিরের জিনিস ভুল হয়ে যায়। জগৎ ভুল হয়ে যায়। নিজের দেহ যে এত প্রিয় জিনিস—তাও ভুল হয়ে যায়।”
এই বলিয়া পরমহংসদেব আবার গান গাহিতেছেন :
সেদিন কবে বা হবে?
হরি বলিতে ধারা বেয়ে পড়বে (সেদিন কবে বা হবে?)
সংসার বাসনা যাবে (সেদিন কবে বা হবে?)
অঙ্গে পুলক হবে (সেদিন কবে বা হবে?) ।
১৮.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ভাব ও কুম্ভক—মহাবায়ু উঠিলে ভগবানদর্শন
এইরূপ কথাবার্তা চলিতেছে, এমন সময় নিমন্ত্রিত আর কয়েকটি ব্রাহ্মভক্ত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তন্মধ্যে কয়েকটি পণ্ডিত ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। তাঁহাদের মধ্যে একজন শ্রীরজনীনাথ রায়।
ঠাকুর বলিতেছেন, ভাব হইলে বায়ু স্থির হয়; আর বলিতেছেন, অর্জুন যখন লক্ষ্য বিঁধেছিল, কেবল মাছের চোখের দিকে দৃষ্টি ছিল—আর কোন দিকে দৃষ্টি ছিল না। এমন কি চোখ ছাড়া আর কোন অঙ্গ দেখতে পায় নাই। এরূপ অবস্থায় বায়ু স্থির হয়, কুম্ভক হয়।
“ঈশ্বরদর্শনের একটি লক্ষণ,—ভিতর থেকে মহাবায়ু গর্গর্ করে উঠে মাথার দিকে যায়! তখন যদি সমাধি হয়, ভগবানের দর্শন হয়।”
[শুধু পাণ্ডিত্য মিথ্যা—ঐশ্বর্য, বিভব, মান, পদ, সব মিথ্যা]
(অভ্যাগত ব্রাহ্মভক্ত দৃষ্টে)—“যারা শুধু পণ্ডিত, কিন্তু যাদের ভগবানে ভক্তি নাই, তাদের কথা গোলমেলে। সামাধ্যায়ী বলে এক পণ্ডিত বলেছিল, ‘ঈশ্বর নীরস, তোমরা নিজের প্রেমভক্তি দিয়ে সরস করো।’ বেদে যাঁকে ‘রসস্বরূপ’ বলেছে তাঁকে কি না নীরস বলে! আর এতে বোধ হচ্ছে, সে ব্যক্তি ঈশ্বর কি বস্তু কখনও জানে নাই। তাই এরূপ গোলমেলে কথা।
“একজন বলেছিল, ‘আমার মামার বাড়িতে এক গোয়াল ঘোড়া আছে।’ এ-কথায় বুঝতে হবে, ঘোড়া আদবেই নাই, কেননা গোয়ালে ঘোড়া থাকে না। (সকলের হাস্য)
“কেউ ঐশ্বর্যের—বিভব, মান, পদ—এই সবের অহংকার করে। এ-সব দুই দিনের জন্য, কিছুই সঙ্গে যাবে না। একটা গানে আছে :
ভেবে দেখ মন কেউ কারু নয়, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে ।
ভুল না দক্ষিণাকালী বদ্ধ হয়ে মায়াজালে ॥
যার জন্য মর ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে ।
সেই প্রেয়সী দিবে ছড়া, অমঙ্গল হবে বলে ॥
দিন দুই-তিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে ।
সেই কর্তারে দেবে ফেলে, কালাকালের কর্তা এলে ॥”
[অহংকারের মহৌষধ—তারে বাড়া আছে]
“আর টাকার অহংকার করতে নাই। যদি বল আমি ধনী,—তো ধনীর আবার তারে বাড়া তারে বাড়া আছে। সন্ধ্যার পর যখন জোনাকি পোকা উঠে, সে মনে করে, আমি এই জগৎকে আলো দিচ্ছি! কিন্তু নক্ষত্র যাই উঠল অমনি তার অভিমান চলে গেল। তখন নক্ষত্রেরা ভাবতে লাগল আমরা জগৎকে আলো দিচ্ছি! কিছু পরে চন্দ্র উঠল, তখন নক্ষত্রেরা লজ্জায় মলিন হয়ে গেল। চন্দ্র মনে করলেন আমার আলোতে জগৎ হাসছে, আমি জগৎকে আলো দিচ্ছি। দেখতে দেখতে অরুণ উদয় হল, সূর্য উঠছেন। চাঁদ মলিন হয়ে গেল,—খানিকক্ষণ পরে আর দেখাই গেল না।
“ধনীরা যদি এইগুলি ভাবে, তাহলে ধনের অহংকার হয় না।”
উত্সব উপলক্ষে মণিলাল অনেক উপাদেয় খাদ্যসামগ্রীর আয়োজন করিয়াছেন। তিনি অনেক যত্ন করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ ও সমবেত ভক্তগণকে পরিতোষ করিয়া খাওয়াইলেন। যখন সকলে বাড়ি প্রত্যাগমন করিলেন, তখন রাত্রি অনেক, কিন্তু কাহারও কোন কষ্ট হয় নাই।
১৮.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – কেশবের বাটীর সম্মুখে—“পশ্যতি তব পন্থানম্”
[কেশব, প্রসন্ন, অমৃত, উমানাথ, কেশবের মা, রাখাল, মাস্টার]
কার্তিক কৃষ্ণা চতুর্দশী; ২৮শে নভেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, বুধবার। আজ একটি ভক্ত কমলকুটিরের (Lily Cottage) ফটকের পূর্বধারের ফুটপাথে পায়চারি করিতেছেন। কাহার জন্য ব্যাকুল হইয়া যেন অপেক্ষা করিতেছেন।
কমলকুটিরের উত্তরে মঙ্গলবাড়ি, ব্রাহ্মভক্তেরা অনেকে বাস করেন। কমলকুটিরে কেশব থাকেন। তাঁহার পীড়া বাড়িয়াছে। অনেকে বলিতেছেন, এবার বোধ হয় বাঁচিবার সম্ভাবনা নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ কেশবকে বড় ভালবাসেন! আজ তাঁহাকে দেখিতে আসিবেন। তিনি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি হইতে আসিতেছেন। তাই ভক্তটি চাহিয়া আছেন, কখন আসেন।
কমলকুটির সার্কুলার রোডের পশ্চিম ধারে। তাই রাস্তাতেই ভক্তটি বেড়াইতেছিলেন। বেলা ২টা হইতে তিনি অপেক্ষা করিতেছেন। কত লোকজন যাইতেছে, তিনি দেখিতেছেন।
রাস্তার পূর্বধারে ভিক্টোরিয়া কলেজ। এখানে কেশবের সমাজের ব্রাহ্মিকাগণ ও তাঁহাদের মেয়েরা অনেকে পড়েন। রাস্তা হইতে স্কুলের ভিতর অনেকটা দেখা যায়। উহার উত্তরে একটি বড় বাগানবাড়িতে কোন ইংরেজ ভদ্রলোক থাকেন। ভক্তটি অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতেছেন যে, তাঁহাদের বাড়িতে কোন বিপদ হইয়াছে। ক্রমে কালোপরিচ্ছদধারী কোচম্যান ও সহিস মৃতদেহের গাড়ি লইয়া উপস্থিত হইল। দেড় দুই ঘণ্টা ধরিয়া ওই সকল আয়োজন হইতেছে।
এই মর্ত্যধাম ছাড়িয়া কে চলিয়া গিয়াছে—তাই আয়োজন।
ভক্তটি ভাবিতেছেন, কোথায়? দেহত্যাগ করিয়া কোথায় যায়?
উত্তর হইতে দক্ষিণদিকে কত গাড়ি আসিতেছে। ভক্তটি এক-একবার লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছেন, তিনি আসিতেছেন কি না।
বেলা প্রায় ৫টা বাজিল। ঠাকুরের গাড়ি আসিয়া উপস্থিত, সঙ্গে লাটু ও আর দু-একটি ভক্ত। আর মাস্টার ও রাখাল আসিয়াছেন।
কেশবের বাড়ির লোকেরা আসিয়া ঠাকুরকে সঙ্গে করিয়া উপরে লইয়া গেলেন। বৈঠকখানার দক্ষিণদিকে বারান্দায় একখানি তক্তপোশ পাতা ছিল। তাহার উপর ঠাকুরকে বসানো হইল।
১৮.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ—ঈশ্বরাবেশে মার সঙ্গে কথা
ঠাকুর অনেকক্ষণ বসিয়া আছেন। কেশবকে দেখিবার জন্য অধৈর্য হইয়াছেন। কেশবের শিষ্যেরা বিনীতভাবে বলিতেছেন, তিনি একটু এই বিশ্রাম করছেন, এইবার একটু পরে আসছেন।
কেশবের সঙ্কটাপন্ন পীড়া। তাই শিষ্যেরা ও বাড়ির লোকেরা এত সাবধান। ঠাকুর কিন্তু কেশবকে দেখিতে উত্তরোত্তর ব্যস্ত হইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের শিষ্যদের প্রতি)—হ্যাঁগা! তাঁর আসবার কি দরকার? আমিই ভেতরে যাই না কেন?
প্রসন্ন (বিনীতভাবে)—আজ্ঞে, আর একটু পরে তিনি আসছেন।
ঠাকুর—যাও; তোমরাই অমন করছ! আমিই ভিতরে যাই।
প্রসন্ন ঠাকুরকে ভুলাইয়া কেশবের গল্প করিতেছেন।
প্রসন্ন—তাঁর অবস্থা আর-একরকম হয়ে গেছে। আপনারই মতো মার সঙ্গে কথা কন। মা কি বলেন, শুনে হাসেন-কাঁদেন।
কেশব জগতের মার সঙ্গে কথা কন, হাসেন-কাঁদেন—এই কথা শুনিবামাত্র ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। দেখিতে দেখিতে সমাধিস্থ!
ঠাকুর সমাধিস্থ! শীতকাল, গায়ে সবুজ রঙের বনাতের গরম জামা; জামার উপর একখানি বনাত। উন্নত দেহ, দৃষ্টি স্থির। একেবারে মগ্ন! অনেকক্ষণ এই অবস্থায়। সমাধিভঙ্গ আর হইতেছে না।
সন্ধ্যা হইয়াছে! ঠাকুর একটু প্রকৃতিস্থ। পার্শ্বের বৈঠকখানায় আলো জ্বালা হইয়াছে। ঠাকুরকে সেই ঘরে বসাইবার চেষ্টা হইতেছে।
অনেক কষ্টে তাঁহাকে বৈঠকখানার ঘরে লইয়া যাওয়া হইল।
ঘরে অনেকগুলি আসবাব—কৌচ, কেদারা, আলনা, গ্যাসের আলো। ঠাকুরকে একখানা কৌচের উপর বসানো হইল।
কৌচের উপর বসিয়াই আবার বাহ্যশূন্য, ভাবাবিষ্ট।
কৌচের উপর দৃষ্টিপাত করিয়া যেন নেশার ঘোরে কি বলিতেছেন, “আগে এ-সব দরকার ছিল। এখন আর কি দরকার?
(রাখাল দৃষ্টে)—“রাখাল, তুই এসেছিস?”
[জগন্মাতাদর্শন ও তাঁহার সহিত কথা—Immortality of the Soul]
বলিতে বলিতে ঠাকুর আবার কি দেখিতেছেন। বলছেন,
“এই যে মা এসেছো! আবার বারাণসী কাপড় পরে কি দেখাও। মা হ্যাঙ্গাম করো না! বসো গো বসো!”
ঠাকুরের মহাভাবের নেশা চলিতেছে। ঘর আলোকময়। ব্রাহ্মভক্তেরা চতুর্দিকে আছেন। লাটু, রাখাল, মাস্টার ইত্যাদি কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুর ভাবাবস্থায় আপনা-আপনি বলিতেছেন,
“দেহ আর আত্মা। দেহ হয়েছে আবার যাবে! আত্মার মৃত্যু নাই। যেমন সুপারি; পাকা সুপারি ছাল থেকে আলাদা হয়ে থাকে, কাঁচা বেলায় ফল আলাদা আর ছাল আলাদা করা বড় শক্ত। তাঁকে দর্শন করলে, তাঁকে লাভ করলে দেহবুদ্ধি যায়! তখন দেহ আলাদা, আত্মা আলাদা বোধ হয়।”
[কেশবের প্রবেশ]
কেশব ঘরে প্রবেশ করিতেছেন। পূর্বদিকের দ্বার দিয়া আসিতেছেন। যাঁহারা তাঁহাকে ব্রাহ্মসমাজ-মন্দিরে বা টাউনহলে দেখিয়াছিলেন, তাঁহারা তাঁহার অস্থিচর্মসার মূর্তি দেখিয়া অবাক্ হইয়া রহিলেন। কেশব দাঁড়াইতে পারিতেছেন না, দেয়াল ধরিয়া ধরিয়া অগ্রসর হইতেছেন। অনেক কষ্টের পর কৌচের সম্মুখে আসিয়া বসিলেন।
ঠাকুর ইতিমধ্যে কৌচ হইতে নামিয়া নিচে বসিয়াছেন। কেশব ঠাকুরের দর্শনলাভ করিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া প্রণাম করিতেছেন। প্রণামান্তর উঠিয়া বসিলেন। ঠাকুর এখনও ভাবাবস্থায়। আপনা-আপনি কি বলিতেছেন। ঠাকুর মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
১৮.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ—মানুষলীলা
এইবার কেশব উচ্চৈঃস্বরে বলছেন, “আমি এসেছি”, “আমি এসেছি!” এই বলিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বাম হাত ধারণ করিলেন ও সেই হাতে হাত বুলাইতে লাগিলেন। ঠাকুর ভাবে গরগর মাতোয়ারা। আপনা-আপনি কত কথা বলিতেছেন। ভক্তেরা সকলে হাঁ করিয়া শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যতক্ষণ উপাধি, ততক্ষণ নানা বোধ। যেমন কেশব, প্রসন্ন, অমৃত—এই সব। পূর্ণজ্ঞান হলে এক চৈতন্য-বোধ হয়।
“আবার পূর্ণজ্ঞানে দেখে যে, সেই এক চৈতন্য এই জীবজগৎ, এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন।
“তবে শক্তিবিশেষ। তিনিই সব হয়েছেন বটে, কিন্তু কোনখানে বেশি শক্তির প্রকাশ, কোনখানে কম শক্তির প্রকাশ।
“বিদ্যাসাগর বলেছিল, ‘তা ঈশ্বর কি কারুকে বেশি শক্তি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?’ আমি বললুম, ‘তা যদি না হতো, তাহলে একজন লোক পঞ্চাশজন লোককে হারিয়ে দেয় কেমন করে, আর তোমাকেই বা আমরা দেখতে এসেছি কেন?’
“তাঁর লীলা যে আধারে প্রকাশ করেন, সেখানে বিশেষ শক্তি।
“জমিদার সব জায়গায় থাকেন। কিন্তু অমুক বৈঠকখানায় তিনি প্রায় বসেন। ভক্ত তাঁর বৈঠকখানা। ভক্তের হৃদয়ে তিনি লীলা করতে ভালবাসেন। ভক্তের হৃদয়ে তাঁর বিশেষ শক্তি অবতীর্ণ হয়।
“তার লক্ষণ কি? যেখানে কার্য বেশি, সেখানে বিশেষ শক্তির প্রকাশ।
“এই আদ্যাশক্তি আর পরব্রহ্ম অভেদ। একটিকে ছেড়ে আর-একটিকে চিন্তা করবার জো নাই। যেমন জ্যোতিঃ আর মণি! মণিকে ছেড়ে মণির জ্যোতিঃকে ভাববার জো নাই, আবার জ্যোতিঃকে ছেড়ে মণিকে ভাববার জো নাই। সাপ আর তির্যগ্গতি। সাপকে ছেড়ে তির্যগ্গতি ভাববার জো নাই, আবার সাপের তির্যগ্গতি ছেড়ে সাপকে ভাববার জো নাই।”
[ব্রাহ্মসমাজ ও মানুষে ঈশ্বরদর্শন—সিদ্ধ ও সাধকের প্রভেদ]
“আদ্যাশক্তিই এই জীবজগৎ, এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। অনুলোম, বিলোম। রাখাল, নরেন্দ্র আর আর ছোকরাদের জন্য ব্যস্ত হই কেন? হাজরা বললে, তুমি ওদের জন্য ব্যস্ত হয়ে বেড়াচ্ছ, তা ঈশ্বরকে ভাববে কখন? (কেশব ও সকলের ঈষৎ হাস্য)
“তখন মহা চিন্তিত হলুম। বললুম, মা একি হল। হাজরা বলে, ওদের জন্য ভাব কেন? তারপর ভোলানাথকে জিজ্ঞাসা করলুম। ভোলানাথ বললে, ভারতে১ ওই কথা আছে। সমাধিস্থ লোক সমাধি থেকে নেমে কোথায় দাঁড়াবে? তাই সত্ত্বগুণী ভক্ত নিয়ে থাকে। ভারতের এই নজির পেয়ে তবে বাঁচলুম! (সকলের হাস্য)১ ‘ভারত’ অর্থাৎ মহাভারত। শ্রীযুক্ত ভোলানাথ তখন কালীবাড়ির মুহুরী, ঠাকুরকে ভক্তি করিতেন ও মাঝে মাঝে গিয়া মহাভারত শুনাইতেন। ৺দীননাথ খাজা়ঞ্চীর পরলোকের পর ভোলানাথ কালীবাড়ির খাজা়ঞ্চী হইয়াছিলেন।
“হাজরার দোষ নাই। সাধক অবস্থায় সব মনটা ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে তাঁর দিকে দিতে হয়। সিদ্ধ অবস্থায় আলাদা কথা, তাঁকে লাভ করবার পর অনুলোম বিলোম। ঘোল ছেড়ে মাখন পেয়ে, তখন বোধ হয়, ‘ঘোলেরই মাখন, মাখনেরই ঘোল।’ তখন ঠিক বোধ হয়, তিনিই সব হয়েছেন। কোনখানে বেশি প্রকাশ, কোনখানে কম প্রকাশ।
“ভাবসমুদ্র উথলালে ডাঙায় একবাঁশ জল। আগে নদী দিয়ে সমুদ্রে আসতে হলে এঁকেবেঁকে ঘুরে আসতে হত। বন্যে এলে ডাঙায় একবাঁশ জল। তখন সোজা নৌকা চালিয়ে দিলেই হল। আর ঘুরে যেতে হয় না। ধানকাটা হলে, আর আলের উপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে আসতে হয় না! সোজা একদিক দিয়ে গেলেই হয়।
“লাভের পর তাঁকে সবতাতেই দেখা যায়। মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ। মানুষের মধ্যে সত্ত্বগুণী ভক্তের ভিতর আরও বেশি প্রকাশ—যাদের কামিনী-কাঞ্চন ভোগ করবার একেবারে ইচ্ছা নাই। (সকলে নিস্তব্ধ) সমাধিস্থ ব্যক্তি যদি নেমে আসে, তাহলে সে কিসে মন দাঁড় করাবে? তাই কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী সত্ত্বগুণী শুদ্ধভক্তের সঙ্গ দরকার হয়। না হলে সমাধিস্থ লোক কি নিয়ে থাকে?”
[ব্রাহ্মসমাজ ও ঈশ্বরের মাতৃভাব—জগতের মা]
“যিনি ব্রহ্ম, তিনিই আদ্যাশক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলি। পুরুষ বলি। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এই সব করেন তাঁকে শক্তি বলি। প্রকৃতি বলি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যিনিই পুরুষ তিনিই প্রকৃতি। আনন্দময় আর আনন্দময়ী।
“যার পুরুষ জ্ঞান আছে, তার মেয়ে জ্ঞানও আছে। যার বাপ জ্ঞান আছে, তার মা জ্ঞানও আছে। (কেশবের হাস্য)
“যার অন্ধকার জ্ঞান আছে, তার আলো জ্ঞানও আছে। যার রাত জ্ঞান আছে, তার দিন জ্ঞানও আছে। যার সুখ জ্ঞান আছে, তার দুঃখ জ্ঞানও আছে। তুমি ওটা বুঝেছ?”
কেশব (সহাস্যে)—হাঁ বুঝেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—মা—কি মা? জগতের মা। যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন, পালন করছেন। যিনি তাঁর ছেলেদের সর্বদা রক্ষা করছেন। আর ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—যে যা চায়, তাই দেন। ঠিক ছেলে মা ছাড়া থাকতে পারে না। তার মা সব জানে। ছেলে খায়, দায়, বেড়ায়; অত শত জানে না।
কেশব—আজ্ঞে হাঁ।
১৮.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – ব্রাহ্মসমাজ ও ঈশ্বরের ঐশ্বর্য বর্ণনা—পূর্বকথা
শ্রীরামকৃষ্ণ কথা কহিতে কহিতে প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। কেশবের সহিত সহাস্যে কথা কহিতেছেন। একঘর লোক উত্কর্ণ হইয়া সমস্ত শুনিতেছেন ও দেখিতেছেন। সকলে অবাক্ যে, “তুমি কেমন আছ” ইত্যাদি কথা আদৌ হইতেছে না। কেবল ঈশ্বরের কথা!
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের প্রতি)—ব্রহ্মজ্ঞানীরা অত মহিমা-বর্ণন করে কেন? “হে ঈশ্বর, তুমি চন্দ্র করিয়াছ, সূর্য করিয়াছ, নক্ষত্র করিয়াছ!” এ-সব কথা এত কি দরকার? অনেকে বাগান দেখেই তারিফ করে। বাবুকে দেখতে চায় কজন। বাগান বড় না বাবু বড়?
“মদ খাওয়া হলে শুঁড়ির দোকানে কত মন মদ আছে, তার হিসাবে আমার কি দরকার? আমার এক বোতলেই কাজ হয়ে যায়।”
[পূর্বকথা—বিষ্ণুঘরের গয়না চুরি ও সেজোবাবু]
“নরেন্দ্রকে যখন দেখি, কখনও জিজ্ঞাসা করি নাই, ‘তোর বাপের নাম কি? তোর বাপের কখানা বাড়ি?’
“কি জান? মানুষ নিজে ঐশ্বর্যের আদর করে বলে, ভাবে ঈশ্বরও আদর করেন। ভাবে, তাঁর ঐশ্বর্যের প্রশংসা করলে তিনি খুশি হবেন। শম্ভু বলেছিল, আর এখন এই আশীর্বাদ কর, যাতে এই ঐশ্বর্য তাঁর পাদপদ্মে দিয়ে মরতে পারি। আমি বললুম, এ তোমার পক্ষেই ঐশ্বর্য, তাঁকে তুমি কি দিবে? তাঁর পক্ষে এগুলো কাঠ মাটি!
“যখন বিষ্ণুঘরের গয়না সব চুরি গেল, তখন সেজোবাবু আর আমি ঠাকুরকে দেখতে গেলাম। সেজোবাবু বললে, ‘দূর ঠাকুর! তোমার কোন যোগ্যতা নাই। তোমার গা থেকে সব গয়না নিয়ে গেল, আর তুমি কিছু করতে পারলে না!’ আমি তাঁকে বললাম, ‘এ তোমার কি কথা! তুমি যাঁর গয়না গয়না করছো, তাঁর পক্ষে এগুলো মাটির ডেলা! লক্ষী যাঁর শক্তি, তিনি তোমার গুটিকতক টাকা চুরি গেল কি না, এই নিয়ে কি হাঁ করে আছেন? এরকম কথা বলতে নাই।’
“ঈশ্বর কি ঐশ্বর্যের বশ? তিনি ভক্তির বশ। তিনি কি চান? টাকা নয়। ভাব, প্রেম, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য—এই সব চান।”
[ঈশ্বরের স্বরূপ ও উপাসক ভেদ—ত্রিগুণাতীত ভক্ত]
“যার যেমন ভাব ঈশ্বরকে সে তেমনই দেখে। তমোগুণী ভক্ত, সে দেখে মা পাঁঠা খায়, আর বলিদান দেয়। রজোগুণী ভক্ত নানা ব্যঞ্জন ভাত করে দেয়। সত্ত্বগুণী ভক্তের পূজার আড়ম্বর নাই। তার পূজা লোকে জানতে পারে না। ফুল নাই, তো বিল্বপত্র, গঙ্গাজল দিয়ে পূজা করে। দুটি মুড়কি দিয়ে কি বাতাসা দিয়ে শীতল দেয়। কখনও বা ঠাকুরকে একটু পায়েস রেঁধে দেয়।
“আর আছে, ত্রিগুণাতীত ভক্ত। তাঁর বালকের স্বভাব। ঈশ্বরের নাম করাই তাঁর পূজা। শুদ্ধ তাঁর নাম।”
১৮.৯ নবম পরিচ্ছেদ – কেশব সঙ্গে কথা—ঈশ্বরের হাসপাতালে আত্মার চিকিত্সা
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের প্রতি, সহাস্যে)—তোমার অসুখ হয়েছে কেন তার মানে আছে। শরীরের ভিতর দিয়ে অনেক ভাব চলে গেছে, তাই ওইরকম হয়েছে। যখন ভাব হয় তখন কিছু বোঝা যায় না, অনেকদিন পরে শরীরে আঘাত লাগে। আমি দেখেছি, বড় জাহাজ গঙ্গা দিয়ে যখন চলে গেল, তখন কিছু টের পাওয়া গেল না; ও মা! খানিকক্ষণ পরে দেখি, কিনারার উপরে জল ধপাস ধপাস করছে; আর তোলপাড় করে দিচ্ছে। হয় তো কিনারার খানিকটা ভেঙে জলে পড়ল!
“কুঁড়েঘরে হাতি প্রবেশ করলে ঘর তোলপাড় করে ভেঙে চুরে দেয়। ভাবহস্তী দেহঘরে প্রবেশ করে, আর তোলপাড় করে।
“হয় কি জান? আগুন লাগলে কতকগুলো জিনিস পুড়িয়ে-টুড়িয়ে ফেলে, আর একটা হইহই কাণ্ড আরম্ভ করে দেয়। জ্ঞানাগ্নি প্রথমে কামক্রোধ এই সব রিপু নাশ করে, তারপর অহংবুদ্ধি নাশ করে। তারপর একটা তোলপাড় আরম্ভ করে!
“তুমি মনে কচ্ছো সব ফুরিয়ে গেল! কিন্তু যতক্ষণ রোগের কিছু বাকী থাকে, ততক্ষণ তিনি ছাড়বেন না। হাসপাতালে যদি তুমি নাম লেখাও, আর চলে আসবার জো নাই। যতক্ষণ রোগের একটু কসুর থাকে, ততক্ষণ ডাক্তার সাহেব চলে আসতে দেবে না। তুমি নাম লিখালে কেন!” (সকলের হাস্য)
কেশব হাসপাতালের কথা শুনিয়া বারবার হাসিতেছেন। হাসি সংবরণ করিতে পারিতেছেন না। থাকেন থাকেন, আবার হাসিতেছেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
[পূর্বকথা—ঠাকুরের পীড়া, রাম কবিরাজের চিকিত্সা]
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের প্রতি)—হৃদু বলত, এমন ভাবও দেখি নাই! এমন রোগও দেখি নাই। তখন আমার খুব অসুখ। সরা সরা বাহ্যে যাচ্ছি। মাথায় যেন দুলাখ পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরীয় কথা রাতদিন চলছে। নাটাগড়ের রাম কবিরাজ দেখতে এল। সে দেখে, আমি বসে বিচার করছি। তখন সে বললে, “একি পাগল। দুখানা হাড় নিয়ে, বিচার করছে!”
(কেশবের প্রতি)—“তাঁর ইচ্ছা। সকলই তোমার ইচ্ছা।
“সকলই তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি ।
তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি ।
“শিশির পাবে বলে মালী বসরাই গোলাপের গাছ শিকড়সুদ্ধ তুলে দেয়। শিশির পেলে গাছ ভাল করে গজাবে। তাই বুঝি তোমার শিকড়সুদ্ধ তুলে দিচ্ছে। (ঠাকুরের ও কেশবের হাস্য) ফিরে ফিরতি বুঝি একটা বড় কাণ্ড হবে।”
[কেশবের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের ক্রন্দন ও সিদ্ধেশ্বরীকে ডাব-চিনি মানন]
“তোমার অসুখ হলেই আমার প্রাণটা বড় ব্যাকুল হয়। আগের বারে তোমার যখন অসুখ হয়, রাত্রি শেষ প্রহরে আমি কাঁদতুম। বলতুম, মা! কেশবের যদি কিছু হয়, তবে কার সঙ্গে কথা কবো। তখন কলকাতায় এলে ডাব-চিনি সিদ্ধেশ্বরীকে দিয়েছিলুম। মার কাছে মেনেছিলুম যাতে অসুখ ভাল হয়।”
কেশবের উপর ঠাকুরের এই অকৃত্রিম ভালবাসা ও তাঁহার জন্য ব্যাকুলতার কথা সকলে অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এবার কিন্তু অত হয় নাই। ঠিক কথা বলব।
“কিন্তু দু-তিনদিন একটু হয়েছে।”
পূর্বদিকের যে দ্বার দিয়া কেশব বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়াছিলেন, সেই দ্বারের কাছে কেশবের পূজনীয়া জননী আসিয়াছেন।
সেই দ্বারদেশ হইতে উমানাথ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে উচ্চৈঃস্বরে বলিতেছেন, “মা আপনাকে প্রণাম করিতেছেন।”
ঠাকুর হাসিতে লাগিলেন। উমানাথ বলিতেছেন, “মা বলছেন, কেশবের অসুখটি যাতে সারে।” ঠাকুর বলিতেছেন, “মা সুবচনী আনন্দময়ীকে ডাকো, তিনি দুঃখ দূর করবেন।”
কেশবকে বলিতেছেন—
“বাড়ির ভিতরে অত থেকো না। মেয়েছেলেদের মধ্যে থাকলে আরও ডুববে, ঈশ্বরীয় কথা হলে আরও ভাল থাকবে।”
গম্ভীরভাবে কথাগুলি বলিয়া আবার বালকের ন্যায় হাসিতেছেন। কেশবকে বলছেন, “দেখি, তোমার হাত দেখি।” ছেলেমানুষের মতো হাত লইয়া যেন ওজন করিতেছেন। অবশেষে বলিতেছেন, “না, তোমার হাত হালকা আছে, খলদের হাত ভারী হয়।” (সকলের হাস্য)
উমানাথ দ্বারদেশ হইতে আবার বলিতেছেন, “মা বলছেন, কেশবকে আশীর্বাদ করুন।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (গম্ভীর স্বরে)—আমার কি সাধ্য! তিনিই আশীর্বাদ করবেন। ‘তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি।’
“ঈশ্বর দুইবার হাসেন। একবার হাসেন যখন দুই ভাই জমি বখরা করে; আর দড়ি মেপে বলে, ‘এ-দিক্টা আমার, ও-দিক্টা তোমার’! ঈশ্বর এই ভেবে হাসেন, আমার জগৎ, তার খানিকটা মাটি নিয়ে করছে এ-দিক্টা আমার ও-দিক্টা তোমার!
“ঈশ্বর আর-একবার হাসেন। ছেলের অসুখ সঙ্কটাপন্ন। মা কাঁদছে। বৈদ্য এসে বলছে, ‘ভয় কি মা, আমি ভাল করব।’ বৈদ্য জানে না ঈশ্বর যদি মারেন, কার সাধ্য রক্ষা করে।” (সকলেই নিস্তব্ধ)
ঠিক এই সময় কেশব অনেকক্ষণ ধরিয়া কাশিতে লাগিলেন। সে কাশি আর থামিতেছে না। সে কাশির শব্দ শুনিয়া সকলেরই কষ্ট হইতেছে। অনেকক্ষণ পরে ও অনেক কষ্টের পর কাশি একটু বন্ধ হইল। কেশব আর থাকিতে পারিতেছেন না। ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। কেশব প্রণাম করিয়া অনেক কষ্টে দেয়াল ধরিয়া ধরিয়া সেই দ্বার দিয়া নিজের কামরায় পুনরায় গমন করিলেন।
১৮.১০ দশম পরিচ্ছেদ – ব্রাহ্মসমাজ ও বেদোল্লিখিত দেবতা—গুরুগিরি নীচবুদ্ধি
[অমৃত—কেশবের বড় ছেলে—দয়ানন্দ সরস্বতী]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু মিষ্টমুখ করিয়া যাইবেন। কেশবের বড় ছেলেটি কাছে আসিয়া বসিয়াছেন।
অমৃত বলিলেন, এইটি বড় ছেলে। আপনি আশীর্বাদ করুন। ও কি! মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করুন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, “আমার আশীর্বাদ করতে নাই।”
এই বলিয়া সহাস্যে ছেলেটির গায়ে হাত বুলাইতে লাগিলেন।
অমৃত (সহাস্যে)—আচ্ছা, তবে গায়ে হাত বুলান। (সকলের হাস্য)
ঠাকুর অমৃতাদি ব্রাহ্মভক্ত সঙ্গে কেশবের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (অমৃত প্রভৃতির প্রতি)—“অসুখ ভাল হোক”—এ-সব কথা আমি বলতে পারি না। ও-ক্ষমতা আমি মার কাছে চাইও না। আমি মাকে শুধু বলি, মা আমাকে শুদ্ধাভক্তি দাও।
“ইনি কি কম লোক গা। যারা টাকা চায়, তারাও মানে, আবার সাধুতেও মানে। দয়ানন্দকে দেখেছিলাম। তখন বাগানে ছিল। কেশব সেন, কেশব সেন, করে ঘর-বাহির করছে,—কখন কেশব আসবে! সেদিন বুঝি কেশবের যাবার কথা ছিল।
“দয়ানন্দ বাঙলা ভাষাকে বলত—‘গৌড়াণ্ড ভাষা’।
“ইনি বুঝি হোম আর দেবতা মানতেন না। তাই বলেছিল ঈশ্বর এত জিনিস করেছেন আর দেবতা করতে পারেন না?”
ঠাকুর কেশবের শিষ্যদের কাছে কেশবের সুখ্যাতি করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেশব হীনবুদ্ধি নয়। ইনি অনেককে বলেছেন, “যা যা সন্দেহ সেখানে গিয়া জিজ্ঞাসা করবে।” আমারও স্বভাব এই। আমি বলি, ইনি আরও কোটিগুণে বাড়ুন। আমি মান নিয়ে কি করব?
“ইনি বড়লোক। টাকা চায় যারা, তারাও মানে, আবার সাধুরাও মানে।”
ঠাকুর কিছু মিষ্টমুখ করিয়া এইবার গাড়িতে উঠিবেন। ব্রাহ্মভক্তেরা সঙ্গে আসিয়া তুলিয়া দিতেছেন।
সিঁড়ি দিয়া নামিবার সময় ঠাকুর দেখিলেন, নিচে আলো নাই। তখন অমৃতাদি ভক্তদের বলিলেন, এ-সব জায়গায় ভাল করে আলো দিতে হয়। আলো না দিলে দারিদ্র্য হয়। এরকম যেন আর না হয়।
ঠাকুর দু-একটি ভক্তসঙ্গে সেই রাত্রে কালীবাড়ি যাত্রা করিলেন।
১৮.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – শ্রীযুক্ত জয়গোপাল সেনের বাড়িতে শুভাগমন
ইংরেজী ২৮শে নভেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। আজ বেলা ৪টা-৫টার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেনের কমলকুটির নামক বাটীতে গিয়াছিলেন। কেশব পীড়িত, শীঘ্রই মর্ত্যধাম ত্যাগ করিয়া যাইবেন। কেশবকে দেখিয়া রাত্রি ৭টার পর মাথাঘষা গলিতে শ্রীযুক্ত জয়গোপালের বাটীতে কয়েকটি ভক্তসঙ্গে ঠাকুর আগমন করিয়াছেন।
ভক্তেরা কত কি ভাবিতেছেন। ঠাকুর দেখিতেছি, নিশিদিন হরিপ্রেমে বিহ্বল। বিবাহ করিয়াছেন, কিন্তু ধর্মপত্নীর সহিত এইরূপ সংসার করেন নাই। ধর্মপত্নীকে ভক্তি করেন, পূজা করেন, তাঁহার সহিত কেবল ঈশ্বরীয় কথা কহেন, ঈশ্বরের গান করেন, ঈশ্বরের পূজা করেন, ধ্যান করেন—মায়িক কোন সম্বন্ধই নাই। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু, ঠাকুর দেখিতেছেন। টাকা, ধাতুদ্রব্য, ঘটি-বাটি স্পর্শ করিতে পারেন না। স্ত্রীলোককে স্পর্শ করিতে পারেন না। স্পর্শ করিলে সিঙি মাছের কাঁটা ফোটার মতো সেইস্থান ঝনঝন কনকন করে! টাকা, সোনা হাতে দিলে হাত তেউড়ে যায়, বিকৃত অবস্থা প্রাপ্ত হয়, নিশ্বাস রুদ্ধ হয়। অবশেষে ফেলিয়া দিলে আবার পূর্বের ন্যায় নিশ্বাস বহিতে থাকে!
ভক্তেরা কত কি ভাবিতেছেন। সংসার কি ত্যাগ করিতে হইবে? পড়াশুনা আর করিবার প্রয়োজন কি? যদি বিবাহ না করি, চাকরি তো করিতে হইবে না। মা-বাপকে কি ত্যাগ করিতে হইবে? আর আমি বিবাহ করিয়াছি, সন্তান হইয়াছে, পরিবার প্রতিপালন করিতে হইবে,—আমার কি হইবে? আমারও ইচ্ছা করে, নিশিদিন হরিপ্রেমে মগ্ন হইয়া থাকি! শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখি আর ভাবি, কি করিতেছি! ইনি রাতদিন তৈলধারার ন্যায় নিরবচ্ছিন্ন ঈশ্বর-চিন্তা করিতেছেন, আর আমি রাতদিন বিষয়চিন্তা করিতে ছুটিতেছি। একমাত্র ইঁহারই দর্শন যেন মেঘাচ্ছন্ন আকাশের একস্থানে একটু জ্যোতিঃ। এখন জীবনসমস্যা কিরূপে পূরণ করিতে হইবে?
“ইনি তো নিজে করে দেখালেন। তবে এখনও সন্দেহ?
“ভেঙে বালির বাঁধ পূরাই মনের সাধ! সত্য কি ‘বালির বাঁধ’? যদি তাঁর উপর সেরূপ ভালবাসা আসে, আর হিসাব আসবে না। যদি জোয়ার গাঙে জল ছুটে কে রোধ করবে? যে প্রেমোদয় হওয়াতে শ্রীগৌরাঙ্গ কৌপীন ধারণ করেছিলেন, যে প্রেমে ঈশা অনন্যচিন্ত হয়ে বনবাসী হয়েছিলেন আর প্রেমময় পিতার মুখ চেয়ে শরীরত্যাগ করেছিলেন, যে প্রেমে বুদ্ধ রাজভোগ ত্যাগ করে বৈরাগী হয়েছিলেন, সেই প্রেমের একবিন্দু যদি উদয় হয়, এই অনিত্য সংসার কোথায় পড়ে থাকে!
“আচ্ছা, যারা দুর্বল, যাদের সে প্রেমোদয় হয় না, যারা সংসারী জীব, যাদের পায়ে মায়ার বেড়ি, তাদের কি উপায়? দেখি, এই প্রেমিক বৈরাগী কি বলেন।”
ভক্তেরা এইরূপ চিন্তা করিতেছেন। ঠাকুর জয়গোপালের বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে উপবিষ্ট—সম্মুখে জয়গোপাল, তাঁহার আত্মীয়েরা ও প্রতিবেশীগণ। একজন প্রতিবেশী বিচার করিবেন বলিয়া প্রস্তুত ছিলেন। তিনিই অগ্রণী হইয়া কথারম্ভ করিলেন। জয়গোপালের ভ্রাতা বৈকুণ্ঠও আছেন।
[গৃহস্থাশ্রম ও শ্রীরামকৃষ্ণ]
বৈকুণ্ঠ—আমরা সংসারী লোক, আমাদের কিছু বলুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁকে জেনে—একহাত ঈশ্বরের পাদপদ্মে রেখে আর-একহাতে সংসারের কার্য কর।
বৈকুণ্ঠ—মহাশয়, সংসার কি মিথ্যা?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যতক্ষণ তাঁকে না জানা যায়, ততক্ষণ মিথ্যা। তখন তাঁকে ভুলে মানুষ ‘আমার আমার’ করে, মায়ায় বদ্ধ হয়ে কামিনী-কাঞ্চনে মুগ্ধ হয়ে আরও ডোবে! মায়াতে এমনই মানুষ অজ্ঞান হয় যে, পালাবার পথ থাকলেও পালাতে পারে না! একটি গান আছে :
এমনি মহামায়ার মায়া রেখেছে কি কুহক করে ।
ব্রহ্মা বিষ্ণু অচৈতন্য জীবে কি জানিতে পারে ॥
বিল করে ঘুনি পাতে মীন প্রবেশ করে তাতে ।
গতায়াতের পথ আছে তবু মীন পালাতে নারে ॥
গুটিপোকায় গুটি করে পালালেও পালাতে পারে ।
মহামায়ায় বদ্ধ গুটি, আপনার নালে আপনি মরে ॥
“তোমরা তো নিজে নিজে দেখছ সংসার অনিত্য। এই দেখ না কেন? কত লোক এল গেল! কত জন্মালো কত দেহত্যাগ করলে! সংসার এই আছে এই নাই। অনিত্য! যাদের এত ‘আমার আমার’ করছ চোখ বুজলেই নাই। কেউ নাই, তবু নাতির জন্য কাশী যাওয়া হয় না। ‘আমার হারুর কি হবে?’ ‘গতায়াতের পথ আছে তবু মীন পালাতে নারে!’ ‘গুটিপোকা আপন নালে আপনি মরে।’ এরূপ সংসার মিথ্যা, অনিত্য।”
প্রতিবেশী—মহাশয়, একহাত ঈশ্বরে আর-একহাত সংসারে রাখব কেন? যদি সংসার অনিত্য, একহাতই বা সংসারে দিব কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁকে জেনে সংসার করলে অনিত্য নয়। গান শোন :
মন রে কৃষি-কাজ জান না ।
এমন মানব-জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা ॥
কালীনামে দাওরে বেড়া, ফসলে তছরূপ হবে না ।
সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া, তার কাছেতে যম ঘেঁসে না ॥
অদ্য কিম্বা শতাব্দান্তে, বাজাপ্ত হবে জান না ।
এখন আপন একতারে (মনরে) চুটিয়ে ফসল কেটে নেনা ॥
গুরুদত্ত বীজ রোপণ করে, ভক্তিবারি সেঁচে দেনা ।
একা যদি না পারিস মন, রামপ্রসাদকে সঙ্গে নেনা ॥
১৮.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – গৃহস্থাশ্রমে ঈশ্বরলাভ—উপায়
শ্রীরামকৃষ্ণ—গান শুনলে? “কালীনামে দাওরে বেড়া, ফসলে তছরূপ হবে না।” ঈশ্বরের শরণাগত হও, সব পাবে। “সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া, তার কাছেতে যম ঘেঁসে না।” শক্ত বেড়া। তাঁকে যদি লাভ করতে পার, সংসার অসার বলে বোধ হবে না। যে তাঁকে জেনেছে, সে দেখে যে জীবজগৎ সে তিনিই হয়েছেন। ছেলেদের খাওয়াবে, যেন গোপালকে খাওয়াচ্ছ। পিতা মাতাকে ঈশ্বর-ঈশ্বরী দেখবে ও সেবা করবে। তাঁকে জেনে সংসার করলে বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় ঐহিক সম্বন্ধ থাকে না। দুজনেই ভক্ত, কেবল ঈশ্বরের কথা কয়, ঈশ্বরের প্রসঙ্গ লয়ে থাকে। ভক্তের সেবা করে। সর্বভূতে তিনি আছেন, তাঁর সেবা দুজনে করে।
প্রতিবেশী—মহাশয়, এরূপ স্ত্রী-পুরুষ তো দেখা যায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আছে, অতি বিরল। বিষয়ী লোকেরা তাদের চিনতে পারে না। তবে এরূপটি হতে গেলে দুজনেরই ভাল হওয়া চাই। দুজনেই যদি সেই ঈশ্বরানন্দ পেয়ে থাকে, তাহলেই এটি সম্ভব হয়। ভগবানের বিশেষ কৃপা চাই। না হলে সর্বদা অমিল হয়। একজনকে তফাতে যেতে হয়। যদি না মিল হয়, তাহলে বড় যন্ত্রণা। স্ত্রী হয়তো রাতদিন বলে, ‘বাবা কেন এখানে বিয়ে দিলে! না খেতে পেলুম, না বাছাদের খাওয়াতে পারলুম; না পরতে পেলুম, না বাছাদের পরাতে পেলুম, না একখানা গয়না! তুমি আমায় কি সুখে রেখেছো! চক্ষু বুজে ঈশ্বর ঈশ্বর করছেন! ও-সব পাগলামি ছাড়ো!’
ভক্ত—এ-সব প্রতিবন্ধক আছে, আবার হয়তো ছেলেরা অবাধ্য। তারপর কত আপদ আছে। তবে, মহাশয় উপায় কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সংসারে থেকে সাধন করা বড় কঠিন। অনেক ব্যাঘাত। তা আর তোমাদের বলতে হবে না—রোগ-শোক, দারিদ্র্য, আবার স্ত্রীর সঙ্গে মিল নাই, ছেলে অবাধ্য, মূর্খ, গোঁয়ার।
“তবে উপায় আছে। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁকে প্রার্থনা করতে হয়, তাঁকে লাভ করবার জন্য চেষ্টা করতে হয়।”
প্রতিবেশী—বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—একেবারে নয়। যখন অবসর পাবে, কোন নির্জন স্থানে গিয়ে একদিন-দুদিন থাকবে—যেন কোন সংসারের সঙ্গে সম্বন্ধ না থাকে, যেন কোন বিষয়ী লোকদের সঙ্গে সাংসারিক বিষয় লয়ে আলাপ না করতে হয়। হয় নির্জনে বাস, নয় সাধুসঙ্গ।
প্রতিবেশী—সাধু চিনব কেমন করে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—যাঁর মন প্রাণ অন্তরাত্মা ঈশ্বরে গত হয়েছে, তিনিই সাধু। যিনি কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী, তিনিই সাধু। যিনি সাধু তিনি স্ত্রীলোককে ঐহিক চক্ষে দেখেন না, সর্বদাই তাদের অন্তরে থাকেন,—যদি স্ত্রীলোকের কাছে আসেন, তাঁকে মাতৃবৎ দেখেন ও পূজা করেন। সাধু সর্বদা ঈশ্বরচিন্তা করেন, ঈশ্বরীয় কথা বই কথা কন না। আর সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন জেনে তাদের সেবা করেন। মোটামুটি এইগুলি সাধুর লক্ষণ।
প্রতিবশেী—নির্জনে বরাবর থাকতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ফুটপাতের গাছ দেখেছ? যতদিন চারা, ততদিন চারিদিকে বেড়া দিতে হয়। না হলে ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলবে। গাছের গুঁড়ি মোটা হলে আর বেড়ার দরকার নাই। তখন হাতি বেঁধে দিলেও গাছ ভাঙবে না। গুঁড়ি যদি করে নিতে পার আর ভাবনা কি, ভয় কি? বিবেক লাভ করবার চেষ্টা আগে কর। তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙ, হাতে আঠা জড়াবে না।
প্রতিবেশী—বিবেক কাহাকে বলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঈশ্বর সৎ আর সব অসৎ—এই বিচার। সৎ মানে নিত্য। অসৎ—অনিত্য। যার বিবেক হয়েছে, সে জানে ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। বিবেক উদয় হলে ঈশ্বরকে জানবার ইচ্ছা হয়। অসৎকে ভালবাসলে—যেমন দেহসুখ, লোকমান্য, টাকা—এই সব ভালবাসলে—ঈশ্বর, যিনি সত্স্বরূপ, তাঁকে জানতে ইচ্ছা হয় না। সদসৎ বিচার এলে তবে ঈশ্বরকে খুঁজতে ইচ্ছা করে।
“শোন, একটা গান শোন :
আয় মন, বেড়াতে যাবি ।
কালী-কল্পতরুমূলে রে মন, চারি ফল কুড়ায়ে পাবি ॥
প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, (তার) নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি ।
ওরে বিবেক নামে তার বেটা, তত্ত্ব-কথা তায় সুধাবি ॥
শুচি অশুচিরে লয়ে দিব্য ঘরে কবে শুবি ।
যখন দুই সতীনে পিরিত হবে, তখন শ্যামা মাকে পাবি ॥
অহংকার অবিদ্যা তোর, পিতামাতায় তাড়িয়ে দিবি ।
যদি মোহ-গর্তে টেনে লয়, ধৈর্য-খোঁটা ধরে রবি ॥
ধর্মাধর্ম দুটো অজা, তুচ্ছ খোঁটায় বেঁধে থুবি ।
যদি না মানে নিষেধ, তবে জ্ঞান-খড়্গে বলি দিবি ॥
প্রথম ভার্যার সন্তানেরে দূর হতে বুঝাইবি ।
যদি না মানে প্রবোধ, জ্ঞান-সিন্ধু মাঝে ডুবাইবি ॥
প্রসাদ বলে, এমন হলে কালের কাছে জবাব দিবি ।
তবে বাপু বাছা বাপের ঠাকুর মনের মতো মন হবি ॥
“মনে নিবৃত্তি এলে তবে বিবেক হয়, বিবেক হলে তত্ত্ব-কথা মনে উঠে। তখন মনের বেড়াতে যেতে সাধ হয়, কালী-কল্পতরুমূলে। সেই গাছতলায় গেলে, ঈশ্বরের কাছে গেলে, চার ফল কুড়িয়ে পাবে—অনায়াসে পাবে, কুড়িয়ে পাবে—ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। তাঁকে পেলে ধর্ম, অর্থ, কাম যা সংসারীর দরকার তাও হয়—যদি কেউ চায়।”
প্রতিবেশী—তবে সংসার মায়া বলে কেন?
[বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ]
শ্রীরামকৃষ্ণ—যতক্ষণ ঈশ্বরকে না পাওয়া যায়, ততক্ষণ “নেতি নেতি” করে ত্যাগ করতে হয়। তাঁকে যারা পেয়েছে, তারা জানে যে তিনিই সব হয়েছেন। তখন বোধ হয়—ঈশ্বর-মায়া-জীব-জগৎ। জীবজগত্সুদ্ধ তিনি। যদি একটা বেলের খোলা, শাঁস, বিচি আলাদা করা যায়, আর একজন বলে, বেলটা কত ওজনে ছিল দেখ তো, তুমি কি খোলা বিচি ফেলে শাঁসটা কেবল ওজন করবে? না; ওজন করতে হলে খোলা বিচি সমস্ত ধরতে হবে। ধরলে তবে বলতে পারবে, বেলটা এত ওজনে ছিল। খোলাটা যেন জগৎ, জীবগুলি যেন বিচি। বিচারের সময় জীব আর জগৎকে অনাত্মা বলেছিলে, অবস্তু বলেছিলে। বিচার করবার সময় শাঁসকেই সার, খোলা আর বিচিকে অসার বলে বোধ হয়। বিচার হয়ে গেলে, সমস্ত জড়িয়ে এক বলে বোধ হয়। আর বোধ হয়, যে সত্ত্বাতে শাঁস সেই সত্ত্বা দিয়েই বেলের খোলা আর বিচি হয়েছে। বেল বুঝতে গেলে সব বুঝিয়ে যাবে।
“অনুলোম বিলোম। ঘোলেরই মাখন, মাখনেরই ঘোল। যদি ঘোল হয়ে থাকে তো মাখনও হয়েছে। যদি মাখন হয়ে থাকে, তাহলে ঘোলও হয়েছে। আত্মা যদি থাকেন, তো অনাত্মাও আছে।
“যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা (Phenomenal world)। যাঁরই লীলা তাঁরই নিত্য (Absolute)। যিনি ঈশ্বর বলে গোচর হন, তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন। যে জেনেছে সে দেখে যে তিনিই সব হয়েছেন—বাপ, মা, ছেলে, প্রতিবেশী, জীবজন্তু, ভাল-মন্দ, শুচি, অশুচি সমস্ত।”
[পাপবোধ—Sense of Sin and Responsibility]
প্রতিবেশী—তবে পাপ-পুণ্য নাই?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আছে, আবার নাই। তিনি যদি অহংতত্ত্ব, (Ego) রেখে দেন, তাহলে ভেদবুদ্ধিও রেখে দেন, পাপ-পুণ্য জ্ঞানও রেখে দেন। তিনি দু-একজনেতে অহংকার একেবারে পুঁছে ফেলেন—তারা পাপ-পুণ্য ভাল-মন্দের পার হয়ে যায়। ঈশ্বরদর্শন যতক্ষণ না হয় ততক্ষণ ভেদবুদ্ধি ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকবেই থাকবে। তুমি মুখে বলতে পার, আমার পাপ-পুণ্য সমান হয়ে গেছে; তিনি যেমন করাচ্ছেন, তেমনি করছি। কিন্তু অন্তরে জান যে, ও-সব কথা মাত্র; মন্দ কাজটি করলেই মন ধুকধুক করবে। ঈশ্বরদর্শনের পরও তাঁর যদি ইচ্ছা হয়, তিনি “দাস আমি” রেখে দেন। সে অবস্থায় ভক্ত বলে—আমি দাস, তুমি প্রভু। সে ভক্তের ঈশ্বরীয় কথা, ঈশ্বরীয় কাজ ভাল লাগে; ঈশ্বরবিমুখ লোককে ভাল লাগে না; ঈশ্বর ছাড়া কাজ ভাল লাগে না। তবেই হল, এরূপ ভক্তেতেও তিনি ভেদবুদ্ধি রাখেন।
প্রতিবেশী—মহাশয় বলছেন, ঈশ্বরকে জেনে সংসার কর। তাঁকে কি জানা যায়?
[The “Unknown and Unknowable”]
শ্রীরামকৃষ্ণ—তাঁকে ইন্দ্রিয় দ্বারা বা এ-মনের দ্বারা জানা যায় না। যে-মনে বিষয়বাসনা নাই সেই শুদ্ধমনের দ্বারা তাঁকে জানা যায়।
প্রতিবেশী—ঈশ্বরকে কে জানতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঠিক কে জানবে? আমাদের যতটুকু দরকার, ততটুকু হলেই হল। আমার এক পাতকুয়া জলের কি দরকার? একঘটি হলেই খুব হল। চিনির পাহাড়ের কাছে একটা পিঁপড়ে গিছল। তার সব পাহাড়টার কি দরকার? একটা-দুটো দানা হলেই হেউ-ঢেউ হয়।
প্রতিবেশী—আমাদের যে বিকার, একঘটি জলে হয় কই? ইচ্ছা করে ঈশ্বরকে সব বুঝে ফেলি!
[সংসার—বিকাররোগ ও ঔষধ—“মামেকং শরণং ব্রজ”]
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা বটে। কিন্তু বিকারের ঔষধও আছে।
প্রতিবেশী—মহাশয়, কি ঔষধ?
শ্রীরামকৃষ্ণ—সাধুসঙ্গ, তাঁর নামগুণগান, তাঁকে সর্বদা প্রার্থনা। আমি বলেছিলাম, মা, আমি জ্ঞান চাই না; এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান,—মা আমায় তোমার পাদপদ্মে কেবল শুদ্ধাভক্তি দাও। আর আমি কিছুই চাই নাই।
“যেমন রোগ, তার তেমনি ঔষধ। গীতায় তিনি বলেছেন, ‘হে অর্জুন, তুমি আমার শরণ লও, তোমাকে সবরকম পাপ থেকে আমি মুক্ত করব।’ তাঁর শরণাগত হও, তিনি সদ্বুদ্ধি দেবেন। তিনি সব ভার লবেন। তখন সবরকম বিকার দূরে যাবে। এ-বুদ্ধি দিয়ে কি তাঁকে বুঝা যায়? একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে? আর তিনি না বুঝালে কি বুঝা যায়? তাই বলছি—তাঁর শরণাগত হও—তাঁর যা ইচ্ছা তিনি করুন। তিনি ইচ্ছাময়। মানুষের কি শক্তি আছে?”